ক্যানসারের ঝুঁকি কমে নিয়মিত রক্তদানে

ডা. ডালিয়া নাসরীন
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৪, ০৭: ৫৭

রক্তের প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয় মানুষকেই। রক্তদান নিঃসন্দেহে মহৎ ও মানবিক কাজ। তবে এর সঙ্গে নানান জটিল দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে বাঁচার উপায়ও হলো নিয়মিত রক্তদান। যেমন—ক্যানসার। হ্যাঁ, নিয়মিত রক্তদান যে ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়, তা বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত।

১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। ডব্লিউএইচও এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘টোয়েন্টি ইয়ারস অব সেলিব্রেটিং গিভিং: থ্যাংক ইউ ব্লাড ডোনারস!’ সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায়—‘দিবস উদ্‌যাপনের ২০ বছর: ধন্যবাদ হে রক্তদাতা!’

বিজ্ঞানীরা বলেন, রক্ত দেওয়ার সময় শরীরের অতিরিক্ত লৌহ উপাদান বেরিয়ে যাওয়ার ফলে রক্তদাতার ক্যানসারের ঝুঁকি কমে যায়। বছরে দুবার রক্তদানে ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। মিলার-কিস্টোন ব্লাড সেন্টার সাড়ে চার বছর ধরে ১ হাজার ২০০ লোকের ওপর গবেষণা চালিয়ে বের করেন যে, রক্তদানের সঙ্গে ক্যানসারের ঝুঁকি কমার সরাসরি সম্পর্ক আছে।

যাঁরা বছরে অন্তত দুবার রক্ত দান করেন, অন্যদের তুলনায় তাঁদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। বিশেষ করে গলা, ফুসফুস, লিভার, কোলন ও পাকস্থলী ক্যানসারের ঝুঁকি কমে যায় রক্ত দিলে। ক্যানসারের ঝুঁকি কমে ৩৭ শতাংশ!

রক্তদানের সঙ্গে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমানো নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন একদল গবেষক। তাঁরা ২০ বছর ধরে নির্দিষ্ট রক্তদাতাদের অবজার্ভ করেন। এই পরীক্ষায় হৃদ্‌রোগের চেয়েও ক্যানসারের ফলাফল দেখে তাঁরা বেশি বিস্মিত হন। গবেষণায় দেখা যায়, রক্তদাতাদের ক্যানসারের ঝুঁকি ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত নেমে গেছে। আর যাঁদের ক্যানসার হয়েছে, তাঁদের মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম।

এই ফলাফলে বিস্ময় প্রকাশ করে ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট জার্নাল। এক রিপোর্টে তারা বলে, ‘রেজাল্টস অলমোস্ট সিম টু বি টু গুড টু বি ট্রু।’ মানে, তাদের কাছে মনে হয়েছে গবেষণার ফলাফল সত্য এবং খুবই ভালো। এ থেকে তারা উপসংহার টানে যে, ছয় মাসের মধ্যে শুধু একবার রক্ত দান করলেই ক্যানসারের ঝুঁকি কমে আসে।

কীভাবে কমে ক্যানসারের ঝুঁকি? রক্তের অন্যতম উপাদান হলো লৌহ বা আয়রন। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত গবেষণায় চমকে উঠছেন যে, রক্তের আয়রন উপাদানের ভারসাম্যের সঙ্গে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি কতটা সরাসরিভাবে সম্পর্কিত। গবেষকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উঠে এসেছে যে, রক্তের আয়রন উপাদান বেশি হলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। যার জন্য গবেষকেরা এ নিয়ে গবেষণাপত্র লিখেছেন যে, ক্যানসার কি তাহলে ফেরোটক্সিক রোগ? ফেরো (Ferro) মানে লৌহবিশিষ্ট, টক্সিক (Toxic) মানে বিষাক্ত।

অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করছেন, আয়রন উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি শরীরে যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তার কারণে ক্যানসার হয় কি না! কারণ আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে রক্ত নেন, তাঁদের শরীরে আয়রন উপাদান বেড়ে যাওয়ার ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমনকি নারীদের, যাঁদের কোনো জটিলতার কারণে যেমন এনডোমেট্রিওসিস মাসিকের সময় ডিম্বাশয়ে (ওভারি) রক্তপাত হয়, তাঁদের ডিম্বাশয়ে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় অনেকাংশে।

নিজ এবং অন্যের জীবন রক্ষার্থে নিয়মিত রক্ত দিন। শুধু ক্যানসারই নয়, রক্তদানের আছে আরও বহুমুখী উপকার। রক্তদানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের মধ্যে অবস্থিত বোনম্যারো নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। দান করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়, আর লোহিত কণিকার ঘাটতি পূরণ হতে সময় লাগে চার থেকে আট সপ্তাহ। আর এই পুরো প্রক্রিয়া আসলে শরীরের সার্বিক সুস্থতা, প্রাণবন্ততা আর কর্মক্ষমতাকেই বাড়িয়ে দেয়। তবে রক্তদানের এই উপকারগুলো আসলে তাঁরাই পাবেন, যাঁরা নিয়মিত রক্ত দান করেন।

ডা. ডালিয়া নাসরীন, জুনিয়র কনসালট্যান্ট, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভা, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত