হাসান মামুন
রাজধানীর বেইলি রোডে রেস্তোরাঁয় ঠাসা একটি ভবনে আগুন লেগে অনেকে করুণভাবে মারা যাওয়ার পর তদারককারী একাধিক সংস্থা এ ধরনের রেস্তোরাঁয় গিয়ে যে আচরণ করল, সেটাকে কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য বলা যাবে না। ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যে অনেক রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে, সেটা যেন তদারককারীদের জানা ছিল না!
যেন কারও কাছ থেকে কোনো রকম ‘সম্মতি’ না নিয়েই ওগুলো প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিলেন উদ্যোক্তারা। এতে অগ্নি বা অন্য কোনো ঝুঁকি তৈরি হয়ে থাকলে সেটা যেন একান্তই তাঁদের দায়। ওই সব ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য রেস্তোরাঁকর্মীদেরও যেন পাইকারিভাবে গ্রেপ্তার করা যায়। এই করতে করতে ‘স্ট্রিট ফুড’ বিক্রেতাদেরও দাবড়ে তুলে দেওয়া যেতে পারে!
বেইলি রোডের ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর করা এজাহারে পুলিশ কী লিখেছে? লিখেছে, রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ করে’ ভবনটিতে রেস্তোরাঁগুলো চলছিল। এ অবস্থায় বরং স্বাভাবিক ছিল অভিযুক্ত ওই সব কর্মকর্তাকে আগে চিহ্নিত করা। অন্য যেসব সংস্থা ঝুঁকিপূর্ণ ওই ব্যবসায় কার্যত সহায়তা জুগিয়ে গেছে, তাদেরও ক্রমে চিহ্নিত করা। এর বদলে যা করা হলো, তাতে মনে হতে পারে—মূল দায় যাদের, তাদের আড়াল করতেই ওই সব ‘অভিযান’। বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালন করে গেলে হঠাৎ জেগে উঠে এই সব করতে হতো না তাদের। বেইলি রোডের অসহনীয় ঘটনাটিও হয়তো এড়ানো যেত।
মানুষের নিরাপত্তার দাবি উপেক্ষা করে যেনতেনভাবে ব্যবসা পরিচালনাকে কেউ সমর্থন করছে না। এসব রেস্তোরাঁ রাতারাতি গড়ে ওঠেনি, এটাও সত্য। আর এর দায় কেবল বিনিয়োগকারীদের নয়। যেসব ভবনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে এই সব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেগুলোর মালিকের দায়ও এড়ানো যাবে না। ভবনের যে ধরনের ব্যবহার ‘অনুমোদিত’ নয়, কিংবা বিপজ্জনক—বাস্তবে সেটাই হয়ে থাকলে তা মালিকের অসম্মতিতে হওয়ার কথা নয়। তদারককারীদের ‘খুশি করে চলা’র কাজটা প্রকৃতপক্ষে শুরু করেন ভবনমালিকেরাই।
তাঁদের অনেকে শুধু অর্থবিত্তে নয়—রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। ঝুঁকিপূর্ণভাবে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলা মানুষজনও অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। বেইলি রোডের ঘটনাটির পর ধানমন্ডিতে সিলগালা করে দেওয়া একটি ‘রেস্তোরাঁ ভবনে’র ওপর সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায়, কেন এমনতরো ঝুঁকি তৈরি হয়ে থাকে!
রেস্তোরাঁর মালিকদের বড় অংশটা অবশ্য ব্যবসা করতেই এসেছিল। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো একাধিক তরুণ উদ্যোক্তা একত্রে কাজটা করতে চেয়েছেন। হয়তো ব্যাংকঋণও নিয়েছিলেন তাঁরা। অতঃপর দেশের ‘বিদ্যমান অবস্থায়’ তাঁদের প্রায় প্রত্যেককে অনিয়মের সুযোগ নিয়েই ব্যবসাটা গোছাতে হয়েছে।
অনিয়মের শিকারও হতে হয়েছে তাঁদের। রাজধানীর বুকে ব্যবসার একটুখানি জায়গা বের করা কত কঠিন! একগাদা সংস্থার ‘সম্মতি আদায়’ করে, মোটা অঙ্কের অ্যাডভান্স ও ভাড়া গুনে, ডেকোরেশন করে, বাবুর্চি ও কর্মচারী খাটিয়ে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এগিয়ে যাওয়া কঠিন। অনেকেই পেরে ওঠেন না; হাল ছেড়ে দেন। আর পেরে ওঠার জন্য যতটা সম্ভব ব্যয় কমিয়ে চলতে চান তাঁরা। কিন্তু ‘ম্যানেজ করা’ বাবদ ব্যয় তো এড়াতে পারেন না। শেষে অন্য জায়গায় করতে হয় কাটছাঁট। অনেকেই তখন আপস করেন খাবারের মানে; উপেক্ষা করেন ‘স্যানিটেশনের’ দাবি। এমনকি ছাড় দেন নিরাপত্তায়! নিজ কর্মীদের প্রাণের নিরাপত্তার দাবিও কি তাঁরা উপেক্ষা করেন না?
লোকে যাতে নিয়মবিধি মেনে ব্যবসা করে, প্রতিষ্ঠান চালায়; সেটা নিশ্চিত করার জন্যই তো রাজউকসহ একগুচ্ছ সংস্থা রয়েছে। তাদের কাছ থেকে সনদ নিয়ে, সেটা নবায়ন করে তবেই ওই সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর শুধু যে ওইভাবে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলা নিয়ে কথা উঠেছে, তা নয়।
আমাদের মনে পড়ে বছরখানেক আগে রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে গ্যাস বিস্ফোরণে অনেকের নিহত হওয়ার ঘটনা। সেখানেও নকশা অমান্য করে ভবন সম্প্রসারণ এবং অননুমোদিতভাবে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে ঝুঁকি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এর আগে ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ থেকে গ্যাস জমে বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয় মগবাজার এলাকা। সব ঘটনা তো এলপি গ্যাস সিলিন্ডার থেকে নয়। আর সমমানের অনেক দেশ কিন্তু এর ব্যবহার করছে ঝুঁকিমুক্তভাবেই। আমরা বরং দেরিতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার শুরু করেছি।
বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড কীভাবে ঘটেছে এবং কেন সেখানে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তা অবশ্য এখনো অজানা। এর সুষ্ঠু তদন্তে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহায়তা লাগবে, যেটা অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না। সিদ্দিকবাজারের ঘটনায় এখনো চার্জশিট দাখিল হয়নি বলে খবর মিলল। আরও ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল চানখাঁরপুলের নিমতলীতে, সেই ২০১০ সালে।
সেখানে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ থেকে আগুন লেগে যায় রাসায়নিক গুদামে। মারা যায় ১২৪ জন। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পুরান ঢাকার ওই সব এলাকা থেকে রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যাওয়ার। কাজটি এগোয়নি এত বছরেও! এরই মধ্যে একই প্রকৃতির আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। আর এর কোনোটিরই বিচার সম্পন্ন হয়নি আজও। ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে জনজীবনকে নিরাপদ করার কাজেও অগ্রগতি আসেনি।
বেইলি রোডের দুর্ঘটনার প্রকৃতি অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। এর শিকারও হয়েছে মূলত একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষজন। সমাজে এর প্রতিক্রিয়াও হয়েছে বেশি। সে কারণেও হয়তো তদারককারী কর্তৃপক্ষ কিছু অতিতৎপরতা দেখিয়েছে, যা একই সঙ্গে চমক সৃষ্টির নামান্তর। এ ধরনের দুর্ঘটনার পর আসলে প্রয়োজন ছিল তদারককারী সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জরুরি বৈঠক।
কাদের গাফিলতিতে আর কোন সমন্বয়হীনতায় এমনটি ঘটে গেল, তা চিহ্নিত করা। একই ধরনের ঝুঁকি রয়েছে আর যেসব ক্ষেত্রে, সেগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা নেওয়া। আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টসও কিন্তু শুরুতে অনুপযোগী অবকাঠামোয় গড়ে উঠেছিল। চাপের মুখে এমন অনেক কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল ভবনের বাইরের দিকে!
গার্মেন্টসের সঙ্গে রেস্তোরাঁ খাতের তুলনা অবশ্য চলে না। গার্মেন্টস আমাদের অর্থনীতির একটি বড় স্তম্ভ। কত মানুষ কতভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। রেস্তোরাঁ খাতেও একেবারে কম লোক জড়িয়ে নেই। এ অবস্থায় হঠাৎ করে এতে বিপর্যয় নেমে এলে বহু পরিবার ধাক্কা সামলাতে পারবে না। দীর্ঘ করোনাকালে যেসব খাত খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এর মধ্যে কিন্তু রয়েছে রেস্তোরাঁ।
সঙ্গে পর্যটন। তারা অন্যান্য খাতের মতো সরকারি সহায়তা পায়নি বলেও অভিযোগ আছে। তবে এ কথা ঠিক, আগের মতো ছাড় দিয়ে তাদের আর ব্যবসা করতে দেওয়া যাবে না। যারা ‘ছাড় দিয়ে’ ব্যবসাটা ওইভাবে করতে দিয়েছিল, সে ক্ষেত্রে তাদের আগে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের পেছনে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের ‘ব্যয়’ কমিয়ে আনা গেলেও কিন্তু তাদের চেপে ধরা যাবে নিরাপত্তাসহ অন্যান্য ইস্যু অ্যাড্রেস করতে। খাবারের দাম আর মানেও তখন এর কিছুটা প্রভাব পড়ার সুযোগ তৈরি হবে।
বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর আজকের পত্রিকায় রাজশাহী আর খুলনা নগরীতেও একই ধরনের ঝুঁকি তৈরি হওয়ার খবর এসেছে। রাজধানীর অনুসরণে ওই সব নগরীতেও মানুষের বসবাস ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রবণতা লক্ষণীয়। ঝুঁকি বিচার না করে এভাবে চলার পরিণতি কোনো ক্ষেত্রেই ভালো হওয়ার কথা নয়। রাজশাহীর প্রধান সব শপিং সেন্টারই নাকি অগ্নিঝুঁকিতে।
খুলনায়ও বহুতল ভবন গড়ে উঠছে এবং তাতে চলছে অননুমোদিত কর্মকাণ্ড। এ অবস্থায় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে ওই সব নগরীর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। অপরিকল্পিত ও অনিরাপদভাবে গড়ে ওঠা রাজধানীকে অনুসরণের তো কিছু নেই।নগরায়ণের দাবি অবশ্য অগ্রাহ্য করা যাবে না। নগরায়ণ মানে আবার নিয়ন্ত্রণহীন কর্মকাণ্ড নয়। তদারককারী সংস্থাগুলোর সিংহভাগ কর্মচারীর দুর্নীতিমূলক যোগাযোগে এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচার চলতে থাকা নয়।
বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর খোদ রাজধানীর হাসপাতালেও অগ্নিনিরাপত্তার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের ছাদে দেখা গেল অননুমোদিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে রেস্তোরাঁ। আর সরকারি বড় বড় হাসপাতালেও অগ্নিঝুঁকি রয়েছে। রোগীবোঝাই হাসপাতালে আগুন লেগে ছড়িয়ে পড়লে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা সহজেই অনুমেয়। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত সংস্কার অবশ্য কঠিন। সহজ বরং নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম গড়ে তুলে ক্রমে লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগোনো। আমরা তো কমবেশি ভূমিকম্পঝুঁকিতেও আছি।
এসব হাসপাতাল যেন উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পও সামলাতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। ভূমিকম্পে হাসপাতালগুলোও ভেঙে পড়লে কত মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটবে! অন্যান্য স্থানের আহতরাই বা এসে চিকিৎসা নেবে কোথায়? এ অবস্থায় রাজধানীর বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকেও সমন্বিত উদ্যোগে নিয়ে আসতে হবে একপ্রকার নিরাপত্তা বলয়ে—যদিও অগ্নিনিরাপত্তা নিয়েই এ মুহূর্তে বেশি আলোচনা হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
রাজধানীর বেইলি রোডে রেস্তোরাঁয় ঠাসা একটি ভবনে আগুন লেগে অনেকে করুণভাবে মারা যাওয়ার পর তদারককারী একাধিক সংস্থা এ ধরনের রেস্তোরাঁয় গিয়ে যে আচরণ করল, সেটাকে কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য বলা যাবে না। ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যে অনেক রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে, সেটা যেন তদারককারীদের জানা ছিল না!
যেন কারও কাছ থেকে কোনো রকম ‘সম্মতি’ না নিয়েই ওগুলো প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিলেন উদ্যোক্তারা। এতে অগ্নি বা অন্য কোনো ঝুঁকি তৈরি হয়ে থাকলে সেটা যেন একান্তই তাঁদের দায়। ওই সব ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য রেস্তোরাঁকর্মীদেরও যেন পাইকারিভাবে গ্রেপ্তার করা যায়। এই করতে করতে ‘স্ট্রিট ফুড’ বিক্রেতাদেরও দাবড়ে তুলে দেওয়া যেতে পারে!
বেইলি রোডের ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর করা এজাহারে পুলিশ কী লিখেছে? লিখেছে, রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ করে’ ভবনটিতে রেস্তোরাঁগুলো চলছিল। এ অবস্থায় বরং স্বাভাবিক ছিল অভিযুক্ত ওই সব কর্মকর্তাকে আগে চিহ্নিত করা। অন্য যেসব সংস্থা ঝুঁকিপূর্ণ ওই ব্যবসায় কার্যত সহায়তা জুগিয়ে গেছে, তাদেরও ক্রমে চিহ্নিত করা। এর বদলে যা করা হলো, তাতে মনে হতে পারে—মূল দায় যাদের, তাদের আড়াল করতেই ওই সব ‘অভিযান’। বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালন করে গেলে হঠাৎ জেগে উঠে এই সব করতে হতো না তাদের। বেইলি রোডের অসহনীয় ঘটনাটিও হয়তো এড়ানো যেত।
মানুষের নিরাপত্তার দাবি উপেক্ষা করে যেনতেনভাবে ব্যবসা পরিচালনাকে কেউ সমর্থন করছে না। এসব রেস্তোরাঁ রাতারাতি গড়ে ওঠেনি, এটাও সত্য। আর এর দায় কেবল বিনিয়োগকারীদের নয়। যেসব ভবনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে এই সব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেগুলোর মালিকের দায়ও এড়ানো যাবে না। ভবনের যে ধরনের ব্যবহার ‘অনুমোদিত’ নয়, কিংবা বিপজ্জনক—বাস্তবে সেটাই হয়ে থাকলে তা মালিকের অসম্মতিতে হওয়ার কথা নয়। তদারককারীদের ‘খুশি করে চলা’র কাজটা প্রকৃতপক্ষে শুরু করেন ভবনমালিকেরাই।
তাঁদের অনেকে শুধু অর্থবিত্তে নয়—রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। ঝুঁকিপূর্ণভাবে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলা মানুষজনও অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। বেইলি রোডের ঘটনাটির পর ধানমন্ডিতে সিলগালা করে দেওয়া একটি ‘রেস্তোরাঁ ভবনে’র ওপর সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায়, কেন এমনতরো ঝুঁকি তৈরি হয়ে থাকে!
রেস্তোরাঁর মালিকদের বড় অংশটা অবশ্য ব্যবসা করতেই এসেছিল। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো একাধিক তরুণ উদ্যোক্তা একত্রে কাজটা করতে চেয়েছেন। হয়তো ব্যাংকঋণও নিয়েছিলেন তাঁরা। অতঃপর দেশের ‘বিদ্যমান অবস্থায়’ তাঁদের প্রায় প্রত্যেককে অনিয়মের সুযোগ নিয়েই ব্যবসাটা গোছাতে হয়েছে।
অনিয়মের শিকারও হতে হয়েছে তাঁদের। রাজধানীর বুকে ব্যবসার একটুখানি জায়গা বের করা কত কঠিন! একগাদা সংস্থার ‘সম্মতি আদায়’ করে, মোটা অঙ্কের অ্যাডভান্স ও ভাড়া গুনে, ডেকোরেশন করে, বাবুর্চি ও কর্মচারী খাটিয়ে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এগিয়ে যাওয়া কঠিন। অনেকেই পেরে ওঠেন না; হাল ছেড়ে দেন। আর পেরে ওঠার জন্য যতটা সম্ভব ব্যয় কমিয়ে চলতে চান তাঁরা। কিন্তু ‘ম্যানেজ করা’ বাবদ ব্যয় তো এড়াতে পারেন না। শেষে অন্য জায়গায় করতে হয় কাটছাঁট। অনেকেই তখন আপস করেন খাবারের মানে; উপেক্ষা করেন ‘স্যানিটেশনের’ দাবি। এমনকি ছাড় দেন নিরাপত্তায়! নিজ কর্মীদের প্রাণের নিরাপত্তার দাবিও কি তাঁরা উপেক্ষা করেন না?
লোকে যাতে নিয়মবিধি মেনে ব্যবসা করে, প্রতিষ্ঠান চালায়; সেটা নিশ্চিত করার জন্যই তো রাজউকসহ একগুচ্ছ সংস্থা রয়েছে। তাদের কাছ থেকে সনদ নিয়ে, সেটা নবায়ন করে তবেই ওই সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর শুধু যে ওইভাবে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলা নিয়ে কথা উঠেছে, তা নয়।
আমাদের মনে পড়ে বছরখানেক আগে রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে গ্যাস বিস্ফোরণে অনেকের নিহত হওয়ার ঘটনা। সেখানেও নকশা অমান্য করে ভবন সম্প্রসারণ এবং অননুমোদিতভাবে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে ঝুঁকি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এর আগে ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ থেকে গ্যাস জমে বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয় মগবাজার এলাকা। সব ঘটনা তো এলপি গ্যাস সিলিন্ডার থেকে নয়। আর সমমানের অনেক দেশ কিন্তু এর ব্যবহার করছে ঝুঁকিমুক্তভাবেই। আমরা বরং দেরিতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার শুরু করেছি।
বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড কীভাবে ঘটেছে এবং কেন সেখানে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তা অবশ্য এখনো অজানা। এর সুষ্ঠু তদন্তে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহায়তা লাগবে, যেটা অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না। সিদ্দিকবাজারের ঘটনায় এখনো চার্জশিট দাখিল হয়নি বলে খবর মিলল। আরও ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল চানখাঁরপুলের নিমতলীতে, সেই ২০১০ সালে।
সেখানে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ থেকে আগুন লেগে যায় রাসায়নিক গুদামে। মারা যায় ১২৪ জন। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পুরান ঢাকার ওই সব এলাকা থেকে রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যাওয়ার। কাজটি এগোয়নি এত বছরেও! এরই মধ্যে একই প্রকৃতির আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। আর এর কোনোটিরই বিচার সম্পন্ন হয়নি আজও। ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে জনজীবনকে নিরাপদ করার কাজেও অগ্রগতি আসেনি।
বেইলি রোডের দুর্ঘটনার প্রকৃতি অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। এর শিকারও হয়েছে মূলত একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষজন। সমাজে এর প্রতিক্রিয়াও হয়েছে বেশি। সে কারণেও হয়তো তদারককারী কর্তৃপক্ষ কিছু অতিতৎপরতা দেখিয়েছে, যা একই সঙ্গে চমক সৃষ্টির নামান্তর। এ ধরনের দুর্ঘটনার পর আসলে প্রয়োজন ছিল তদারককারী সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জরুরি বৈঠক।
কাদের গাফিলতিতে আর কোন সমন্বয়হীনতায় এমনটি ঘটে গেল, তা চিহ্নিত করা। একই ধরনের ঝুঁকি রয়েছে আর যেসব ক্ষেত্রে, সেগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা নেওয়া। আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টসও কিন্তু শুরুতে অনুপযোগী অবকাঠামোয় গড়ে উঠেছিল। চাপের মুখে এমন অনেক কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল ভবনের বাইরের দিকে!
গার্মেন্টসের সঙ্গে রেস্তোরাঁ খাতের তুলনা অবশ্য চলে না। গার্মেন্টস আমাদের অর্থনীতির একটি বড় স্তম্ভ। কত মানুষ কতভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। রেস্তোরাঁ খাতেও একেবারে কম লোক জড়িয়ে নেই। এ অবস্থায় হঠাৎ করে এতে বিপর্যয় নেমে এলে বহু পরিবার ধাক্কা সামলাতে পারবে না। দীর্ঘ করোনাকালে যেসব খাত খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এর মধ্যে কিন্তু রয়েছে রেস্তোরাঁ।
সঙ্গে পর্যটন। তারা অন্যান্য খাতের মতো সরকারি সহায়তা পায়নি বলেও অভিযোগ আছে। তবে এ কথা ঠিক, আগের মতো ছাড় দিয়ে তাদের আর ব্যবসা করতে দেওয়া যাবে না। যারা ‘ছাড় দিয়ে’ ব্যবসাটা ওইভাবে করতে দিয়েছিল, সে ক্ষেত্রে তাদের আগে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের পেছনে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের ‘ব্যয়’ কমিয়ে আনা গেলেও কিন্তু তাদের চেপে ধরা যাবে নিরাপত্তাসহ অন্যান্য ইস্যু অ্যাড্রেস করতে। খাবারের দাম আর মানেও তখন এর কিছুটা প্রভাব পড়ার সুযোগ তৈরি হবে।
বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর আজকের পত্রিকায় রাজশাহী আর খুলনা নগরীতেও একই ধরনের ঝুঁকি তৈরি হওয়ার খবর এসেছে। রাজধানীর অনুসরণে ওই সব নগরীতেও মানুষের বসবাস ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রবণতা লক্ষণীয়। ঝুঁকি বিচার না করে এভাবে চলার পরিণতি কোনো ক্ষেত্রেই ভালো হওয়ার কথা নয়। রাজশাহীর প্রধান সব শপিং সেন্টারই নাকি অগ্নিঝুঁকিতে।
খুলনায়ও বহুতল ভবন গড়ে উঠছে এবং তাতে চলছে অননুমোদিত কর্মকাণ্ড। এ অবস্থায় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে ওই সব নগরীর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। অপরিকল্পিত ও অনিরাপদভাবে গড়ে ওঠা রাজধানীকে অনুসরণের তো কিছু নেই।নগরায়ণের দাবি অবশ্য অগ্রাহ্য করা যাবে না। নগরায়ণ মানে আবার নিয়ন্ত্রণহীন কর্মকাণ্ড নয়। তদারককারী সংস্থাগুলোর সিংহভাগ কর্মচারীর দুর্নীতিমূলক যোগাযোগে এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচার চলতে থাকা নয়।
বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর খোদ রাজধানীর হাসপাতালেও অগ্নিনিরাপত্তার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের ছাদে দেখা গেল অননুমোদিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে রেস্তোরাঁ। আর সরকারি বড় বড় হাসপাতালেও অগ্নিঝুঁকি রয়েছে। রোগীবোঝাই হাসপাতালে আগুন লেগে ছড়িয়ে পড়লে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা সহজেই অনুমেয়। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত সংস্কার অবশ্য কঠিন। সহজ বরং নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম গড়ে তুলে ক্রমে লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগোনো। আমরা তো কমবেশি ভূমিকম্পঝুঁকিতেও আছি।
এসব হাসপাতাল যেন উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পও সামলাতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। ভূমিকম্পে হাসপাতালগুলোও ভেঙে পড়লে কত মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটবে! অন্যান্য স্থানের আহতরাই বা এসে চিকিৎসা নেবে কোথায়? এ অবস্থায় রাজধানীর বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকেও সমন্বিত উদ্যোগে নিয়ে আসতে হবে একপ্রকার নিরাপত্তা বলয়ে—যদিও অগ্নিনিরাপত্তা নিয়েই এ মুহূর্তে বেশি আলোচনা হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে