চাপের মুখে কৌতুকে দিন মন

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ০৮
Thumbnail image

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে চোখ রাখলে বরাবরের মতোই মনে হয়, এ দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে। বাক্‌স্বাধীনতার এ এক স্বর্গরাজ্য যেন। যে যার মতো কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছেন। কেউ অন্তর্বর্তী সরকারকে এক তুড়িতে ফেলে দিচ্ছেন, কেউ শেখ হাসিনাকে নিমেষে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করে ফেলছেন, কেউ বিএনপির কর্মীদের চাঁদাবাজি নিয়ে মন্তব্য করছেন, কেউ অতি দ্রুত নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছেন—এ রকম হাজারো বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঝালাপালা হয়ে আছে। এর মধ্যে কিছু থাকছে বস্তুনিষ্ঠ খবর ও তার মূল্যায়ন, কিছু থাকছে নিতান্তই গুজবের ওপর দাঁড় করানো বিষয়বস্তু। ইউটিউবে অনেকেই এখন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন।

যেকোনো আলাপই এখন হয়ে গেছে রাজনীতিকেন্দ্রিক। পাড়া-মহল্লায় আড্ডায় এখন সিনেমা নেই, খেলাধুলা নেই, গান নেই, আছে শুধু রাজনীতি। এবং মজার ব্যাপার হলো, প্রত্যেক বক্তাই এমন দৃঢ়তার সঙ্গে তার মত প্রকাশ করেন, তাতে মনে হয় এটাই বুঝি একমাত্র সত্য। কোথা থেকে তিনি তথ্য জোগাড় করেছেন, সেটা ঊহ্য থাকে। কিন্তু তথ্যের উৎস থাকুক আর না-ই থাকুক, তার কথাগুলো হিমালয়ের মতো শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

এ রকম গুমোট অবস্থায় আমি একটু অবকাশ খুঁজি। সে সময় মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে আমার বসবাসের দিনগুলোর কথা। অনেকেই জানেন, সোভিয়েত শাসনের সময়টিতে সে দেশে বাক্‌স্বাধীনতার কোনো বালাই ছিল না। সরকারের বিপক্ষে কিছু করা বা বলার শাস্তি ছিল ভয়াবহ। কিন্তু বাক্‌স্বাধীনতাহীন সেই দিনগুলোতে মানুষ রসিকতা করতে শিখে গিয়েছিল। রাশান কৌতুকগুলো তাই সব সময়ই ছিল সরস। আজ সেই সব কৌতুক থেকে অল্প কিছু কৌতুক ছেঁকে নিয়ে পরিবেশন করব স্রেফ মাথা থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বোঝা খানিকক্ষণের জন্য নামিয়ে রাখার স্বার্থে। এই কৌতুকগুলোর জন্মস্থান রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়ন হলেও বাংলার পাঠক তা পড়ে আরাম পাবে না, এমন নয়।

দুই.

আমরা একসময় পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের কথা বলতাম। শৈশবেই আমরা গড়গড় করে বলে দিতে পারতাম ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান, মিসরের পিরামিড, তাজমহল ইত্যাদির কথা। সোভিয়েত রসিক মানুষ সোভিয়েত সমাজেও সাতটি আশ্চর্য ঘটনার কথা ভেবেছেন।

কী ছিল সোভিয়েত সমাজের সপ্তাশ্চর্য?

১. বেকারত্ব নেই, কিন্তু কেউ কাজ করে না।

২. কেউ কাজ করে না, কিন্তু পরিকল্পনামতো ফলন হয়।

৩. পরিকল্পনামতো ফলন হয়, কিন্তু দোকানে কিছুই কিনতে পাওয়া যায় না।

৪. দোকানে কিছুই কিনতে পাওয়া যায় না, কিন্তু সবখানেই থাকে কিউ।

৫. সবখানেই থাকে কিউ, কিন্তু সরকারি প্রচারণায় থাকে—আমাদের ফলন উপচে পড়ছে।

৬. সরকারি প্রচারণায় আমাদের ফলন উপচে পড়ছে, কিন্তু জনমনে থাকে অসন্তোষ।

৭. জনমনে অসন্তোষ থাকে কিন্তু সবাই আমরা কমিউনিস্ট সরকারের পক্ষেই ভোট দিই!

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাকেও ছাড় দেয়নি রুশরা। যদি প্রশ্ন করা হয়, কাকে বলে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা, তার উত্তরে রুশরা বলবে, ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা হলো প্রকাশ্যে সবাই মিলে পার্টির গুণগান করবে আর একা হলে প্রত্যেকেই নিয়ম করে পার্টিকে গাল দেবে।’

পরের কৌতুকটি আগেও একবার বলেছিলাম। আগে যারা পড়েননি, তাদের পড়ার সুবিধার্থে আবার তা বলা যায়।

এক রোগী গেছে হাসপাতালে। অভ্যর্থনাকক্ষে গিয়ে বলছে, ‘কান-চোখের ডাক্তারের কাছে যাব।’

‘কান-চোখ! এ কেমন কথা! নাক-কান–গলার ডাক্তার একজন। চোখের ডাক্তার অন্য একজন! আপনি আসলে কোন ডাক্তার দেখাবেন?’

রোগী বলল, ‘সেই সমস্যাটার কথাই তো বলছি! আমি চোখে দেখছি একটা, আর কানে শুনছি অন্যটা! চোখকে না কানকে বিশ্বাস করব আমি?’

এক কমিউনিস্ট নেতা ৩০ বছর ধরে সংসদ সদস্য (ওদের দেশে বলা হয় দেপুতাৎ বা ডেপুটি)।

সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘এত দিন ধরে আপনি সংসদ সদস্য। কেমন লাগে এই জীবনটা?’

উত্তরে সংসদ সদস্য বললেন, ‘এই ৩০টা বছর মনে হয় জেলখানায় আছি। কী যে চাপের মধ্যে থাকতে হয়! ঘরবাড়ির খবর রাখতে পারি না। বউ-সন্তানদের নিয়ে যে একটু সমুদ্রপাড়ে অবকাশে যাব, তারও উপায় নেই। আমার পরম শত্রুকেও সংসদ সদস্য হওয়ার উপদেশ দেব না।’

সাংবাদিকের প্রশ্ন, ‘আর আপনার ছেলে যদি সংসদ সদস্য হতে চায়, তাকে অনুমতি দেবেন?’

‘নিশ্চয়ই দেব!’ সংসদ সদস্যের উত্তর।

রাশিয়ার অন্যতম সেরা সংগীতকার সের্গেই রাখমানিনোভের কথা অনেকেই জানেন। তিনি শুরুতে ১৯১৭ সালের বিপ্লবটা কী, তা বোঝেননি, তাই রাশিয়া ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন।

‘আর যখন বিপ্লবটা বুঝলেন, তখন?’

যখন সের্গেই রাখমানিনোভ বিপ্লব কাকে বলে বুঝলেন, তখন তিনি রাশিয়া থেকে আরও বেশি দূরে চলে গেলেন। সুইজার‍ল্যান্ড ত্যাগ করে তিনি চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে।’

বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ে তো সারা পৃথিবীতেই তুমুল বিতর্ক রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই বিতর্ক কেমন ছিল? সেখানে কী বাক্‌স্বাধীনতা ছিল?

এ ব্যাপারে একজন বিচক্ষণ পার্টি নেতা বলেছিলেন, ‘কী যে বলেন! কেন থাকবে না? অবশ্যই আপনার বাক্‌স্বাধীনতা আছে। কিন্তু আপনি মুক্তভাবে বাক্‌স্বাধীনতা ব্যবহার করে যা খুশি বলার পর আপনার সঙ্গে কী ঘটবে, সে ব্যাপারে কোনো গ্যারান্টি আমি দিতে পারব না!’

হঠাৎ পত্রিকার পাতায় ছাপা হলো এক ২৪ বছর বয়সী সুন্দরী নারীর ঝকঝকে সাক্ষাৎকার। তিনি একটি ডাকসাঁইটে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক! কী করে এই বয়সে এত বড় স্বীকৃতি পেলেন, তা জিজ্ঞাসা করার পর যা জানা গেল:

১. তিনি ভোর ৫টায় ঘুম থেকে ওঠেন।

২. এরপর নানা ধরনের ঝরনার পানিতে স্নান করেন।

৩. এরপর যোগব্যায়াম করেন।

৪. এরপর ধ্যান বা মেডিটেশনে বসেন।

৫. ডায়েট কন্ট্রোলের নিয়ম মেনে খান।

৬. আত্ম-উন্নয়নমূলক বই পড়েন।

৭. ইতিবাচক চিন্তা করেন।

ব্যবসা সামলানোর জন্য আর কিছু কি করেন?

৮. তাকে কিছুই করতে হয় না। তার বাবা এই কোম্পানির মালিক এবং দেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি।

রাশিয়ায় একসময় দেখা গেল, অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠছে। তার মানে কী! মানুষ কি চুরি কমিয়ে দিয়েছে?

আরে না! চুরি কমাবে কেন? যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় চোরেরা টাকা পাচার করতে পারছে না। তাই সেই টাকা দেশেই খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে। আর তাই উন্নতি হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার!

রাজনীতিবিদকে প্রশ্ন: রাজনীতিবিদেরা কেন জনগণকে গবেট মনে করে?’

রাজনীতিবিদের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘কারণ জনগণ আমাদের ভোট দেয়।’

শিয়াল আর কাকের গল্পটা তো সবার জানা আছে। গাছের ডালে মুখে মাংসের টুকরা নিয়ে বসে আছে কাক। শিয়াল নিচ থেকে কাককে কথা বলানোর চেষ্টা করছে। কাক যদি কা কা করে ওঠে, তাহলে ওর ঠোঁট থেকে মাংসের টুকরা পড়ে যাবে। শিয়াল খেয়ে নেবে—এই হলো গল্পের শুরুটা। দেখা যাক, রুশ রসিকের দল গল্পটাকে কীভাবে তৈরি করেছে।

শিয়াল: কাক, তুই কি পুতিনকে ভোট দিবি?

কাক নিশ্চুপ।

শিয়াল: চুপ থাকিস না কাক। সত্যিই বল, তুই কি নির্বাচনে পুতিনকে ভোট দিবি?

এবারও কাক নিশ্চুপ।

শিয়াল: ভেবে দ্যাখ, কাক! তুই কি নির্বাচনে পুতিনকে ভোট দিবি?’

এবার কাক চিৎকার করে বলল, ‘হ্যাঁ...হ্যাঁ...হ্যাঁ...

ব্যস! ঠোঁট থেকে মাংসের টুকরা পড়ে গেল মাটিতে। সেটা গেল শিয়ালের অধিকারে।

মাংস নিয়ে যখন পালাচ্ছিল শিয়াল, তখন কাক চিৎকার করে বলল, ‘শুনে যা! যদি “না” বলতাম, তাহলে কি দেশের কোনো ইতরবিশেষ পরিবর্তন হতো?’

শেষ করি একটি খুবই নির্দয় কৌতুক দিয়ে।

রাজনীতিবিদ তাঁর ছেলেকে নিয়ে বসেছেন। সামনে তাঁদের প্রিয় কুকুর। রাজনীতিবিদ বাবা ছেলেকে বলছেন, ‘বল তো, গত পরশু আমি কুকুরটাকে কয়টা হাড় দিয়েছিলাম?’

‘দুটো।’

‘ঠিক বলেছিস! তখন কুকুরটা কী করেছিল?’

‘দুটো হাড় পেয়ে খুশিতে লাফাচ্ছিল। তোমার হাত চেটে দিয়েছিল আনন্দে।’

‘ঠিক বলেছিস। কাল আমি ওকে একটা হাড় দিয়েছিলাম। ও কী করেছিল?’

‘ও বোকার মতো তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল।’

‘ঠিক বলেছিস। আজ আমি কুকুরটাকে বলেছি, “আজ কোনো হাড় নেই, নে রুটি খা।” এই কথা শুনে কুকুরটা কী করেছিল?’

‘রুটিটা শুঁকে পেছন ফিরে নিজের ঘরে চলে গেছে।’

বাবা বলল, ‘কাল আমি ওকে তিনটি হাড্ডি দেব। তখন ও নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী কুকুর বলে ভাববে। আর আমাকে ভাববে সবচেয়ে বড় বন্ধু। বুঝেছিস, এটাই হচ্ছে রাজনীতির সবচেয়ে বড় শিক্ষা!’

লেখক: জাহীদ রেজা নূর
উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শপথ নিয়েই বাইডেনের নীতি বাতিল ও ১০০ নির্বাহী আদেশের ঘোষণা ট্রাম্পের

আয়রন রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট পরবে পুলিশ

বিচার বিভাগের সমস্যা তুলে ধরলেন বিচারক, আনিসুল হক বললেন ‘সমস্যা কেটে যাবে’

শাহজালাল বিমানবন্দরে চাকরি নেননি মনোজ কুমার, বিজ্ঞাপনচিত্র নিয়ে বিভ্রান্তি

সিলেটে রিসোর্টে ৮ তরুণ-তরুণীকে জোর করে বিয়ে, কিছু না করেই ফিরে এল পুলিশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত