মামুনুর রশীদ
রবার্ট ক্লাইভ ভারতবর্ষে এসেছিলেন ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কেরানি হিসেবে। ভারতবর্ষে এসেই তিনি এক বিশাল রত্নভান্ডারের সন্ধান পান। কলকাতায় এসে সেখান থেকে কাশিমবাজার গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদে গভীর প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলছে। যাঁরা ধনকুবের, যেমন জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ, রায় দুর্লভ তাঁরা নবাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মীর জাফর আলি খাঁও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত আছেন। সেই সঙ্গে আছেন নবাব আলিবর্দীর জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘসেটি বেগম। ক্লাইভ বুঝতে পারলেন এর মধ্য থেকে ব্রিটিশদের অবাধ বাণিজ্যের জন্য প্রধান বাধা হচ্ছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। কিন্তু এই নবাবকে ধনকুবের এবং মন্ত্রিসভার অনেকেই গ্রহণ করছেন না। এই ষড়যন্ত্রে প্রায়ই যোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত নানা যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদ কবজা করে ফেললেন ক্লাইভ।
নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করার পর মুর্শিদাবাদের কোষাগার তাঁর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলেন। ব্যাপক লুণ্ঠন চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ, সোনাদানা লুটপাট করে তিনি ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন। এর মধ্যে কিছু ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা হলেও তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠে। এ অবস্থা থেকে তিনি দিল্লির স্বীকৃতিস্বরূপ সনদটি তাঁর ব্যক্তিগত নামে করিয়ে নেন। কোম্পানির শাসন ভারতবর্ষে বিস্তার লাভ করে। একের পর এক লুণ্ঠন করে ভারতবর্ষকে দরিদ্র করে ফেলে। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের প্রাচুর্য দিন দিন বাড়তেই থাকে। অর্থ, মূল্যবান সোনা, হীরা, জহরত, মণিমুক্তা এসব পাচার করে ইয়র্কশায়ারের ছিঁচকে মাস্তান ক্লাইভ ‘লর্ড’ উপাধিতে ভূষিত হন। সম্পদ পাচারের ক্ষেত্রে তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীকালে এমন শাসনব্যবস্থা চালু হয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে সম্পদ পাচারে একটা বড় সুযোগ তৈরি করে নেয়। এক শ বছরের বেশি সময় ধরে কোম্পানির শাসন চলে। এই শাসনকালে এ দেশের কাঁচামাল লুণ্ঠন করে ইংল্যান্ডে নতুন নতুন কারখানা চালু হয়। ভারতবর্ষের শাসনভার ইংল্যান্ডের সরকার গ্রহণ করলে এই সম্পদ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া নানাভাবে আরও প্রসারিত হয়। এই লুটেরারা ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে দরিদ্র রেখে দেশটাকে ধর্মের নামে দুই ভাগ করে সসম্মানে দেশে ফিরে যায়। বাংলার পূর্বাঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান নাম ধারণ করে নতুন এক উপনিবেশে পরিণত হয়। দারিদ্র্যক্লিষ্ট এই পূর্ব বাংলা নানান আন্দোলন, সংগ্রাম এবং সবশেষে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বিদায় করতে সক্ষম হয়।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ আবারও ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়। ক্লাইভের পথ ধরে কিছু দানব বাংলাদেশের সম্পদকে বিদেশে পাচারের একটা উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে। রাজনৈতিক অনুমোদনে এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এ দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের প্রবাহ অক্ষুণ্নই থেকে গেল। ক্লাইভ বিজিত ভারতবর্ষের সম্পদ নিজ দেশে নিয়ে গিয়েছিল আর ‘নব্য ক্লাইভরা’ নিজের দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করতে থাকে। এই পাচারে প্রথমে আবারও সেই ইংল্যান্ড এবং পরে আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ সমৃদ্ধ হতে থাকে। শুধু সম্পদ নয়, মেধা পাচারেরও একটা সুন্দর অবস্থান তৈরি হয়।
এই পাচারকারীরা নানা দিক থেকে প্রভাবশালী, তাই তাদের টিকির নাগাল পাওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর মধ্যে রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী সবাই একযোগে যুক্ত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রের মানি লন্ডারিংয়ের আইনকানুন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হলো না। ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি—সবটা মিলিয়ে জনগণ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে দিন যাপন করছে। বহু বছর ধরে বিদেশে অর্থ পাচারের ব্যাপারে প্রতিদিনই পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বা কানাডায় কীভাবে বেগমপাড়াগুলো গড়ে উঠেছে, কীভাবে ইংল্যান্ডে বিশাল একটি অভিবাসী দল এই পাচারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, কী প্রক্রিয়ায় সুইস ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ জমা হচ্ছে—এসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। আজকের দিনে ডিজিটাল প্রযুক্তির কিছু কিছু দুর্বলতার কারণে সেগুলো ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। কার কত অর্থ জমা হয়েছে, তারও হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এসবের তেমন কোনো প্রতিকার দেখা যাচ্ছে না।
আজকাল মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা সন্তানসন্ততিদের এ দেশে পড়ালেখা করাতে চায় না। নানা কারণেই দেশটাকে নিরাপদ ভাবে না এবং বাসযোগ্যও মনে করে না। যে শিক্ষিত শ্রেণি ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক—সকল দেশের সেরা’ এ গানটি শুনতে শুনতে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে, দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা প্রদান করে, তারাই ছেলেমেয়েকে ও লেভেল, এ লেভেল পড়িয়ে দ্রুত টাকা পাচার করে বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেয়। এই ভর্তি করা শুধু শিক্ষার জন্য নয়, এমনটি ভাবাও যায় না যে তারা শিক্ষার পাট চুকিয়ে নিজ দেশে ফিরে আসবে। ওই অবৈধ অর্থ দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি কেনারও একটা ব্যবস্থা করে ফেলে। প্রায়ই শোনা যায়, অমুকের এতগুলো বাড়ি, তমুকের খামারবাড়ি, একাধিক ফ্ল্যাট অথবা কারও কারও আরও নানান ধরনের সম্পদ সেখানে কেনা হয়ে গেছে।
এ কথাও সত্যি, ওই সব দেশে অভিবাসন নিয়ে অনেকেই ওখানকার উপার্জিত অর্থে বড় ধরনের সম্পদের অধিকারী হয়েছে এবং সে দেশের সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সম্মান নিয়ে বসবাস করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা ওই সব দেশে উপার্জিত অর্থ দিয়ে স্বদেশে বিভিন্ন জায়গায় টাকা লগ্নি করছে। সেই লগ্নির পরিমাণ অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য দেশের অদক্ষ শ্রমিকদের উপার্জিত অর্থ পাঠানোর চেয়ে অনেক কম। দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারিভাবে যে অর্থ বরাদ্দ আছে তাতে কোনো সম্মানজনক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না; বরং শিক্ষা-বাণিজ্যে বিশাল বিশাল প্রাইভেট স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। সেখানেও একটাই বড় আকাঙ্ক্ষা, কোনো একটি পর্যায়ে তাদের সন্তানদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নিতে হবে।
বিদেশে গিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করা কোনো অন্যায় কাজ নয়। একসময় মেধাবী ছাত্ররা এ দেশ থেকে বিদেশে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসত এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তারা বিদেশের স্কলারশিপে পড়ালেখা করে কিছু উদ্বৃত্ত অর্থও দেশে নিয়ে আসতে পারত। মেধাবী ছাত্রদের ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থা এখনো আছে। কিন্তু এখনকার সময়ে সেই মেধাবী ছাত্ররা আর দেশে ফিরে আসছে না। অবশ্য আমাদের দেশে মেধাকে সহ্য করার ক্ষমতাও অধিকাংশ বাঙালির নেই। যারা মেধাবী নয়, তাদেরও শক্তি এত বেশি যে একজন মেধাবী ও সৎ মানুষ এই সমাজে বিভিন্ন চাপে টিকতে পারে না। আমার জানামতে, দেশের সেবা করার জন্য অনেকেই ফিরে এসেছিল কিন্তু তারা এখানে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি। বেশ কিছুদিন কালক্ষেপণ করে আবার বিদেশে ফিরে গেছে।
ক্লাইভের প্রেতাত্মারা দেশটাকে দুর্নীতির একটা অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। আর এই দুর্নীতির উৎস কোনো উৎপাদনশীল খাত নয়, একেবারে শূন্যের ওপরে নির্ভর। নিয়োগ-বাণিজ্য, তদবির-বাণিজ্য, ঘুষ—এসবেই মুখ্যভাবে দুর্নীতির কাজটা হয়। এই লোকগুলোর মধ্যে বিন্দুমাত্র বিবেক নেই, এরা শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি করে, মরণাপন্ন মানুষকে নিয়ে দুর্নীতি করে, একেবারে অনুপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়ে দুর্নীতি করে। কালক্রমে দুর্নীতিটা এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে কোথাও টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। নিরীহ মানুষদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতির এই টাকাটা দেশে আসারও প্রয়োজন পড়ে না। মোটা কমিশনের টাকা বিদেশের ব্যাংকেই জমা হয়।
দেশে উন্নয়নের সমান্তরালে প্রচুর দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়ে থাকে। এক কিলোমিটার রাস্তা করতে গিয়ে দেশে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তা বিদেশি যেকোনো রাষ্ট্রের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এই উদ্বৃত্ত টাকাটিও কিন্তু ক্লাইভের প্রেতাত্মারা এ দেশে রাখে না। বর্তমানে যেসব সত্যিকারের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষ নিজ অর্থে বাজার করে (অধিকাংশ উচ্চবিত্ত লোকেরা নিজ অর্থে বাজার করে না) ক্ষুন্নি বৃত্তির জন্য, তাদের মধ্যে ইতিমধ্যে হাহাকার উঠে গেছে। কারণ প্রতিদিনই ওই প্রেতাত্মারা জিনিসপাতির দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়েই যাচ্ছে। প্রতিকারহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর এসব নানা স্তরের ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আরও মহান মহান ক্লাইভ গড়ে তুলছে।
প্রসঙ্গত, একটি কথা বলে রাখি। এই শহরে একদা টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত, পরবর্তীকালে টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত ১৭৫৭ সালে। সেই ঢাকা শহরে ১৭৭৪ সালে টাকায় ছয় সের চাল পাওয়া যেত; যা ওই ছিঁচকে মাস্তান ক্লাইভেরই কল্যাণে। সেই সময়ে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় দুর্ভিক্ষে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। ক্লাইভের প্রেতাত্মারা কি দেশটাকে সেই দিকেই নিয়ে যাবে?
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
রবার্ট ক্লাইভ ভারতবর্ষে এসেছিলেন ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কেরানি হিসেবে। ভারতবর্ষে এসেই তিনি এক বিশাল রত্নভান্ডারের সন্ধান পান। কলকাতায় এসে সেখান থেকে কাশিমবাজার গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদে গভীর প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলছে। যাঁরা ধনকুবের, যেমন জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ, রায় দুর্লভ তাঁরা নবাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মীর জাফর আলি খাঁও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত আছেন। সেই সঙ্গে আছেন নবাব আলিবর্দীর জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘসেটি বেগম। ক্লাইভ বুঝতে পারলেন এর মধ্য থেকে ব্রিটিশদের অবাধ বাণিজ্যের জন্য প্রধান বাধা হচ্ছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। কিন্তু এই নবাবকে ধনকুবের এবং মন্ত্রিসভার অনেকেই গ্রহণ করছেন না। এই ষড়যন্ত্রে প্রায়ই যোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত নানা যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদ কবজা করে ফেললেন ক্লাইভ।
নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করার পর মুর্শিদাবাদের কোষাগার তাঁর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলেন। ব্যাপক লুণ্ঠন চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ, সোনাদানা লুটপাট করে তিনি ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন। এর মধ্যে কিছু ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা হলেও তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠে। এ অবস্থা থেকে তিনি দিল্লির স্বীকৃতিস্বরূপ সনদটি তাঁর ব্যক্তিগত নামে করিয়ে নেন। কোম্পানির শাসন ভারতবর্ষে বিস্তার লাভ করে। একের পর এক লুণ্ঠন করে ভারতবর্ষকে দরিদ্র করে ফেলে। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের প্রাচুর্য দিন দিন বাড়তেই থাকে। অর্থ, মূল্যবান সোনা, হীরা, জহরত, মণিমুক্তা এসব পাচার করে ইয়র্কশায়ারের ছিঁচকে মাস্তান ক্লাইভ ‘লর্ড’ উপাধিতে ভূষিত হন। সম্পদ পাচারের ক্ষেত্রে তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীকালে এমন শাসনব্যবস্থা চালু হয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে সম্পদ পাচারে একটা বড় সুযোগ তৈরি করে নেয়। এক শ বছরের বেশি সময় ধরে কোম্পানির শাসন চলে। এই শাসনকালে এ দেশের কাঁচামাল লুণ্ঠন করে ইংল্যান্ডে নতুন নতুন কারখানা চালু হয়। ভারতবর্ষের শাসনভার ইংল্যান্ডের সরকার গ্রহণ করলে এই সম্পদ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া নানাভাবে আরও প্রসারিত হয়। এই লুটেরারা ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে দরিদ্র রেখে দেশটাকে ধর্মের নামে দুই ভাগ করে সসম্মানে দেশে ফিরে যায়। বাংলার পূর্বাঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান নাম ধারণ করে নতুন এক উপনিবেশে পরিণত হয়। দারিদ্র্যক্লিষ্ট এই পূর্ব বাংলা নানান আন্দোলন, সংগ্রাম এবং সবশেষে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বিদায় করতে সক্ষম হয়।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ আবারও ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়। ক্লাইভের পথ ধরে কিছু দানব বাংলাদেশের সম্পদকে বিদেশে পাচারের একটা উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে। রাজনৈতিক অনুমোদনে এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এ দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের প্রবাহ অক্ষুণ্নই থেকে গেল। ক্লাইভ বিজিত ভারতবর্ষের সম্পদ নিজ দেশে নিয়ে গিয়েছিল আর ‘নব্য ক্লাইভরা’ নিজের দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করতে থাকে। এই পাচারে প্রথমে আবারও সেই ইংল্যান্ড এবং পরে আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ সমৃদ্ধ হতে থাকে। শুধু সম্পদ নয়, মেধা পাচারেরও একটা সুন্দর অবস্থান তৈরি হয়।
এই পাচারকারীরা নানা দিক থেকে প্রভাবশালী, তাই তাদের টিকির নাগাল পাওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর মধ্যে রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী সবাই একযোগে যুক্ত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রের মানি লন্ডারিংয়ের আইনকানুন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হলো না। ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি—সবটা মিলিয়ে জনগণ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে দিন যাপন করছে। বহু বছর ধরে বিদেশে অর্থ পাচারের ব্যাপারে প্রতিদিনই পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বা কানাডায় কীভাবে বেগমপাড়াগুলো গড়ে উঠেছে, কীভাবে ইংল্যান্ডে বিশাল একটি অভিবাসী দল এই পাচারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, কী প্রক্রিয়ায় সুইস ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ জমা হচ্ছে—এসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। আজকের দিনে ডিজিটাল প্রযুক্তির কিছু কিছু দুর্বলতার কারণে সেগুলো ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। কার কত অর্থ জমা হয়েছে, তারও হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এসবের তেমন কোনো প্রতিকার দেখা যাচ্ছে না।
আজকাল মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা সন্তানসন্ততিদের এ দেশে পড়ালেখা করাতে চায় না। নানা কারণেই দেশটাকে নিরাপদ ভাবে না এবং বাসযোগ্যও মনে করে না। যে শিক্ষিত শ্রেণি ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক—সকল দেশের সেরা’ এ গানটি শুনতে শুনতে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে, দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা প্রদান করে, তারাই ছেলেমেয়েকে ও লেভেল, এ লেভেল পড়িয়ে দ্রুত টাকা পাচার করে বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেয়। এই ভর্তি করা শুধু শিক্ষার জন্য নয়, এমনটি ভাবাও যায় না যে তারা শিক্ষার পাট চুকিয়ে নিজ দেশে ফিরে আসবে। ওই অবৈধ অর্থ দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি কেনারও একটা ব্যবস্থা করে ফেলে। প্রায়ই শোনা যায়, অমুকের এতগুলো বাড়ি, তমুকের খামারবাড়ি, একাধিক ফ্ল্যাট অথবা কারও কারও আরও নানান ধরনের সম্পদ সেখানে কেনা হয়ে গেছে।
এ কথাও সত্যি, ওই সব দেশে অভিবাসন নিয়ে অনেকেই ওখানকার উপার্জিত অর্থে বড় ধরনের সম্পদের অধিকারী হয়েছে এবং সে দেশের সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সম্মান নিয়ে বসবাস করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা ওই সব দেশে উপার্জিত অর্থ দিয়ে স্বদেশে বিভিন্ন জায়গায় টাকা লগ্নি করছে। সেই লগ্নির পরিমাণ অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য দেশের অদক্ষ শ্রমিকদের উপার্জিত অর্থ পাঠানোর চেয়ে অনেক কম। দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারিভাবে যে অর্থ বরাদ্দ আছে তাতে কোনো সম্মানজনক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না; বরং শিক্ষা-বাণিজ্যে বিশাল বিশাল প্রাইভেট স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। সেখানেও একটাই বড় আকাঙ্ক্ষা, কোনো একটি পর্যায়ে তাদের সন্তানদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নিতে হবে।
বিদেশে গিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করা কোনো অন্যায় কাজ নয়। একসময় মেধাবী ছাত্ররা এ দেশ থেকে বিদেশে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসত এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তারা বিদেশের স্কলারশিপে পড়ালেখা করে কিছু উদ্বৃত্ত অর্থও দেশে নিয়ে আসতে পারত। মেধাবী ছাত্রদের ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থা এখনো আছে। কিন্তু এখনকার সময়ে সেই মেধাবী ছাত্ররা আর দেশে ফিরে আসছে না। অবশ্য আমাদের দেশে মেধাকে সহ্য করার ক্ষমতাও অধিকাংশ বাঙালির নেই। যারা মেধাবী নয়, তাদেরও শক্তি এত বেশি যে একজন মেধাবী ও সৎ মানুষ এই সমাজে বিভিন্ন চাপে টিকতে পারে না। আমার জানামতে, দেশের সেবা করার জন্য অনেকেই ফিরে এসেছিল কিন্তু তারা এখানে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি। বেশ কিছুদিন কালক্ষেপণ করে আবার বিদেশে ফিরে গেছে।
ক্লাইভের প্রেতাত্মারা দেশটাকে দুর্নীতির একটা অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। আর এই দুর্নীতির উৎস কোনো উৎপাদনশীল খাত নয়, একেবারে শূন্যের ওপরে নির্ভর। নিয়োগ-বাণিজ্য, তদবির-বাণিজ্য, ঘুষ—এসবেই মুখ্যভাবে দুর্নীতির কাজটা হয়। এই লোকগুলোর মধ্যে বিন্দুমাত্র বিবেক নেই, এরা শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি করে, মরণাপন্ন মানুষকে নিয়ে দুর্নীতি করে, একেবারে অনুপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়ে দুর্নীতি করে। কালক্রমে দুর্নীতিটা এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে কোথাও টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। নিরীহ মানুষদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতির এই টাকাটা দেশে আসারও প্রয়োজন পড়ে না। মোটা কমিশনের টাকা বিদেশের ব্যাংকেই জমা হয়।
দেশে উন্নয়নের সমান্তরালে প্রচুর দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়ে থাকে। এক কিলোমিটার রাস্তা করতে গিয়ে দেশে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তা বিদেশি যেকোনো রাষ্ট্রের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এই উদ্বৃত্ত টাকাটিও কিন্তু ক্লাইভের প্রেতাত্মারা এ দেশে রাখে না। বর্তমানে যেসব সত্যিকারের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষ নিজ অর্থে বাজার করে (অধিকাংশ উচ্চবিত্ত লোকেরা নিজ অর্থে বাজার করে না) ক্ষুন্নি বৃত্তির জন্য, তাদের মধ্যে ইতিমধ্যে হাহাকার উঠে গেছে। কারণ প্রতিদিনই ওই প্রেতাত্মারা জিনিসপাতির দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়েই যাচ্ছে। প্রতিকারহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর এসব নানা স্তরের ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আরও মহান মহান ক্লাইভ গড়ে তুলছে।
প্রসঙ্গত, একটি কথা বলে রাখি। এই শহরে একদা টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত, পরবর্তীকালে টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত ১৭৫৭ সালে। সেই ঢাকা শহরে ১৭৭৪ সালে টাকায় ছয় সের চাল পাওয়া যেত; যা ওই ছিঁচকে মাস্তান ক্লাইভেরই কল্যাণে। সেই সময়ে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় দুর্ভিক্ষে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। ক্লাইভের প্রেতাত্মারা কি দেশটাকে সেই দিকেই নিয়ে যাবে?
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে