লিবিয়ায় জিম্মি করে বিক্রি হয় কিডনি

ফরিদপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ৩৫
আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ৩৬

ফরিদপুরের উঠতি বয়সী তরুণেরা দালালদের প্রলোভনে পড়ে অবৈধ পথে ইতালিযাত্রা করেই চলেছেন। তবে তাঁদের এই যাত্রায় অধিকাংশ সময়ই পড়তে হয় মাফিয়া চক্রের হাতে। হতে হয় অমানবিক নির্যাতনের শিকার। জিম্মি করে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ, না দিলে নেওয়া হয় কিডনি। উত্তাল ভূমধ্যসাগরে ডুবে প্রাণহানি তো রয়েছেই।

নির্যাতনের শিকার ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, এসব যুবকের মধ্যে কেউ কেউ উন্নত জীবনের আশায়, কেউবা পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে এই পন্থা অবলম্বন করছেন।

ইতালিযাত্রার পথে লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে জিম্মিদশায় নির্যাতনের শিকার হয়ে গত দুই মাসে ফরিদপুরের চারজনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। কারও কারও আবার লাখ লাখ টাকায় মিলেছে মুক্তি। এখনো চক্রের হাতে জিম্মি অনেকে। প্রতিনিয়ত তাঁদের ওপর চলছে অমানবিক নির্যাতন।

সম্প্রতি লিবিয়া মাফিয়া চক্রের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরেছেন ফরিদপুরের সালথা উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের টিটুল মিয়ার ছেলে শাকিল মিয়া (২৪)। ওই চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। তাঁর কাছ থেকেই এসব তথ্য জানা গেছে।

শাকিলের ভাষ্যমতে, ওই চক্রের হোতা কুমিল্লা সদরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের ছেলে শরিফুল হোসেন। তিনি ‘মাফিয়া শরিফ’ নামে পরিচিত। লিবিয়ার ত্রিপোলি বিভাগের জোয়াইন এলাকায় তাঁর রয়েছে ‘গেম ঘর’। যেখানে বন্দী রেখে নির্যাতন এবং মুক্তিপণ আদায় করা হয়। শ্রমিক হিসেবে লিবিয়া গিয়ে ‘মাফিয়া’ বনে যান শরিফ। তাঁর ‘সিন্ডিকেটে’ যুক্ত আছেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ইমন, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বিজয় তালুকদার ও খান নামে পরিচিত এক ব্যক্তি, সিলেটের সোহাগ ও কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ইমন মোল্যা ও মুন্সি মো. কুদরতল্লাহ। এর মধ্যে বিজয় মুক্তিপণের টাকা ওঠানোর দায়িত্বে রয়েছেন। চক্রে ফরিদপুরের সালথা উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের মকবুল ঠাকুর ওরফে মুকুল ঠাকুর, জেলা সদরের চরমাধবদিয়ার নুরু উদ্দিন, রমজান মোল্যা ও শাহীদ হাসান ঝন্টু, ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গারপাড় গ্রামের শেখ মেহেদি, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার মহারাজপুর গ্রামের শাহিন খাঁর ছেলে শাকিল খাঁ ও নগরকান্দা উপজেলার গজারিয়া গ্রামের সালাম কাজীর ছেলে আলামিন কাজী রয়েছেন।
মারা যাওয়া যুবকদের একজন সালথা উপজেলার বল্লভদী ইউনিয়নের চরবল্লভদী গ্রামের কৃষক মো. ইউনুস মুন্সির ছেলে রিয়াজ মুন্সি (২০)। গত ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর লাশ আসে। রিয়াজের চাচাতো ভাই কালাচাঁদ মুন্সি বলেন, ‘মুকসুদপুরের শাকিল খাঁ ও নগরকান্দার আল আমিন কাজীর ফাঁদে পড়ে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে লিবিয়ায় যায় রিয়াজ। তাতে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়। এরপর লিবিয়ায় তাঁকে কয়েক মাস আটকে রেখে চক্রটি আরও ১৫ লাখ টাকা দাবি করে নির্মম নির্যাতন চালাতে থাকে। এতেই রিয়াজের মৃত্যু হয়েছে।’ 

খেতে দেওয়া হতো নোংরা পানি
দালাল চক্রের সদস্য মুকুল ঠাকুরের প্রলোভনে পড়ে গত জানুয়ারিতে লিবিয়ায় পৌঁছান সালথার শাকিল মিয়া। এরপর দীর্ঘ ২ মাস ১৭ দিন অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে মুক্তিপণ দিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।

শাকিল জানান, যাত্রাপথে তাকে দুবাই নিয়ে ২৫ দিন রাখা হয়। সেখান থেকে লিবিয়ার ব্যাঙ্গাচি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন সকালে দুই দিনের যাত্রা শেষে নেওয়া হয় ত্রিপোলি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছোট্ট একটি রুমে প্রায় ৪৫ জনকে রাখা হয়। সেখানে দুই দিন থাকার পর মুকুল ঠাকুরকে ফোন দিয়ে বিষয়গুলো জানালে সেখানেই থাকতে বলে এবং পরিবারের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়ে নেয় চক্রটি। এরপর সেখানে প্রায় এক মাস পর্যন্ত আটকিয়ে রাখে। শাকিল বলেন, ‘ঠিকমতো খাবার দিত না, নোংরা পানি খেতে দিত। ক্ষুধায় কান্না করতাম।’ 

টাকা না দিলে কিডনি বিক্রি
শাকিলের ভাষ্যমতে, ওই গেম ঘরে ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে আটকে রাখা হয়। তাঁর কক্ষে প্রায় ২৫ জনকে আটকিয়ে নির্যাতন করে। কারও বাড়ি থেকে টাকা না দিলে খাবারের সঙ্গে কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করা হতো। এরপর তাঁদের কিডনি নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হতো। 

মুক্তিপণের টাকা নেওয়া হয় মাদারীপুর থেকে
শাকিলের মুক্তিপণের ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় মাদারীপুরের রাজৈর থানার কলাগাছিয়া নামক এলাকার একটি ফাঁকা মাঠ থেকে। টাকা আদায়ের সময় শাকিলের পাশে বসে তাঁর বাবাকে ভিডিও কল দিয়ে নির্দেশনা দেন বিজয়।

শাকিলের বাবা টিটুল মিয়া বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে জমিজমা বিক্রি করে এবং ধারদেনা করে একাই একটি ব্যাগে ভরে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে যাই। প্রথমে আমাকে ভাঙ্গা গোলচত্বরে যেতে বলে। সেখান থেকে ফোন দিয়ে মাদারীপুরের দিকে যেতে বলে। এরপর কলাগাছিয়া কলেজের পাশ দিয়ে ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটতে বলে। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি এক লোক মাঠের মধ্যে খেত কোপাচ্ছে। তাঁর কিছু দূরে বোরকা পরা একজন মহিলাকে দেখা যায়। এ সময় একটি তালগাছের নিচে টাকার ব্যাগ রাখতে বলে এবং তাঁদের নির্দেশনা অনুযায়ী সেখানে টাকা রেখে দ্রুত চলে আসি।’

এই চক্রের সদস্য কুদরত উল্লাহ বলেন, ‘তিনিও মাফিয়াদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। ক্যাম্পে থাকাকালীন শরিফ ও ইমন মোল্যার নেতৃত্বে অন্যদের মারধর করতেন।’ তবে চক্রের অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। 

যা বলছে পুলিশ
ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলন চাকমা (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) বলেন, ‘জেলার বিভিন্ন থানায় মানব পাচারের মামলা হচ্ছে। প্রতি মাসেই কেউ না কেউ অভিযোগ দিচ্ছেন। তবে সংখ্যাটা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। মামলাগুলো তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

ভারতের পাল্টা আক্রমণে দিশেহারা অস্ট্রেলিয়া

ঢাকা কলেজে সংঘর্ষকালে বোমা বিস্ফোরণে ছিটকে পড়েন সেনাসদস্য—ভাইরাল ভিডিওটির প্রকৃত ঘটনা

ঐশ্বরিয়ার বিচ্ছেদের খবরে মুখ খুললেন অমিতাভ

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত