অরুণ কর্মকার
ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত বলে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ছোট-বড় অনেক ভূমিকম্পের সাক্ষ্য বহন করছে। দেশের অভ্যন্তরের ভূ-চ্যুতি (জিওলজিক্যাল ফল্ট) থেকে এখানে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির ইতিহাস আছে। যেমন রিখটার স্কেলে সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প শ্রীমঙ্গলে হয়েছিল। আবার ৩ থেকে সাড়ে ৫ মাত্রার অনেক ছোট ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পও এখানে হয়েছে। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে সৃষ্ট অনেক ভূমিকম্পেও বাংলাদেশ বহুবার কেঁপে উঠেছে।
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। পৃথিবী নামের আমাদের গ্রহটি যে টেকটোনিক প্লেটগুলোর ওপর বসে আছে, সেগুলো অবিরাম সঞ্চরণশীল। এই সঞ্চরণের পথে কখনো কখনো দুটি প্লেটের মধ্যে (প্লেট বাউন্ডারিতে) টক্কর লাগে। তারই ফল হচ্ছে ভূমিকম্প।
টক্কর বা ঘর্ষণের তীব্রতা ও কেন্দ্রস্থলের গভীরতা অনুযায়ী কখনো একটি ছোট এলাকার, কখনো বা কোনো বিশদ অঞ্চলের ভূমি কেঁপে ওঠে। কম্পনের তীব্রতা যত বেশি হয়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তত বাড়ে। বড় ভূমিকম্প হতে হলে বড় ধরনের ভূ-চ্যুতি দরকার হয়। এই সাধারণ ও মৌলিক কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা কতখানি।
দুই. বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হতে পারে দুই কারণে। প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরের বড় কোনো ভূ-চ্যুতি যদি থেকে থাকে। দ্বিতীয়ত, দেশের সীমানার বাইরে ভিন্ন কোনো দেশের কিংবা আন্তদেশীয় কোনো ভূ-চ্যুতিতে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প হলে তার প্রভাবে।
দেশের অভ্যন্তরে এমন কোনো চ্যুতি কি আছে, যেটি কোনো বড় ভূমিকম্পের উৎসস্থল হতে পারে? এ ক্ষেত্রে আমরা সিলেটের শ্রীমঙ্গল এবং মধুপুর চ্যুতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে পারি। দেশের অভ্যন্তরে এই দুটো চ্যুতি বড় ভূমিকম্পের উৎস হওয়ার মতো ছিল। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গল চ্যুতি সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টিও করেছিল শতাধিক বছর আগে। বিজ্ঞানীদের সর্বশেষ গবেষণার ফলাফল বলে, এই চ্যুতিগুলো এখন আর সক্রিয় নয়। ফলে এগুলো আর কোনো বড় ভূমিকম্পের উৎস হতে পারবে না।
দেশের অভ্যন্তরে বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর প্রভৃতি অঞ্চলে আরও কয়েকটি বড় ভূ-চ্যুতির কথাও বিজ্ঞানীরা বলতেন। এখন সেগুলো সবই নিষ্ক্রিয়
এবং বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির সহায়ক নয়। সুতরাং দেশের অভ্যন্তরের কোনো ভূ-চ্যুতি থেকে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির আশঙ্কা নেই বললেই চলে।
দেশের বাইরে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠার মতো ভূ-চ্যুতি ছিল বা রয়েছে প্রতিবেশী ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে, আন্দামান সাগরে এবং মিয়ানমারে। আসাম ও মেঘালয়ের ভূ-চ্যুতিগুলো সুদূর অতীতে ‘গ্রেট বেঙ্গল আর্থকোয়েক’সহ একাধিক বড় ভূমিকম্পের কারণ হয়েছে, যার প্রভাব তখন ঢাকাসহ বাংলাদেশেও পড়েছিল। তবে বাংলাদেশের কোথাও তা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠেনি, কিংবা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞও সৃষ্টি করেনি। মনে রাখা দরকার, এর মধ্যে গ্রেট বেঙ্গল আর্থকোয়েক ছিল রিখটার স্কেলে প্রায় সাড়ে ৮ মাত্রার।
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের বিপজ্জনক চ্যুতিগুলোতে অনেকবারই ভূমিকম্প হয়েছে। তবে তা বাংলাদেশের কোনো এলাকায় বলার মতো কোনো
ধ্বংস সাধন করেনি। ভবিষ্যতে যদি সেখানে ৮ কিংবা এরও বেশি মাত্রার কোনো ভূমিকম্প হয়, তার প্রভাব বাংলাদেশে অবশ্যই পড়বে। তবে তা বাংলাদেশকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে—এমন আশঙ্কা বিজ্ঞানীরা করেন না।
তিন. বাংলাদেশে বড় এবং প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের আশঙ্কা সৃষ্টি হলো কীভাবে? প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরের পুরোনো ও বর্তমানে নিষ্ক্রিয় চ্যুতিগুলো অনেকের মনে ঐতিহাসিকভাবে ওই আশঙ্কার বীজ বুনে রেখেছে। আমাদের দেশে ভূ-চ্যুতির সংখ্যা, অবস্থান ও প্রকৃতির বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত কোনো জরিপ হয়নি। ফলে বিজ্ঞানীরা নিরাপদ অবস্থানে থাকার জন্য বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কাকে নাকচ করে দেন না।
আরেকটি কারণ, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কার ভিত্তি তৈরি করতে পারলে যেকোনো ধরনের নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। তাতে প্রকল্পগুলোর পরামর্শক, স্থপতি, প্রকৌশলীদেরও কাজের পরিধি এবং উপার্জনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। যেমন ধরুন, আমাদের পদ্মা সেতুর ডিজাইন করা হয়েছে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পসহনশীল হিসেবে। যদি সেটি ৮ মাত্রার ভূমিকম্পসহনশীল হিসেবে ডিজাইন করা হতো, তাহলে ব্যয় কয়েক হাজার কোটি টাকা কম হতো। সব স্থাপনার ক্ষেত্রেই বিষয়টি এ রকম।
সর্বশেষ কারণ হচ্ছে একটি গবেষণা প্রতিবেদন, যা সংশ্লিষ্ট গবেষক দল ইতিমধ্যে ভুল স্বীকার করে সংশোধনও করেছে। অবশ্য সংশোধনের পরও বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন আছে। এসব খবর দেশের খুব বেশি লোক রাখে না। ২০১৬ সালে আমেরিকান ভূপদার্থবিদ মাইকেল স্টেকলার একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাতে ঢাকার তলদেশ দিয়ে প্রায় মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অভিন্ন ভূ-চ্যুতিরেখা টেনে বলা হয়, এটি ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার একটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের উৎস হবে। সেই ভূমিকম্প বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকায় প্রলয় ঘটাবে। ঢাকার ভূস্তর কাদামাটিতে পরিণত হবে। ঢাকায় কোনো স্থাপনা কিংবা মানুষজনের অস্তিত্ব থাকবে না।
তাতে আরও বলা হয়, ইন্দো-বার্মা রেঞ্জের একটি টেকটোনিক প্লেট বাউন্ডারিতে লক সৃষ্টি হয়ে নিশ্চল হয়ে আছে। ফলে সেখানকার ভূগর্ভে এত বেশি শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে যে ওই লক যখন খুলবে, তখন এক শক্তিশালী ভূমিকম্প হবে, যা বাংলাদেশের জন্যও বিপর্যয়কর হবে। আমাদের দেশের কয়েকজন ভূবিজ্ঞানীও এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত।
এই গবেষণার ফলাফল আমাদের দেশের মতোই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহলেও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, একটি মাত্র মডেলের ওপর ভিত্তি করে করা কোনো গবেষণার ফলাফল থেকে এত বড় একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।
তা ছাড়া ঢাকার তলদেশ দিয়ে যে চ্যুতিরেখাটি তাঁরা টেনেছেন, সেটি একটানা অভিন্ন কোনো ভূ-চ্যুতি নয়। মানুষ যত দিন থেকে পৃথিবীতে ভূমিকম্পের সঙ্গে পরিচিত, তত দিনের মধ্যে, অর্থাৎ এখন পর্যন্ত ওই চ্যুতি কোনো ভূমিকম্পের উৎস হয়েছে বলে তথ্য-প্রমাণ নেই।
মাইকেল স্টেকলার বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্ব ভারত ও বার্মিজ রেঞ্জে দুটি টেকটোনিক প্লেটের বাউন্ডারিতে যে লকের কথা বলেছেন, সেটিও মিয়ানমারের অনেক ভেতরে। সেখানে সৃষ্ট ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।
বিশেষজ্ঞদের এহেন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণেই বোধ হয় স্টেকলার তাঁর গবেষণার ফলাফল কিছুটা সংশোধন করেছেন। সেই সংশোধনীর সংক্ষিপ্তসারে (অ্যাবস্ট্রাক্ট) বলা হয়েছে, তাঁদের প্রাপ্ত চ্যুতিতে সর্বোচ্চ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২ মাত্রার কথা। এটি কি দ্বিচারিতা, নাকি আরেকটি ভুল, সে প্রশ্নও উঠেছে।
প্রসঙ্গত, রজার বিলহাম নামের আরেক আমেরিকান ভূতত্ত্ববিদ ও গবেষক হিমালয় অঞ্চলে ভারতীয় ও ইউরেশিয়ান প্লেট বাউন্ডারিতে স্টেকলারের মতোই একটি লক (হিমালয়ান লক) আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর গবেষণার ফলাফলেও দেখানো হয়েছিল, ওই লকের ফলে ওই অঞ্চলে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে।
ভারত সরকারের নির্দেশে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে নিবিড় সমীক্ষা ও অনুসন্ধান চালানোর পর রজার বিলহামের গবেষণার ফলাফলকে অতিরঞ্জিত ও অনেকটাই ভিত্তিহীন বলে অভিমত দেন। তার ভিত্তিতে ভারত সরকার তৎক্ষণাৎ রজার বিলহামের ভারতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়।
চার. গত ১০-১২ বছরে ঢাকার আশপাশে ৩ থেকে সাড়ে ৫ মাত্রার অন্তত ৮টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। ঘন ঘন এসব ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প কী বার্তা দেয়? মোটামুটি চারটি বার্তা দেয় বলা যায়।
প্রথম বার্তা হচ্ছে, এই অঞ্চলে ‘টেকটোনিক অ্যাকটিভিটি’ বৃদ্ধি পেয়েছে। সব সময় সব অঞ্চলে এই অ্যাকটিভিটি সমান থাকে না। দ্বিতীয় বার্তা হচ্ছে, ছোট ও মাঝারি শক্তির এসব ভূমিকম্পের ফলে ভূগর্ভে সঞ্চিত শক্তি বের হয়ে যাচ্ছে। ফলে বেশি শক্তি সঞ্চিত হয়ে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা কমছে। তৃতীয় বার্তাটি হচ্ছে, ঢাকার আশপাশে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো কোনো সক্রিয় ভূ-চ্যুতি নেই। চতুর্থ বার্তা হচ্ছে, আমরা যদি বিদ্যমান বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করি, তাহলে এই ভূমিকম্পগুলো এবং প্রতিবেশী দেশের বিপজ্জনক ভূ-চ্যুতিতে সৃষ্ট বড় ভূমিকম্পও আমাদের জন্য বিপর্যয়কর হবে না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত বলে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ছোট-বড় অনেক ভূমিকম্পের সাক্ষ্য বহন করছে। দেশের অভ্যন্তরের ভূ-চ্যুতি (জিওলজিক্যাল ফল্ট) থেকে এখানে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির ইতিহাস আছে। যেমন রিখটার স্কেলে সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প শ্রীমঙ্গলে হয়েছিল। আবার ৩ থেকে সাড়ে ৫ মাত্রার অনেক ছোট ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পও এখানে হয়েছে। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে সৃষ্ট অনেক ভূমিকম্পেও বাংলাদেশ বহুবার কেঁপে উঠেছে।
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। পৃথিবী নামের আমাদের গ্রহটি যে টেকটোনিক প্লেটগুলোর ওপর বসে আছে, সেগুলো অবিরাম সঞ্চরণশীল। এই সঞ্চরণের পথে কখনো কখনো দুটি প্লেটের মধ্যে (প্লেট বাউন্ডারিতে) টক্কর লাগে। তারই ফল হচ্ছে ভূমিকম্প।
টক্কর বা ঘর্ষণের তীব্রতা ও কেন্দ্রস্থলের গভীরতা অনুযায়ী কখনো একটি ছোট এলাকার, কখনো বা কোনো বিশদ অঞ্চলের ভূমি কেঁপে ওঠে। কম্পনের তীব্রতা যত বেশি হয়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তত বাড়ে। বড় ভূমিকম্প হতে হলে বড় ধরনের ভূ-চ্যুতি দরকার হয়। এই সাধারণ ও মৌলিক কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা কতখানি।
দুই. বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হতে পারে দুই কারণে। প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরের বড় কোনো ভূ-চ্যুতি যদি থেকে থাকে। দ্বিতীয়ত, দেশের সীমানার বাইরে ভিন্ন কোনো দেশের কিংবা আন্তদেশীয় কোনো ভূ-চ্যুতিতে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প হলে তার প্রভাবে।
দেশের অভ্যন্তরে এমন কোনো চ্যুতি কি আছে, যেটি কোনো বড় ভূমিকম্পের উৎসস্থল হতে পারে? এ ক্ষেত্রে আমরা সিলেটের শ্রীমঙ্গল এবং মধুপুর চ্যুতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে পারি। দেশের অভ্যন্তরে এই দুটো চ্যুতি বড় ভূমিকম্পের উৎস হওয়ার মতো ছিল। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গল চ্যুতি সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টিও করেছিল শতাধিক বছর আগে। বিজ্ঞানীদের সর্বশেষ গবেষণার ফলাফল বলে, এই চ্যুতিগুলো এখন আর সক্রিয় নয়। ফলে এগুলো আর কোনো বড় ভূমিকম্পের উৎস হতে পারবে না।
দেশের অভ্যন্তরে বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর প্রভৃতি অঞ্চলে আরও কয়েকটি বড় ভূ-চ্যুতির কথাও বিজ্ঞানীরা বলতেন। এখন সেগুলো সবই নিষ্ক্রিয়
এবং বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির সহায়ক নয়। সুতরাং দেশের অভ্যন্তরের কোনো ভূ-চ্যুতি থেকে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির আশঙ্কা নেই বললেই চলে।
দেশের বাইরে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠার মতো ভূ-চ্যুতি ছিল বা রয়েছে প্রতিবেশী ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে, আন্দামান সাগরে এবং মিয়ানমারে। আসাম ও মেঘালয়ের ভূ-চ্যুতিগুলো সুদূর অতীতে ‘গ্রেট বেঙ্গল আর্থকোয়েক’সহ একাধিক বড় ভূমিকম্পের কারণ হয়েছে, যার প্রভাব তখন ঢাকাসহ বাংলাদেশেও পড়েছিল। তবে বাংলাদেশের কোথাও তা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠেনি, কিংবা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞও সৃষ্টি করেনি। মনে রাখা দরকার, এর মধ্যে গ্রেট বেঙ্গল আর্থকোয়েক ছিল রিখটার স্কেলে প্রায় সাড়ে ৮ মাত্রার।
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের বিপজ্জনক চ্যুতিগুলোতে অনেকবারই ভূমিকম্প হয়েছে। তবে তা বাংলাদেশের কোনো এলাকায় বলার মতো কোনো
ধ্বংস সাধন করেনি। ভবিষ্যতে যদি সেখানে ৮ কিংবা এরও বেশি মাত্রার কোনো ভূমিকম্প হয়, তার প্রভাব বাংলাদেশে অবশ্যই পড়বে। তবে তা বাংলাদেশকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে—এমন আশঙ্কা বিজ্ঞানীরা করেন না।
তিন. বাংলাদেশে বড় এবং প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের আশঙ্কা সৃষ্টি হলো কীভাবে? প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরের পুরোনো ও বর্তমানে নিষ্ক্রিয় চ্যুতিগুলো অনেকের মনে ঐতিহাসিকভাবে ওই আশঙ্কার বীজ বুনে রেখেছে। আমাদের দেশে ভূ-চ্যুতির সংখ্যা, অবস্থান ও প্রকৃতির বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত কোনো জরিপ হয়নি। ফলে বিজ্ঞানীরা নিরাপদ অবস্থানে থাকার জন্য বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কাকে নাকচ করে দেন না।
আরেকটি কারণ, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কার ভিত্তি তৈরি করতে পারলে যেকোনো ধরনের নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। তাতে প্রকল্পগুলোর পরামর্শক, স্থপতি, প্রকৌশলীদেরও কাজের পরিধি এবং উপার্জনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। যেমন ধরুন, আমাদের পদ্মা সেতুর ডিজাইন করা হয়েছে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পসহনশীল হিসেবে। যদি সেটি ৮ মাত্রার ভূমিকম্পসহনশীল হিসেবে ডিজাইন করা হতো, তাহলে ব্যয় কয়েক হাজার কোটি টাকা কম হতো। সব স্থাপনার ক্ষেত্রেই বিষয়টি এ রকম।
সর্বশেষ কারণ হচ্ছে একটি গবেষণা প্রতিবেদন, যা সংশ্লিষ্ট গবেষক দল ইতিমধ্যে ভুল স্বীকার করে সংশোধনও করেছে। অবশ্য সংশোধনের পরও বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন আছে। এসব খবর দেশের খুব বেশি লোক রাখে না। ২০১৬ সালে আমেরিকান ভূপদার্থবিদ মাইকেল স্টেকলার একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাতে ঢাকার তলদেশ দিয়ে প্রায় মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অভিন্ন ভূ-চ্যুতিরেখা টেনে বলা হয়, এটি ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার একটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের উৎস হবে। সেই ভূমিকম্প বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকায় প্রলয় ঘটাবে। ঢাকার ভূস্তর কাদামাটিতে পরিণত হবে। ঢাকায় কোনো স্থাপনা কিংবা মানুষজনের অস্তিত্ব থাকবে না।
তাতে আরও বলা হয়, ইন্দো-বার্মা রেঞ্জের একটি টেকটোনিক প্লেট বাউন্ডারিতে লক সৃষ্টি হয়ে নিশ্চল হয়ে আছে। ফলে সেখানকার ভূগর্ভে এত বেশি শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে যে ওই লক যখন খুলবে, তখন এক শক্তিশালী ভূমিকম্প হবে, যা বাংলাদেশের জন্যও বিপর্যয়কর হবে। আমাদের দেশের কয়েকজন ভূবিজ্ঞানীও এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত।
এই গবেষণার ফলাফল আমাদের দেশের মতোই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহলেও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, একটি মাত্র মডেলের ওপর ভিত্তি করে করা কোনো গবেষণার ফলাফল থেকে এত বড় একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।
তা ছাড়া ঢাকার তলদেশ দিয়ে যে চ্যুতিরেখাটি তাঁরা টেনেছেন, সেটি একটানা অভিন্ন কোনো ভূ-চ্যুতি নয়। মানুষ যত দিন থেকে পৃথিবীতে ভূমিকম্পের সঙ্গে পরিচিত, তত দিনের মধ্যে, অর্থাৎ এখন পর্যন্ত ওই চ্যুতি কোনো ভূমিকম্পের উৎস হয়েছে বলে তথ্য-প্রমাণ নেই।
মাইকেল স্টেকলার বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্ব ভারত ও বার্মিজ রেঞ্জে দুটি টেকটোনিক প্লেটের বাউন্ডারিতে যে লকের কথা বলেছেন, সেটিও মিয়ানমারের অনেক ভেতরে। সেখানে সৃষ্ট ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।
বিশেষজ্ঞদের এহেন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণেই বোধ হয় স্টেকলার তাঁর গবেষণার ফলাফল কিছুটা সংশোধন করেছেন। সেই সংশোধনীর সংক্ষিপ্তসারে (অ্যাবস্ট্রাক্ট) বলা হয়েছে, তাঁদের প্রাপ্ত চ্যুতিতে সর্বোচ্চ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২ মাত্রার কথা। এটি কি দ্বিচারিতা, নাকি আরেকটি ভুল, সে প্রশ্নও উঠেছে।
প্রসঙ্গত, রজার বিলহাম নামের আরেক আমেরিকান ভূতত্ত্ববিদ ও গবেষক হিমালয় অঞ্চলে ভারতীয় ও ইউরেশিয়ান প্লেট বাউন্ডারিতে স্টেকলারের মতোই একটি লক (হিমালয়ান লক) আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর গবেষণার ফলাফলেও দেখানো হয়েছিল, ওই লকের ফলে ওই অঞ্চলে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে।
ভারত সরকারের নির্দেশে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে নিবিড় সমীক্ষা ও অনুসন্ধান চালানোর পর রজার বিলহামের গবেষণার ফলাফলকে অতিরঞ্জিত ও অনেকটাই ভিত্তিহীন বলে অভিমত দেন। তার ভিত্তিতে ভারত সরকার তৎক্ষণাৎ রজার বিলহামের ভারতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়।
চার. গত ১০-১২ বছরে ঢাকার আশপাশে ৩ থেকে সাড়ে ৫ মাত্রার অন্তত ৮টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। ঘন ঘন এসব ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প কী বার্তা দেয়? মোটামুটি চারটি বার্তা দেয় বলা যায়।
প্রথম বার্তা হচ্ছে, এই অঞ্চলে ‘টেকটোনিক অ্যাকটিভিটি’ বৃদ্ধি পেয়েছে। সব সময় সব অঞ্চলে এই অ্যাকটিভিটি সমান থাকে না। দ্বিতীয় বার্তা হচ্ছে, ছোট ও মাঝারি শক্তির এসব ভূমিকম্পের ফলে ভূগর্ভে সঞ্চিত শক্তি বের হয়ে যাচ্ছে। ফলে বেশি শক্তি সঞ্চিত হয়ে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা কমছে। তৃতীয় বার্তাটি হচ্ছে, ঢাকার আশপাশে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো কোনো সক্রিয় ভূ-চ্যুতি নেই। চতুর্থ বার্তা হচ্ছে, আমরা যদি বিদ্যমান বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করি, তাহলে এই ভূমিকম্পগুলো এবং প্রতিবেশী দেশের বিপজ্জনক ভূ-চ্যুতিতে সৃষ্ট বড় ভূমিকম্পও আমাদের জন্য বিপর্যয়কর হবে না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে