সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে একটা নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পরেও একুশে ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন বিষয়টি আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ, আজকেও আমাদের কাছে এর আবেদন বহমান, আজকেও আমাদের ডাকে, আমাদের মনে এক অনুভূতি সৃষ্টি করে। কেন করে? সে কি শুধু এ কারণেই করে যে, বাংলা ভাষা শিক্ষার সর্বস্তরে প্রযুক্ত হয়নি? সে কি শুধু এই কারণেই করে যে, বাংলা ভাষা সরকারি সব কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না? না, সেটা নয়। তার চেয়েও বড় তাৎপর্য এখানে আছে। সে হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির যে আন্দোলন ছিল শাসকশ্রেণির নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের নিপীড়নবিরোধী যে চেতনা, তার প্রকাশ লাভ করেছিল। সে জন্যই নিপীড়ন যত দিন আছে, নিষ্পেষণ যত দিন থাকছে, অন্যায় যত দিন চলবে, তত দিন তো মনে হয় একুশে ফেব্রুয়ারি তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে থাকবে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন মধ্যবিত্ত তরুণেরা করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের মূল শক্তি কোথা থেকে এসেছিল? আন্দোলন যত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যত দিন রমনা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল, তত দিন প্রবল ছিল না। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই গুলি চালনার দিনে যখন এই আন্দোলন রমনা পার হয়ে পুরান ঢাকায় এসে পৌঁছেছিল, যখন পুরান ঢাকা পার হয়ে সমগ্র বাংলাদেশের আনাচ-কানাচে পৌঁছে গেল, যখন এই আন্দোলনে কৃষকের বিক্ষোভ যুক্ত হলো, শ্রমিক অসন্তোষ এর সঙ্গে মিশে গেল, যখন রিকশাওয়ালা এসে যোগ দিল, যখন নিম্নমধ্যবিত্ত এর সঙ্গে যুক্ত হলো, তখনই সে অত্যন্ত প্রবল হলো, তখন সে দুর্দমনীয় হয়ে উঠল। এর আগে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা একবার আন্দোলন করেছিলেন বেতনের জন্য, ’৫২ সালের আগেই, কিন্তু সেই আন্দোলন সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি এবং সমস্ত বাংলাদেশে ছড়িয়েও যায়নি। কেন যায়নি? পুলিশদের ওপর কম নির্যাতন হয়নি, পুলিশদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আন্দোলন বিস্তৃত হলো না এই জন্য যে, তা সীমাবদ্ধ ছিল সরকারি কর্মচারীর একাংশের মধ্যে। এই যে একুশের আন্দোলন এত প্রবল হলো, দুর্দমনীয় হলো, সে যে এত দূর এগিয়ে এল, তার কারণ হচ্ছে, এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সব মানুষের বিক্ষোভ জড়িত ছিল।
আমরা যদি আজকে আমাদের পুরোনো ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, একুশে ফেব্রুয়ারির এই যাত্রাপথ ধরে নতুন সংগঠন গড়ে উঠেছে। নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, সে আমরা জানি। এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রবল হয়েছে, সে-ও আমরা জানি। কিন্তু এককভাবে এদের কোনোটাই একুশের একক অবদান নয়।
একুশের মূল সৃষ্টি যদি চিহ্নিত করতে হয় তাহলে বলতে হবে, একুশে ফেব্রুয়ারি একটি চেতনার নাম। এবং সেই চেতনাকে যদি চিহ্নিত করতে চাই, তবে তার পরিচয় দিতে হবে কতগুলো লক্ষণ দ্বারা—সে ছিল ইহজাগতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক, সেই চেতনা ছিল অন্যায়বিরোধী, বিদ্রোহী এবং সর্বোপরি সে ছিল সৃজনশীল। এই যে ইহজাগতিকতা, গণতান্ত্রিকতার, এই যে বিদ্রোহের চেতনা, এই যে সৃজনশীলতা—এর সমস্ত কিছুকে একত্র করেই একুশের পরিচয়। এতকাল আমাদের অনুভূতিগুলো নানা প্রকার আধ্যাত্মিক ও ভাববাদী পথে বিচরণ করত। ধর্ম ছিল আমাদের একটা বড় সাংস্কৃতিক উপাদান। সেখানে ভাষা এসে আমাদের বস্তুজগৎ ও চারদিকের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন করল এবং যে গণতান্ত্রিক চেতনা এল, সেটা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। আগে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ভাগাভাগি ছিল। হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানগুলো আলাদা, প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা এবং তারা আলাদা আলাদা থাকত। একুশে ফেব্রুয়ারি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিকে ভেঙে দিল। সব মানুষের গণতান্ত্রিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করল। একুশে ফেব্রুয়ারি অন্যায়ের, শোষণের এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাল! এই সমস্ত কিছুকে, এই ইহজাগতিকতাকে, গণতান্ত্রিকতাকে, বিদ্রোহকে সম্মিলিত করে সে একটা নতুন সৃজনশীলতার জন্ম দিল। সেই সৃজনশীলতার পথ ধরেই আমরা দেখেছি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ওই পথেই আমরা দেখেছি যে আমরা আরও এগোতে পারছি, একটা নতুন সমাজব্যবস্থা চাইছি, একটা নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে যাচ্ছি।
ভাষা আন্দোলন আরও একটা কাজ করেছে, সে হচ্ছে এই যে, সে একটা বিভাজনের রেখা আমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। বিভাজনটা হচ্ছে আলোর সঙ্গে অন্ধকারের বিভাজন। এ হচ্ছে তারুণ্যের সঙ্গে বার্ধক্যের, প্রগতির সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার বিভাজন। সেইখানে দাঁড়িয়ে আলো ও অন্ধকার, তারুণ্য ও বার্ধক্য, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়া আলাদা হয়ে গেছে।
এই আন্দোলন তারুণ্য ও বার্ধক্যকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। তারুণ্য এখানে বয়সের নাম নয়, তারুণ্য এখানে একটি শক্তির নাম। আর তারুণ্যের গুণ যে সৃজনশীলতা, একুশে ফেব্রুয়ারি সেই গুণে গুণান্বিত। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা দুঃসাহস দেখেছি মানুষের, দুঃসাহস দেখেছি তারুণ্যের। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা সৃজনশীলতা দেখেছি তারুণ্যের। সেই জন্য তারুণ্যের চিহ্নে একে চিহ্নিত করতে চাই এবং আমরা তখনই দুঃসাহসী হই, যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, যেমন আমরা ’৭১ সালের যুদ্ধের সময় দেখেছি। আমরা যখন আলাদা, বিচ্ছিন্ন, যখন পরস্পর পরস্পরের শত্রু, তখন আমরা সবাই ভীরু, তখন সবাই সন্ত্রস্ত। যখন আমরা সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, যখন আমরা এক হতে পারি, যখন আমাদের চেতনা একসঙ্গে গ্রথিত হয়, তখনই আমরা দুঃসাহসী হয়ে উঠি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেই দুঃসাহসকে আমরা দেখেছি। কাজেই আবার আমরা দুঃসাহসী হতে পারব, যখন আমরা সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পাবর।
একুশে ফেব্রুয়ারি একটা প্রশ্ন রাখে আমাদের সবার সামনে। সেটা হলো, আমরা কে কোন পক্ষে। আলোর, নাকি অন্ধকারের? যদি আলোর পক্ষ হই তাহলে কি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি? দায়িত্ব পালন না করলে দেশ কেমন করে এগোবে? প্রশ্নটা শুরুতে ছিল, এখনো আছে, থাকবে আগামীকালও।
একুশের আন্দোলন যে শেষ হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ একুশের লক্ষ্য আজও অর্জিত হয়নি। হ্যাঁ, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে বৈকি, কিন্তু সর্বত্র সে প্রযুক্ত হচ্ছে না। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিণতিতে আমরা নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি ঠিকই, কিন্তু এই রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা এখন অত্যন্ত বিপন্ন, গণতন্ত্র গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের মতো আছে বলা হয়, কিন্তু আসলে নেই।
মাতৃভাষার মর্যাদা আমরা তখনই প্রতিষ্ঠা করতে পারব, যখন আমাদের এই রাষ্ট্র পুরোপুরি গণতান্ত্রিক হবে। পুঁজিবাদী বিশ্ব আমাদের গণতান্ত্রিক হতে দেয় না। আমাদের শাসকশ্রেণির সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা কখনো নির্বাচিত, কখনো অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক শাসন চাপিয়ে দেয়, যাতে করে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতে পারে এবং দেশকে একটি বৃহৎ বাজারে পরিণত করা সম্ভব হয়। পুঁজিবাদী বিশ্ব এই রাষ্ট্রকে স্বাধীন হতে দিচ্ছে না, তাঁবেদার করে রাখছে। অথচ একুশের আন্দোলনের মূল প্রেরণাটাই ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব সেদিন বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার ভয়ংকর অপচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম।
আন্দোলন চলছে এবং চলবে। নদীতে যেমন ঢেউয়ের পরে ঢেউ ওঠে, এখানেও তেমনটা ঘটা চাই। ঢেউ যদি না থাকে, তবে তো বুঝতে হবে নদী নেই, সে মারা গেছে।
এই আন্দোলনে নিরপেক্ষতার কোনো স্থান নেই। সেদিনও ছিল না, আজও নেই। আবারও তাই বলতে হয়, এই আন্দোলনে আমরা কে কী ভূমিকা নিচ্ছি, সেই প্রশ্নটা নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে হয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে একটা নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পরেও একুশে ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন বিষয়টি আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ, আজকেও আমাদের কাছে এর আবেদন বহমান, আজকেও আমাদের ডাকে, আমাদের মনে এক অনুভূতি সৃষ্টি করে। কেন করে? সে কি শুধু এ কারণেই করে যে, বাংলা ভাষা শিক্ষার সর্বস্তরে প্রযুক্ত হয়নি? সে কি শুধু এই কারণেই করে যে, বাংলা ভাষা সরকারি সব কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না? না, সেটা নয়। তার চেয়েও বড় তাৎপর্য এখানে আছে। সে হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির যে আন্দোলন ছিল শাসকশ্রেণির নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের নিপীড়নবিরোধী যে চেতনা, তার প্রকাশ লাভ করেছিল। সে জন্যই নিপীড়ন যত দিন আছে, নিষ্পেষণ যত দিন থাকছে, অন্যায় যত দিন চলবে, তত দিন তো মনে হয় একুশে ফেব্রুয়ারি তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে থাকবে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন মধ্যবিত্ত তরুণেরা করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের মূল শক্তি কোথা থেকে এসেছিল? আন্দোলন যত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যত দিন রমনা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল, তত দিন প্রবল ছিল না। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই গুলি চালনার দিনে যখন এই আন্দোলন রমনা পার হয়ে পুরান ঢাকায় এসে পৌঁছেছিল, যখন পুরান ঢাকা পার হয়ে সমগ্র বাংলাদেশের আনাচ-কানাচে পৌঁছে গেল, যখন এই আন্দোলনে কৃষকের বিক্ষোভ যুক্ত হলো, শ্রমিক অসন্তোষ এর সঙ্গে মিশে গেল, যখন রিকশাওয়ালা এসে যোগ দিল, যখন নিম্নমধ্যবিত্ত এর সঙ্গে যুক্ত হলো, তখনই সে অত্যন্ত প্রবল হলো, তখন সে দুর্দমনীয় হয়ে উঠল। এর আগে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা একবার আন্দোলন করেছিলেন বেতনের জন্য, ’৫২ সালের আগেই, কিন্তু সেই আন্দোলন সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি এবং সমস্ত বাংলাদেশে ছড়িয়েও যায়নি। কেন যায়নি? পুলিশদের ওপর কম নির্যাতন হয়নি, পুলিশদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আন্দোলন বিস্তৃত হলো না এই জন্য যে, তা সীমাবদ্ধ ছিল সরকারি কর্মচারীর একাংশের মধ্যে। এই যে একুশের আন্দোলন এত প্রবল হলো, দুর্দমনীয় হলো, সে যে এত দূর এগিয়ে এল, তার কারণ হচ্ছে, এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সব মানুষের বিক্ষোভ জড়িত ছিল।
আমরা যদি আজকে আমাদের পুরোনো ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, একুশে ফেব্রুয়ারির এই যাত্রাপথ ধরে নতুন সংগঠন গড়ে উঠেছে। নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, সে আমরা জানি। এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রবল হয়েছে, সে-ও আমরা জানি। কিন্তু এককভাবে এদের কোনোটাই একুশের একক অবদান নয়।
একুশের মূল সৃষ্টি যদি চিহ্নিত করতে হয় তাহলে বলতে হবে, একুশে ফেব্রুয়ারি একটি চেতনার নাম। এবং সেই চেতনাকে যদি চিহ্নিত করতে চাই, তবে তার পরিচয় দিতে হবে কতগুলো লক্ষণ দ্বারা—সে ছিল ইহজাগতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক, সেই চেতনা ছিল অন্যায়বিরোধী, বিদ্রোহী এবং সর্বোপরি সে ছিল সৃজনশীল। এই যে ইহজাগতিকতা, গণতান্ত্রিকতার, এই যে বিদ্রোহের চেতনা, এই যে সৃজনশীলতা—এর সমস্ত কিছুকে একত্র করেই একুশের পরিচয়। এতকাল আমাদের অনুভূতিগুলো নানা প্রকার আধ্যাত্মিক ও ভাববাদী পথে বিচরণ করত। ধর্ম ছিল আমাদের একটা বড় সাংস্কৃতিক উপাদান। সেখানে ভাষা এসে আমাদের বস্তুজগৎ ও চারদিকের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন করল এবং যে গণতান্ত্রিক চেতনা এল, সেটা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। আগে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ভাগাভাগি ছিল। হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানগুলো আলাদা, প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা এবং তারা আলাদা আলাদা থাকত। একুশে ফেব্রুয়ারি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিকে ভেঙে দিল। সব মানুষের গণতান্ত্রিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করল। একুশে ফেব্রুয়ারি অন্যায়ের, শোষণের এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাল! এই সমস্ত কিছুকে, এই ইহজাগতিকতাকে, গণতান্ত্রিকতাকে, বিদ্রোহকে সম্মিলিত করে সে একটা নতুন সৃজনশীলতার জন্ম দিল। সেই সৃজনশীলতার পথ ধরেই আমরা দেখেছি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ওই পথেই আমরা দেখেছি যে আমরা আরও এগোতে পারছি, একটা নতুন সমাজব্যবস্থা চাইছি, একটা নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে যাচ্ছি।
ভাষা আন্দোলন আরও একটা কাজ করেছে, সে হচ্ছে এই যে, সে একটা বিভাজনের রেখা আমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। বিভাজনটা হচ্ছে আলোর সঙ্গে অন্ধকারের বিভাজন। এ হচ্ছে তারুণ্যের সঙ্গে বার্ধক্যের, প্রগতির সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার বিভাজন। সেইখানে দাঁড়িয়ে আলো ও অন্ধকার, তারুণ্য ও বার্ধক্য, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়া আলাদা হয়ে গেছে।
এই আন্দোলন তারুণ্য ও বার্ধক্যকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। তারুণ্য এখানে বয়সের নাম নয়, তারুণ্য এখানে একটি শক্তির নাম। আর তারুণ্যের গুণ যে সৃজনশীলতা, একুশে ফেব্রুয়ারি সেই গুণে গুণান্বিত। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা দুঃসাহস দেখেছি মানুষের, দুঃসাহস দেখেছি তারুণ্যের। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা সৃজনশীলতা দেখেছি তারুণ্যের। সেই জন্য তারুণ্যের চিহ্নে একে চিহ্নিত করতে চাই এবং আমরা তখনই দুঃসাহসী হই, যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, যেমন আমরা ’৭১ সালের যুদ্ধের সময় দেখেছি। আমরা যখন আলাদা, বিচ্ছিন্ন, যখন পরস্পর পরস্পরের শত্রু, তখন আমরা সবাই ভীরু, তখন সবাই সন্ত্রস্ত। যখন আমরা সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, যখন আমরা এক হতে পারি, যখন আমাদের চেতনা একসঙ্গে গ্রথিত হয়, তখনই আমরা দুঃসাহসী হয়ে উঠি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেই দুঃসাহসকে আমরা দেখেছি। কাজেই আবার আমরা দুঃসাহসী হতে পারব, যখন আমরা সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পাবর।
একুশে ফেব্রুয়ারি একটা প্রশ্ন রাখে আমাদের সবার সামনে। সেটা হলো, আমরা কে কোন পক্ষে। আলোর, নাকি অন্ধকারের? যদি আলোর পক্ষ হই তাহলে কি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি? দায়িত্ব পালন না করলে দেশ কেমন করে এগোবে? প্রশ্নটা শুরুতে ছিল, এখনো আছে, থাকবে আগামীকালও।
একুশের আন্দোলন যে শেষ হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ একুশের লক্ষ্য আজও অর্জিত হয়নি। হ্যাঁ, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে বৈকি, কিন্তু সর্বত্র সে প্রযুক্ত হচ্ছে না। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিণতিতে আমরা নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি ঠিকই, কিন্তু এই রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা এখন অত্যন্ত বিপন্ন, গণতন্ত্র গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের মতো আছে বলা হয়, কিন্তু আসলে নেই।
মাতৃভাষার মর্যাদা আমরা তখনই প্রতিষ্ঠা করতে পারব, যখন আমাদের এই রাষ্ট্র পুরোপুরি গণতান্ত্রিক হবে। পুঁজিবাদী বিশ্ব আমাদের গণতান্ত্রিক হতে দেয় না। আমাদের শাসকশ্রেণির সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা কখনো নির্বাচিত, কখনো অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক শাসন চাপিয়ে দেয়, যাতে করে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতে পারে এবং দেশকে একটি বৃহৎ বাজারে পরিণত করা সম্ভব হয়। পুঁজিবাদী বিশ্ব এই রাষ্ট্রকে স্বাধীন হতে দিচ্ছে না, তাঁবেদার করে রাখছে। অথচ একুশের আন্দোলনের মূল প্রেরণাটাই ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব সেদিন বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার ভয়ংকর অপচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম।
আন্দোলন চলছে এবং চলবে। নদীতে যেমন ঢেউয়ের পরে ঢেউ ওঠে, এখানেও তেমনটা ঘটা চাই। ঢেউ যদি না থাকে, তবে তো বুঝতে হবে নদী নেই, সে মারা গেছে।
এই আন্দোলনে নিরপেক্ষতার কোনো স্থান নেই। সেদিনও ছিল না, আজও নেই। আবারও তাই বলতে হয়, এই আন্দোলনে আমরা কে কী ভূমিকা নিচ্ছি, সেই প্রশ্নটা নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে হয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে