মোনায়েম সরকার
ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতিবাহী মাস ফেব্রুয়ারি এসে গেছে আমাদের মাঝে। এই মাসজুড়েই আমরা স্মরণ করি মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে যাঁরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের। পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির মুখের ভাষাকে ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা’ দিতেও রাজি ছিল না শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবিসংবাদিত নেতা বলে বিবেচিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পর্যন্ত এই প্রশ্নে অত্যন্ত নেতিবাচক অবস্থান নিলে এই অঞ্চলের ছাত্র ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এর পরবর্তী ইতিহাস সবারই জানা।
ভাষা আন্দোলনে আত্মদানের ঘটনার ধারাবাহিকতায়, এর কয়েক বছর পর, ১৯৫৬ সালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করে নেয় পাকিস্তান সরকার। কিন্তু তত দিনে অসন্তোষ চরমে ওঠে, পাকিস্তান সরকারের ওপর আস্থা বিনষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে ইতিবাচক যে ঘটনা ঘটে, তা হলো ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয় চেতনার উদ্ভব। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, বিশেষত বাঙালিরা তাদের স্বদেশকে দেখতে পায় এবং আবিষ্কার করে নিজেদের অস্তিত্ব। তাই এ কথা বলা হয়ে থাকে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা বাঙালিকে আত্মপরিচয়ের সন্ধান দিয়েছে। তারই প্রভাব লক্ষ করা যায় ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিরাট বিজয়ে। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা মুসলিম লীগ বলতে গেলে মুছে যায় এই অঞ্চল থেকে এবং বাঙালির মন থেকেও। শুরু হয় এক নতুন পথচলা।
ভাষা আন্দোলনে জেগে ওঠা চেতনাই আমাদের মধ্যে নিয়ে আসে স্বাধিকারের বোধ। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ অব্যাহতভাবে এর অবমাননা করতে থাকলে সেটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। আমাদের স্বতন্ত্র ইতিহাস, ঐতিহ্য সামনে চলে আসে ক্রমে। আমাদের নিজস্বতা ও অধিকারের প্রশ্ন প্রবলভাবে উঠে আসতে থাকে সাহিত্যেও। ভাষা আন্দোলনে আত্মদানের ঘটনার পর তার প্রতিক্রিয়ায় যেসব কবিতা লেখেন এই অঞ্চলের বাঙালি কবিরা, সেগুলো আজও পঠিত হয় গভীর আবেগের সঙ্গে। কেবল নিজ ভাষার প্রতি ভালোবাসা নয়, নিজ জনগোষ্ঠীর কল্যাণচিন্তা প্রবলভাবে সামনে আসে এভাবেই। দানা বাঁধতে থাকে স্বায়ত্তশাসনের দাবি। দশকব্যাপী সামরিক শাসন দিয়েও তা দমনের চেষ্টা করা হয়েছিল। এরই মধ্যে চালানো হয় বাঙালির যা কিছু গৌরবের, তাকে খাটো ও বিনষ্ট করার চেষ্টা। মুসলমানিত্বের নামে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকারের চেষ্টা চালানো হলে সেটা বরং বুমেরাং হয়। পূর্ব বাংলার গ্রামীণ সমাজ থেকে উঠে আসা শিক্ষিত সম্প্রদায় নজরুলের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথকেও তার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রধান অবলম্বন বলে ঘোষণা করে। ষাটের দশকজুড়ে বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ চলে পাশাপাশি, কখনো একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে। সেটা অবধারিতভাবে আমাদের নিয়ে যায় স্বাধীনতার দিকে। এ কথা বলা তাই খুব যুক্তিযুক্ত যে, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা তথা স্বাধীন বাংলাদেশ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গে বিপুলসংখ্যক বাঙালি বসবাস করলেও বাঙালির নিজস্ব দেশ হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে দিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ বাঙালিকে চেনে ও সম্মান দেয়। তারা এ জন্য সম্মান দেয় যে, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালি কেবল আত্মদান করেনি, তাকে যোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠিতও করেছে। বিশ্বের মানুষ আজ জানে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ভিত্তিতে একটি দেশও প্রতিষ্ঠা করেছে এই অঞ্চলের মানুষ। স্বাধীনতা অর্জনের পর রচিত সংবিধানে তারা সেই রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদকেও স্থান দিয়েছিল, পরে যাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালায় একটি সামরিক সরকার। জাতীয়তা ও নাগরিকতাকে গুলিয়ে ফেলে তারা এ দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল নিয়েছিল। কিন্তু মানুষকে বেশি দিন বিভ্রান্ত করে রাখা যায়নি। তারা আবারও ফিরে এসেছে জাতীয়তাবাদের মূল স্রোতে। আমাদের জাতীয় চেতনা আরও শক্তিশালী হয়েছে রাজনৈতিকভাবে দেশ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে আসায়। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে দেশে। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারও কঠোর মনোভাব নিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান। দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। একদা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে বর্ণিত দেশটি আজ চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ উন্নতি করেছে কেবল বিদেশে জনশক্তি পাঠিয়ে নয়, বরং দেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প এখন বাস্তবায়ন করতে পারে বাংলাদেশ, এমনকি নিজস্ব অর্থায়নে। ভাষা আন্দোলনের ধারায় সৃষ্ট দেশে না খেয়ে কিংবা আধপেটা থাকা জনগোষ্ঠী নেই বললেই চলে। গ্রামেও মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের চিত্রই গেছে বদলে। কৃষি থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে শিল্পের দিকে এবং এখানে সেবা খাতেরও বিকাশ ঘটে চলেছে। বায়ান্ন ও একাত্তরের শহীদেরা এমন একটি দেশের স্বপ্নই নিশ্চয় দেখেছিলেন।
বাংলাদেশে আমরা প্রত্যাশিত সবকিছু পেয়ে গেছি, সেটা অবশ্য বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার কথাটা শুরুতেই বলতে হয়। শিক্ষার বিস্তার আমরা ঘটাতে পেরেছি সন্দেহ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে তুলতে পেরেছি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও অনেক; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও কম না। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা কতটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। প্রাথমিক স্তর থেকে বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের নতুন প্রজন্মকে একই ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে দিচ্ছে না। বিত্তশালী পরিবারের সন্তানেরা ভিন্ন প্রকৃতির শিক্ষা পেয়ে জীবন গঠনে এগিয়ে যাওয়ায় সেটা আবার বৈষম্য সৃষ্টির কারণ হচ্ছে। মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করব বা সর্বস্তরে বাংলা চালু করব—এটি ছিল আমাদের অঙ্গীকার। সেটা পরিপূরণের জন্য যে সমন্বিত কর্মপ্রয়াস প্রয়োজন, তা আমরা কতখানি নিতে সমর্থ হয়েছি? উচ্চশিক্ষা স্তরে বাংলায় মানসম্মত বইপুস্তক রচনা, এমনকি অনুবাদের কাজে আসলে কতটা অগ্রসর হতে পেরেছি? ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতিবাহী মাসে বইমেলার আয়োজন করে আসছে বাংলা একাডেমি। এই মেলা কালক্রমে অনেক প্রসারিত হয়েছে এবং তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। এ উপলক্ষে সাহিত্যসহ নানা ধরনের বইপত্রও কম প্রকাশিত হচ্ছে না। কিন্তু মানের দিকে লক্ষ করলে অনেক ক্ষেত্রেই কি হতাশ হতে হয় না? ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও চলছে অরাজকতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারও এর জন্য দায়ী। তবে অনলাইনে বাংলায় লেখালেখি অনেক বেড়েছে। তাতে তরুণদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। আমাদের প্রয়োজন ইংরেজিসহ বহুল ব্যবহৃত ভাষাগুলোয় বাংলায় রচিত উচ্চমানের সাহিত্যের অনুবাদ এবং তা প্রচারের উদ্যোগ। ‘জাতির মননের প্রতীক’ বাংলা একাডেমিকেও এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলা একাডেমি হলো ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল।
একুশে ফেব্রুয়ারি অবশ্য এখন জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এ স্বীকৃতিও আমাদের জন্য গৌরবের। এ ধরনের স্বীকৃতির মর্যাদা রক্ষায় আমাদের আবার নজর দিতে হবে নিজ দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মুখের ভাষা রক্ষায়। তাদের শিশুরা যেন মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে, একই সঙ্গে উন্নয়নের মূল স্রোতে এসে মিশতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। ভাষা আন্দোলন আমাদের গৌরবান্বিত যেমন করেছে, তেমনি কিছু কাজে দায়বদ্ধও করে ফেলেছে, যা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। নিজ ভাষা ও দেশকে আমরা গৌরবান্বিত করতে পারব না নিজেরা শিক্ষা, সংস্কৃতিতে এগিয়ে যেতে না পারলে এবং উন্নত মানবসম্পদ হয়ে উঠতে ব্যর্থ হলে। এ ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভাষা আন্দোলনের ধারায় সৃষ্ট এ দেশে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কাজের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নও নিশ্চিত করতে হবে। পাকিস্তান আমলে আমরা যে সাংস্কৃতিক বিভাজন অস্বীকার করে গণতান্ত্রিক চেতনা লালনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছিলাম, সেটা পরিহার করা চলবে না। বিভাজন নয়, বরং ঐক্যের পথেই এগিয়ে যেতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার এক বড় অন্তরায় এ ক্ষেত্রে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশে দেশে এসব পশ্চাৎপদ উপাদান মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার মধ্যে ভিন্ন পথে এগিয়ে যাওয়া কঠিন বৈকি। এই ধারায় অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্পও নেই। বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রশ্নে সুবিধাবাদ ও আপসকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সেটা জাতীয় জীবনে বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। এর ফলে একসময় হয়তো দেখা যাবে, অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারলেও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। এই লড়াইয়ের মূলে রয়েছে শিক্ষা। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভাজনের বদলে ঐক্যের ভিত্তিকে তাই মজবুত করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক যে, এত অগ্রগতির মধ্যেও রাষ্ট্রীয় অর্থে লিখিত ও মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক নিয়ে অপ্রত্যাশিত বিতর্কের মুখে পড়তে হচ্ছে। তাতে বিভাজনের শক্তি উটকো বক্তব্য নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগও পাচ্ছে। এসব বিষয়ে সতর্ক হয়েই পথ চলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিকে।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী মাস ফেব্রুয়ারি আমাদের মধ্যে যেন আত্মবিশ্লেষণেরও সুযোগ এনে দেয়। বড় বড় অর্জন নিয়ে উচ্ছ্বসিত আলোচনার নিচে যেন চাপা পড়ে না যায়, যা এখনো অর্জন করা যায়নি কিংবা খর্ব হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর
ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতিবাহী মাস ফেব্রুয়ারি এসে গেছে আমাদের মাঝে। এই মাসজুড়েই আমরা স্মরণ করি মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে যাঁরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের। পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির মুখের ভাষাকে ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা’ দিতেও রাজি ছিল না শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবিসংবাদিত নেতা বলে বিবেচিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পর্যন্ত এই প্রশ্নে অত্যন্ত নেতিবাচক অবস্থান নিলে এই অঞ্চলের ছাত্র ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এর পরবর্তী ইতিহাস সবারই জানা।
ভাষা আন্দোলনে আত্মদানের ঘটনার ধারাবাহিকতায়, এর কয়েক বছর পর, ১৯৫৬ সালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করে নেয় পাকিস্তান সরকার। কিন্তু তত দিনে অসন্তোষ চরমে ওঠে, পাকিস্তান সরকারের ওপর আস্থা বিনষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে ইতিবাচক যে ঘটনা ঘটে, তা হলো ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয় চেতনার উদ্ভব। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, বিশেষত বাঙালিরা তাদের স্বদেশকে দেখতে পায় এবং আবিষ্কার করে নিজেদের অস্তিত্ব। তাই এ কথা বলা হয়ে থাকে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা বাঙালিকে আত্মপরিচয়ের সন্ধান দিয়েছে। তারই প্রভাব লক্ষ করা যায় ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিরাট বিজয়ে। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা মুসলিম লীগ বলতে গেলে মুছে যায় এই অঞ্চল থেকে এবং বাঙালির মন থেকেও। শুরু হয় এক নতুন পথচলা।
ভাষা আন্দোলনে জেগে ওঠা চেতনাই আমাদের মধ্যে নিয়ে আসে স্বাধিকারের বোধ। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ অব্যাহতভাবে এর অবমাননা করতে থাকলে সেটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। আমাদের স্বতন্ত্র ইতিহাস, ঐতিহ্য সামনে চলে আসে ক্রমে। আমাদের নিজস্বতা ও অধিকারের প্রশ্ন প্রবলভাবে উঠে আসতে থাকে সাহিত্যেও। ভাষা আন্দোলনে আত্মদানের ঘটনার পর তার প্রতিক্রিয়ায় যেসব কবিতা লেখেন এই অঞ্চলের বাঙালি কবিরা, সেগুলো আজও পঠিত হয় গভীর আবেগের সঙ্গে। কেবল নিজ ভাষার প্রতি ভালোবাসা নয়, নিজ জনগোষ্ঠীর কল্যাণচিন্তা প্রবলভাবে সামনে আসে এভাবেই। দানা বাঁধতে থাকে স্বায়ত্তশাসনের দাবি। দশকব্যাপী সামরিক শাসন দিয়েও তা দমনের চেষ্টা করা হয়েছিল। এরই মধ্যে চালানো হয় বাঙালির যা কিছু গৌরবের, তাকে খাটো ও বিনষ্ট করার চেষ্টা। মুসলমানিত্বের নামে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকারের চেষ্টা চালানো হলে সেটা বরং বুমেরাং হয়। পূর্ব বাংলার গ্রামীণ সমাজ থেকে উঠে আসা শিক্ষিত সম্প্রদায় নজরুলের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথকেও তার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রধান অবলম্বন বলে ঘোষণা করে। ষাটের দশকজুড়ে বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ চলে পাশাপাশি, কখনো একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে। সেটা অবধারিতভাবে আমাদের নিয়ে যায় স্বাধীনতার দিকে। এ কথা বলা তাই খুব যুক্তিযুক্ত যে, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা তথা স্বাধীন বাংলাদেশ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গে বিপুলসংখ্যক বাঙালি বসবাস করলেও বাঙালির নিজস্ব দেশ হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে দিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ বাঙালিকে চেনে ও সম্মান দেয়। তারা এ জন্য সম্মান দেয় যে, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালি কেবল আত্মদান করেনি, তাকে যোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠিতও করেছে। বিশ্বের মানুষ আজ জানে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ভিত্তিতে একটি দেশও প্রতিষ্ঠা করেছে এই অঞ্চলের মানুষ। স্বাধীনতা অর্জনের পর রচিত সংবিধানে তারা সেই রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদকেও স্থান দিয়েছিল, পরে যাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালায় একটি সামরিক সরকার। জাতীয়তা ও নাগরিকতাকে গুলিয়ে ফেলে তারা এ দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল নিয়েছিল। কিন্তু মানুষকে বেশি দিন বিভ্রান্ত করে রাখা যায়নি। তারা আবারও ফিরে এসেছে জাতীয়তাবাদের মূল স্রোতে। আমাদের জাতীয় চেতনা আরও শক্তিশালী হয়েছে রাজনৈতিকভাবে দেশ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে আসায়। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে দেশে। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারও কঠোর মনোভাব নিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান। দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। একদা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে বর্ণিত দেশটি আজ চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ উন্নতি করেছে কেবল বিদেশে জনশক্তি পাঠিয়ে নয়, বরং দেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প এখন বাস্তবায়ন করতে পারে বাংলাদেশ, এমনকি নিজস্ব অর্থায়নে। ভাষা আন্দোলনের ধারায় সৃষ্ট দেশে না খেয়ে কিংবা আধপেটা থাকা জনগোষ্ঠী নেই বললেই চলে। গ্রামেও মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের চিত্রই গেছে বদলে। কৃষি থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে শিল্পের দিকে এবং এখানে সেবা খাতেরও বিকাশ ঘটে চলেছে। বায়ান্ন ও একাত্তরের শহীদেরা এমন একটি দেশের স্বপ্নই নিশ্চয় দেখেছিলেন।
বাংলাদেশে আমরা প্রত্যাশিত সবকিছু পেয়ে গেছি, সেটা অবশ্য বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার কথাটা শুরুতেই বলতে হয়। শিক্ষার বিস্তার আমরা ঘটাতে পেরেছি সন্দেহ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে তুলতে পেরেছি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও অনেক; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও কম না। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা কতটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। প্রাথমিক স্তর থেকে বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের নতুন প্রজন্মকে একই ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে দিচ্ছে না। বিত্তশালী পরিবারের সন্তানেরা ভিন্ন প্রকৃতির শিক্ষা পেয়ে জীবন গঠনে এগিয়ে যাওয়ায় সেটা আবার বৈষম্য সৃষ্টির কারণ হচ্ছে। মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করব বা সর্বস্তরে বাংলা চালু করব—এটি ছিল আমাদের অঙ্গীকার। সেটা পরিপূরণের জন্য যে সমন্বিত কর্মপ্রয়াস প্রয়োজন, তা আমরা কতখানি নিতে সমর্থ হয়েছি? উচ্চশিক্ষা স্তরে বাংলায় মানসম্মত বইপুস্তক রচনা, এমনকি অনুবাদের কাজে আসলে কতটা অগ্রসর হতে পেরেছি? ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতিবাহী মাসে বইমেলার আয়োজন করে আসছে বাংলা একাডেমি। এই মেলা কালক্রমে অনেক প্রসারিত হয়েছে এবং তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। এ উপলক্ষে সাহিত্যসহ নানা ধরনের বইপত্রও কম প্রকাশিত হচ্ছে না। কিন্তু মানের দিকে লক্ষ করলে অনেক ক্ষেত্রেই কি হতাশ হতে হয় না? ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও চলছে অরাজকতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারও এর জন্য দায়ী। তবে অনলাইনে বাংলায় লেখালেখি অনেক বেড়েছে। তাতে তরুণদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। আমাদের প্রয়োজন ইংরেজিসহ বহুল ব্যবহৃত ভাষাগুলোয় বাংলায় রচিত উচ্চমানের সাহিত্যের অনুবাদ এবং তা প্রচারের উদ্যোগ। ‘জাতির মননের প্রতীক’ বাংলা একাডেমিকেও এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলা একাডেমি হলো ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল।
একুশে ফেব্রুয়ারি অবশ্য এখন জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এ স্বীকৃতিও আমাদের জন্য গৌরবের। এ ধরনের স্বীকৃতির মর্যাদা রক্ষায় আমাদের আবার নজর দিতে হবে নিজ দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মুখের ভাষা রক্ষায়। তাদের শিশুরা যেন মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে, একই সঙ্গে উন্নয়নের মূল স্রোতে এসে মিশতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। ভাষা আন্দোলন আমাদের গৌরবান্বিত যেমন করেছে, তেমনি কিছু কাজে দায়বদ্ধও করে ফেলেছে, যা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। নিজ ভাষা ও দেশকে আমরা গৌরবান্বিত করতে পারব না নিজেরা শিক্ষা, সংস্কৃতিতে এগিয়ে যেতে না পারলে এবং উন্নত মানবসম্পদ হয়ে উঠতে ব্যর্থ হলে। এ ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভাষা আন্দোলনের ধারায় সৃষ্ট এ দেশে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কাজের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নও নিশ্চিত করতে হবে। পাকিস্তান আমলে আমরা যে সাংস্কৃতিক বিভাজন অস্বীকার করে গণতান্ত্রিক চেতনা লালনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছিলাম, সেটা পরিহার করা চলবে না। বিভাজন নয়, বরং ঐক্যের পথেই এগিয়ে যেতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার এক বড় অন্তরায় এ ক্ষেত্রে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশে দেশে এসব পশ্চাৎপদ উপাদান মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার মধ্যে ভিন্ন পথে এগিয়ে যাওয়া কঠিন বৈকি। এই ধারায় অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্পও নেই। বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রশ্নে সুবিধাবাদ ও আপসকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সেটা জাতীয় জীবনে বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। এর ফলে একসময় হয়তো দেখা যাবে, অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারলেও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। এই লড়াইয়ের মূলে রয়েছে শিক্ষা। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভাজনের বদলে ঐক্যের ভিত্তিকে তাই মজবুত করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক যে, এত অগ্রগতির মধ্যেও রাষ্ট্রীয় অর্থে লিখিত ও মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক নিয়ে অপ্রত্যাশিত বিতর্কের মুখে পড়তে হচ্ছে। তাতে বিভাজনের শক্তি উটকো বক্তব্য নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগও পাচ্ছে। এসব বিষয়ে সতর্ক হয়েই পথ চলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিকে।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী মাস ফেব্রুয়ারি আমাদের মধ্যে যেন আত্মবিশ্লেষণেরও সুযোগ এনে দেয়। বড় বড় অর্জন নিয়ে উচ্ছ্বসিত আলোচনার নিচে যেন চাপা পড়ে না যায়, যা এখনো অর্জন করা যায়নি কিংবা খর্ব হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে