ভাষা নিয়ে আবেগ ও আত্মজিজ্ঞাসা

মোনায়েম সরকার
Thumbnail image

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে বাঙালি যে গৌরবের সমাচার তৈরি করেছে, তা তুলনাহীন। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি হেঁটেছে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশের মানুষ নবীন রাষ্ট্রকে উন্নত করতে ছিল ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে আস্থায় না নিয়ে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে রাজি না হয়ে এককভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়ে বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে তুলল।

পাকিস্তানের মোহাজের এবং পাঞ্জাবি সিভিল ও মিলিটারি চক্র প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল না। তারা বাঙালিদের সঙ্গে সব সময় অস্ত্রের ভাষায় কথা বলত। তাদের একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে বাঙালি ভিতু জাতি, তাদের ভয়ভীতির মাধ্যমে দমিয়ে রেখে নিরন্তর শোষণ করেই পাকিস্তানের সমৃদ্ধি আনা সম্ভব। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে তারা উপনিবেশ হিসেবেই গণ্য করত।

তখন পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য ছিল পাট। আর এই পাট পূর্ব পাকিস্তানেই চাষ হতো। এই পাট রপ্তানির টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিচালিত হতো। চক্ষুলজ্জা বিসর্জন দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ছিটেফোঁটা বরাদ্দ দেওয়া হতো। এই কাজে তারা এ দেশে কিছু দালাল সৃষ্টি করে তাদের দিয়েই শাসন-শোষণ পরিচালনা করত। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান ছিল একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। দুই প্রদেশের মধ্যে হাজার মাইলের ব্যবধান ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনেক সময় মজা করে বলতেন, ‘আসলে মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাই—এই স্লোগান ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সেতুবন্ধের আর কোনো বন্ধন ছিল না। তবু বাঙালিরা এই পাকিস্তান মেনে নিয়েছিল। এমনকি পাকিস্তান ইস্যুতে গণভোটে পাকিস্তানের পক্ষে এই অংশের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট দিয়েছিল। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে, ভাষার প্রশ্নে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর একগুঁয়ে মনোভাব বাঙালিকে বাধ্য করেছে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তার দিকে ঠেলে দিতে। তারা বুঝতে পারেনি ভাষার প্রশ্নেই কৃত্রিম রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়বে। ফলে ’৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে তারা গুলি চালানোর মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। ভাষার দাবিটি যে বাঙালি জাতির জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকের জীবনদান সমগ্র বাঙালি জাতিকে উদ্বেলিত করে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, যা ইতিহাসে বিরল ঘটনা। আমরা পরবর্তী সময়ে অনেক মৃত্যু দেখেছি; কিন্তু সমগ্র জাতির মধ্যে এমন গণজাগরণ আর দেখা যায়নি। একুশের শহীদদের আত্মদান বাঙালি জাতিকে রাষ্ট্রভাষা, স্বাধীনতা এবং বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। কাজেই এই মৃত্যু গৌরবের ও মর্যাদার।

যে রেসকোর্স ময়দানে বলদর্পী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে বিভেদের বীজ রোপণ করেছিলেন, সেই রেসকোর্স ময়দানেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থেকে যার যা আছে তাই নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই বাংলার আপামর জনগণ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিশাল পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ৯৫ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে সেই রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল।

ভাষার প্রশ্নটি প্রথমে বাঙালি জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত এই গণপরিষদ সদস্য পাকিস্তান গণপরিষদে আলোচনার ভাষা কী হবে—এই বিতর্কে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানি জনগণের ভাষা বাংলাকে পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি জানাতে পরিষদ সদস্যদের আহ্বান জানান। কিন্তু সেদিন তাঁর আহ্বানে তেমন কেউ সাড়া দেননি।

গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই ক্ষীণ কণ্ঠের উচ্চারিত দাবি পরবর্তীকালে সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে কুমিল্লার বাসা থেকে ধরে নিয়ে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে আটক রেখে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছে। আমরা আশা করি যত দিন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সরকারি আদেশে বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পর অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এই উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেওয়া যেতে পারে না। এ আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা সরকারি অফিসগুলোয় কেবল বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এ বিষয়ে কোনো অন্যথা হলে এই বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’

এরপর কয়েক যুগ চলে গেলেও সরকারি অফিসে বাংলা চালু শতভাগ নিশ্চিত হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (১৯৯৬-২০০১) ২১ ফেব্রুয়ারি দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য। তাঁর ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণের ফলেই ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি মাতৃভাষার প্রসার ও উন্নয়নের জন্য দেশে ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসেই এসব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এসব প্রকল্প আবার চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

আমাদের দেশে বর্তমান বাজার অর্থনীতির যুগে সর্বস্তরের মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষা প্রচলনে কিছু সমস্যা দেখা হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলামাধ্যমে লেখাপড়া হলেও উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে বাংলামাধ্যমে পড়ালেখা করার সুযোগ-সুবিধা আশানুরূপ নয়। বিশেষ করে চিকিৎসা, কারিগরি, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে এখনো বাংলামাধ্যমে পড়ালেখা করার যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এ ছাড়া কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এগুলোতে বাংলা ভাষার প্রচলন নেই বললেও বেশি বলা হবে না। যে জন্য দরকার সরকারিভাবে সুসমন্বিত উদ্যোগ। অতীতের সরকারগুলো উদাসীন থাকায় এসব বিষয়ে সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে।  
 ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বাংলা একাডেমি যে ঐতিহ্যবাহী বইমেলার আয়োজন করে থাকে, দিনে দিনে তার প্রসার ঘটছে। এবারও একুশের বইমেলায় ছয় শতাধিক বইয়ের স্টল রয়েছে। মেলায় প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতির বিষয়টি অনুপ্রেরণাদায়ক। তবে যারা মেলায় যায়, তাদের কত অংশ বই কেনে, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। বলা হয়, এখন অনেকেই পাঠবিমুখ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। ছাপা বইয়ের প্রতি নাকি আগ্রহ কমে আসছে। আবার এমন অভিযোগও আছে যে প্রতিবছর বইমেলায় নতুন যত বই বের হয়, তার বেশির ভাগই নিম্নমানের। মানসম্পন্ন বই প্রকাশের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। কেবল সংখ্যায় বাড়লে হবে না, গুণেমানেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার যোগ্য হতে হবে। বর্তমান সময়টা প্রতিযোগিতার। আর প্রতিযোগিতায় কেবল যোগ্যরাই টিকতে পারে।

ফেব্রুয়ারি মাসকে আমরা ভাষার মাস, সাহস, সংগ্রাম ও আত্মোপলব্ধির মাস হিসেবে অভিহিত করে থাকি। কিন্তু স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আজ অনেকের মনে প্রশ্ন: ফেব্রুয়ারির ধারায় আমরা ঠিকঠাক পথ চলছি তো?

রক্ত দিতে শিখেছিলাম বলে আমাদের নেতা বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।’

আমরা নানা ক্ষেত্রে যেমন এগিয়ে যাচ্ছি, তেমনি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের পর যেসব বিষয় অর্জন করেছি, তার কিছু কিছু আমাদের হাতছাড়াও হয়েছে। গণতন্ত্র নিষ্কণ্টক হয়নি। অসাম্প্রদায়িক মনোভাব কমে আসছে। বাড়ছে ধনবৈষম্য। বারবার রক্ত দিয়েও আমরা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথের কাঁটা একেবারে বিনাশ করতে পারিনি। ভাষা আন্দোলনের এত যুগ পরেও বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা কমেছে বৈ বাড়েনি। নানা অজুহাতে সর্বস্তরে বাংলা চালু করা সম্ভব হয়নি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শত্রুদের নিষ্ক্রিয় করা যায়নি। ভিনদেশি শত্রু পরাভূত হলেও স্বদেশের শত্রুরা এখনো তৎপর, সক্রিয়।

ফেব্রুয়ারি মাস এলে শুধু আবেগাপ্লুত না হয়ে আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুবই জরুরি। আবেগমুক্ত হয়ে আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে।

লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত