নীরব মিনিট

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ১৯
Thumbnail image

১৫ অক্টোবর রোববার সকাল ১০টা থেকে ১০টা ১ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের নির্ধারিত কয়েকটি স্থান শব্দহীন থাকার কথা ছিল। শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানুষকে মুক্ত রাখতে সচেতনতার অংশ হিসেবে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে একটি প্রতীকী কর্মসূচি পালন করে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণাকেন্দ্র।

শব্দসচেতনতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ‘শব্দদূষণ বন্ধ করি, নীরব মিনিট পালন করি’ স্লোগান নিয়ে কর্মসূচিটি পালন করা হয়েছে। সেদিন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ, যাত্রী ও গাড়িচালকদের মধ্যে শব্দসচেতনতামূলক লিফলেট, স্টিকার বিতরণসহ এক মিনিট হর্ন বাজানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।

কিন্তু হায়! এক মিনিটও নীরব রাখা গেল না এই শহরটাকে। প্রকৃতপক্ষে এক মিনিট বড় বিষয় নয়। বিষয়টি হলো, একটি বার্তা সাধারণ জনগণের মাঝে পৌঁছে দেওয়া।বর্তমানে শব্দদূষণ একটি মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা, যা আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করছে। গাড়ির হর্ন শব্দদূষণের জন্য প্রধানত দায়ী থাকলেও, আমাদের আধুনিক জীবনে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শব্দদূষণ সৃষ্টি হচ্ছে। উচ্চমাত্রার শব্দযুক্ত স্থানে দীর্ঘ সময় অবস্থান করার ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং এমনকি কার্ডিওভাসকুলারজনিত সমস্যা।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা (২০০৬) সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এর বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৫-২০১৭ দুই বছর মেয়াদে ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক কর্মসূচি’ বাস্তবায়ন করেছে। কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণ, সভা, সেমিনার, লিফলেট বিতরণ, জেলা অফিসে সাউন্ড লেভেল মিটার প্রদান, সাপ্তাহিক সচেতনতামূলক টিভি অনুষ্ঠান প্রচার এবং জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। সারা দেশে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১১টি স্থানকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২২ সালে ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয়, যার কার্যক্রম এখনো চলমান।

শব্দদূষণ রোধে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে, সেগুলো হলো: শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ বাস্তবায়নে তথ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসক এবং থানা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা; ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অন্তর্ভুক্ত করা; শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ সংশোধন সাপেক্ষে ট্রাফিক পুলিশকে এর প্রয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করা; পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে নিয়মিত সমন্বয় সভা করা; হর্ন বন্ধে যৌথ অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা; আমদানিনীতির আলোকে হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ; ট্রাফিক আইনে হর্ন বাজানোর শাস্তি বৃদ্ধি করা; শব্দের মান মাত্রানুযায়ী যানবাহনের ছাড়পত্র দেওয়া; চালকদের শব্দসচেতনতার স্তর যাচাই সাপেক্ষে লাইসেন্স দেওয়া; বিধিমালা কর্তৃক সংজ্ঞায়িত জোন (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) চিহ্নিত ও গেজেট; নোটিফিকেশন দ্বারা সংশ্লিষ্টদের অবগত করা; জেনারেটরের মানমাত্রা নির্ধারণ করা; শব্দের মানমাত্রা হ্রাসে পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যতীত শিল্প-কারখানা স্থাপনে ছাড়পত্র না দেওয়া; অনুমতি ব্যতীত সভা-সমিতি ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ করা; শব্দ সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিধিমালা সম্পর্কে অবহিত করা; বিধিমালা বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত অংশীজনদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা; পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা; নাগরিক, জনপ্রতিনিধি, পেশাজীবী, প্রশাসনের সমন্বয়ে কমিউনিটিভিত্তিক কমিটি করে শব্দদূষণসংক্রান্ত আইন ভঙ্গের বিষয়ে তদারকির দায়িত্ব দেওয়া; বিধিমালার সংজ্ঞানুযায়ী চিহ্নিত জোনে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট স্থাপন করা; যানবাহনসংক্রান্ত শব্দ হ্রাসে সড়কের পাশে গাছ লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা; গণপরিবহনব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা; শিল্প-কারখানার শব্দ আটকানোর জন্য মালিক কর্তৃক প্রতিবন্ধক তৈরি করা; জেনারেটরের জন্য আচ্ছাদন তৈরি করা এবং ঘেরা দিয়ে নির্মাণকাজের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।

আমরা যারা শব্দদূষণ সৃষ্টি করছি, তারাও এর ক্ষতির শিকার হই। কাজেই সরকার গৃহীত কর্মসূচির পাশাপাশি শব্দদূষণের উৎসগুলো বন্ধ করার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, সরকার কিংবা কোনো একটি সংস্থা কর্তৃক এককভাবে শব্দদূষণের মতো একটি জটিল সামাজিক ব্যাধির সমাধান করা দুরূহ ব্যাপার। তাই সবাই মিলে শব্দদূষণ প্রতিরোধ করতে হলে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ ও ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত