বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেধা-নেতৃত্ব

সেলিম জাহান
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৪, ০৭: ৩২

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে, আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ভূমিকা বিষয়ে, প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেধা-নেতৃত্ব’ বিষয়ে, আলোচিত হচ্ছে ভবিষ্যৎ সংস্কারের নানা দিক। এর মধ্যে আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেধা-নেতৃত্ব বিষয়টি আলোচনা-বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসি, তাহলে তিনটি মাত্রিকতার দিকে চোখ নিবদ্ধ করা প্রয়োজন। প্রথমত, মেধা-নেতৃত্ব বলতে আসলে কী বোঝায়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেধা-নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়গুলো কী কী এবং তৃতীয়ত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মেধা-নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কী কী করণীয়।  

শুরুতেই  বলা প্রয়োজন, আমরা যখন মেধা-নেতৃত্বের কথা বলি, তখন শুধু শিক্ষাগত উৎকর্ষ বা বিদ্যার্জনের কথা বলি না, মেধা-নেতৃত্বের কথা বলতে আমরা মনন, চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তি এবং এগুলোকে একটি উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলি। সুতরাং সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকে মেধা-নেতৃত্বের পাঁচটি মাত্রিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, মেধা-নেতৃত্ব দিতে হলে একটা বিশ্ববীক্ষণে একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠান যদি চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে, মননের ক্ষেত্রে কূপমণ্ডূক হয়, তাহলে তার পক্ষে মেধা-নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, মেধা-নেতৃত্ব দিতে হলে মন ও চিন্তার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা থাকতে হবে এবং সত্যিকার অর্থে মেধা-নেতৃত্বদানকারী একটি প্রতিষ্ঠানকে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার আধার হতে হবে। তৃতীয়ত, মেধা-নেতৃত্ব দিতে হলে মেধা-নেতার প্রয়োজন হবে। সেই মেধা-নেতার একদল হবে শিক্ষার্থী এবং অন্য দল হবেন শিক্ষক ও গবেষকেরা। মেধা-নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শিক্ষক ও গবেষককে যেমন উচ্চমানের হতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের শাণিত হতে হবে সর্ব অর্থেই।

চতুর্থত, মেধা-নেতৃত্ব দিতে গেলে পুঁথিগতবিদ্যা কিংবা শ্রেণিকক্ষের জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, শ্রেণিকক্ষের বাইরে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির জগতে যে জ্ঞান রয়েছে, তা আমাদের জানতে হবে এবং পঞ্চমত, মেধা-নেতৃত্ব মানে শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞানার্জন নয়, শুধু নেওয়া নয়, মেধা-নেতৃত্ব মানে দেওয়াও—দেশ ও জাতির জীবনের বহু ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে। 

মেধা-নেতৃত্বের এই পরিপ্রেক্ষিতকে মনে রেখে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক সমস্যাগুলোর দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে পাঁচটি সমস্যা আমরা চিহ্নিত করতে পারি। এক. আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য যে কী, সেটা বোধ হয় খুব সংহত ও পরিষ্কারভাবে আমরা এখনো সংজ্ঞায়িত করতে পারিনি। উচ্চশিক্ষার জন্য যিনি আসেন, তাঁর কাছে হয়তো একটি সনদপ্রাপ্তিই মূল কথা। একটি সনদ পেলে তিনি একটি ভালো চাকরি পাবেন—এমনটাই হয়তো ধারণা। উচ্চশিক্ষা যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরাও হয়তো ভাবেন যে সনদ প্রদান করতে পারলে তাঁদের দায়িত্ব শেষ। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা কি অধিকার, নাকি এটা একটা সুযোগ, সে প্রশ্নেও একটা ধোঁয়াটে ভাব আছে। সুতরাং বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কী, সে ব্যাপারে একটি দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত।

দুই. রাষ্ট্রের দিক থেকেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো পরিষ্কার দিক-দর্শন নেই। এই যে রাষ্ট্র উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ করছে, কেন সে সেটা করছে, কী তার প্রত্যাশা, কী সে চায় উচ্চশিক্ষা খাত থেকে, উচ্চশিক্ষা রাষ্ট্রকে কী দিতে পারে, তার খুব স্বচ্ছ সংহত কোনো ব্যাখ্যা নেই। বাংলাদেশে এ-জাতীয় একটি ব্যাখ্যার অনুপস্থিতিতে উচ্চশিক্ষা খাতে সমস্যার সৃষ্টি হয়।

তিন. উচ্চশিক্ষার পরিবেশের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে। এ ব্যাপারে আমি শুধু শ্রেণিকক্ষের ভেতরের পরিবেশের কথা বলছি না, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ভৌত অবকাঠামোর কথা বলছি। একটি পঞ্চতল ইমারতে ‘শিশু শিক্ষাসদন’ বসতে পারে, কিন্তু সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এমন একটি ভৌত অবকাঠামোর পরিবেশ থাকতে হবে, যেখানে শ্রেণিবহির্ভূত যেসব কার্যকর্ম থাকতে হবে এবং যা চলতে পারে, তার ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ যেন থাকে।

চার. উচ্চশিক্ষার একটি বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। আমি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—এ বিভাজনের কথা বলছি না। আমি মনে করি, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেওয়া-নেওয়া, দাতা-গ্রহীতা বড় হওয়ার কারণে উচ্চশিক্ষা একটি বাণিজ্যিক সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। ফলে সময়, সনদ এগুলোই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় মুখ্য হয়ে উঠেছে এবং জ্ঞানার্জন—কী শিখছি—তা গৌণ হয়ে গেছে।

পাঁচ. শুধু বাণিজ্যিকীকরণ নয়, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় একধরনের অশুভ রাজনীতিকীকরণ ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকারি মদদপুষ্ট ছাত্রগোষ্ঠীই ক্ষমতাসীন সরকারের পেটোয়াবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তারা শুধু শিক্ষার পরিবেশই নষ্ট করেনি, সাধারণ ছাত্রদের জন্য তারা একটি ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল। শিক্ষকদের রাজনীতিকীকরণের প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, উচ্চশিক্ষা—সব বিষয়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্ধারিত হয়েছে। ফলে মেধা নয়, মধ্যমমান পুরো ব্যবস্থার নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সব সময়ই রাজনীতি ছিল এবং সব সময়ই রাজনীতি থাকবে। কিন্তু তা হবে শুভ, সুস্থ এবং গঠনমূলক। দেশ গঠনে, সমাজ পরিবর্তনে, গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল বিনির্মাণে এই রাজনীতি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ভুলে গেলে চলবে না যে বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি ছিল বলেই এ দেশে গণ-আন্দোলন হয়েছে, জনযুদ্ধ হয়েছে, স্বাধীনতাসংগ্রাম এগিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেধা-নেতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য পাঁচটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার। প্রথমত, মেধা-নেতৃত্ব দেওয়ার শর্তগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে পূরণ করতে হবে। যেমন এক. বিশ্ববিদ্যালয়ের মনন, চিন্তা-চেতনা এবং বুদ্ধিবৃত্তিকে উচ্চতম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একটি বিশ্ববীক্ষণ এবং একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। দুই. বিশ্ববিদ্যালয়কে মনন ও চিন্তার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করতে হবে এবং তাদের মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার আধার হতে হবে। তিন. বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মধ্যে মেধা-নেতা তৈরি করতে হবে। চার. পুঁথিগত বিদ্যা কিংবা শ্রেণিকক্ষের জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, শ্রেণিকক্ষের বাইরে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির জগতে যে জ্ঞান রয়েছে, তা জানতে হবে। পাঁচ. দেশ, জাতি এবং জীবনের বহু ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে।  

দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ কী চায়, রাষ্ট্রই বা উচ্চশিক্ষার ভূমিকা কীভাবে দেখে, তা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে উচ্চশিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—শিক্ষার্থীদেরই প্রত্যাশা কী, তারও পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন এবং শিক্ষকদের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে পরিস্ফুট হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু দ্বন্দ্ব এই প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে নানা ধোঁয়াটে ভাব উদ্ভূত।

তৃতীয়ত, রাজনীতিকরণের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে মেধাভিত্তিক একটি কাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গড়ে তুলতে হবে এবং মেধার ভিত্তিতেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে হবে। সেটা যেমন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে করতে হবে, তেমনি শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও করতে হবে। 

চতুর্থত, বিশ্ববিদ্যালগুলোর জন্য একদিকে যেমন সম্পদ লভ্য করে দিতে হবে, তেমনি যথাযথ পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। আমি যে পরিবেশের কথা বলছি, সেখানে শিক্ষার্থীরা নিগৃহীত হবে না, তাদের অমানবিক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে হবে না, তাদের নানা রকমের বৈষম্যের শিকার হতে হবে না। কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে দিনের পর দিন একটি ছাত্রাবাসের বারান্দায় থেকে অতি শীতের কারণে মৃত্যুবরণ করতে হবে? 

শেষত, ইদানীং ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি কমিশনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে, সুপারিশমালা তৈরি করবে। অমন একটি কমিশন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও তো হতে পারে। ওই কমিশনটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সুযোগ্য ব্যক্তিত্বের সমাহারে হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার নানা দিক বিবেচনা করে মেধা-নেতৃত্বের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কী জাতীয় সংস্কার দরকার, তার জন্য একটি শ্বেতপত্র উপস্থাপন করতে পারে। আগামী দিনের বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার দিকনির্দেশনার ভিত্তি হতে পারে সেই শ্বেতপত্রটি।

লেখক: সেলিম জাহান
অর্থনীতিবিদ

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত