চিররঞ্জন সরকার
স্বাধীনতার গুরুত্ব কী, সেটা খুব ভালোভাবে জানে ফিলিস্তিনি জনগণ। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা না পাওয়ার কারণে তারা যুগের পর যুগ ধরে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার তো নেই-ই, জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও নেই। ১৯৭১ সালের আগে আমরাও পরাধীন ছিলাম।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের প্রাপ্য অধিকার তো দেয়ইনি, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকেও কেড়ে নিতে চেয়েছে। চাকরিবাকরি, শিল্পকারখানায় সুযোগ-সুবিধা সব ছিল তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য। আমরা ছিলাম চরম বৈষম্য আর বঞ্চনার শিকার। তারা যখন আমাদের রাজনৈতিক অধিকারও পুরোপুরি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, বিরোধ তখনই চরম আকার ধারণ করল—যা রূপ নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। ২৬ মার্চ যার শুরু, ১৬ ডিসেম্বর যার শেষ।
২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। এই দিনই শুরু হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সম্মুখযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস লড়াই করার পর ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ লাভ করি। স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করি না। একটা মামুলি ছুটির দিন হিসেবে কাটিয়ে দিই। যদিও এই দিবসটির মূল্য বাঙালি জাতির কাছে অপরিসীম। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে এই স্বাধীনতা। যদিও স্বাধীনতার লড়াই শেষ হয়ে যায়নি।
আমাদের স্বাধীনতার মূল আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ছিল অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে স্বশাসন; স্বশাসনের মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। যেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠীনির্বিশেষে সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের মানুষের অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কারও প্রতি কোনো রকম বৈষম্য করা হবে না। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের স্বাধীনতার সেই আকাঙ্ক্ষা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ক্ষমতায় যারাই গেছে, তারা গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষুদ্র দল ও গোষ্ঠী স্বার্থে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে। এতে করে দেশের সব মানুষের জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যায়নি।
একশ্রেণির মানুষ ফুলেফেঁপে বড়লোক হয়েছে। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু মানুষেরা চরম বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাদের জমিজমা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের নিরাপত্তা চরম ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। থানা-পুলিশ-আইন-প্রশাসন কোনো কিছুই তাদের পক্ষে ভূমিকা পালন করেনি।
স্বাধীনতার মানেটাও আমাদের দেশের অনেক মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। ‘আমাদের দেশ স্বাধীন, আমরা যা খুশি তা-ই করতে পারি’ এমন মনোভাবের মানুষও সমাজে আছে। যদিও স্বাধীনতা মানে অন্য কিছু। স্বাধীনতা মানে অরাজকতা নয়। স্বাধীনতা মানে শুধু ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ নয়। স্বাধীনতা মানে দেশপ্রেম, দেশকে মারূপে পরিগণিত করা, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার, আমার দেশ।’ স্বাধীনতা মানে এক দিনের ছুটি নয়, নয় পতাকা উত্তোলন, নয় মোড়ে মোড়ে উচ্চ স্বরে মাইক বাজানো। এই মুহূর্তে স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর পেরিয়ে আমরা কি স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছি?
যৌন হয়রানির প্রতিকার না পেয়ে আত্মমর্যাদার জন্য যদি কাউকে আত্মহত্যা করতে হয়, ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকারটা যদি পাওয়া না যায়, অথবা প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারটা যদি কারও দয়াদাক্ষিণ্যের ওপরে নির্ভর করতে থাকে, তবে কি আমরা স্বাধীন?
স্বাধীনতার অর্থ দেশকে একটি সুদৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড় করানো; দেশের মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র ও বসবাসযোগ্য স্থানের চাহিদা পূরণে সক্ষম করে তোলার সঙ্গে কর্মসংস্থান ও বিজ্ঞানবিষয়ক ধ্যানধারণার দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, স্বনির্ভর করে তোলা। স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করা, স্বাধীনতার অর্থ দেশের প্রতি আরও কর্তব্যপরায়ণ হওয়া।
স্বাধীনতার অর্থ এটা নয় যে নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে সিঁড়ি বানিয়ে ক্ষমতা দখল আর সিংহাসনে বসে তার অপব্যবহার করা। স্বাধীনতার মানে এটাও নয় যে বিদেশিশক্তির মুখাপেক্ষী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার ও ক্ষমতায় থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, বাংলাদেশ আজ বৃহত্তর পুঁজিবাদী দেশগুলোর অবাধ বিচরণভূমিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের দেউলিয়া রাজনৈতিক শক্তিই তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে, নিজের শক্তি-সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো শক্ত মেরুদণ্ডসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের আজ বড়ই অভাব।
দেশ উন্নত হচ্ছে—‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’—মেট্রোরেল হয়েছে, নতুন বোয়িং কেনা হয়েছে, মহাশূন্যে স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়েছে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেনের সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে—উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে আমার দেশ। কিন্তু আসল অস্ত্রটি সঠিকভাবে বানানো গেল না। সব জনগণকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া গেল না। দেশের আসল ‘অস্ত্র’ সমৃদ্ধ করায় আমাদের মনোযোগ নেই। শুধু অশিক্ষার আগুনে বাতাস দিলেই দেশ জ্বলে ছারখার হয়ে যাবে। কোনো অস্ত্রই কাজে আসবে না। অশিক্ষার কারণে আরও বেশি করে জন্ম নেবে দেশের মধ্যে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের চাহিদা, যা মেটাতে প্রচুর দাম দিয়ে কেনা অস্ত্র বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার আগেই দেশের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে।
স্বাধীনতার সঠিক অর্থ একমাত্র হতে পারে দেশের জনগণের ন্যূনতম সঠিক শিক্ষাদানের অঙ্গীকারে ব্রত হাওয়া। শিক্ষাই পারে সব পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে। অন্ধকারে আলো জ্বালাতে। দেশের জনগণের সুশিক্ষা বিনা সব স্বাধীনতাই পরাধীনতার শিকলে বাঁধা।
বর্তমানে রাজনৈতিক নেতাদের ন্যূনতম শিক্ষার প্রয়োজন সব থেকে বেশি। তাঁদের জানা বা অনুভব করা উচিত যে ‘দেশের ঊর্ধ্বে রাজনীতি নয়, রাজনীতির ঊর্ধ্বে দেশ’। নির্বাচন যায়, আবার ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু যে মানুষটা একবার দেশের সীমা ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে, সে আর কোনো দিন ফিরে আসে না। প্রতিনিয়ত মাইগ্রেশন হচ্ছে। ব্রেইনড্রেইন হচ্ছে।
দেশে একধরনের বেপরোয়া জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। এরা বেকার। পেশিশক্তি আছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের টার্গেট করছে। তাদের সঙ্গে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল আছে। এরা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে চাঁদাবাজি করে, বনভূমি উজাড় করে, বালু উত্তোলন করে, হাট-বাজার-রাস্তা-সাঁকো, খেয়াঘাট দখল করে, ইজারা নেয়। স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছরে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রথম উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিশুদ্ধকরণের সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতি একটা দায়িত্ববোধের কথা সর্বদা মনে করিয়ে দেওয়া।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবা উচিত—দেশের উন্নতি তখনই সম্ভব যদি সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের সবার উচিত দেশের স্বার্থে ও নিজেদের স্বার্থে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা। সবাই যদি চিন্তা করি রাজনীতি খারাপ, তার ফলস্বরূপ দেশের সব নাগরিকও খারাপ থাকতে বাধ্য। দেশের নাগরিকেরা ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। নিজেদের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে ভালো নেতার দরকার। ভালো ব্যক্তিত্ব বিনা ভালো নেতৃত্বের জন্ম হয় না। পচা পাঁকে বাস করে পঙ্কজ সর্বদা হওয়া যায় না।
তাই প্রথমে উচিত পচা পাঁক সরিয়ে ভালো সরোবর তৈরি করা, তাতে নিশ্চিত পদ্ম ফুটবে। তেমনি দেশের শিক্ষিত নাগরিক সমাজের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিশুদ্ধকরণ করা। নচেৎ দেশের ও দশের উন্নতি সম্ভব নয়। কোনো মানুষই রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়, রাজনীতি দেশের ঊর্ধ্বে নয়। দেশ রাজনীতি বিনা নয়। অতএব সব উন্নতির, সব স্বাধীনতার, সব রাজনীতির সঠিক নেতৃত্বের দরকার, সঠিক নাগরিক দরকার, শিক্ষার দরকার, শ্রদ্ধার দরকার, ত্যাগের দরকার, আদর্শের দরকার, দায়িত্ববোধের দরকার।
রাজনীতিতে যে সুবিধাবাদ, দেশপ্রেমবর্জিত আখের গোছানোর যে প্রবণতা আমাদের দেশে চলছে, এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে অবশ্যই বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো যে সেই পরিবর্তন করবে না তা আমরা স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছরে বুঝে ফেলেছি।
অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত জনগণের অন্ধবিশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক কুসংস্কারকে মূলধন করে ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি কখনোই দেশের কল্যাণ সাধন করতে পারে না—এ সত্য বোঝা এবং বোঝানো এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
প্রয়োজন নতুন চেতনা, নতুন সংগঠন, নতুন কর্মী বাহিনী। অভ্যস্ত স্লোগান, চেনা রাজনীতিকদের বুলি আমাদের কাছে ক্লিশে হয়ে গেছে। এখন বিকল্পের অন্বেষণ করতে হবে। কার্যকর রাজনৈতিক বিকল্পের অন্বেষণ ও বিকল্প সৃষ্টিই হোক এবারের স্বাধীনতা দিবসের প্রধান অঙ্গীকার।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
স্বাধীনতার গুরুত্ব কী, সেটা খুব ভালোভাবে জানে ফিলিস্তিনি জনগণ। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা না পাওয়ার কারণে তারা যুগের পর যুগ ধরে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার তো নেই-ই, জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও নেই। ১৯৭১ সালের আগে আমরাও পরাধীন ছিলাম।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের প্রাপ্য অধিকার তো দেয়ইনি, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকেও কেড়ে নিতে চেয়েছে। চাকরিবাকরি, শিল্পকারখানায় সুযোগ-সুবিধা সব ছিল তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য। আমরা ছিলাম চরম বৈষম্য আর বঞ্চনার শিকার। তারা যখন আমাদের রাজনৈতিক অধিকারও পুরোপুরি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, বিরোধ তখনই চরম আকার ধারণ করল—যা রূপ নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। ২৬ মার্চ যার শুরু, ১৬ ডিসেম্বর যার শেষ।
২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। এই দিনই শুরু হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সম্মুখযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস লড়াই করার পর ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ লাভ করি। স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করি না। একটা মামুলি ছুটির দিন হিসেবে কাটিয়ে দিই। যদিও এই দিবসটির মূল্য বাঙালি জাতির কাছে অপরিসীম। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে এই স্বাধীনতা। যদিও স্বাধীনতার লড়াই শেষ হয়ে যায়নি।
আমাদের স্বাধীনতার মূল আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ছিল অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে স্বশাসন; স্বশাসনের মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। যেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠীনির্বিশেষে সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের মানুষের অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কারও প্রতি কোনো রকম বৈষম্য করা হবে না। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের স্বাধীনতার সেই আকাঙ্ক্ষা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ক্ষমতায় যারাই গেছে, তারা গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষুদ্র দল ও গোষ্ঠী স্বার্থে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে। এতে করে দেশের সব মানুষের জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যায়নি।
একশ্রেণির মানুষ ফুলেফেঁপে বড়লোক হয়েছে। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু মানুষেরা চরম বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাদের জমিজমা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের নিরাপত্তা চরম ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। থানা-পুলিশ-আইন-প্রশাসন কোনো কিছুই তাদের পক্ষে ভূমিকা পালন করেনি।
স্বাধীনতার মানেটাও আমাদের দেশের অনেক মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। ‘আমাদের দেশ স্বাধীন, আমরা যা খুশি তা-ই করতে পারি’ এমন মনোভাবের মানুষও সমাজে আছে। যদিও স্বাধীনতা মানে অন্য কিছু। স্বাধীনতা মানে অরাজকতা নয়। স্বাধীনতা মানে শুধু ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ নয়। স্বাধীনতা মানে দেশপ্রেম, দেশকে মারূপে পরিগণিত করা, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার, আমার দেশ।’ স্বাধীনতা মানে এক দিনের ছুটি নয়, নয় পতাকা উত্তোলন, নয় মোড়ে মোড়ে উচ্চ স্বরে মাইক বাজানো। এই মুহূর্তে স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর পেরিয়ে আমরা কি স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছি?
যৌন হয়রানির প্রতিকার না পেয়ে আত্মমর্যাদার জন্য যদি কাউকে আত্মহত্যা করতে হয়, ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকারটা যদি পাওয়া না যায়, অথবা প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারটা যদি কারও দয়াদাক্ষিণ্যের ওপরে নির্ভর করতে থাকে, তবে কি আমরা স্বাধীন?
স্বাধীনতার অর্থ দেশকে একটি সুদৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড় করানো; দেশের মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র ও বসবাসযোগ্য স্থানের চাহিদা পূরণে সক্ষম করে তোলার সঙ্গে কর্মসংস্থান ও বিজ্ঞানবিষয়ক ধ্যানধারণার দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, স্বনির্ভর করে তোলা। স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করা, স্বাধীনতার অর্থ দেশের প্রতি আরও কর্তব্যপরায়ণ হওয়া।
স্বাধীনতার অর্থ এটা নয় যে নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে সিঁড়ি বানিয়ে ক্ষমতা দখল আর সিংহাসনে বসে তার অপব্যবহার করা। স্বাধীনতার মানে এটাও নয় যে বিদেশিশক্তির মুখাপেক্ষী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার ও ক্ষমতায় থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, বাংলাদেশ আজ বৃহত্তর পুঁজিবাদী দেশগুলোর অবাধ বিচরণভূমিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের দেউলিয়া রাজনৈতিক শক্তিই তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে, নিজের শক্তি-সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো শক্ত মেরুদণ্ডসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের আজ বড়ই অভাব।
দেশ উন্নত হচ্ছে—‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’—মেট্রোরেল হয়েছে, নতুন বোয়িং কেনা হয়েছে, মহাশূন্যে স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়েছে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেনের সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে—উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে আমার দেশ। কিন্তু আসল অস্ত্রটি সঠিকভাবে বানানো গেল না। সব জনগণকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া গেল না। দেশের আসল ‘অস্ত্র’ সমৃদ্ধ করায় আমাদের মনোযোগ নেই। শুধু অশিক্ষার আগুনে বাতাস দিলেই দেশ জ্বলে ছারখার হয়ে যাবে। কোনো অস্ত্রই কাজে আসবে না। অশিক্ষার কারণে আরও বেশি করে জন্ম নেবে দেশের মধ্যে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের চাহিদা, যা মেটাতে প্রচুর দাম দিয়ে কেনা অস্ত্র বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার আগেই দেশের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে।
স্বাধীনতার সঠিক অর্থ একমাত্র হতে পারে দেশের জনগণের ন্যূনতম সঠিক শিক্ষাদানের অঙ্গীকারে ব্রত হাওয়া। শিক্ষাই পারে সব পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে। অন্ধকারে আলো জ্বালাতে। দেশের জনগণের সুশিক্ষা বিনা সব স্বাধীনতাই পরাধীনতার শিকলে বাঁধা।
বর্তমানে রাজনৈতিক নেতাদের ন্যূনতম শিক্ষার প্রয়োজন সব থেকে বেশি। তাঁদের জানা বা অনুভব করা উচিত যে ‘দেশের ঊর্ধ্বে রাজনীতি নয়, রাজনীতির ঊর্ধ্বে দেশ’। নির্বাচন যায়, আবার ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু যে মানুষটা একবার দেশের সীমা ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে, সে আর কোনো দিন ফিরে আসে না। প্রতিনিয়ত মাইগ্রেশন হচ্ছে। ব্রেইনড্রেইন হচ্ছে।
দেশে একধরনের বেপরোয়া জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। এরা বেকার। পেশিশক্তি আছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের টার্গেট করছে। তাদের সঙ্গে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল আছে। এরা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে চাঁদাবাজি করে, বনভূমি উজাড় করে, বালু উত্তোলন করে, হাট-বাজার-রাস্তা-সাঁকো, খেয়াঘাট দখল করে, ইজারা নেয়। স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছরে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রথম উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিশুদ্ধকরণের সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতি একটা দায়িত্ববোধের কথা সর্বদা মনে করিয়ে দেওয়া।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবা উচিত—দেশের উন্নতি তখনই সম্ভব যদি সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। আমাদের সবার উচিত দেশের স্বার্থে ও নিজেদের স্বার্থে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা। সবাই যদি চিন্তা করি রাজনীতি খারাপ, তার ফলস্বরূপ দেশের সব নাগরিকও খারাপ থাকতে বাধ্য। দেশের নাগরিকেরা ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। নিজেদের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে ভালো নেতার দরকার। ভালো ব্যক্তিত্ব বিনা ভালো নেতৃত্বের জন্ম হয় না। পচা পাঁকে বাস করে পঙ্কজ সর্বদা হওয়া যায় না।
তাই প্রথমে উচিত পচা পাঁক সরিয়ে ভালো সরোবর তৈরি করা, তাতে নিশ্চিত পদ্ম ফুটবে। তেমনি দেশের শিক্ষিত নাগরিক সমাজের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিশুদ্ধকরণ করা। নচেৎ দেশের ও দশের উন্নতি সম্ভব নয়। কোনো মানুষই রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়, রাজনীতি দেশের ঊর্ধ্বে নয়। দেশ রাজনীতি বিনা নয়। অতএব সব উন্নতির, সব স্বাধীনতার, সব রাজনীতির সঠিক নেতৃত্বের দরকার, সঠিক নাগরিক দরকার, শিক্ষার দরকার, শ্রদ্ধার দরকার, ত্যাগের দরকার, আদর্শের দরকার, দায়িত্ববোধের দরকার।
রাজনীতিতে যে সুবিধাবাদ, দেশপ্রেমবর্জিত আখের গোছানোর যে প্রবণতা আমাদের দেশে চলছে, এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে অবশ্যই বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো যে সেই পরিবর্তন করবে না তা আমরা স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছরে বুঝে ফেলেছি।
অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত জনগণের অন্ধবিশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক কুসংস্কারকে মূলধন করে ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি কখনোই দেশের কল্যাণ সাধন করতে পারে না—এ সত্য বোঝা এবং বোঝানো এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
প্রয়োজন নতুন চেতনা, নতুন সংগঠন, নতুন কর্মী বাহিনী। অভ্যস্ত স্লোগান, চেনা রাজনীতিকদের বুলি আমাদের কাছে ক্লিশে হয়ে গেছে। এখন বিকল্পের অন্বেষণ করতে হবে। কার্যকর রাজনৈতিক বিকল্পের অন্বেষণ ও বিকল্প সৃষ্টিই হোক এবারের স্বাধীনতা দিবসের প্রধান অঙ্গীকার।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে