অবরুদ্ধ দেশের সাংবাদিকতা

প্রেক্ষিত একাত্তর-৩

জাহীদ রেজা নূর
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭: ১০
জাহীদ রেজা নূর

পাকিস্তানপন্থী সংবাদপত্রগুলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা পাকিস্তান সরকারের তাঁবেদারি করেছে। শুধু তাঁবেদারি করেছে, তা নয়, মুক্তিকামী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও ছিল। অধিকাংশ পত্রিকার সাংবাদিকেরা বাংলার এই আন্দোলনকে সমর্থন করতেন বলে তাঁরা চেষ্টা করতেন সত্য সংবাদ পাঠককে জানাতে।

একাত্তরের পত্রিকাগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করলে কৌশলী সাংবাদিকতার বিষয়টি নজরে পড়ে। এই সময়ের পত্রিকাগুলো নিয়ে কেউ সুচারু গবেষণা করেছেন বলে আমার জানা নেই। অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল ইয়াহিয়া সরকার। ৬ দফা তখন পরিণত হয়েছিল ১ দফায়। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো সমাধান তখন আর ছিল না। পুরো ৯ মাসই ক্ষমতা নিয়ে নানা ধরনের টালবাহানা যখন চলেছে, তখন পত্রিকার পাতায় সরাসরি কিছুই লেখা যেত না। লিখতে হতো কৌশলে।

পাকিস্তান সরকারের জানা ছিল, একমাত্র দৈনিক সংগ্রাম ছাড়া ঢাকা থেকে প্রকাশিত অধিকাংশ সংবাদপত্রের সাংবাদিকেরাই ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। কিন্তু প্রকাশ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কিছু প্রকাশ করা তাঁদের জন্য ছিল দুরূহ। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সাংবাদিকদের এই সমর্থনকে ভয় পেত সামরিক সরকার। তাই পত্রিকায় যেকোনো রাজনৈতিক সংবাদ ছাপার আগে তা প্রকাশের জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হতো। অর্থাৎ প্রি-সেন্সর বলবৎ হয়েছিল।

পত্রিকাগুলো যেন বশে থাকে, তা নজরদারি করার জন্য সিদ্দিক সালিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা। মেজর। কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়েছিল জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্ব। দৈনিক পাকিস্তানের সাংবাদিকদের অনেকেই ছিলেন আন্দোলন সমর্থক। ফলে তাঁদের ওপরও রাখা হয়েছিল কড়া নজর। অগত্যা দৈনিক পাকিস্তান নিজস্ব সম্পাদকীয় প্রকাশ না করে মর্নিং নিউজের ইংরেজি সম্পাদকীয় অনুবাদ করে ছাপাতে শুরু করে। এটাও সামরিক কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে যায়। তারা দৈনিক পাকিস্তানকে বাধ্য করে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী সম্পাদকীয় লিখতে। পত্রিকা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে ছিল আইএসপিআর (ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস)। একাত্তরের জুলাই মাস থেকেই আইএসপিআর সব পত্রিকা অফিসে ‘প্রেস অ্যাডভাইস’ পাঠাতে শুরু করে। নামে পরামর্শ হলেও কাজে তা ছিল নির্দেশ। কী কী সংবাদ ছাপা যাবে, কোন সংবাদ ছাপা যাবে না—তা নির্ধারণ করে দিত এই নির্দেশমালা।

তারই কিছু নমুনা এখানে রাখব।

১৯৭১ সালের ১৫ জুলাই এ রকম এক নির্দেশে বলা হয়, কোনো বিস্ফোরণের খবর প্রকাশ করা যাবে না। মুক্তিফৌজ, মুক্তিবাহিনী, গণবাহিনী, বাংলাদেশ, জয় বাংলা—এসব শব্দ পত্রিকায় লেখা যাবে না। শুধু তা-ই নয়, ‘তথাকথিত মুক্তিবাহিনী’ও লেখা যাবে না। যদি লিখতে হয়, তাহলে লিখতে হবে ‘বিদ্রোহী’ কিংবা ‘ভারতের এজেন্ট’।

৩০ সেপ্টেম্বর এল আরেক নির্দেশ। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পিতা-মাতা ও পরিবার সম্পর্কে কোনো খবর প্রকাশ করা যাবে না। ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় বঙ্গবন্ধুর বাবা ও মায়ের অসুস্থতা নিয়ে সিরাজুদ্দীন হোসেন যে খবর ছেপেছিলেন, তারই প্রতিক্রিয়া ছিল এটা।

এর পরের বাধা এল তাহরিকে ইশতেকলাল পার্টির সভাপতি এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খানকে নিয়ে। এই নির্দেশে বলা হলো, আসগর খানের বক্তৃতা-বিবৃতি ছাপা যাবে না, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা হলে ছাপা যাবে। এই নির্দেশের তারিখ ছিল ৩ অক্টোবর। নেগেটিভ নিউজও নিউজ—এই কথা উপলব্ধি করে ৬ অক্টোবর এল আরেক নির্দেশ—আসগর খানের সমালোচনাও ছাপা যাবে না।

যাঁরা একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে কিছু জানতে ইচ্ছুক, তাঁদের বলে রাখি, আসগর খান খুবই দায়িত্বশীল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত এই সামরিক কর্মকর্তা বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তাঁর লেখা ‘জেনারেল ইন পলিটিকস ১৯৫৮-১৯৮২’ নামের বইটি পড়লে এ সময়কার অনেক খবর উৎসুক পাঠক পাবেন। বইটির বাংলা অনুবাদও হয়েছে।

আসগর খানের প্রতি পাকিস্তান সরকার সে সময়ে এতটা কঠোর হলো কেন, তা-ও জেনে রাখা দরকার। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় আসগর খান ঢাকায় এসেছিলেন, নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছিলেন। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আরেকবার তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। সে সময় তিনি এক সংবাদ সম্মেলন করেন এবং হত্যা ও নির্যাতনের জন্য শান্তি কমিটির লোকদের কঠোর সমালোচনা করেন। গভর্নর মালিকের মন্ত্রিসভার সমালোচনা করেন তিনি। এই অযোগ্য লোকদের মন্ত্রী পদে রেখে ঘোষিত উপনির্বাচন হতে পারে না বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন। তারই প্রতিক্রিয়ায় আসগর খানের খবর প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।

এইসব নিষেধাজ্ঞার খড়্গ নিয়েই সে সময় প্রকাশিত হতো পত্রিকা। এবং কীভাবে এই নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে জনগণের কাছে মুক্তিবাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রকাশ করা হতো, সে বিষয়েই কথা হবে এরপর।

লেখক: জাহীদ রেজা নূর

উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

(চলবে)

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইসরায়েলের ‘হৃৎপিণ্ড’ তেল আবিবে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

সাগরে নিম্নচাপ, কত দিন বৃষ্টি হতে পারে জানাল আবহাওয়া দপ্তর

শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান যার যার স্থানে শ্রেষ্ঠ: গয়েশ্বর

র‌্যাব বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি: নূর খান লিটন

হাসিনার আমলে রাশিয়ার সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি, জড়াল টিউলিপের নামও

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত