নীলাকাশে ঘুড়ির মেলা

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)
আপডেট : ২২ মে ২০২২, ০৯: ০২
Thumbnail image

আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি, তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি। কবি বেগম সুফিয়া কামাল ‘আজিকার শিশু’ কবিতায় সেকাল ও একালের শিশুদের বিনোদনের তুলনামূলক স্মৃতিচারণা করেছেন। তখনকার শিশুরা যখন আকাশে ঘুড়ি ওড়াত, একালের শিশুরা সেই বয়সে আকাশজুড়ে জাহাজ চালায়।

প্রযুক্তির কল্যাণে কয়েক যুগ আগের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ধারা বদলে এসেছে কল্পনাতীত সাফল্য। ব্যস্ত জীবনে সবাই ছুটে চলছে। ভুলে যাচ্ছে শৈশব-কৈশোরের আনন্দ-স্মৃতি, অতীতের ঐতিহ্য। তবে একেবারেই যে সেসব বিলীন হয়ে গেছে তা নয়। একালের শিশু-কিশোররাও যে বাহারি রঙের শত শত ঘুড়িতে আকাশে বসায় রঙিন মেলা, এমন সৌন্দর্য দেখা যায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায়।

হাতে নাটাই, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে বাহারি ঘুড়ি। চারপাশে মিহি সুরের ছন্দ। দল বেঁধে, পরিবার-পরিজন নিয়ে চলছে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী, নালী, সিংজুরী, পয়লা, বালিয়াখোড়া, ঘিওর সদর, বড়টিয়া এলাকার মানুষ মেতে উঠেছেন ঘুড়ি উৎসবে। পাড়া-মহল্লায় এখন কেবলই রংবেরঙের ঘুড়ি উড়ছে নীল আকাশে। শিশু-তরুণ-যুবা এমনকি মাঝবয়সীরাও বাদ যাননি এই ঘুড়ি ওড়ানো থেকে। দিন-রাত আকাশে শোভা পাচ্ছে নানা রঙের ঘুড়ি। বিশেষ করে রাতের আকাশে লাইটিং ঘুড়ির ঝলমলে আলো দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন এলাকার মানুষ।

গত বুধবার বিকেলে উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের জাবরা কালীগঙ্গা নদীর পাড়ে দেখা যায়, অর্ধশতাধিক মানুষ ঘুড়ি খেলায় মেতেছেন। আকাশে চোখ মেললেই ঘুড়ির লড়াইয়ের দৃশ্য। এমনকি এলাকার কিশোরীরাও পরিবারের সঙ্গে মেতে উঠেছে ঘুড়ি উৎসবে। বাতাসে দুলতে দুলতে ভূপাতিত হয়ে যাওয়া ঘুড়ির পেছনে শিশুদের দৌড়ের দৃশ্য সত্যিই মনোরম।

এদিকে উপজেলায় ঘুড়ি বানানোর ধুম পড়েছে। ঘুড়ি বাজারে বিক্রি করে সংসারের আয় বাড়াচ্ছেন কেউ। বর্তমানে চাহিদা বাড়তে থাকায় ২০০ থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে এসব ঘুড়ি। বিক্রি বেড়েছে চিল, কয়রা, ঢোল, পতিঙ্গা, পাখি, পরী, বাজ, ফুল, প্রজাপতি, সাপাসহ রংবেরঙের ঘুড়ির।

মানিকগঞ্জের ঘুড়ির আছে বাহারি নাম। কোনোটার নাম কালাপাহাড়, কোনোটার নাম লালপাহাড়, কোনোটা চুড়িদার, পেটকাটা, চুমকি, পঙ্খিরাজ, আবার কোনোটার নাম প্রজাপতি। আকাশে ওড়ার সময় দেখতে অনেকটা উড়ন্ত চিলের মতো লাগে বলে একে বলা হয় ‘চিল ঘুড়ি’। মাছ বা প্রজাপতির আকারেও ঘুড়ি বানানো হয়। বড় আকৃতির অন্য একটি ঘুড়ির নাম উড়োজাহাজ ঘুড়ি। মানুষের মতো দেখতে মানবঘুড়ি উড়ানো হয় রাতে এবং এর দুই হাতে দুটি মশাল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আর সেই মশালের আলোতে দেখা যায় ঘুড়িটি হেলেদুলে আকাশে উড়ছে।

ঘিওরের রাথুরা গ্রামের বাসিন্দা ঘুড়িপ্রেমী স্কুলছাত্রী লিজা আক্তার বলে, ‘৩০০ টাকা দিয়ে দুটি ঘুড়ি কিনেছি। বিকেলে বাড়ির পাশের চকে বান্ধবীরা মিলে ঘুড়ি উড়িয়ে অনেক মজা পাই।’

বানিয়াজুরীর স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাড়ির পাশের চকে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘রঙিন ঘুড়ি পেয়ে আমার মেয়ে অনেক খুশি। ছোট ছেলেকে ঘুড়ি ওড়ানো শেখাচ্ছি। বেশ ভালো লাগছে।’

বাগ বানিয়াজুরী এলাকার ঘুড়ি বানানোর কারিগর ছৈয়দ আলী বলেন, ‘এখন প্রচুর পরিমাণ ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে। বাঁশ, বেত এবং বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিক ও কাগজের মোড়কে ঘুড়ি বানিয়ে থাকি। আবার কেউ ঘুড়িতে বাতি লাগিয়ে নিয়ে রাতের আকাশে উড়িয়ে থাকেন।’

বায়রা গ্রামের কারিগর কালিপদ কবিরাজ বলেন, ‘আগে ঘুড়ি ওড়ানো হতো বেশি। ঘুড়ি উৎসব হতো। এখন এসব কমে গেছে।’

পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষা কমিটির নেত্রী লক্ষ্মী চ্যাটার্জি এ বিষয়ে বলেন, ‘স্মার্টফোনে বুঁদ হওয়া তরুণ প্রজন্মকে মাঠে ফেরাতে দারুণ কাজ করছে ঘুড়ি। ঘরে বসে শিশুরা কম্পিউটার বা ভিডিও গেম খেলে সময় কাটায়। এসব খেলার ভিড়ে ঘুড়ি ওড়ানো বিলীন হয়েছিল প্রায়। তবে এখনকার চিত্র দেখে মনে হচ্ছে, সেই ঘুড়ি ওড়ানো বিকেলগুলো আবার হয়তো ফিরে আসবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত