১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলিমপ্রধান উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া হয়নি—এমনকি স্বায়ত্তশাসনও দেওয়া হয়নি। পূর্ব বাংলার মানুষের মনে তখন থেকেই ছিল অসন্তোষের বীজ।
২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও অধ্যাপকের উদ্যোগে তমুদ্দিন মজলিশ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে এ প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও আইন-আদালতের ভাষা করার পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালায়। ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামে তাঁরা একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।
অক্টোবর মাসে তমুদ্দিন মজলিশের উদ্যোগে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল হক।
৫ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
ঢাকায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির, অর্থাৎ বিভাগ-পূর্ব আমলের অখণ্ড বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, উর্দুকে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা করা হবে। বৈঠকটি হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউসে। সেখানে উপস্থিত ছাত্র ও শিক্ষকেরা বাংলাকে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ করেন।
৫ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
করাচির শিক্ষা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার এবং আব্দুল হামিদ ঢাকায় এসে জানান, সম্মেলনের উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। আরেকটি খবরে বলা হয়, শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের ভার দেওয়া হয়েছে গণপরিষদের ওপর।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বেলা ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রথম সাধারণ ছাত্র সমাবেশ হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও তমুদ্দিন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাশেম। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, আব্দুর রহমান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ কে এম হাসান ও এস আহমদ।
২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮
পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু এবং ইংরেজির সঙ্গে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার করার দাবি জানান। প্রস্তাবটি নিয়ে গণপরিষদে তুমুল বিতর্ক হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তীব্র ভাষায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আক্রমণ করেন। তিনি এই প্রস্তাবকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্য বলে মত দেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।
২ মার্চ, ১৯৪৮
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও তমুদ্দিন মজলিশের যৌথ উদ্যোগে ফজলুল হক মাঠে কামরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের একটি সভা আহ্বান করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে একটি ব্যাপক ভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। ১১ মার্চ পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান করা হয়।
১১ মার্চ, ১৯৪৮
এ দিন সকাল থেকেই পিকেটিং চলতে থাকে। ইডেন বিল্ডিংয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় গেট, রমনা পোস্ট অফিস, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাক, জেলা আদালত, হাইকোর্ট, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ সবখানেই পিকেটিং চলে। সেক্রেটারিয়েটে পিকেটিংয়ের জন্য ছাত্ররা তোপখানা ও আব্দুল গনি সড়কের উভয় গেটের সামনে উপস্থিত হয়েছিল। আব্দুল গনি রোডে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ। তোপখানা রোডে উপস্থিত ছিলেন কাজী গোলাম মাহমুদ, শওকত আলী, বরকত প্রমুখ। এ দিন পুলিশকে নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় এবং যাঁদের নাম বলা হলো, তাঁদের গ্রেপ্তার করে ওয়াইজঘাটের কোতোয়ালিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। সেদিন আহত হয়েছিলেন ২০০ জন এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ৯০০ ছাত্র। তাঁদের মধ্যে ৬৯ জনকে জেলে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
১৫ মার্চ, ১৯৪৮
পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভার সদস্য বগুড়ার মোহাম্মদ আলী এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের একান্ত সচিব খাজা নজরুল্লাহ সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা কামরুদ্দিন আহম্মদের বাসায় যান। খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ভাষার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে চান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। সাক্ষাতে কী আলোচনা হতে পারে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করেন। নাজিমুদ্দিনের সঙ্গী হয়ে আলোচনার জন্য যান কামরুদ্দীন আহমদ, মো. তোয়াহা, আবুল কাশেম, নঈম উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আজিজ আহমদ, আব্দুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।
অনেক বাদ–প্রতিবাদের পর 8 দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার আগে জেলখানায় বন্দী শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব এবং শওকত আলী প্রমুখকে চুক্তির শর্ত দেখানো হয়। এরপর তাঁরা স্বাক্ষর করেন।
পরে বোঝা যায়, ‘মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে আসবেন’ বলে যে কথা বলা হয়েছিল, সেটা ছিল খাজা নাজিমুদ্দিনের চাতুরী।
২১ মার্চ, ১৯৪৮
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ঢাকায় আসেন ১৯ মার্চ। ২১ মার্চ তাঁকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে তিনি প্রায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে বোঝাতে চান যে এ দেশের শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য রাজনৈতিক অন্তর্ঘাতক এবং তাদের এজেন্টরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, আর কোনো ভাষা নয়।’ ২৪ মার্চ তিনি কার্জন হলেও ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ বলেন। তাতে ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ করেন ছাত্ররা।
ছাত্র নেতারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে যান। সাক্ষাৎকারের সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জিন্নাহর কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
৬ এপ্রিল, ১৯৪৮
পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাঁর চুক্তি লঙ্ঘন করে ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব পেশ করেন। এরপর কিছুদিন ভাষা আন্দোলন স্তিমিত থাকে।
১৯৪৯-১৯৫০
বাংলা হরফ পরিবর্তিত করে আরবি হরফ চালানোর একটি ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। ১৯৫০ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা দপ্তরের উদ্যোগে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় ২০টি কেন্দ্রে আরবি হরফে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু হয় প্রাপ্তবয়স্কদের। প্রত্যেক শিক্ষা কেন্দ্রে ২৫ থেকে ৩৫ জন ছাত্র শিক্ষা গ্রহণ আরম্ভ করেন। (ছবি: সংবাদপত্রে ভাষা আন্দোলন ১৯০) ৪ অক্টোবর, ১৯৫০ ভাষাসংস্কার কমিটির সদস্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আরবি হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন।
৪ অক্টোবর, ১৯৫০
ভাষাসংস্কার কমিটির সদস্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আরবি হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন।
১১ মার্চ, ১৯৫১
রাষ্ট্রভাষা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে খালেক নেওয়াজ খানের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ছাত্র সভা হয়। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল তা এ সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তাই ওই সভাতেই আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ২৫ মার্চ হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসংবলিত একটি স্মারকলিপি মুদ্রণের পর পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যদের কাছে এবং পাকিস্তানের সব পত্রিকায় পাঠানো হয়।
১৬ অক্টোবর, ১৯৫১
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন।
২৭ জানুয়ারি, ১৯৫২
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়।’ এই বক্তৃতার পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেয়ালে পোস্টার লাগাতে থাকে। ৩০ জানুয়ারি প্রতীকী ধর্মঘট আহ্বান করে।
৩০ জানুয়ারি, ১৯৫২
এদিন ছাত্র সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৩১ জানুয়ারি, ১৯৫২
আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদসহ অপরাপর রাজনৈতিক এবং ছাত্রসংগঠন যোগদান করে। বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত এ সভায় কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের পর ছাত্ররা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। এরপর রাজিউল হকের সভাপতিত্বে সেখানে একটি ছাত্র সভা হয়। সভার একটি প্রস্তাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলা পরিষদের পরবর্তী অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা সরকার ঘোষণা করেছিল। সেদিক লক্ষ রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ দিনের জন্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। রেডিওর মাধ্যমে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদের সামনে এক বড় প্রশ্ন এসে হাজির হয়, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না। ৫৪ নবাবপুর রোডে অবস্থিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে। পরিষদের বেশির ভাগ সদস্যই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে কথা বলেন। ১১-৩ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিপক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আব্দুল মতিনের প্রস্তাব ছিল, একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রসভায় দুই পক্ষের যুক্তি তুলে ধরা হবে। ছাত্ররা যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই মেনে নেওয়া হবে। সেভাবেই পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় হাজির হন ছাত্ররা।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
সকাল থেকেই ছাত্ররা জমায়েত হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অসংখ্য পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তৎকালীন কলা ভবনের সামনে মোতায়েন ছিল। সকাল ১০টার দিকে ছাত্রছাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। আগের রাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শামসুল হক ও কাজী গোলাম মাহবুব সমবেত ছাত্রছাত্রীদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বোঝানোর চেষ্টা করেন। উত্তেজিত ছাত্ররা তাঁদের কথা মানেননি। তাঁরা বরং চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। আব্দুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত প্রকাশ করে বলেন, আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে গেলে ১৪৪ ধারা ভাঙতেই হবে। ঘণ্টাখানেক চলার পর সভার সভাপতি গাজীউল হক বক্তব্য দেন। তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। উত্তেজিত ছাত্রছাত্রীরা ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। এরপর ১০ জন করে এক একটি মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয় গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে। প্রথম যে মিছিলটি বের হয় তার নেতৃত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান শেলী।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে মেডিকেল হোস্টেলের দিকে যেতে থাকেন। তার কাছেই ছিল পরিষদ ভবন। লাঠিপেটা, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ চলতে থাকে। বিকেল তিনটার দিকে কোনো রকম সতর্ক না করে গুলি করে পুলিশ। খুলি উড়ে যায় রফিক উদ্দিনের। ২০ নম্বর ব্যারাকের সামনে গুলিতে ঢলে পড়েন আবুল বরকত। গুলি লাগে আবদুল জব্বারের শরীরে। তিনিও শহীদ হন। আবদুস সালাম আহত হন এবং ৭ এপ্রিল তিনি মারা যান।
২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
নিহত চার শহীদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে। সারা ঢাকা ভেঙে পড়ে সেদিন। পুলিশের সঙ্গে ইপিআই এবং সেনাবাহিনীর টহল দিতে থাকে পূর্ব বাংলার রাজধানী। গুলি চলে। নিহত হন সফিউর রহমান, আবদুর আওয়াল, ওহিউল্লাহ এবং সিরাজুদ্দিন নামে চারজন। আরও কেউ কেউ নিহত হয়েছেন বলেও ধারণা করা হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
মেডিকেল ছাত্ররা এদিন শহীদ মিনার গড়ে তোলেন। ১০ ফুট উঁচু এই স্মৃতিস্তম্ভটির নকশা করেন বদরুল আলম। তাঁকে সহযোগিতা করেন সাঈদ হায়দার। ২৬ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণে স্মৃতিস্তম্ভটি গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ এবং ট্রাকে করে ভাঙা শহীদ মিনারটির ইট-বালু-সিমেন্ট সব নিয়ে যায়।
১৯৫৬ সাল
পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। উর্দু ও বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়।
১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯
ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলিমপ্রধান উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া হয়নি—এমনকি স্বায়ত্তশাসনও দেওয়া হয়নি। পূর্ব বাংলার মানুষের মনে তখন থেকেই ছিল অসন্তোষের বীজ।
২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও অধ্যাপকের উদ্যোগে তমুদ্দিন মজলিশ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে এ প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও আইন-আদালতের ভাষা করার পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালায়। ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামে তাঁরা একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।
অক্টোবর মাসে তমুদ্দিন মজলিশের উদ্যোগে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল হক।
৫ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
ঢাকায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির, অর্থাৎ বিভাগ-পূর্ব আমলের অখণ্ড বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, উর্দুকে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা করা হবে। বৈঠকটি হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউসে। সেখানে উপস্থিত ছাত্র ও শিক্ষকেরা বাংলাকে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ করেন।
৫ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
করাচির শিক্ষা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার এবং আব্দুল হামিদ ঢাকায় এসে জানান, সম্মেলনের উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। আরেকটি খবরে বলা হয়, শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের ভার দেওয়া হয়েছে গণপরিষদের ওপর।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বেলা ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রথম সাধারণ ছাত্র সমাবেশ হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও তমুদ্দিন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাশেম। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, আব্দুর রহমান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ কে এম হাসান ও এস আহমদ।
২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮
পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু এবং ইংরেজির সঙ্গে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার করার দাবি জানান। প্রস্তাবটি নিয়ে গণপরিষদে তুমুল বিতর্ক হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তীব্র ভাষায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আক্রমণ করেন। তিনি এই প্রস্তাবকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্য বলে মত দেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।
২ মার্চ, ১৯৪৮
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও তমুদ্দিন মজলিশের যৌথ উদ্যোগে ফজলুল হক মাঠে কামরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের একটি সভা আহ্বান করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে একটি ব্যাপক ভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। ১১ মার্চ পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান করা হয়।
১১ মার্চ, ১৯৪৮
এ দিন সকাল থেকেই পিকেটিং চলতে থাকে। ইডেন বিল্ডিংয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় গেট, রমনা পোস্ট অফিস, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাক, জেলা আদালত, হাইকোর্ট, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ সবখানেই পিকেটিং চলে। সেক্রেটারিয়েটে পিকেটিংয়ের জন্য ছাত্ররা তোপখানা ও আব্দুল গনি সড়কের উভয় গেটের সামনে উপস্থিত হয়েছিল। আব্দুল গনি রোডে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ। তোপখানা রোডে উপস্থিত ছিলেন কাজী গোলাম মাহমুদ, শওকত আলী, বরকত প্রমুখ। এ দিন পুলিশকে নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় এবং যাঁদের নাম বলা হলো, তাঁদের গ্রেপ্তার করে ওয়াইজঘাটের কোতোয়ালিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। সেদিন আহত হয়েছিলেন ২০০ জন এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ৯০০ ছাত্র। তাঁদের মধ্যে ৬৯ জনকে জেলে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
১৫ মার্চ, ১৯৪৮
পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভার সদস্য বগুড়ার মোহাম্মদ আলী এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের একান্ত সচিব খাজা নজরুল্লাহ সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা কামরুদ্দিন আহম্মদের বাসায় যান। খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ভাষার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে চান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। সাক্ষাতে কী আলোচনা হতে পারে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করেন। নাজিমুদ্দিনের সঙ্গী হয়ে আলোচনার জন্য যান কামরুদ্দীন আহমদ, মো. তোয়াহা, আবুল কাশেম, নঈম উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আজিজ আহমদ, আব্দুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।
অনেক বাদ–প্রতিবাদের পর 8 দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার আগে জেলখানায় বন্দী শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব এবং শওকত আলী প্রমুখকে চুক্তির শর্ত দেখানো হয়। এরপর তাঁরা স্বাক্ষর করেন।
পরে বোঝা যায়, ‘মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে আসবেন’ বলে যে কথা বলা হয়েছিল, সেটা ছিল খাজা নাজিমুদ্দিনের চাতুরী।
২১ মার্চ, ১৯৪৮
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ঢাকায় আসেন ১৯ মার্চ। ২১ মার্চ তাঁকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে তিনি প্রায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে বোঝাতে চান যে এ দেশের শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য রাজনৈতিক অন্তর্ঘাতক এবং তাদের এজেন্টরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, আর কোনো ভাষা নয়।’ ২৪ মার্চ তিনি কার্জন হলেও ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ বলেন। তাতে ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ করেন ছাত্ররা।
ছাত্র নেতারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে যান। সাক্ষাৎকারের সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জিন্নাহর কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
৬ এপ্রিল, ১৯৪৮
পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাঁর চুক্তি লঙ্ঘন করে ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব পেশ করেন। এরপর কিছুদিন ভাষা আন্দোলন স্তিমিত থাকে।
১৯৪৯-১৯৫০
বাংলা হরফ পরিবর্তিত করে আরবি হরফ চালানোর একটি ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। ১৯৫০ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা দপ্তরের উদ্যোগে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় ২০টি কেন্দ্রে আরবি হরফে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু হয় প্রাপ্তবয়স্কদের। প্রত্যেক শিক্ষা কেন্দ্রে ২৫ থেকে ৩৫ জন ছাত্র শিক্ষা গ্রহণ আরম্ভ করেন। (ছবি: সংবাদপত্রে ভাষা আন্দোলন ১৯০) ৪ অক্টোবর, ১৯৫০ ভাষাসংস্কার কমিটির সদস্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আরবি হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন।
৪ অক্টোবর, ১৯৫০
ভাষাসংস্কার কমিটির সদস্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আরবি হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন।
১১ মার্চ, ১৯৫১
রাষ্ট্রভাষা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে খালেক নেওয়াজ খানের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ছাত্র সভা হয়। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল তা এ সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তাই ওই সভাতেই আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ২৫ মার্চ হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসংবলিত একটি স্মারকলিপি মুদ্রণের পর পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যদের কাছে এবং পাকিস্তানের সব পত্রিকায় পাঠানো হয়।
১৬ অক্টোবর, ১৯৫১
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন।
২৭ জানুয়ারি, ১৯৫২
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়।’ এই বক্তৃতার পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেয়ালে পোস্টার লাগাতে থাকে। ৩০ জানুয়ারি প্রতীকী ধর্মঘট আহ্বান করে।
৩০ জানুয়ারি, ১৯৫২
এদিন ছাত্র সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৩১ জানুয়ারি, ১৯৫২
আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদসহ অপরাপর রাজনৈতিক এবং ছাত্রসংগঠন যোগদান করে। বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত এ সভায় কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের পর ছাত্ররা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। এরপর রাজিউল হকের সভাপতিত্বে সেখানে একটি ছাত্র সভা হয়। সভার একটি প্রস্তাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলা পরিষদের পরবর্তী অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা সরকার ঘোষণা করেছিল। সেদিক লক্ষ রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ দিনের জন্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। রেডিওর মাধ্যমে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদের সামনে এক বড় প্রশ্ন এসে হাজির হয়, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না। ৫৪ নবাবপুর রোডে অবস্থিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে। পরিষদের বেশির ভাগ সদস্যই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে কথা বলেন। ১১-৩ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার বিপক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আব্দুল মতিনের প্রস্তাব ছিল, একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রসভায় দুই পক্ষের যুক্তি তুলে ধরা হবে। ছাত্ররা যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই মেনে নেওয়া হবে। সেভাবেই পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় হাজির হন ছাত্ররা।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
সকাল থেকেই ছাত্ররা জমায়েত হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অসংখ্য পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তৎকালীন কলা ভবনের সামনে মোতায়েন ছিল। সকাল ১০টার দিকে ছাত্রছাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। আগের রাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শামসুল হক ও কাজী গোলাম মাহবুব সমবেত ছাত্রছাত্রীদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বোঝানোর চেষ্টা করেন। উত্তেজিত ছাত্ররা তাঁদের কথা মানেননি। তাঁরা বরং চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। আব্দুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত প্রকাশ করে বলেন, আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে গেলে ১৪৪ ধারা ভাঙতেই হবে। ঘণ্টাখানেক চলার পর সভার সভাপতি গাজীউল হক বক্তব্য দেন। তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। উত্তেজিত ছাত্রছাত্রীরা ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। এরপর ১০ জন করে এক একটি মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয় গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে। প্রথম যে মিছিলটি বের হয় তার নেতৃত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান শেলী।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে মেডিকেল হোস্টেলের দিকে যেতে থাকেন। তার কাছেই ছিল পরিষদ ভবন। লাঠিপেটা, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ চলতে থাকে। বিকেল তিনটার দিকে কোনো রকম সতর্ক না করে গুলি করে পুলিশ। খুলি উড়ে যায় রফিক উদ্দিনের। ২০ নম্বর ব্যারাকের সামনে গুলিতে ঢলে পড়েন আবুল বরকত। গুলি লাগে আবদুল জব্বারের শরীরে। তিনিও শহীদ হন। আবদুস সালাম আহত হন এবং ৭ এপ্রিল তিনি মারা যান।
২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
নিহত চার শহীদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে। সারা ঢাকা ভেঙে পড়ে সেদিন। পুলিশের সঙ্গে ইপিআই এবং সেনাবাহিনীর টহল দিতে থাকে পূর্ব বাংলার রাজধানী। গুলি চলে। নিহত হন সফিউর রহমান, আবদুর আওয়াল, ওহিউল্লাহ এবং সিরাজুদ্দিন নামে চারজন। আরও কেউ কেউ নিহত হয়েছেন বলেও ধারণা করা হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
মেডিকেল ছাত্ররা এদিন শহীদ মিনার গড়ে তোলেন। ১০ ফুট উঁচু এই স্মৃতিস্তম্ভটির নকশা করেন বদরুল আলম। তাঁকে সহযোগিতা করেন সাঈদ হায়দার। ২৬ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণে স্মৃতিস্তম্ভটি গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ এবং ট্রাকে করে ভাঙা শহীদ মিনারটির ইট-বালু-সিমেন্ট সব নিয়ে যায়।
১৯৫৬ সাল
পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। উর্দু ও বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়।
১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯
ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে