মামুনুর রশীদ
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। প্রতিবছর এভাবেই একটা দিন আসে, ‘আদিবাসী দিবস’। এই দিবসে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা শহীদ মিনারে একত্র হয়। দেশের রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, আইনজীবীরা একত্র হয়ে তাদের পক্ষে একটা জোর আওয়াজ তোলেন। কিন্তু এই আওয়াজ সারা বছরে নানান নিষ্ফলতা বয়ে আনে। শতবর্ষের ভূমি জটিলতা শেষ হয় না, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন হয় না, পাহাড় ও সমতলের পর্বতসমান সমস্যা থেকেই যায়।
আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর একটি পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। যদিও এই সব চুক্তি পৃথিবীর কোথাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, তবু আমাদের মনে একটা আশার আলো জাগিয়েছিল যে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে, সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা তাদের ভূমির অধিকার ফিরে পাবে এবং মধুপুরসহ বিভিন্ন বন এলাকায় আদিবাসীদের ওপর বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলার নিষ্পত্তি হবে। কিন্তু যতই দিন গেল, বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হলো না; বরং বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হলো। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সবচেয়ে বড় সংকট হলো ভূমির ওপর তাদের অধিকার এবং শত শত বর্ষের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ওপর শান্তিতে বেঁচে থাকা। কিন্তু তার বদলে উত্তরবঙ্গের তরুণ কৃষকনেতা ভূমিদস্যুদের আক্রমণে নিহত হন, গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালরা নিষ্ঠুরভাবে উচ্ছেদের শিকার হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি দিন দিন বাড়তেই থাকে।
বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পার্বত্য চুক্তিকে সর্বতোভাবে অস্বীকার করে একটা উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। খাসিয়া অঞ্চলে তাদের জীবিকার ওপর নির্মমতা শুরু হয়। সেই সঙ্গে মধুপুরে চলেশ রিছিল এক-এগারোর পর সেনাবাহিনীর দ্বারা নিহত হন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে যে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান এবং সংখ্যালঘু নিপীড়নের কথা বলা হচ্ছে, তা অত্যন্ত সরলভাবে বলা যায়, এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা ও সংখ্যালঘু কোনো বিষয় নয়, এটা চিরন্তন দুর্বলের প্রতি সবলের নিপীড়ন এবং সম্পদ বৃদ্ধি। একটা লুটেরা শ্রেণি সেই চল্লিশের দশক থেকেই এই সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তারা রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে এই লুণ্ঠন কাজ করে চলেছে।
পাকিস্তান আমলে পাঞ্জাবি চক্র এক দুঃশাসনের রচনা করেছিল। সেই দুঃশাসনের একটা জলজ্যান্ত ফলাফল আমরা দেখেছি কাপ্তাই হ্রদ। কাপ্তাইয়ের পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করার এক রাতে হাজার হাজার পার্বত্য অধিবাসীকে জলমগ্ন করা হলো। চাকমা রাজার বাড়িটিও গভীর পানিতে ডুবে গেল। ফসল, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি সব তলিয়ে গেল অতল জলে। পাকিস্তান সরকার এসব কোনো কিছু তোয়াক্কা করল না। মানবসন্তানদের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র মানবিকবোধ জাগ্রত হয়নি। আজও কাপ্তাই হ্রদের পানিতে হাজার হাজার পার্বত্য অধিবাসীর অশ্রু মিশে আছে। বিনিময়ে বর্তমানে কতটুকু জলবিদ্যুৎ সেখানে উৎপাদিত হচ্ছে তা-ও বিবেচনার বিষয়। কোনো মানবিকবোধ জাগ্রত না হলেও পাকিস্তানিরা ভারতের বিদ্রোহীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব সংকটের আশু সমাধান হবে বলে সবাই প্রত্যাশা করেছিল, কিন্তু তা হয়নি। যে আশার আলো জ্বলে উঠেছিল পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে, তা-ও দিনে দিনে নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা যেহেতু প্রকৃতির সন্তান, ধরিত্রী তাদের মা, তাই অখণ্ড পৃথিবীতে তাদের বাস করা ও ভূমিকে লালনপালন করে বাসযোগ্য করার সাংস্কৃতিকভাবে একটা দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সেখানে রাষ্ট্রের ভূমি আইন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কথা নয়। ভূমির ওপর কাস্টমারি ল্যান্ড রাইটই যথেষ্ট। আর এই ভূমির অধিকার আইএলও কনভেনশনে ১০৭ ধারায় স্বীকৃত। বাংলাদেশ এই আইএলও কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ।
এ কথা আমরা অনেকেই জানি, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা এ দেশের অনেক অনাবাদি জমি, বন, জঙ্গল এসবকে বাসযোগ্য করে তুলেছে, উর্বর করে তুলেছে। দেশে খাদ্য উৎপাদনে তারা একটা বড় ভূমিকাও পালন করছে। সেই স্বীকৃতি তাদের ভাগ্যে জুটল না। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের যে ভূমিকা, সেটা কোথাও তেমনভাবে উচ্চারিত হয় না। আমাদের ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের সংখ্যা কয়েক লাখ। কিন্তু অবদান সেই তুলনায় অনেক বেশি। আমরা অনেক কিছু তাদের কাছ থেকে শিখতে পারতাম। যেহেতু তারা যুগযুগান্তর ধরে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, নানান ধরনের উৎপাদনের দক্ষতাও তাদের আছে। বয়নশিল্প, পশুপালন এবং নানা ধরনের সনাতন চিকিৎসাপদ্ধতিও তারা জানে। এ ছাড়া তাদের সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির প্রতি তাদের সহমর্মিতা—এসবও আমাদের শিক্ষণীয় বিষয়। তাদের ব্যক্তিগত জীবনাচরণ খুবই সারল্যের, স্নিগ্ধতায় এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধায় নিয়ত মনোমুগ্ধকর। দেশে তাদের জন্য আমরা একটি শিক্ষাব্যবস্থা করতে পারিনি বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। অবশ্য এখন এসবকে অতিক্রম করে তারা উচ্চশিক্ষায় নানা রকম কৃতির স্বাক্ষর রেখেছে।
আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিশ্রুতি দেয় যে পৃথিবীর প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষ তাদের মাতৃভাষার অধিকার পাবে। সেই উদ্দেশ্যে যে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, আমাদের রাষ্ট্র তা নেয়নি। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা সব সময় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। শুধু চিন্তিতই নয়, তারা এক অনিশ্চয়তার মাঝে বসবাস করে। এই অনিশ্চয়তায় কোনো মানুষই তার জীবন ও ভবিষ্যৎ সঠিকভাবে রচনা করতে পারে না। তার ওপর বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীদের ভূমি দখল করার জন্য নানা ধরনের দাঙ্গা বাধানো হয়। এই দাঙ্গার পরেও তারা কোথাও সুবিচার পায় না। তাদের প্রাণহানি হয়, দিনের পর দিন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে। রোদ-বৃষ্টি-শীতে তারা মানবেতর জীবন যাপন করে। তবু কি মায়া-মমতায় তাদের আবাসভূমিকে ফুল, ফল ও পরিচ্ছন্নতা দিয়ে ভরিয়ে রাখে। এসব আমাদের শেখার কথা ছিল। শেখার কথা ছিল, কী করে শত শত বছর ধরে শত অত্যাচার-নিপীড়নের পরেও নিজেদের সংস্কৃতিকে তারা ধরে রেখেছে।
আজ যখন আমাদের বয়স্ক লোকেরা উপেক্ষিত হন, পিতৃপ্রতিম শিক্ষককে হত্যা করা হয়, অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়, তখন আমরা সম্মানিত ব্যক্তির প্রতি আচরণটা কী হবে, তা কিন্তু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কাছ থেকেই জানতে পারি। আজ যখন আমাদের সংস্কৃতি বিদেশি সংস্কৃতির সামনে গড্ডলিকাপ্রবাহে ভেসে যাচ্ছে, তখন তাদের কাছ থেকে জানতে পারতাম তারা কী করে তাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করছে। বাঙালি সংস্কৃতিরও একটা শক্তিশালী ধারা আছে, সেই ধারা বয়স্কদের সম্মান করতে শেখায়, জ্ঞানের কাছে মাথা নত করতে শেখায়, পরিচ্ছন্ন ও সরল জীবন যাপন করতে শেখায়। আমাদের শিল্প-সাহিত্যের যাঁরা গুরু, যাঁরা সামাজিকভাবে শত শত বছর ধরে একটা পরম্পরা সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের শিক্ষা আমরা কাজে লাগিয়ে এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সঙ্গে একটা ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতাম। কিন্তু দুরাচার আমাদের তা করতে দেয়নি। দুরাচারদের লুণ্ঠনপ্রবণতা, একে অপরের প্রতি অশ্রদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি অবহেলা ও শোষণ, একটা উদ্দেশ্যহীন ও উচ্ছৃঙ্খল সমাজের দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে।
আমরা এখনো মাতৃত্বের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা মাতৃতান্ত্রিক। যদিও সবাই নয়। তবু এই মাতৃতান্ত্রিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারতাম, কীভাবে মায়েরা সমাজের নেতৃত্ব দেন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মায়েরা শুধু সম্পত্তির মালিক নন, সম্পদের রক্ষক ও সুষম বণ্টনের নিশ্চয়তা দেন। তাতে সমাজে কলহ কমে যায়, প্রত্যেকের সঙ্গে একটা জোটবদ্ধতা ও আবেগের সৃষ্টি হয়। এই আবেগ অত্যন্ত গভীর এবং উৎপাদনশীল, উৎপাদনের কাজে তারা তা ব্যবহার করে।
বর্ষ পরিক্রমায় ৯ আগস্ট আবার এসেছিল ‘আদিবাসী দিবস-২০২২’। আবারও দিন যাবে, মাস যাবে, বছর যাবে, আবারও আসবে এই দিবস। একটি বছরের সঙ্গে আরেকটি বছরের পার্থক্য ৩৬৫ দিনের। এই ৩৬৫ দিনের পরিক্রমায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জীবনে যদি কোনো নতুন স্বপ্ন তৈরি না হয়, তাহলে এই দিবস অর্থহীন। জাতিসংঘের অন্য দিবসগুলোর মতোই দিবস আসবে, দিবস যাবে।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। প্রতিবছর এভাবেই একটা দিন আসে, ‘আদিবাসী দিবস’। এই দিবসে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা শহীদ মিনারে একত্র হয়। দেশের রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, আইনজীবীরা একত্র হয়ে তাদের পক্ষে একটা জোর আওয়াজ তোলেন। কিন্তু এই আওয়াজ সারা বছরে নানান নিষ্ফলতা বয়ে আনে। শতবর্ষের ভূমি জটিলতা শেষ হয় না, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন হয় না, পাহাড় ও সমতলের পর্বতসমান সমস্যা থেকেই যায়।
আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর একটি পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। যদিও এই সব চুক্তি পৃথিবীর কোথাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, তবু আমাদের মনে একটা আশার আলো জাগিয়েছিল যে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে, সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা তাদের ভূমির অধিকার ফিরে পাবে এবং মধুপুরসহ বিভিন্ন বন এলাকায় আদিবাসীদের ওপর বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলার নিষ্পত্তি হবে। কিন্তু যতই দিন গেল, বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হলো না; বরং বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হলো। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সবচেয়ে বড় সংকট হলো ভূমির ওপর তাদের অধিকার এবং শত শত বর্ষের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ওপর শান্তিতে বেঁচে থাকা। কিন্তু তার বদলে উত্তরবঙ্গের তরুণ কৃষকনেতা ভূমিদস্যুদের আক্রমণে নিহত হন, গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালরা নিষ্ঠুরভাবে উচ্ছেদের শিকার হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি দিন দিন বাড়তেই থাকে।
বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পার্বত্য চুক্তিকে সর্বতোভাবে অস্বীকার করে একটা উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। খাসিয়া অঞ্চলে তাদের জীবিকার ওপর নির্মমতা শুরু হয়। সেই সঙ্গে মধুপুরে চলেশ রিছিল এক-এগারোর পর সেনাবাহিনীর দ্বারা নিহত হন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে যে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান এবং সংখ্যালঘু নিপীড়নের কথা বলা হচ্ছে, তা অত্যন্ত সরলভাবে বলা যায়, এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা ও সংখ্যালঘু কোনো বিষয় নয়, এটা চিরন্তন দুর্বলের প্রতি সবলের নিপীড়ন এবং সম্পদ বৃদ্ধি। একটা লুটেরা শ্রেণি সেই চল্লিশের দশক থেকেই এই সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তারা রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে এই লুণ্ঠন কাজ করে চলেছে।
পাকিস্তান আমলে পাঞ্জাবি চক্র এক দুঃশাসনের রচনা করেছিল। সেই দুঃশাসনের একটা জলজ্যান্ত ফলাফল আমরা দেখেছি কাপ্তাই হ্রদ। কাপ্তাইয়ের পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করার এক রাতে হাজার হাজার পার্বত্য অধিবাসীকে জলমগ্ন করা হলো। চাকমা রাজার বাড়িটিও গভীর পানিতে ডুবে গেল। ফসল, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি সব তলিয়ে গেল অতল জলে। পাকিস্তান সরকার এসব কোনো কিছু তোয়াক্কা করল না। মানবসন্তানদের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র মানবিকবোধ জাগ্রত হয়নি। আজও কাপ্তাই হ্রদের পানিতে হাজার হাজার পার্বত্য অধিবাসীর অশ্রু মিশে আছে। বিনিময়ে বর্তমানে কতটুকু জলবিদ্যুৎ সেখানে উৎপাদিত হচ্ছে তা-ও বিবেচনার বিষয়। কোনো মানবিকবোধ জাগ্রত না হলেও পাকিস্তানিরা ভারতের বিদ্রোহীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব সংকটের আশু সমাধান হবে বলে সবাই প্রত্যাশা করেছিল, কিন্তু তা হয়নি। যে আশার আলো জ্বলে উঠেছিল পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে, তা-ও দিনে দিনে নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা যেহেতু প্রকৃতির সন্তান, ধরিত্রী তাদের মা, তাই অখণ্ড পৃথিবীতে তাদের বাস করা ও ভূমিকে লালনপালন করে বাসযোগ্য করার সাংস্কৃতিকভাবে একটা দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সেখানে রাষ্ট্রের ভূমি আইন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কথা নয়। ভূমির ওপর কাস্টমারি ল্যান্ড রাইটই যথেষ্ট। আর এই ভূমির অধিকার আইএলও কনভেনশনে ১০৭ ধারায় স্বীকৃত। বাংলাদেশ এই আইএলও কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ।
এ কথা আমরা অনেকেই জানি, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা এ দেশের অনেক অনাবাদি জমি, বন, জঙ্গল এসবকে বাসযোগ্য করে তুলেছে, উর্বর করে তুলেছে। দেশে খাদ্য উৎপাদনে তারা একটা বড় ভূমিকাও পালন করছে। সেই স্বীকৃতি তাদের ভাগ্যে জুটল না। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের যে ভূমিকা, সেটা কোথাও তেমনভাবে উচ্চারিত হয় না। আমাদের ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের সংখ্যা কয়েক লাখ। কিন্তু অবদান সেই তুলনায় অনেক বেশি। আমরা অনেক কিছু তাদের কাছ থেকে শিখতে পারতাম। যেহেতু তারা যুগযুগান্তর ধরে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, নানান ধরনের উৎপাদনের দক্ষতাও তাদের আছে। বয়নশিল্প, পশুপালন এবং নানা ধরনের সনাতন চিকিৎসাপদ্ধতিও তারা জানে। এ ছাড়া তাদের সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির প্রতি তাদের সহমর্মিতা—এসবও আমাদের শিক্ষণীয় বিষয়। তাদের ব্যক্তিগত জীবনাচরণ খুবই সারল্যের, স্নিগ্ধতায় এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধায় নিয়ত মনোমুগ্ধকর। দেশে তাদের জন্য আমরা একটি শিক্ষাব্যবস্থা করতে পারিনি বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। অবশ্য এখন এসবকে অতিক্রম করে তারা উচ্চশিক্ষায় নানা রকম কৃতির স্বাক্ষর রেখেছে।
আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিশ্রুতি দেয় যে পৃথিবীর প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষ তাদের মাতৃভাষার অধিকার পাবে। সেই উদ্দেশ্যে যে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, আমাদের রাষ্ট্র তা নেয়নি। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা সব সময় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। শুধু চিন্তিতই নয়, তারা এক অনিশ্চয়তার মাঝে বসবাস করে। এই অনিশ্চয়তায় কোনো মানুষই তার জীবন ও ভবিষ্যৎ সঠিকভাবে রচনা করতে পারে না। তার ওপর বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীদের ভূমি দখল করার জন্য নানা ধরনের দাঙ্গা বাধানো হয়। এই দাঙ্গার পরেও তারা কোথাও সুবিচার পায় না। তাদের প্রাণহানি হয়, দিনের পর দিন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে। রোদ-বৃষ্টি-শীতে তারা মানবেতর জীবন যাপন করে। তবু কি মায়া-মমতায় তাদের আবাসভূমিকে ফুল, ফল ও পরিচ্ছন্নতা দিয়ে ভরিয়ে রাখে। এসব আমাদের শেখার কথা ছিল। শেখার কথা ছিল, কী করে শত শত বছর ধরে শত অত্যাচার-নিপীড়নের পরেও নিজেদের সংস্কৃতিকে তারা ধরে রেখেছে।
আজ যখন আমাদের বয়স্ক লোকেরা উপেক্ষিত হন, পিতৃপ্রতিম শিক্ষককে হত্যা করা হয়, অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়, তখন আমরা সম্মানিত ব্যক্তির প্রতি আচরণটা কী হবে, তা কিন্তু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কাছ থেকেই জানতে পারি। আজ যখন আমাদের সংস্কৃতি বিদেশি সংস্কৃতির সামনে গড্ডলিকাপ্রবাহে ভেসে যাচ্ছে, তখন তাদের কাছ থেকে জানতে পারতাম তারা কী করে তাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করছে। বাঙালি সংস্কৃতিরও একটা শক্তিশালী ধারা আছে, সেই ধারা বয়স্কদের সম্মান করতে শেখায়, জ্ঞানের কাছে মাথা নত করতে শেখায়, পরিচ্ছন্ন ও সরল জীবন যাপন করতে শেখায়। আমাদের শিল্প-সাহিত্যের যাঁরা গুরু, যাঁরা সামাজিকভাবে শত শত বছর ধরে একটা পরম্পরা সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের শিক্ষা আমরা কাজে লাগিয়ে এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সঙ্গে একটা ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতাম। কিন্তু দুরাচার আমাদের তা করতে দেয়নি। দুরাচারদের লুণ্ঠনপ্রবণতা, একে অপরের প্রতি অশ্রদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি অবহেলা ও শোষণ, একটা উদ্দেশ্যহীন ও উচ্ছৃঙ্খল সমাজের দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে।
আমরা এখনো মাতৃত্বের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা মাতৃতান্ত্রিক। যদিও সবাই নয়। তবু এই মাতৃতান্ত্রিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারতাম, কীভাবে মায়েরা সমাজের নেতৃত্ব দেন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মায়েরা শুধু সম্পত্তির মালিক নন, সম্পদের রক্ষক ও সুষম বণ্টনের নিশ্চয়তা দেন। তাতে সমাজে কলহ কমে যায়, প্রত্যেকের সঙ্গে একটা জোটবদ্ধতা ও আবেগের সৃষ্টি হয়। এই আবেগ অত্যন্ত গভীর এবং উৎপাদনশীল, উৎপাদনের কাজে তারা তা ব্যবহার করে।
বর্ষ পরিক্রমায় ৯ আগস্ট আবার এসেছিল ‘আদিবাসী দিবস-২০২২’। আবারও দিন যাবে, মাস যাবে, বছর যাবে, আবারও আসবে এই দিবস। একটি বছরের সঙ্গে আরেকটি বছরের পার্থক্য ৩৬৫ দিনের। এই ৩৬৫ দিনের পরিক্রমায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জীবনে যদি কোনো নতুন স্বপ্ন তৈরি না হয়, তাহলে এই দিবস অর্থহীন। জাতিসংঘের অন্য দিবসগুলোর মতোই দিবস আসবে, দিবস যাবে।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে