আজাদুর রহমান চন্দন
এই ভূখণ্ডের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমনি সেই সব সংগ্রামের সাফল্য বা বিজয় বেহাত হওয়ার ইতিহাসও কম দীর্ঘ নয়। এক ইংরেজ শাসনামলেই এখানকার মানুষের সাহসী ও প্রবল সংগ্রামের তিন-চারটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায়ের সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদের কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু হওয়া সংগ্রামগুলোর মধ্যে আছে ‘ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’, ফরায়েজি আন্দোলন, বারাকপুর বিপ্লব, বালাকোট যুদ্ধ ইত্যাদি। প্রথম পর্যায়ের সংগ্রামে কৃষক সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও নেতৃত্ব ছিল সদ্য ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হওয়া ভূস্বামীদের হাতে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু হলে নব্য ভূস্বামীরা তাতে লাভবান হওয়ায় আন্দোলনে তাদের ভূমিকা পুরোপুরি দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু নানা রূপে কৃষকদের সংগ্রাম চলতে থাকলে উচ্ছেদ হওয়া ভূস্বামীদের একাংশও তাতে যুক্ত হয়েছিল। ১৮১১ সালে মধ্যস্বত্বভোগী প্রথা চালু হওয়ার পর থেকে ইংরেজদের প্রতি বাংলার জমিদারদের বেশ আস্থাভাব দেখা দেয়। ফলে কৃষকদের সংগ্রাম আরও গতি ও ব্যাপ্তি পায়। সেই পর্যায়ে কৃষকদের সংগ্রামের এক বড় নজির সাঁওতাল বিদ্রোহ।
ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের উদ্ভব এবং রাষ্ট্র আরোপিত আইন ও বিধিবিধান, খাজনা প্রবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে প্রথম দিকে সাঁওতালরা তাদের আদি বাসভূমি কটক, ধলভূম, মানভূম, বড়ভূম, ছোট নাগপুর, পালামৌ, হাজারীবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, ও বীরভূমের পার্বত্য এলাকা ছেড়ে রাজমহল পাহাড়ের সমতলভূমিতে বসতি স্থাপন করেছিল। বিস্তীর্ণ এলাকার জঙ্গল কেটে তারা চাষাবাদের উপযোগী করে তোলে। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সেখানেও তাদের মালিকানার দাবি নিয়ে হাজির হলে সাঁওতালরা সেই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং নিজেদের প্রাকৃতিক অধিকার বজায় রাখতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে জমিদারেরা জমিতে নিজেদের মালিকানার দাবি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলে ১৮১১, ১৮২০ ও ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সাঁওতালরা। সবচেয়ে সুসংগঠিত ও ব্যাপক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৮৫৫-৫৬ সালে। সেটি দমন করতে সরকারকে কয়েক দফা সামরিক অভিযানও চালাতে হয়।
মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া সিপাহি বিপ্লব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছিল মিরাট, দিল্লিসহ ভারতের অন্যান্য অংশে। বাংলাদেশজুড়েও তা চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং সিলেট, যশোর, রংপুর, পাবনা ও দিনাজপুরের খণ্ডযুদ্ধ বাংলাদেশকে উত্তেজিত করে তুলেছিল। বাংলার জমিদার-জোতদারেরা তখন সিপাহিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গরু ও ঘোড়ার গাড়ি, হাতি সরবরাহ; পলায়নরত সিপাহিদের গতিবিধির সন্ধান দেওয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে কোম্পানির স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এসব নানা কারণে ওই বিপ্লব কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় স্বদেশি আন্দোলন। স্বদেশি আদর্শে উদ্বুদ্ধ এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে ব্রিটিশ শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তাদের উচ্ছেদ এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতিসাধন। আন্দোলনের কৌশলের অন্তর্গত ছিল ব্রিটিশ পণ্য বয়কট এবং দেশীয় শিল্প ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন। স্বদেশি আন্দোলন ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী গণজাগরণ থেকে উৎসারিত। এটি ১৯১১ সাল পর্যন্ত চলেছিল। বাংলায় সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল এই আন্দোলন। গান্ধী, আন্দোলনের উচ্চতম অবস্থায় ব্রিটিশ রাজের অনুগত থাকায় আশু কোনো সুফল না মিললেও ১৯১১ থেকে ১৯৩৭ সালের ঘটনাপ্রবাহ ছিল খুবই উত্তাল। ওই পর্যায়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা তেভাগা, নানকার, নাচোল আন্দোলনসহ অনেকগুলো কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করেছিল। উত্তর ময়মনসিংহে বিশেষ করে কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী থানা এলাকায় ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চলে তেভাগা আন্দোলন। এর ফল হিসেবে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এ সব টঙ্ক কৃষককে তাঁদের দখলীয় জমির স্বাভাবিক মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার ঘাড়ে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র চাপিয়ে দেওয়ায় বছর না যেতেই আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে প্রথমে ভাষার প্রশ্নে। এরপর কখনো শিক্ষার আন্দোলন, কখনো ভোটাধিকারের আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথ বেয়ে একাত্তরে ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে স্বাধীনতা। স্বাধীনতাসংগ্রামের সেই ৯ মাসের প্রতিটি মুহূর্তের ব্যাপ্তি, গভীরতা ও ঘনত্ব যেন ছাড়িয়ে যায় হাজার বছরকে। একাত্তরের মর্মবাণী আর ‘মহাসিন্ধুর কল্লোল ধ্বনি’ এখনো এতটাই প্রতিধ্বনি তোলে যে তাকে এড়িয়ে বিজয়ের এই মাসে কোনো আলোচনাই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আবার সেই বিজয়ও অনেকাংশে বেহাত হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। এক সাগর রক্ত আর সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার পর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মাহেন্দ্রক্ষণে বিপুল বিজয় আনন্দে জাতির জীবনে যে জোয়ার জেগেছিল, তাতে ভাটা পড়তে সময় লাগেনি বেশি। দেখতে দেখতে জাতির জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। একদিকে কিছু মানুষ তার সহায়সম্পদ হারাতে থাকে, অন্যদিকে কিছু মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে থাকে। চুরি-ডাকাতি-লুটপাট বেড়ে যায়; বেড়ে যায় দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য ও জনদুর্ভোগ। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে, জাতীয় সংসদে ২৯৩টি আসন নিয়েও সামাল দিতে পারছিল না সরকার। স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় শেখ মুজিবুর রহমান সমমনা কয়েকটি দলকে একীভূত করে কার্যত একদলীয় সরকারকেই জাতীয় সরকার বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। অসময়ের সেই চেষ্টার ফল কী হয়েছিল, সে কথা সবারই জানা।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে দেশ উল্টো পথে যাত্রা করে। পরের দেড় দশকের ইতিহাস কার্যত সামরিক শাসনের। সামরিক শাসকদের মধ্যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনাবাহিনীর সাহায্যে ক্ষমতা জবরদখল করে দীর্ঘদিন একনায়কতন্ত্র কায়েম রেখেছিলেন। এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে গোটা আশির দশকের অধিকাংশ সময় ধরে রাজপথে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে, দিতে হয়েছে রক্ত। শেষ পর্যন্ত তিন জোটের ঘোষিত রূপরেখা অনুযায়ী ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ। ‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও রাজনীতি-রাষ্ট্র পরিচালনার’ সেই রূপরেখা পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি। ওই রূপরেখার ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। পরে ওই সংসদেই রূপরেখায় থাকা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতির বদলে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করা হয়। এর বাইরে রূপরেখার আর কোনো ঘোষণাই কার্যকর করা হয়নি।
তিন জোটের রূপরেখায় একটি আচরণবিধি ছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘জোটভুক্ত দলসমূহ ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকবে। জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেবে না এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করবে।’ এ ছাড়া দলগুলো এরশাদের কোনো সহযোগীকে নিজ নিজ দলে না নেওয়ার অঙ্গীকারও করেছিল। কিন্তু একানব্বই সালের নির্বাচনেই বিএনপির হয়ে অংশ নেন এরশাদ জমানার প্রভাবশালী দুই আমলা এম কে আনোয়ার ও কাজী কেরামত আলী। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সরকারপদ্ধতি পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই হলো না। একপর্যায়ে সংসদও অকার্যকর হয়ে গেল। ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনের পর এরশাদ সরকার গঠনে শেখ হাসিনাকেই সহায়তা করেন। পুরস্কারস্বরূপ এরশাদ কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর বাকি জীবন তিনি পেন্ডুলামের মতো এদিক-ওদিক দোল খেয়েছেন।
নব্বইয়ের পর আরেকটি সুযোগ এনে দিয়েছে জুলাইয়ের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান। শেখ হাসিনার দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে সব দল-মতের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। একটি বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার সুযোগ আজ জাতির সামনে। কিন্তু নানা মতের ভেদাভেদে এই সুযোগও আমরা হারিয়ে ফেলব কি না, সেই সংশয় উঁকি দিতে শুরু করেছে। যারা দলে ভারী, তারা অন্যদের ওপর নিজেদের মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত না হলে এবারের বিজয় বেহাত হতেও সময় লাগবে না।
এই ভূখণ্ডের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমনি সেই সব সংগ্রামের সাফল্য বা বিজয় বেহাত হওয়ার ইতিহাসও কম দীর্ঘ নয়। এক ইংরেজ শাসনামলেই এখানকার মানুষের সাহসী ও প্রবল সংগ্রামের তিন-চারটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায়ের সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদের কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু হওয়া সংগ্রামগুলোর মধ্যে আছে ‘ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’, ফরায়েজি আন্দোলন, বারাকপুর বিপ্লব, বালাকোট যুদ্ধ ইত্যাদি। প্রথম পর্যায়ের সংগ্রামে কৃষক সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও নেতৃত্ব ছিল সদ্য ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হওয়া ভূস্বামীদের হাতে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু হলে নব্য ভূস্বামীরা তাতে লাভবান হওয়ায় আন্দোলনে তাদের ভূমিকা পুরোপুরি দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু নানা রূপে কৃষকদের সংগ্রাম চলতে থাকলে উচ্ছেদ হওয়া ভূস্বামীদের একাংশও তাতে যুক্ত হয়েছিল। ১৮১১ সালে মধ্যস্বত্বভোগী প্রথা চালু হওয়ার পর থেকে ইংরেজদের প্রতি বাংলার জমিদারদের বেশ আস্থাভাব দেখা দেয়। ফলে কৃষকদের সংগ্রাম আরও গতি ও ব্যাপ্তি পায়। সেই পর্যায়ে কৃষকদের সংগ্রামের এক বড় নজির সাঁওতাল বিদ্রোহ।
ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের উদ্ভব এবং রাষ্ট্র আরোপিত আইন ও বিধিবিধান, খাজনা প্রবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে প্রথম দিকে সাঁওতালরা তাদের আদি বাসভূমি কটক, ধলভূম, মানভূম, বড়ভূম, ছোট নাগপুর, পালামৌ, হাজারীবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, ও বীরভূমের পার্বত্য এলাকা ছেড়ে রাজমহল পাহাড়ের সমতলভূমিতে বসতি স্থাপন করেছিল। বিস্তীর্ণ এলাকার জঙ্গল কেটে তারা চাষাবাদের উপযোগী করে তোলে। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সেখানেও তাদের মালিকানার দাবি নিয়ে হাজির হলে সাঁওতালরা সেই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং নিজেদের প্রাকৃতিক অধিকার বজায় রাখতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে জমিদারেরা জমিতে নিজেদের মালিকানার দাবি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলে ১৮১১, ১৮২০ ও ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সাঁওতালরা। সবচেয়ে সুসংগঠিত ও ব্যাপক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৮৫৫-৫৬ সালে। সেটি দমন করতে সরকারকে কয়েক দফা সামরিক অভিযানও চালাতে হয়।
মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া সিপাহি বিপ্লব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছিল মিরাট, দিল্লিসহ ভারতের অন্যান্য অংশে। বাংলাদেশজুড়েও তা চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং সিলেট, যশোর, রংপুর, পাবনা ও দিনাজপুরের খণ্ডযুদ্ধ বাংলাদেশকে উত্তেজিত করে তুলেছিল। বাংলার জমিদার-জোতদারেরা তখন সিপাহিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গরু ও ঘোড়ার গাড়ি, হাতি সরবরাহ; পলায়নরত সিপাহিদের গতিবিধির সন্ধান দেওয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে কোম্পানির স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এসব নানা কারণে ওই বিপ্লব কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় স্বদেশি আন্দোলন। স্বদেশি আদর্শে উদ্বুদ্ধ এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে ব্রিটিশ শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তাদের উচ্ছেদ এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতিসাধন। আন্দোলনের কৌশলের অন্তর্গত ছিল ব্রিটিশ পণ্য বয়কট এবং দেশীয় শিল্প ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন। স্বদেশি আন্দোলন ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী গণজাগরণ থেকে উৎসারিত। এটি ১৯১১ সাল পর্যন্ত চলেছিল। বাংলায় সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল এই আন্দোলন। গান্ধী, আন্দোলনের উচ্চতম অবস্থায় ব্রিটিশ রাজের অনুগত থাকায় আশু কোনো সুফল না মিললেও ১৯১১ থেকে ১৯৩৭ সালের ঘটনাপ্রবাহ ছিল খুবই উত্তাল। ওই পর্যায়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা তেভাগা, নানকার, নাচোল আন্দোলনসহ অনেকগুলো কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করেছিল। উত্তর ময়মনসিংহে বিশেষ করে কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী থানা এলাকায় ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চলে তেভাগা আন্দোলন। এর ফল হিসেবে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এ সব টঙ্ক কৃষককে তাঁদের দখলীয় জমির স্বাভাবিক মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার ঘাড়ে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র চাপিয়ে দেওয়ায় বছর না যেতেই আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে প্রথমে ভাষার প্রশ্নে। এরপর কখনো শিক্ষার আন্দোলন, কখনো ভোটাধিকারের আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথ বেয়ে একাত্তরে ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে স্বাধীনতা। স্বাধীনতাসংগ্রামের সেই ৯ মাসের প্রতিটি মুহূর্তের ব্যাপ্তি, গভীরতা ও ঘনত্ব যেন ছাড়িয়ে যায় হাজার বছরকে। একাত্তরের মর্মবাণী আর ‘মহাসিন্ধুর কল্লোল ধ্বনি’ এখনো এতটাই প্রতিধ্বনি তোলে যে তাকে এড়িয়ে বিজয়ের এই মাসে কোনো আলোচনাই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আবার সেই বিজয়ও অনেকাংশে বেহাত হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। এক সাগর রক্ত আর সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার পর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মাহেন্দ্রক্ষণে বিপুল বিজয় আনন্দে জাতির জীবনে যে জোয়ার জেগেছিল, তাতে ভাটা পড়তে সময় লাগেনি বেশি। দেখতে দেখতে জাতির জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। একদিকে কিছু মানুষ তার সহায়সম্পদ হারাতে থাকে, অন্যদিকে কিছু মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে থাকে। চুরি-ডাকাতি-লুটপাট বেড়ে যায়; বেড়ে যায় দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য ও জনদুর্ভোগ। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে, জাতীয় সংসদে ২৯৩টি আসন নিয়েও সামাল দিতে পারছিল না সরকার। স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় শেখ মুজিবুর রহমান সমমনা কয়েকটি দলকে একীভূত করে কার্যত একদলীয় সরকারকেই জাতীয় সরকার বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। অসময়ের সেই চেষ্টার ফল কী হয়েছিল, সে কথা সবারই জানা।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে দেশ উল্টো পথে যাত্রা করে। পরের দেড় দশকের ইতিহাস কার্যত সামরিক শাসনের। সামরিক শাসকদের মধ্যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনাবাহিনীর সাহায্যে ক্ষমতা জবরদখল করে দীর্ঘদিন একনায়কতন্ত্র কায়েম রেখেছিলেন। এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে গোটা আশির দশকের অধিকাংশ সময় ধরে রাজপথে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে, দিতে হয়েছে রক্ত। শেষ পর্যন্ত তিন জোটের ঘোষিত রূপরেখা অনুযায়ী ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ। ‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও রাজনীতি-রাষ্ট্র পরিচালনার’ সেই রূপরেখা পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি। ওই রূপরেখার ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। পরে ওই সংসদেই রূপরেখায় থাকা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতির বদলে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করা হয়। এর বাইরে রূপরেখার আর কোনো ঘোষণাই কার্যকর করা হয়নি।
তিন জোটের রূপরেখায় একটি আচরণবিধি ছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘জোটভুক্ত দলসমূহ ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকবে। জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেবে না এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করবে।’ এ ছাড়া দলগুলো এরশাদের কোনো সহযোগীকে নিজ নিজ দলে না নেওয়ার অঙ্গীকারও করেছিল। কিন্তু একানব্বই সালের নির্বাচনেই বিএনপির হয়ে অংশ নেন এরশাদ জমানার প্রভাবশালী দুই আমলা এম কে আনোয়ার ও কাজী কেরামত আলী। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সরকারপদ্ধতি পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই হলো না। একপর্যায়ে সংসদও অকার্যকর হয়ে গেল। ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনের পর এরশাদ সরকার গঠনে শেখ হাসিনাকেই সহায়তা করেন। পুরস্কারস্বরূপ এরশাদ কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর বাকি জীবন তিনি পেন্ডুলামের মতো এদিক-ওদিক দোল খেয়েছেন।
নব্বইয়ের পর আরেকটি সুযোগ এনে দিয়েছে জুলাইয়ের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান। শেখ হাসিনার দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে সব দল-মতের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। একটি বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার সুযোগ আজ জাতির সামনে। কিন্তু নানা মতের ভেদাভেদে এই সুযোগও আমরা হারিয়ে ফেলব কি না, সেই সংশয় উঁকি দিতে শুরু করেছে। যারা দলে ভারী, তারা অন্যদের ওপর নিজেদের মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত না হলে এবারের বিজয় বেহাত হতেও সময় লাগবে না।
১৫ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বলার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দরকার। ফ্যাসিবাদী কাঠামো থেকে বের হওয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত খুব প্রয়োজন। সেই বন্দোবস্তের রূপরেখাটা কেমন হবে, সেটা নিয়ে বহু বছর ধরে কথা হচ্ছে।
১ দিন আগেযেকোনো সরকারের অজনপ্রিয় তথা জনবিচ্ছিন্ন হওয়া এবং তার পরিণতিতে পতনের পেছনে আমলাতন্ত্রের বিরাট ভূমিকা থাকে। বিপরীতে সরকারের জনপ্রিয় হওয়ার পেছনেও প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে তার প্রশাসনযন্ত্র। কেননা, সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা এবং তার রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হয় প্রশাসনের লোকজনের মাধ্যমেই
১ দিন আগেনভেম্বর মাসে ঢাকা শহরের অবস্থা কতটা অরক্ষিত ছিল, সেটা বোঝা যাবে ১১ নভেম্বর প্রকাশিত একটি সংবাদে। সংক্ষেপে সে খবরটি এ রকম: রোকেয়া হলে ডাকাতি গত মঙ্গলবার দিবাগত শেষ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে এক মারাত্মক ডাকাতি সংঘটিত হয়। দুষ্কৃতিকারীরা হলের প্রভোষ্ট ও হলে অবস্থানকারী ছাত্রীদের হাজার হাজার
১ দিন আগেপ্রতিকূলে চলা মানুষেরাই। আমাদের খাই খাই স্বভাবের সমাজে একজন ব্যতিক্রমী মানুষের উদাহরণ ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পাহাড়ভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা খোরশেদ আলী। তিনি একাই ১ লাখ ১০ হাজার তালগাছ রোপণ করেছেন। এ জন্য তিনি নিজের জমি বিক্রি করতেও কার্পণ্য করেননি। আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল নন খোরশেদ। অভাব-অনটন তাঁর সংসারে
১ দিন আগে