একুশে ফেব্রুয়ারি: বাংলা ভাষার মহিমা

মামুনুর রশীদ
প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯: ৫৭

বসন্তকালের নয়া উৎসবের শহর কলকাতায় এসেছি ১৯ ফেব্রুয়ারি। এবারের আগমনের উদ্দেশ্য একুশে ফেব্রুয়ারি পালন। আমন্ত্রণ করেছে ভাষা ও চেতনা সমিতি, কর্ণধার হচ্ছেন লেখক-অধ্যাপক ইমান-উল-হক। একাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে মুক্তমঞ্চে এই অনুষ্ঠান হয়ে আসছে ২৫ বছর ধরে। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেই সঙ্গে বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এখানে সমবেত হন। এবারের উদ্বোধনের দায়িত্ব পালন করেছি আমি।

অন্যান্য বছরে শুধু ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে একুশের ভোরে প্রভাতফেরি করে অনুষ্ঠান শেষ হতো। এবারে তা তিন দিন করা হয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে আলোচনা অনুষ্ঠান, সংগীত, আবৃত্তি, নাটক, নৃত্যানুষ্ঠান শেষ হয় রাত ১২টায়। আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনজনই নাটকের মানুষ। মনোজ মিত্র, দেবাশীষ মজুমদার এবং আমি। ২০ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন বিকেল সোয়া ৫টায়। উদ্বোধনী আলোচনায় ভাষার শক্তি, ভাষার প্রতি দায়িত্ব এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য নিয়ে মূলত একটিই বক্তৃতা হলো। আমার বক্তৃতার পরই শুরু হয় একুশের গান। প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পীরা সংগীতানুষ্ঠানে অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়, যাঁর ‘আমি বাংলায় গান গাই’ বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে অনেক দিন ধরেই মাতিয়ে রেখেছে। বেশ কটি গান গাইলেন প্রতুল। গানের ফাঁকে ফাঁকে কথাও বললেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি কবিয়াল রমেশ শীলের গানের পুনঃ সুরারোপ করেও গাইলেন। এরপর গানে, নৃত্যে, আবৃত্তিতে অনুষ্ঠান চলতে লাগল। এভাবেই রাত গভীর হলো, ভোরের প্রভাতফেরিতে আবার ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’ গেয়ে শেষ হলো।

কলকাতায় তখন ভোরের আলো। ঢাকার একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপনের তুলনায় কলকাতায় এই আয়োজন ছোট হলেও নানা দিক থেকেই তা তাৎপর্যপূর্ণ। দেশভাগের সেই করুণ এবং নারকীয় অধ্যায়ের পর এক বাংলা যখন দ্বিখণ্ডিত হলো, তখন মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে দুটি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। নিঃসঙ্গ, বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর সঙ্গে রইল মাতৃভাষা বাংলা। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি। অন্য অনেক ভাষার সঙ্গে বাংলা রইল মাতৃভাষা হিসেবে। ইংরেজি প্রবল দাপটে রাজত্ব করে চলল। অদ্ভুত এক রাষ্ট্রের দুটি ডানা। একটির সঙ্গে আরেকটির দূরত্ব বারো শ মাইল।

১৯৪৭-এর পর বছর না ঘুরতেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ঘোষণা দিয়ে দিল উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। অথচ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা। আচমকা পাকিস্তানের নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণায় চমকে গেল পূর্ব বাংলার মানুষ। ক্ষুব্ধ মানুষ এই ঘোষণায় সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পারল। সেই থেকে শুরু হলো লড়াই। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল প্রতিবাদের আগুন। সেই আগুন ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। শেষ পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের চেহারাটা নগ্ন করেই ফেলল। প্রাণ দিলেন ভাষাসংগ্রামীরা।

পাকিস্তানি শাসকেরা আপাতত থামল, কিন্তু ষড়যন্ত্র, নিপীড়ন শেষ হলো না। গণতান্ত্রিক সব আন্দোলন স্তব্ধ করে দিয়ে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হলো। আন্দোলন শুরু হলো নতুন পর্যায়ে। ভাষা ও সংস্কৃতিকে সংকুচিত করার সব পথই অবলম্বন করে একটি জাতিরাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো ধর্মরাষ্ট্র। কিন্তু বাঙালিরা তা মানল না। শেষ পর্যন্ত সামরিক শাসন ও শক্তিকে পর্যুদস্ত করে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্ম হলো। এক রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ও যুদ্ধের মধ্যেই বাংলা ভাষা বিজয়ী হলো, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেল বাংলা।

পশ্চিমবঙ্গেও তার ঢেউ এসে লেগেছিল। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ভারত গণতান্ত্রিক দেশ। আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্ক, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন—সবটা মিলিয়ে আন্দোলনের পথ বন্ধ হয়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও যে কখনো রক্তে রঞ্জিত হয়নি, তা নয়। কিন্তু গণতন্ত্রে একটা আপসের জায়গা থাকে। কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যেও একটা সহনীয় সংঘাত থাকে। তাই মধ্যবিত্তের চর্চায় বাংলা ভাষাকে তেমন কোনো বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। তবে শ্রেণিসংগ্রাম তীব্র হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার উত্থান হয়েছে, ধর্ম কখনো বাড়াবাড়ি ধরনের পর্যায়ে চলে গেছে। একটা সময় ভাষাকে তাই আশ্রয় করতে হয়েছে। সমৃদ্ধ এই ভাষা ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ভাষার লড়াইটাও গৌণ থেকে মুখ্য হয়েছে।

দুই বাংলায় বহু বছর ধরে একটি গুরুতর সমস্যায় জর্জরিত তা হলো—বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। মূলত ইংরেজি শিক্ষা। দুটি দেশেই হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি স্কুল, বেসরকারি ইংরেজি বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের গুরুতর সংকট সৃষ্টি করেছে ধর্মীয় শিক্ষা। অনাধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিহীন এই ব্যবস্থা মানুষকে পেছনের দিকে নিয়ে চলেছে।

মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করেও পৃথিবীর প্রতিটি দেশে একটি ভিন্ন ভাষার শিক্ষা প্রয়োজন হয়। আজকের দিনে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ যেখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে ইংরেজি, ফারসি, জার্মান বা স্প্যানিশ ভাষার একটি-দুটি জানতেই হবে। কিন্তু প্রথম থেকেই শিশুকে যদি অন্য ভাষায় শিক্ষিত করতে হয়, তাহলে শুরুতেই সে নিজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই বিচ্ছিন্নতা তাকে আজীবন নিঃসঙ্গ করে তোলে। ভিন্ন ভাষার সংস্কৃতিকে আমল করতে গিয়ে সে একধরনের নৈরাশ্যের এবং নৈরাজ্যের মধ্যে পড়ে যায়। ফলে তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে অভিবাসন। এই অভিবাসন তাকে করে তোলে এক ‘নেই’ রাজ্যের নাগরিক। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন এই নেই রাজ্যের নাগরিক তাই উন্নত প্রযুক্তিতে ডুব দিয়ে দেশহারা, সংস্কৃতিহারা মানুষ হয়ে যায়। বাংলার মতো উন্নত সংস্কৃতির মানুষ বাজার অর্থনীতির কবলে পড়ে উদ্ভট এক ভোগবাদী সমাজেই ঢুকে পড়ে। তার নিত্যসঙ্গী তখন ইন্টারনেটের কবলে পড়া প্রযুক্তি। মূলত সে নিঃসঙ্গ, ভোগবাদী প্রাণহীন, আবেগহীন এক কঙ্কাল। তাই যেকোনো ভাষাভাষী মানুষের এই সংস্কৃতিবিচ্ছিন্নতা এক ভয়াবহ সংকটের সৃষ্টি করে।

বাঙালির মধ্যে ইংরেজিপ্রীতির এক অকারণ হীনম্মন্যতা রয়েছে বহুদিন ধরেই। ইংরেজিতে কথা বলতে পারলে সে নিজেকে কুলীন ভাবতে শুরু করে।অভিভাবকেরাও খুবই খুশি হন যখন তাঁর সন্তান ইংরেজি ভালো বলে, বাংলা না বললেও তাঁরা দুঃখিত হন না। এই প্রবণতা যে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আমাদের সমাজে আছে। বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান, নাটক, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় যথেষ্ট এগিয়ে। আমাদের গর্ব করার অনেক কিছুই আছে সেখানে। কোনোই কারণ নেই হীনম্মন্যতায় ভোগার।

ভাষা ও চেতনা সমিতির এই অনুষ্ঠানমালায় বক্তৃতায়, গানে, আবৃত্তিতে, নৃত্যে এসব কথাই বারবার ভিন্নভাবে বলা হলো। একুশে ফেব্রুয়ারিতেও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে একই কথা বলা হয় নানাভাবে, নানা আয়োজনে। অনেকেই বলবেন, এসব জানা কথা, কী লাভ তাতে? ইমান-উল-হক বারবার অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় বলছিলেন ভালো কথাও, প্রয়োজনীয় কথাও বারবার বলতে হয়। আমিও বলি। না হলে খারাপ কথার বাজারে ভালো কথা হারিয়ে যায়। বাংলা ভাষা দিব্যি ছড়িয়ে যাক তার মহিমা নিয়ে।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত