সৌভিক রেজা
রবীন্দ্রনাথ সেই কত আগে, ফাল্গুন ১২৮৯ বঙ্গাব্দে বলেছিলেন, ‘আজকাল সকলেই সকল বিষয়েই চেঁচিয়ে কথা কয়। আস্তে বলা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। চেঁচিয়ে দান করে, চেঁচিয়ে সমাজসংস্কার করে, চেঁচিয়ে খবরের কাগজ চালায়, এমন-কি গোল থামাইতে গোল করে।’ মানুষের কখন চেঁচিয়ে কথা বলার প্রয়োজন হয় না? এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘প্রাণের সঙ্গে যখন কোনো কথা বলি, তখন যাহা বলি তাহারই একটা বল থাকে।’ অন্যদিকে তাঁর মতে, ‘যখন প্রাণে বাজে নাই অথচ মুখে বলিতে হইবে, তখন চেঁচাইয়া বলিতে হয়, বিস্তর বলিতে হয়। বঙ্গসমাজে যে আজকাল বিশেষ চেঁচামেচি পড়িয়া গিয়াছে ইহাও তাহার একটি কারণ।’
হাসান হাফিজুর রহমানের সাহিত্যকর্ম হচ্ছে, সেই প্রাণের সঙ্গে প্রাণকে নিয়ে পাঠকের সঙ্গে কথা বলা। শুধুই কি পাঠকের সঙ্গে? না, তা নয়। কারণ একজন সাহিত্যিককে তাঁর নিজের সঙ্গেও কথোপকথন করতে হয়। শুধু একজন কবি বা সাহিত্যিক কেন, যেকোনো সচেতন মানুষকেই তো নিজেকে নানাভাবে পাঠ করতে হয়। হাসান সেটি জানতেন বলেই সেই বিষয়টিকে মান্যতা দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতা-প্রবন্ধ-কথাসাহিত্যের একটি বড় গুণ হচ্ছে, এই প্রাণে-প্রাণ মিলিয়ে কথা বলা, যা কিনা প্রবহমান জীবনের সমান্তরালে সংঘাত আর সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে পাশাপাশি বিরাজমান।
২.
মাত্র একান্ন বছরের পরমায়ু নিয়ে হাসান নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, আজকের দিনে আমাদের কল্পনায়ও সেটি আনতে পারা যায় না। আমাদের আরেকজন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ হাসানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, হাসান হলেন ‘পঞ্চাশের দশকের একজন প্রধান কবি, দাঙ্গার বিরুদ্ধে পাঁচটি গল্পের যুগ্ম সম্পাদক-প্রকাশক, একুশের সংকলনের সাহসী নির্মাতা, সাম্প্রতিক ঘটনার বিদগ্ধ ভাষ্যকার; প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের নিবেদিত সংগঠক, সমকাল-গোষ্ঠীর মধ্যমণি কিংবা স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের সত্যভাষী গবেষক।’ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার সার্বিক চেতনা সম্পর্কে হাসান নিজেও অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। আর সে কারণেই তাঁর পক্ষে এভাবে বলা সম্ভব হয়েছিল, ‘যে মৌলিক চেতনা ভাষার অধিকার রক্ষায় আমাদের জাগ্রত করেছে, তা স্বাধীনতাসংগ্রামেরও প্রেরণা। সে জন্যে বলতে পারি, চরিত্রগত দিক থেকে ভাষা এবং স্বাধীনতাসংগ্রাম এক জাতের মূল্যবোধের ফসল। দুটোই মৌলিক অধিকার রক্ষা বা আদায়ের সংকল্পে উদ্বুদ্ধ।’ হাসানের কবিতায় এবং তাঁর কাব্যচেতনায় সেই উদ্ভাসনের একটি সামগ্রিক চিত্র আমরা দেখতে পাই।
৩.
শামসুর রাহমান তাঁর এক স্মৃতিচারণামূলক নিবন্ধে হাসানের কাব্য-প্রবণতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন বরাবরই একজন দায়বদ্ধ লেখক।...হাসান হাফিজুর রহমানের মধ্যে সমাজসচেতনতার সঙ্গে নান্দনিক চেতনাও প্রখর ছিল।’ হাসান নিজেও তাঁর কাব্যাদর্শের বিষয়ে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘আমার চেতনা এমন ধরনের জিনিস, যার সাথে বিশ্বভ্রমণের কোনো যোগ নেই। চেতনা দিয়েই আমি বিশ্বকে দেখি।’ আমরা বুঝে নিতে পারি যে ‘সমস্ত চৈতন্য দিয়ে দেখবার অভিজ্ঞতা’কে আত্মস্থ করে নিয়ে হাসান তাঁর কাব্যাদর্শের জায়গা-জমিতে কবিতার ফসল ফলিয়েছিলেন। আবার এর পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক চেতনাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে হাসান জানিয়েছিলেন, ‘রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ ১৯৪৯-৫০ সাল থেকেই। এ সময়ই আমি বামপন্থী গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করি। মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলসের রচনা ও অন্যান্য রাজনৈতিক ক্লাসিকগুলো এ সময়ই পড়ে ফেলি। জড়িত হই প্রগতি লেখক সংঘের সাথে।’ হাসানের কবিতায় সেই আদর্শরূপের একটি সমন্বিত শৈল্পিক নিদর্শন কতভাবেই না আমরা দেখতে পেয়েছি।
এ বিষয়ে কবি বিষ্ণু দের অভিমত বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর মতে, ‘প্রগতিশীল সাহিত্যের চিরকালীন লক্ষণ হলো...চৈতন্য-জ্যাবদ্ধ টান।’ সাহিত্যের প্রগতিবাদের সূত্র ধরে বিষ্ণু দে আরও বলেছিলেন, ‘টেকনিকের সাধনাই শিল্পীকে জিজ্ঞাসার সীমান্তে টেকনিকের উৎসে নিয়ে যেতে পারে।’ হাসান হাফিজুরের কবিতার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা ঘটেনি। সেখানে দেখতে পাই, এই কবি সব সময়ই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে উঠে আসতে চেয়েছেন।
৪.
হাসান হাফিজুর রহমান মনে করতেন, ‘প্রকৃতপক্ষে কবিতা একটি বিমূর্ত ও স্বতন্ত্র জগৎ রূপায়ণের সকল রকম কলা-কৌশলেরই অধিকারী। ঘটমান জীবনের আভাসে এক স্বতন্ত্র জীবন এতে গড়ে ওঠে। জীবনের এক শুদ্ধতর নবজন্মের অভিষেক যেন কবিতা, যেখানে প্রতিটি মরণশীল মুহূর্ত ও মানবীয় কর্ম চিরন্তন অমর যৌবনের লাবণ্যে দীপ্ত।’ তাঁর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় হাসান বলেছিলেন, ‘এ যেন জীবনের পাশেপাশে সমান্তরাল জীবন, প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই যা পরিশীলিত, উন্নততর।’ কেন পরিশীলিত, কেন উন্নততর তার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন হাসান। তাঁর মতে, ‘বস্তুত কবিতার বিষয়বস্তু হলো, জাগতিক আবর্তের স্বরূপ আর কবির মন। নিশ্চিতভাবে কাব্যে কবির মনকেই আমরা আস্বাদন করি। তাঁর আবেগ, তাঁর বুদ্ধি, তাঁর দেখা, প্রেম-অপ্রেম, সুন্দর-অসুন্দর সম্পর্কে তাঁর রুচি।’ এরই সূত্র ধরে তিনি কবিতার আধুনিকতাকে সাহিত্যের প্রাসঙ্গিক ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে চেয়েছিলেন। শুধু এটুকুই নয়, ‘আধুনিক কবিতা মানবসভ্যতার অগ্রসরমাণ ঐতিহ্যের নিবিড়তম সত্য। সেই সত্যের যথার্থতম মূল্যায়ন এবং তার সার্থক প্রতিষ্ঠা ও বিপুলতর বিকাশের দিকেই প্রসারিত।’ আর সে-কারণেই তাঁর রাজনৈতিক চেতনাকে কোনো সীমাবদ্ধতায় আটকে রাখতে চাননি, হাসান বরং তাকে সাহিত্যের বিস্তারের মধ্য দিয়ে মানুষের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন। একজন আধুনিক কবি হিসেবে এখানেই তাঁর কৃতিত্ব।
৫.
হাসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামসুর রাহমান জানিয়েছিলেন, ‘সহজেই তিনি যেকোনো মানুষকে আপনজন বলে গ্রহণ করতে পারতেন। এ জন্যই তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে লোকপ্রিয়। তাঁর ব্যবহারে এমন এক সহজ, সুন্দর মাধুর্য ছিল যে যিনি তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, তিনি তাঁকে ভালো না বেসে পারেননি।’ আবার অন্যদিকে, হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর বেড়ে ওঠা, শরীর-মন-চেতনার বিকাশ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তিনটা জায়গায় আমার ছোটকাল কেটেছে। যার ভিত্তি ছিল ঢাকা, নিজের বাড়ি ও অতঃপর মামাবাড়ি।...উল্লিখিত তিন স্তরে কোথাও নিষ্ঠুরতা পাইনি। সেখানে ছিল সহজ, স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনপ্রণালি, ন্যায়ের প্রতি আসক্তি, অন্যায়ের প্রতি অনীহা। এর ফলে একটা সেকিউলার মনোভঙ্গির সৃষ্টি হয় আমার মধ্যে।’ তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা গোড়া থেকেই সঞ্চারিত হয়েছিল আমার মধ্যে। পরিবেশ ও আবেষ্টনীলব্ধ এই...ধারণা আমার সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে।’ এটিই হচ্ছে হাসান সম্পর্কে আসল কথা।
৬.
নিজের জীবন-সংগ্রামে খাবি খেতে-খেতে, হাসানও যে কখনো-সখনো উত্তেজিত হননি, এমন নয়। হাসান তাঁর অবিনাশী আশাবাদে আস্থা রেখেও, প্রাত্যহিকতার চারদিকে নানা রকম দোজখের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হোঁচট খেয়েছেন আর সে কারণেই সম্ভবত সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের স্বপ্ন দেখা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে হতাশায়, অন্ধ আক্রোশে নানাভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। ‘আমার ভেতরের বাঘ’ কাব্যের একটি কবিতায় কবির সচেতন অন্তর্মুখিতার মধ্যেও দেখতে পাই সংবেদনশীলতার এক দীর্ঘশ্বাসজনিত বেদনা। আক্রান্ত কবি বেদনায় জীর্ণ হতে হতে বলেছেন,
যখন একদিন শোকসভায় উঠব আমি,
করতালিতে নয়, অবিরাম দীর্ঘশ্বাসে
মুহূর্তেই জান্তব হয়ে যাবো ফের।
তোমরা বলবে, বড্ড প্রয়োজনীয় ছিলো লোকটা।
এখন দরকারের ফর্দে আছি উদ্বাহু, ফিরেও তাকাও না।
তোমরা বলবে, অপূরণীয় ক্ষতি হলো
লোকটার তিরোধানে।
এরপরই নিজের অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে হাসান ব্যথিত-মনে জানিয়েছেন,
এখন সকল ক্ষতি পুরিয়ে দিতে আছি এক পায়ে দাঁড়িয়ে
ফিরেও তাকাও না।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রবীন্দ্রনাথ সেই কত আগে, ফাল্গুন ১২৮৯ বঙ্গাব্দে বলেছিলেন, ‘আজকাল সকলেই সকল বিষয়েই চেঁচিয়ে কথা কয়। আস্তে বলা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। চেঁচিয়ে দান করে, চেঁচিয়ে সমাজসংস্কার করে, চেঁচিয়ে খবরের কাগজ চালায়, এমন-কি গোল থামাইতে গোল করে।’ মানুষের কখন চেঁচিয়ে কথা বলার প্রয়োজন হয় না? এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘প্রাণের সঙ্গে যখন কোনো কথা বলি, তখন যাহা বলি তাহারই একটা বল থাকে।’ অন্যদিকে তাঁর মতে, ‘যখন প্রাণে বাজে নাই অথচ মুখে বলিতে হইবে, তখন চেঁচাইয়া বলিতে হয়, বিস্তর বলিতে হয়। বঙ্গসমাজে যে আজকাল বিশেষ চেঁচামেচি পড়িয়া গিয়াছে ইহাও তাহার একটি কারণ।’
হাসান হাফিজুর রহমানের সাহিত্যকর্ম হচ্ছে, সেই প্রাণের সঙ্গে প্রাণকে নিয়ে পাঠকের সঙ্গে কথা বলা। শুধুই কি পাঠকের সঙ্গে? না, তা নয়। কারণ একজন সাহিত্যিককে তাঁর নিজের সঙ্গেও কথোপকথন করতে হয়। শুধু একজন কবি বা সাহিত্যিক কেন, যেকোনো সচেতন মানুষকেই তো নিজেকে নানাভাবে পাঠ করতে হয়। হাসান সেটি জানতেন বলেই সেই বিষয়টিকে মান্যতা দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতা-প্রবন্ধ-কথাসাহিত্যের একটি বড় গুণ হচ্ছে, এই প্রাণে-প্রাণ মিলিয়ে কথা বলা, যা কিনা প্রবহমান জীবনের সমান্তরালে সংঘাত আর সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে পাশাপাশি বিরাজমান।
২.
মাত্র একান্ন বছরের পরমায়ু নিয়ে হাসান নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, আজকের দিনে আমাদের কল্পনায়ও সেটি আনতে পারা যায় না। আমাদের আরেকজন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ হাসানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, হাসান হলেন ‘পঞ্চাশের দশকের একজন প্রধান কবি, দাঙ্গার বিরুদ্ধে পাঁচটি গল্পের যুগ্ম সম্পাদক-প্রকাশক, একুশের সংকলনের সাহসী নির্মাতা, সাম্প্রতিক ঘটনার বিদগ্ধ ভাষ্যকার; প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের নিবেদিত সংগঠক, সমকাল-গোষ্ঠীর মধ্যমণি কিংবা স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের সত্যভাষী গবেষক।’ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার সার্বিক চেতনা সম্পর্কে হাসান নিজেও অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। আর সে কারণেই তাঁর পক্ষে এভাবে বলা সম্ভব হয়েছিল, ‘যে মৌলিক চেতনা ভাষার অধিকার রক্ষায় আমাদের জাগ্রত করেছে, তা স্বাধীনতাসংগ্রামেরও প্রেরণা। সে জন্যে বলতে পারি, চরিত্রগত দিক থেকে ভাষা এবং স্বাধীনতাসংগ্রাম এক জাতের মূল্যবোধের ফসল। দুটোই মৌলিক অধিকার রক্ষা বা আদায়ের সংকল্পে উদ্বুদ্ধ।’ হাসানের কবিতায় এবং তাঁর কাব্যচেতনায় সেই উদ্ভাসনের একটি সামগ্রিক চিত্র আমরা দেখতে পাই।
৩.
শামসুর রাহমান তাঁর এক স্মৃতিচারণামূলক নিবন্ধে হাসানের কাব্য-প্রবণতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন বরাবরই একজন দায়বদ্ধ লেখক।...হাসান হাফিজুর রহমানের মধ্যে সমাজসচেতনতার সঙ্গে নান্দনিক চেতনাও প্রখর ছিল।’ হাসান নিজেও তাঁর কাব্যাদর্শের বিষয়ে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘আমার চেতনা এমন ধরনের জিনিস, যার সাথে বিশ্বভ্রমণের কোনো যোগ নেই। চেতনা দিয়েই আমি বিশ্বকে দেখি।’ আমরা বুঝে নিতে পারি যে ‘সমস্ত চৈতন্য দিয়ে দেখবার অভিজ্ঞতা’কে আত্মস্থ করে নিয়ে হাসান তাঁর কাব্যাদর্শের জায়গা-জমিতে কবিতার ফসল ফলিয়েছিলেন। আবার এর পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক চেতনাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে হাসান জানিয়েছিলেন, ‘রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ ১৯৪৯-৫০ সাল থেকেই। এ সময়ই আমি বামপন্থী গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করি। মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলসের রচনা ও অন্যান্য রাজনৈতিক ক্লাসিকগুলো এ সময়ই পড়ে ফেলি। জড়িত হই প্রগতি লেখক সংঘের সাথে।’ হাসানের কবিতায় সেই আদর্শরূপের একটি সমন্বিত শৈল্পিক নিদর্শন কতভাবেই না আমরা দেখতে পেয়েছি।
এ বিষয়ে কবি বিষ্ণু দের অভিমত বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর মতে, ‘প্রগতিশীল সাহিত্যের চিরকালীন লক্ষণ হলো...চৈতন্য-জ্যাবদ্ধ টান।’ সাহিত্যের প্রগতিবাদের সূত্র ধরে বিষ্ণু দে আরও বলেছিলেন, ‘টেকনিকের সাধনাই শিল্পীকে জিজ্ঞাসার সীমান্তে টেকনিকের উৎসে নিয়ে যেতে পারে।’ হাসান হাফিজুরের কবিতার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা ঘটেনি। সেখানে দেখতে পাই, এই কবি সব সময়ই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে উঠে আসতে চেয়েছেন।
৪.
হাসান হাফিজুর রহমান মনে করতেন, ‘প্রকৃতপক্ষে কবিতা একটি বিমূর্ত ও স্বতন্ত্র জগৎ রূপায়ণের সকল রকম কলা-কৌশলেরই অধিকারী। ঘটমান জীবনের আভাসে এক স্বতন্ত্র জীবন এতে গড়ে ওঠে। জীবনের এক শুদ্ধতর নবজন্মের অভিষেক যেন কবিতা, যেখানে প্রতিটি মরণশীল মুহূর্ত ও মানবীয় কর্ম চিরন্তন অমর যৌবনের লাবণ্যে দীপ্ত।’ তাঁর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় হাসান বলেছিলেন, ‘এ যেন জীবনের পাশেপাশে সমান্তরাল জীবন, প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই যা পরিশীলিত, উন্নততর।’ কেন পরিশীলিত, কেন উন্নততর তার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন হাসান। তাঁর মতে, ‘বস্তুত কবিতার বিষয়বস্তু হলো, জাগতিক আবর্তের স্বরূপ আর কবির মন। নিশ্চিতভাবে কাব্যে কবির মনকেই আমরা আস্বাদন করি। তাঁর আবেগ, তাঁর বুদ্ধি, তাঁর দেখা, প্রেম-অপ্রেম, সুন্দর-অসুন্দর সম্পর্কে তাঁর রুচি।’ এরই সূত্র ধরে তিনি কবিতার আধুনিকতাকে সাহিত্যের প্রাসঙ্গিক ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে চেয়েছিলেন। শুধু এটুকুই নয়, ‘আধুনিক কবিতা মানবসভ্যতার অগ্রসরমাণ ঐতিহ্যের নিবিড়তম সত্য। সেই সত্যের যথার্থতম মূল্যায়ন এবং তার সার্থক প্রতিষ্ঠা ও বিপুলতর বিকাশের দিকেই প্রসারিত।’ আর সে-কারণেই তাঁর রাজনৈতিক চেতনাকে কোনো সীমাবদ্ধতায় আটকে রাখতে চাননি, হাসান বরং তাকে সাহিত্যের বিস্তারের মধ্য দিয়ে মানুষের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন। একজন আধুনিক কবি হিসেবে এখানেই তাঁর কৃতিত্ব।
৫.
হাসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামসুর রাহমান জানিয়েছিলেন, ‘সহজেই তিনি যেকোনো মানুষকে আপনজন বলে গ্রহণ করতে পারতেন। এ জন্যই তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে লোকপ্রিয়। তাঁর ব্যবহারে এমন এক সহজ, সুন্দর মাধুর্য ছিল যে যিনি তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, তিনি তাঁকে ভালো না বেসে পারেননি।’ আবার অন্যদিকে, হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর বেড়ে ওঠা, শরীর-মন-চেতনার বিকাশ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তিনটা জায়গায় আমার ছোটকাল কেটেছে। যার ভিত্তি ছিল ঢাকা, নিজের বাড়ি ও অতঃপর মামাবাড়ি।...উল্লিখিত তিন স্তরে কোথাও নিষ্ঠুরতা পাইনি। সেখানে ছিল সহজ, স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনপ্রণালি, ন্যায়ের প্রতি আসক্তি, অন্যায়ের প্রতি অনীহা। এর ফলে একটা সেকিউলার মনোভঙ্গির সৃষ্টি হয় আমার মধ্যে।’ তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা গোড়া থেকেই সঞ্চারিত হয়েছিল আমার মধ্যে। পরিবেশ ও আবেষ্টনীলব্ধ এই...ধারণা আমার সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে।’ এটিই হচ্ছে হাসান সম্পর্কে আসল কথা।
৬.
নিজের জীবন-সংগ্রামে খাবি খেতে-খেতে, হাসানও যে কখনো-সখনো উত্তেজিত হননি, এমন নয়। হাসান তাঁর অবিনাশী আশাবাদে আস্থা রেখেও, প্রাত্যহিকতার চারদিকে নানা রকম দোজখের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হোঁচট খেয়েছেন আর সে কারণেই সম্ভবত সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের স্বপ্ন দেখা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে হতাশায়, অন্ধ আক্রোশে নানাভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। ‘আমার ভেতরের বাঘ’ কাব্যের একটি কবিতায় কবির সচেতন অন্তর্মুখিতার মধ্যেও দেখতে পাই সংবেদনশীলতার এক দীর্ঘশ্বাসজনিত বেদনা। আক্রান্ত কবি বেদনায় জীর্ণ হতে হতে বলেছেন,
যখন একদিন শোকসভায় উঠব আমি,
করতালিতে নয়, অবিরাম দীর্ঘশ্বাসে
মুহূর্তেই জান্তব হয়ে যাবো ফের।
তোমরা বলবে, বড্ড প্রয়োজনীয় ছিলো লোকটা।
এখন দরকারের ফর্দে আছি উদ্বাহু, ফিরেও তাকাও না।
তোমরা বলবে, অপূরণীয় ক্ষতি হলো
লোকটার তিরোধানে।
এরপরই নিজের অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে হাসান ব্যথিত-মনে জানিয়েছেন,
এখন সকল ক্ষতি পুরিয়ে দিতে আছি এক পায়ে দাঁড়িয়ে
ফিরেও তাকাও না।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে