মো. নাজমুল হোসাইন
গত বছরই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করলাম, জাতি হিসেবে আমাদের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেল। অর্ধশতক পেরিয়েও বিজ্ঞান গবেষণায় আমাদের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। তবে পরিস্থিতি পুরোটাই আঁধারে আচ্ছন্ন নয়, আলোর রেখাও আছে। মন ভালো করার মতো একটি খবর হলো, বাংলাদেশি গবেষকেরা হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
ওপরের কথাটা আপনাদের বিশ্বাস না-ই হতে পারে। তাই চলুন, হিসাব দেখা যাক। বাংলাদেশ ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো স্কোপাস ইনডেক্সড বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যায় ১০ হাজারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। স্কোপাস হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানসম্মত বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার (peer reviewed) অন্যতম ইনডেক্সিং ডেটাবেজগুলোর একটি এবং প্রকাশনার সংখ্যার দিক থেকে সর্ববৃহৎ। উক্ত ডেটাবেজের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে বাংলাদেশি গবেষকেরা ১১ হাজার ৯২৬টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন (৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২-এর স্কোপাস ডেটা অনুযায়ী, সূত্র: scopus. com)। গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যায় দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। ২০২০ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশের উক্ত প্রকাশনার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯ হাজার ১০৯ ও ৮ হাজার ৩০২।
আমাদের শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ (জিডিপির শতাংশ) দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। এই হিসাব মাথায় রেখে বলা যায়, গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যা ও এর ক্রমবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের কিছু গবেষক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অন্তত গবেষণার চেষ্টা করে চলেছেন। তবে গবেষণায় দৃশ্যমান উন্নতির জন্য আরও ব্যাপকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণামুখী হওয়া একান্ত জরুরি।
অন্যদিকে শুধু গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যা গবেষণার অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং প্রায়োগিক/ফলিত গবেষণার (applied research) পাশাপাশি আমাদের মৌলিক গবেষণাকে (fundamental research) সমানভাবে উৎসাহিত করা দরকার। মৌলিক গবেষণার বিকাশ ছাড়া প্রায়োগিক গবেষণা পূর্ণতা পায় না। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো নিরবচ্ছিন্ন মৌলিক গবেষণা ও এর ব্যাপক বিস্তার। সমগ্র পৃথিবীতে সমাদৃত নেচার বা সায়েন্স জার্নালের সিংহভাগ গবেষণা মৌলিক গবেষণারই অংশ। প্রায়োগিক গবেষণা যেহেতু সরাসরি বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই বেশির ভাগ সময়ই আমরা মৌলিক গবেষণায় উৎসাহী হই না। এ কারণে নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে আমরা তেমন অগ্রসর হতে পারিনি। আবার এ ক্ষেত্রে অনেক গবেষক আগ্রহী থাকলেও দেশে উন্নত মৌলিক গবেষণায় (advanced fundamental research) সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে সামগ্রিকভাবে গবেষণার মানোন্নয়নে আমরা বেশ পিছিয়ে পড়ছি।
উদাহরণস্বরূপ, দেশে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জীবের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচিত হলেও এর পরবর্তী প্রোটিওমিক্স (বৃহৎ পরিসরে প্রোটিনসম্পর্কিত গবেষণা) ও সেলুলার (কোষীয়) বায়োলজির গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক গবেষণাগুলো বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে। তবে উন্নত বিশ্বে মৌলিক ও প্রায়োগিক—উভয় ক্ষেত্রেই সমানতালে গবেষণা এগিয়ে চলে এবং গবেষকেরাও প্রয়োজনে একে অন্যকে সহযোগিতা করেন। কারণ, তাঁদের উপলব্ধি এটাই যে মৌলিক গবেষণার অনুশীলন ছাড়া প্রায়োগিক গবেষণা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কাজেই মৌলিক গবেষণার বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ ব্যতীত শুধুমাত্র প্রায়োগিক গবেষণাকে প্রাধান্য দিলে অদূর ভবিষ্যতে গবেষণার মানে তেমন পরিবর্তন হবে না—এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং প্রকাশিত হলেই আমাদের দেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। কারণ, আতশি কাচ দিয়েও বিশ্বের প্রথম ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজকে। আসলে গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও ভালো গবেষণার স্বীকৃতি না থাকলে গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না। এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রাতারাতি র্যাঙ্কিংয়ে উন্নয়ন ঘটাবেন—এটা আশা করা ভুল ও অবান্তর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞান গবেষণায় প্রকৃত সফলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। গবেষণায় বিনিয়োগ অনেকটা ফলদ বৃক্ষ রোপণের মতো। আপনাকে সুমিষ্ট ফলের স্বাদ নিতে হলে গাছটির জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করতে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করতে হবে। তার পরই আপনি কাঙ্ক্ষিত ফল পাবেন।
ঠিক সেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে প্রথম এর গবেষণাগারগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে রূপান্তর করা দরকার। এগুলোকে সচল রাখতে দেশীয় ও বৈদেশিক উৎস থেকে প্রকল্প নেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী ১০, ২০, এমনকি ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান থাকতে হবে। ওই বছরগুলোতে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোন পর্যায়ে দেখতে চাই, তার পূর্ণ রূপ থাকতে হবে সে মহাপরিকল্পনায়।
অন্যদিকে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও মোট জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা ক্ষেত্রে আশানুরূপ বরাদ্দ নেই। আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অল্পসংখ্যক যে গবেষণা বা প্রকাশনা হয়, তার তথ্য ওয়েবসাইটে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটগুলোর চিত্র দেখলে মনে হবে, শুধু নোটিশ বোর্ডের দায়িত্ব পালন করা ছাড়া এর আর কোনো কাজ নেই। এসব সুস্পষ্ট অসামঞ্জস্যতার আশু সমাধান ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং, তথা বিজ্ঞান গবেষণার প্রকৃত উন্নয়ন আশা করা অরণ্যে রোদন বৈ কিছু নয়। এ ছাড়া গবেষণার উপকরণে অন্যান্য বাণিজ্যিক দ্রব্যের মতো উচ্চকর থাকায় বাংলাদেশি গবেষকদের সেসব উপকরণ কিনতে হয় ক্ষেত্রবিশেষ কয়েক গুণ বেশি দামে। এসব কারণে বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগ চলে যায় উপকরণ কেনাকাটায়। কাজেই আমাদের গবেষণার অগ্রগতির স্বার্থেই গবেষণার উপকরণে করহার নামমাত্র বা খুবই সীমিত হওয়া উচিত।
প্রকৃত বৈজ্ঞানিক গবেষণার পূর্বশর্ত হচ্ছে, প্রবীণ-নবীন গবেষকদের সমন্বয়ে দক্ষ গবেষণা দল গঠন। আমাদের প্রচলিত নিয়মে নবীন গবেষকদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার দরকার। এখানে নবীন গবেষক বলতে আমি এমন একজনকে বোঝাতে চেয়েছি, যিনি পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরেট হয়েছেন। এখন গবেষণায় যুক্ত হয়ে ক্রমে একজন স্বাধীন গবেষকে তিনি পরিণত হতে চান। কিন্তু এই পর্যায়ের কোনো গবেষককে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যুক্ত করার তেমন বৃহৎ কোনো উদ্যোগ নেই। আমাদের দেশীয় অনেক তরুণ গবেষক আছেন, যাঁরা পোস্ট ডক্টরাল পর্যায়ে উন্নত বিশ্বে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, তাঁদের দেশে এনে কাজে লাগানো দরকার, বিশ্বমানের গবেষণার নিরিখেই।
২০০৮ সালে চীন ‘থাউজেন্ড ট্যালেন্ট প্রোগ্রাম’ চালু করে। এ রকম উদ্যোগের ফলাফল এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে চীন, যার ফলাফল কারও অজানা নয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় থেমে নেই। ভারতে এ রকম কিছু প্রকল্প চালু আছে, যার মধ্যে ‘রামালিঙ্গস্বামী রি-এন্ট্রি ফেলোশিপ’ অন্যতম। এই প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য হলো—মেধা পাচার প্রতিরোধ করে নিজ দেশের বিজ্ঞান গবেষণায় মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ প্রোগ্রামে ভারতীয় যেসব পোস্ট ডক্টরাল গবেষক অন্য দেশে গবেষণায় সফল হচ্ছেন, তাঁদের তিন-পাঁচ বছরের একটা ফেলোশিপ দিয়ে ভারতীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অথবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে এসে স্বাধীন গবেষক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালানো হয়। এতে নিযুক্ত ফেলো গবেষণা পরিচালনা করেন এবং মাস্টার্স ও পিএইচডির শিক্ষার্থী সুপারভাইজ করেন, যার ফান্ড আবার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ফেলোকেই জোগাড় করতে হয়। ফেলোর প্রোগ্রেস যাচাই-বাছাই করে উক্ত প্রতিষ্ঠান পরে ওই গবেষককে স্থায়ী নিয়োগ দেয়। এভাবেই ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করছে।
যা হোক, আমরাও এগিয়ে যেতে চাই। আমরা চাই শুধু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুহার হ্রাস বা নারীর ক্ষমতায়নেই নয়, বাংলাদেশ হবে বিজ্ঞান গবেষণাতেও অগ্রগামী একটি দেশের নাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারগুলোতে রাতদিন গবেষণায় মত্ত থাকবে একদল গবেষক/শিক্ষার্থী, যাদের চোখে থাকবে নিত্যনতুন আবিষ্কারের নেশা। একই সঙ্গে বিজ্ঞানে স্নাতকদের চাকরির ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে। চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো হবে বিষয়ভিত্তিক/টেকনিক্যাল। তাহলেই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলোর গ্রুপ স্টাডিতে চাকরির গাইড মুখস্থের বদলে পৃথিবীর কোনো শ্রেষ্ঠ গবেষকের প্রকাশিত নিবন্ধ নিয়ে চলবে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক।
আমরা তো অনেক কিছুই দেখে শিখি। শিক্ষা ও গবেষণায় উন্নয়নে অনুকরণীয় অনেক ভালো উদাহরণ আমাদের আশপাশের দেশগুলোতেই রয়েছে। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা চাইলেই তা অনুসরণ করতে পারেন। কেননা একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের অন্যতম হাতিয়ার, যা একটি দেশকে কয়েক যুগ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য ও সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষা ছুটি), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
গত বছরই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করলাম, জাতি হিসেবে আমাদের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেল। অর্ধশতক পেরিয়েও বিজ্ঞান গবেষণায় আমাদের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। তবে পরিস্থিতি পুরোটাই আঁধারে আচ্ছন্ন নয়, আলোর রেখাও আছে। মন ভালো করার মতো একটি খবর হলো, বাংলাদেশি গবেষকেরা হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
ওপরের কথাটা আপনাদের বিশ্বাস না-ই হতে পারে। তাই চলুন, হিসাব দেখা যাক। বাংলাদেশ ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো স্কোপাস ইনডেক্সড বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যায় ১০ হাজারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। স্কোপাস হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানসম্মত বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার (peer reviewed) অন্যতম ইনডেক্সিং ডেটাবেজগুলোর একটি এবং প্রকাশনার সংখ্যার দিক থেকে সর্ববৃহৎ। উক্ত ডেটাবেজের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে বাংলাদেশি গবেষকেরা ১১ হাজার ৯২৬টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন (৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২-এর স্কোপাস ডেটা অনুযায়ী, সূত্র: scopus. com)। গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যায় দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। ২০২০ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশের উক্ত প্রকাশনার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯ হাজার ১০৯ ও ৮ হাজার ৩০২।
আমাদের শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ (জিডিপির শতাংশ) দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। এই হিসাব মাথায় রেখে বলা যায়, গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যা ও এর ক্রমবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের কিছু গবেষক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অন্তত গবেষণার চেষ্টা করে চলেছেন। তবে গবেষণায় দৃশ্যমান উন্নতির জন্য আরও ব্যাপকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণামুখী হওয়া একান্ত জরুরি।
অন্যদিকে শুধু গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যা গবেষণার অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং প্রায়োগিক/ফলিত গবেষণার (applied research) পাশাপাশি আমাদের মৌলিক গবেষণাকে (fundamental research) সমানভাবে উৎসাহিত করা দরকার। মৌলিক গবেষণার বিকাশ ছাড়া প্রায়োগিক গবেষণা পূর্ণতা পায় না। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো নিরবচ্ছিন্ন মৌলিক গবেষণা ও এর ব্যাপক বিস্তার। সমগ্র পৃথিবীতে সমাদৃত নেচার বা সায়েন্স জার্নালের সিংহভাগ গবেষণা মৌলিক গবেষণারই অংশ। প্রায়োগিক গবেষণা যেহেতু সরাসরি বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই বেশির ভাগ সময়ই আমরা মৌলিক গবেষণায় উৎসাহী হই না। এ কারণে নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে আমরা তেমন অগ্রসর হতে পারিনি। আবার এ ক্ষেত্রে অনেক গবেষক আগ্রহী থাকলেও দেশে উন্নত মৌলিক গবেষণায় (advanced fundamental research) সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে সামগ্রিকভাবে গবেষণার মানোন্নয়নে আমরা বেশ পিছিয়ে পড়ছি।
উদাহরণস্বরূপ, দেশে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জীবের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচিত হলেও এর পরবর্তী প্রোটিওমিক্স (বৃহৎ পরিসরে প্রোটিনসম্পর্কিত গবেষণা) ও সেলুলার (কোষীয়) বায়োলজির গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক গবেষণাগুলো বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে। তবে উন্নত বিশ্বে মৌলিক ও প্রায়োগিক—উভয় ক্ষেত্রেই সমানতালে গবেষণা এগিয়ে চলে এবং গবেষকেরাও প্রয়োজনে একে অন্যকে সহযোগিতা করেন। কারণ, তাঁদের উপলব্ধি এটাই যে মৌলিক গবেষণার অনুশীলন ছাড়া প্রায়োগিক গবেষণা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কাজেই মৌলিক গবেষণার বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ ব্যতীত শুধুমাত্র প্রায়োগিক গবেষণাকে প্রাধান্য দিলে অদূর ভবিষ্যতে গবেষণার মানে তেমন পরিবর্তন হবে না—এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং প্রকাশিত হলেই আমাদের দেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। কারণ, আতশি কাচ দিয়েও বিশ্বের প্রথম ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজকে। আসলে গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও ভালো গবেষণার স্বীকৃতি না থাকলে গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না। এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রাতারাতি র্যাঙ্কিংয়ে উন্নয়ন ঘটাবেন—এটা আশা করা ভুল ও অবান্তর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞান গবেষণায় প্রকৃত সফলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। গবেষণায় বিনিয়োগ অনেকটা ফলদ বৃক্ষ রোপণের মতো। আপনাকে সুমিষ্ট ফলের স্বাদ নিতে হলে গাছটির জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করতে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করতে হবে। তার পরই আপনি কাঙ্ক্ষিত ফল পাবেন।
ঠিক সেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে প্রথম এর গবেষণাগারগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে রূপান্তর করা দরকার। এগুলোকে সচল রাখতে দেশীয় ও বৈদেশিক উৎস থেকে প্রকল্প নেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী ১০, ২০, এমনকি ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান থাকতে হবে। ওই বছরগুলোতে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোন পর্যায়ে দেখতে চাই, তার পূর্ণ রূপ থাকতে হবে সে মহাপরিকল্পনায়।
অন্যদিকে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও মোট জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা ক্ষেত্রে আশানুরূপ বরাদ্দ নেই। আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অল্পসংখ্যক যে গবেষণা বা প্রকাশনা হয়, তার তথ্য ওয়েবসাইটে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটগুলোর চিত্র দেখলে মনে হবে, শুধু নোটিশ বোর্ডের দায়িত্ব পালন করা ছাড়া এর আর কোনো কাজ নেই। এসব সুস্পষ্ট অসামঞ্জস্যতার আশু সমাধান ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং, তথা বিজ্ঞান গবেষণার প্রকৃত উন্নয়ন আশা করা অরণ্যে রোদন বৈ কিছু নয়। এ ছাড়া গবেষণার উপকরণে অন্যান্য বাণিজ্যিক দ্রব্যের মতো উচ্চকর থাকায় বাংলাদেশি গবেষকদের সেসব উপকরণ কিনতে হয় ক্ষেত্রবিশেষ কয়েক গুণ বেশি দামে। এসব কারণে বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগ চলে যায় উপকরণ কেনাকাটায়। কাজেই আমাদের গবেষণার অগ্রগতির স্বার্থেই গবেষণার উপকরণে করহার নামমাত্র বা খুবই সীমিত হওয়া উচিত।
প্রকৃত বৈজ্ঞানিক গবেষণার পূর্বশর্ত হচ্ছে, প্রবীণ-নবীন গবেষকদের সমন্বয়ে দক্ষ গবেষণা দল গঠন। আমাদের প্রচলিত নিয়মে নবীন গবেষকদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার দরকার। এখানে নবীন গবেষক বলতে আমি এমন একজনকে বোঝাতে চেয়েছি, যিনি পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরেট হয়েছেন। এখন গবেষণায় যুক্ত হয়ে ক্রমে একজন স্বাধীন গবেষকে তিনি পরিণত হতে চান। কিন্তু এই পর্যায়ের কোনো গবেষককে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যুক্ত করার তেমন বৃহৎ কোনো উদ্যোগ নেই। আমাদের দেশীয় অনেক তরুণ গবেষক আছেন, যাঁরা পোস্ট ডক্টরাল পর্যায়ে উন্নত বিশ্বে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, তাঁদের দেশে এনে কাজে লাগানো দরকার, বিশ্বমানের গবেষণার নিরিখেই।
২০০৮ সালে চীন ‘থাউজেন্ড ট্যালেন্ট প্রোগ্রাম’ চালু করে। এ রকম উদ্যোগের ফলাফল এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে চীন, যার ফলাফল কারও অজানা নয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় থেমে নেই। ভারতে এ রকম কিছু প্রকল্প চালু আছে, যার মধ্যে ‘রামালিঙ্গস্বামী রি-এন্ট্রি ফেলোশিপ’ অন্যতম। এই প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য হলো—মেধা পাচার প্রতিরোধ করে নিজ দেশের বিজ্ঞান গবেষণায় মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ প্রোগ্রামে ভারতীয় যেসব পোস্ট ডক্টরাল গবেষক অন্য দেশে গবেষণায় সফল হচ্ছেন, তাঁদের তিন-পাঁচ বছরের একটা ফেলোশিপ দিয়ে ভারতীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অথবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে এসে স্বাধীন গবেষক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালানো হয়। এতে নিযুক্ত ফেলো গবেষণা পরিচালনা করেন এবং মাস্টার্স ও পিএইচডির শিক্ষার্থী সুপারভাইজ করেন, যার ফান্ড আবার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ফেলোকেই জোগাড় করতে হয়। ফেলোর প্রোগ্রেস যাচাই-বাছাই করে উক্ত প্রতিষ্ঠান পরে ওই গবেষককে স্থায়ী নিয়োগ দেয়। এভাবেই ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করছে।
যা হোক, আমরাও এগিয়ে যেতে চাই। আমরা চাই শুধু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুহার হ্রাস বা নারীর ক্ষমতায়নেই নয়, বাংলাদেশ হবে বিজ্ঞান গবেষণাতেও অগ্রগামী একটি দেশের নাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারগুলোতে রাতদিন গবেষণায় মত্ত থাকবে একদল গবেষক/শিক্ষার্থী, যাদের চোখে থাকবে নিত্যনতুন আবিষ্কারের নেশা। একই সঙ্গে বিজ্ঞানে স্নাতকদের চাকরির ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে। চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো হবে বিষয়ভিত্তিক/টেকনিক্যাল। তাহলেই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলোর গ্রুপ স্টাডিতে চাকরির গাইড মুখস্থের বদলে পৃথিবীর কোনো শ্রেষ্ঠ গবেষকের প্রকাশিত নিবন্ধ নিয়ে চলবে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক।
আমরা তো অনেক কিছুই দেখে শিখি। শিক্ষা ও গবেষণায় উন্নয়নে অনুকরণীয় অনেক ভালো উদাহরণ আমাদের আশপাশের দেশগুলোতেই রয়েছে। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা চাইলেই তা অনুসরণ করতে পারেন। কেননা একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের অন্যতম হাতিয়ার, যা একটি দেশকে কয়েক যুগ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য ও সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষা ছুটি), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে নীতিনির্ধারণী একটি বিষয় অগ্রাধিকার বিবেচনার জন্য অপেক্ষমাণ আছে, আর তা হলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন করা, নাকি যথাশিগগির নির্বাচন আয়োজন করা? অনেক ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য জাতীয় সংসদের বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।
২ ঘণ্টা আগেকিছু কিছু বিতর্ক তৈরি করা হয় সমসাময়িক বিষয় থেকে দৃষ্টি দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। পুরো পাকিস্তান আমলেই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বিতর্ক জারি রাখা হয়েছিল। আমলাতন্ত্র আর সামরিক আমলাতন্ত্র মিলে পাকিস্তান নামক দেশটায় যে স্বৈরশাসন কায়েম করে রেখেছিল, সেদিকে যেন সচেতন মানুষের চোখ না যায়, সে অভিসন্ধি থেকেই রবীন্দ্রনাথ
২ ঘণ্টা আগেএকটি কলা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। একটি সাধারণ কলা, যা নিলামে বিক্রি হলো ৭৪ কোটি টাকায়। এটি শিল্প, না কৌতুক, না সামাজিক শ্লেষ—নাকি তিনটির মিশেল? ইতালীয় শিল্পী মরিজিও ক্যাটালানের এই ‘কমেডিয়ান’ আমাদের শিল্পের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আর বাজারজাত সৃজনশীলতার প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
২ ঘণ্টা আগে‘গণতন্ত্র মঞ্চ’র অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ঐক্য ফোরামের নেতা ছিলেন। তিনি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। এখন পর্যন্ত ২০টি বই লিখেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে...
১ দিন আগে