জাহীদ রেজা নূর
ঘুষ বা দুর্নীতির খবর আমাদের দেশে যে খুব একটা পাত্তা পায় না, তার একটি বড় কারণ হলো, সবাই মেনে নিয়েছে, এই ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। যদি নতুন কিছু করতে হয়, ঘাটে ঘাটে পয়সা গুনতে হবে। এমনকি যদি চাকরিজীবন শেষে পেনশনের টাকা তুলতে যাওয়া হয়, তাহলেও ঘুষ দেওয়াটাই রীতি।
আমাদের এই অঞ্চলে ঘুষের শুরু করেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস—এ রকম একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে। মীরজাফরের পত্নী মুন্নী বেগমের কাছ থেকে নাকি হেস্টিংস ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেন। মুন্নী বেগমের ছেলে নাজিমউদ্দৌলা ১৫ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেছিল।
কে প্রথম ঘুষ নিয়েছিলেন, সেটা খুব বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, সেই ঘুষপ্রথা অলিখিতভাবে আমাদের সমাজে ভিত্তি পেয়েছে। জরিপ হওয়া দরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঘুষখোরের সংখ্যা বেশি, নাকি সৎমানুষের সংখ্যা বেশি? অনেক সময় আমরা লক্ষ করেছি, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য ঘুষখোরদের কেউ কেউ বলে থাকেন, ‘আমি নিজে ঘুষ খাই না।
সিস্টেমে এমনিতেই আমার কাছে ঘুষের টাকা চলে আসে। আমি না নিলে বরং আমাকে একঘরে করে ফেলা হবে।’ কথাটা হাস্যকর শোনালেও এ কথার মধ্যে সত্যতা আছে। কোনো প্রতিষ্ঠান যখন বুঝতে পারে, এখানে ঘুষ নেওয়া হলে কেউ এসে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করবে না, তখন সেই প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই ঘুষের প্রচলন হতে পারে। আমাদের দেশে এই ঘুষপ্রবণতা যেন গণতন্ত্রের অঙ্গ হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের ভালো-মন্দ নিয়ে একটু কথা বলা বোধ হয় অসমীচীন হবে না।
২. আজকের লেখাটা একটু ভারী হয়ে যেতে পারে। তবে তার দরকার আছে। গণতন্ত্রকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আপাত পতনের পর গণতন্ত্রই নির্ভরযোগ্য শাসনব্যবস্থা হিসেবে টিকে আছে। কিন্তু দেখুন, রাষ্ট্রপতিশাসিত ও সংসদশাসিত দুই বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতে গণতন্ত্রের যে হাল, তাতে এই ‘তন্ত্র’ পরিবর্তিত হয়ে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, সেটাই ব্যথিত মনে দেখতে হয়। নরেন্দ্র মোদির গণতন্ত্রের সঙ্গে হিন্দুত্বের মিলন এখন ভারতের গণতন্ত্রকেই হুমকির মুখোমুখি করেছে। দেশভাগের আগে বা পরে জাতীয় কংগ্রেস যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলত, বর্তমান ভারত সেই জায়গা থেকে অনেক দূর সরে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র তো এলিট শ্রেণির কবজায় সেই কবে থেকেই বন্দী। পুঁজির বিকাশ হচ্ছে সেখানে, কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে গায়ের জোরে গণতন্ত্রী করতে গিয়ে কোটি কোটি টাকার অপচয় করছে তারা। ফলে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করতে হয়। আমাদের দেশে হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের পুনরাগমনের সময়টা হলো নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র কতটা কোন দিকে বিকশিত হয়েছে, সেই আলোচনা করা খুবই জরুরি।
৩. এরশাদের পতনের পর প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘুরেফিরে ক্ষমতায় এসেছে। একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সফলভাবেই নির্বাচন ও ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এরপর বিএনপির আমলে হঠাৎ করেই ইয়াজউদ্দিন-ম্যাজিক গোটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের চিন্তকেরা প্রশাসনের সর্বত্র নিজের লোকদের বসিয়ে নির্বাচনের নামে একটা প্রহসনের জন্ম দিতে চেয়েছিলেন। সেই সময়কার তীব্র উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল যে ফখরুদ্দীন আহমদের কেয়ারটেকার সরকার, তারাও নানাভাবে সমালোচিত হয়েছিল। এরপর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে।
আমরা দেখতে পেয়েছি, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য নানা চেষ্টা করে এসেছে। আমরা এ-ও দেখেছি, ক্ষমতায় এসে সমাজ থেকে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, ঘুষ ইত্যাদি নির্মূল করার প্রতিজ্ঞা করেছে সেনাসমর্থিত কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর হয় তারা নিজেরাই যুক্ত হয়ে গেছে এই সব অসৎ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অথবা কেউ এই অসৎ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হলে তার শাস্তির ব্যবস্থা করেনি। বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে আইনের শাসন শিথিল হয়ে পড়ে, একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী অপরাধ করতে থাকে এবং বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বের প্রভাবে পার পেয়ে যায়—এটা সর্বত্রই দেখা যায়। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
এ কারণেই সমাজের ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়তে থাকে, বুদ্ধিজীবীশ্রেণির বড় অংশটাই হয়ে ওঠে ক্ষমতার তাঁবেদার, সরকারও বিভিন্ন প্রকল্প গড়ে প্রতিবাদী মেধাবীদের ‘উপহার’ দিয়ে তাঁদের হাতে রাখে। আর আইনশৃঙ্খলা? সেটা ‘যেমনে নাচাও তেমনে নাচি, পুতুলের কী দোষ’ বলে নিজের দোষ ঢেকে রাখার প্রয়াস নিতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
৪. বৃহৎ এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও অনেক কিছুই ধরে ধরে বলার থাকতে পারে। কিন্তু আজকের আলোচনায় সেদিকে যাব না। গণতন্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায় যে আপদটি বড় করে বাসা বেঁধেছে, তা নিয়েই এখন বলব। ওপরে যা বলা হলো, তার কারণগুলো হয়তো এই আলোচনায় পাওয়া যেতেও পারে। এই আলোচনা আমাদের গণতন্ত্রের দৈন্যদশা নিয়ে খানিকটা ভাবতে সাহায্য করবে বলে আমার ধারণা।
দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তান পর্যায়ের নিরন্তর আন্দোলনের কথা কমবেশি সবাই জানেন। সেই সময়টা পেরিয়ে এসে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যখন জন্ম হলো, তখন যা দেখা গেল, তা থেকেই কথার শুরু হোক। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দেশের নাম পরিবর্তন হয়ে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলো, তা ছিল অর্থনৈতিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত এক দেশ। ভেঙে পড়া অর্থনীতির দেশটার হাল ধরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিছুদিন বাদেই ছাত্রলীগে এল ভাঙন, তৈরি হলো জাসদ। ডান-বামের প্রবল বিরোধিতার মধ্য দিয়ে পথ কেটে এগিয়ে যেতে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারকে। পাকিস্তানি দালালেরাও করছিল সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র।
এই বিভিন্ন আক্রমণের মধ্যেই আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগেও নৈতিক স্খলন দেখা গেছে। দিনে দিনে বঙ্গবন্ধু একা হয়ে যেতে থাকলেন। শেখ মুজিব-তাজউদ্দীন বন্ধনটিও থাকল না। সে এক অস্থির সময়ে সমাজতান্ত্রিক পথ বেছে নিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বাকশাল গঠনের পরপরই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে তিনি নিহত হলেন।
এই ইতিহাস নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার কারণ হলো, সামরিক সরকার দেশের ক্ষমতা নেওয়ার পর জিয়াউর রহমানের সরকার নব্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা শুরু করেছিল। একধরনের পুঁজিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল তাতে। অনভ্যস্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে এই নতুন পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছিল শক্ত। তার ফল হয়েছিল কী?
৫. পুঁজিবাদের উত্থান মানেই বিপুল নগরায়ণ বা নগরসভ্যতার দিকে যাওয়া। ইউরোপে দেখা গেছে, নগরায়ণের ফলে গ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ শহরে চলে আসে। কাজ নেয় কারখানায়। তাদের মনে গ্রামীণ সংস্কৃতির জায়গায় শহুরে সংস্কৃতি জায়গা করে নিতে থাকে।
নগরসভ্যতা হচ্ছে শিল্প বিকাশের সঙ্গে যুক্ত জীবনধারার শৈল্পিক রূপ। চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রেও শীলিত পরিবর্তন আসে তাতে। শিল্পের উন্নতিকে বাধাহীন করতে হলে প্রয়োজন পড়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের। রক্ষণশীল পশ্চাৎপদ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার দরকার হয়। ফলে তখন গড়ে তুলতে হয় নয়া নয়া জ্ঞানকেন্দ্র। গড়ে তুলতে হয় শিক্ষাব্যবস্থা। যে শিক্ষা জীবনে কাজে লাগে, সেই শিক্ষাকেই তুলে আনতে হয়। আর শহুরে মানুষের বিনোদনের খোরাক হিসেবে গড়ে তুলতে হয় শিল্পকেন্দ্র। সংগীত, নৃত্য, ভাস্কর্য, নাটক ইত্যাদি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু এগুলো গড়ে তুলতে হলে দেশজ উপাদানের ওপর গড়ে তুলতে হয় ভিত্তিমূল। আমাদের এই নগরায়ণ দেশীয় না হয়ে বহুজাতিক করপোরেশন ও কোম্পানির শিকড়ে বাঁধা পড়েছে। ফলে লোকজ, দেশীয় উপাদানের অভাবে সেই সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে শিকড়বিহীন। এই আধ্যাত্মিকভাবে শিকড়হীন মানুষের পক্ষে দেশপ্রেম, উন্নত নৈতিক অবস্থা, রুচিবোধের জন্ম দেওয়া কঠিন।
সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সাধারণ মানুষের জীবনে সাম্যের একটা স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে পারত। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সেটি ধাক্কা খাওয়ার পর গণতান্ত্রিক আচরণও স্বৈরাচারী আচরণের দিকে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বলে রাখা ভালো, পাকিস্তান আমলে যে স্বাধিকার আন্দোলন হয়েছে, তাতে রাজনীতি আর সংস্কৃতি চলেছে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে। এরপর তা কোথায় হারিয়ে গেল, চলে গেল সবার অগোচরে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক শক্তি কি কিছু ভাবে?
৬. অর্থাৎ শিকড়বিহীন একটা সমাজ গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। প্রশাসনে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখে আসছেন, উপরি পাওনাটা জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নিজ দল ক্ষমতায় থাকার ফলে প্রতিভাবান কর্মীরা দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা এবং মানবসেবার বদলে বেছে নিচ্ছেন ঠিকাদারি। কারণ, তাঁরা জানেন, ভাগ্য ভালো থাকলে এই পেশায় এক নিমেষে কোটিপতি হয়ে যাওয়া সম্ভব।
আমাদের দেশের সরকারি কেনাকাটায় একটা ৫০০ টাকার বালিশের দাম ২২ হাজার টাকা হওয়াটা তাই কোনো ব্যাপার নয়। আমরা যে নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে থাকি, তা ব্যক্তিজীবনেই পালন করি না বলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের চিন্তার ফাঁকফোকরগুলো ধরে ফেলে। তাই পূর্ব-প্রজন্মের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা থাকে না। তারা বুঝতে পারে, নৈতিকভাবে অবক্ষয়িত এই পূর্ব-প্রজন্ম তাদের নৈতিক শক্তি দিতে পারে না। কিন্তু যে বলয়ের মধ্যে বসবাস, সেই বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকলে ওই ঘুষ আর দুর্নীতির পথই বেছে নিতে হয় তাদেরও। এই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঘুষ বা দুর্নীতির খবর আমাদের দেশে যে খুব একটা পাত্তা পায় না, তার একটি বড় কারণ হলো, সবাই মেনে নিয়েছে, এই ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। যদি নতুন কিছু করতে হয়, ঘাটে ঘাটে পয়সা গুনতে হবে। এমনকি যদি চাকরিজীবন শেষে পেনশনের টাকা তুলতে যাওয়া হয়, তাহলেও ঘুষ দেওয়াটাই রীতি।
আমাদের এই অঞ্চলে ঘুষের শুরু করেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস—এ রকম একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে। মীরজাফরের পত্নী মুন্নী বেগমের কাছ থেকে নাকি হেস্টিংস ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেন। মুন্নী বেগমের ছেলে নাজিমউদ্দৌলা ১৫ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেছিল।
কে প্রথম ঘুষ নিয়েছিলেন, সেটা খুব বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, সেই ঘুষপ্রথা অলিখিতভাবে আমাদের সমাজে ভিত্তি পেয়েছে। জরিপ হওয়া দরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঘুষখোরের সংখ্যা বেশি, নাকি সৎমানুষের সংখ্যা বেশি? অনেক সময় আমরা লক্ষ করেছি, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য ঘুষখোরদের কেউ কেউ বলে থাকেন, ‘আমি নিজে ঘুষ খাই না।
সিস্টেমে এমনিতেই আমার কাছে ঘুষের টাকা চলে আসে। আমি না নিলে বরং আমাকে একঘরে করে ফেলা হবে।’ কথাটা হাস্যকর শোনালেও এ কথার মধ্যে সত্যতা আছে। কোনো প্রতিষ্ঠান যখন বুঝতে পারে, এখানে ঘুষ নেওয়া হলে কেউ এসে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করবে না, তখন সেই প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই ঘুষের প্রচলন হতে পারে। আমাদের দেশে এই ঘুষপ্রবণতা যেন গণতন্ত্রের অঙ্গ হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের ভালো-মন্দ নিয়ে একটু কথা বলা বোধ হয় অসমীচীন হবে না।
২. আজকের লেখাটা একটু ভারী হয়ে যেতে পারে। তবে তার দরকার আছে। গণতন্ত্রকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আপাত পতনের পর গণতন্ত্রই নির্ভরযোগ্য শাসনব্যবস্থা হিসেবে টিকে আছে। কিন্তু দেখুন, রাষ্ট্রপতিশাসিত ও সংসদশাসিত দুই বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতে গণতন্ত্রের যে হাল, তাতে এই ‘তন্ত্র’ পরিবর্তিত হয়ে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, সেটাই ব্যথিত মনে দেখতে হয়। নরেন্দ্র মোদির গণতন্ত্রের সঙ্গে হিন্দুত্বের মিলন এখন ভারতের গণতন্ত্রকেই হুমকির মুখোমুখি করেছে। দেশভাগের আগে বা পরে জাতীয় কংগ্রেস যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলত, বর্তমান ভারত সেই জায়গা থেকে অনেক দূর সরে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র তো এলিট শ্রেণির কবজায় সেই কবে থেকেই বন্দী। পুঁজির বিকাশ হচ্ছে সেখানে, কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে গায়ের জোরে গণতন্ত্রী করতে গিয়ে কোটি কোটি টাকার অপচয় করছে তারা। ফলে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করতে হয়। আমাদের দেশে হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের পুনরাগমনের সময়টা হলো নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র কতটা কোন দিকে বিকশিত হয়েছে, সেই আলোচনা করা খুবই জরুরি।
৩. এরশাদের পতনের পর প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘুরেফিরে ক্ষমতায় এসেছে। একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সফলভাবেই নির্বাচন ও ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এরপর বিএনপির আমলে হঠাৎ করেই ইয়াজউদ্দিন-ম্যাজিক গোটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের চিন্তকেরা প্রশাসনের সর্বত্র নিজের লোকদের বসিয়ে নির্বাচনের নামে একটা প্রহসনের জন্ম দিতে চেয়েছিলেন। সেই সময়কার তীব্র উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল যে ফখরুদ্দীন আহমদের কেয়ারটেকার সরকার, তারাও নানাভাবে সমালোচিত হয়েছিল। এরপর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে।
আমরা দেখতে পেয়েছি, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য নানা চেষ্টা করে এসেছে। আমরা এ-ও দেখেছি, ক্ষমতায় এসে সমাজ থেকে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, ঘুষ ইত্যাদি নির্মূল করার প্রতিজ্ঞা করেছে সেনাসমর্থিত কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর হয় তারা নিজেরাই যুক্ত হয়ে গেছে এই সব অসৎ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অথবা কেউ এই অসৎ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হলে তার শাস্তির ব্যবস্থা করেনি। বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে আইনের শাসন শিথিল হয়ে পড়ে, একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী অপরাধ করতে থাকে এবং বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বের প্রভাবে পার পেয়ে যায়—এটা সর্বত্রই দেখা যায়। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
এ কারণেই সমাজের ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়তে থাকে, বুদ্ধিজীবীশ্রেণির বড় অংশটাই হয়ে ওঠে ক্ষমতার তাঁবেদার, সরকারও বিভিন্ন প্রকল্প গড়ে প্রতিবাদী মেধাবীদের ‘উপহার’ দিয়ে তাঁদের হাতে রাখে। আর আইনশৃঙ্খলা? সেটা ‘যেমনে নাচাও তেমনে নাচি, পুতুলের কী দোষ’ বলে নিজের দোষ ঢেকে রাখার প্রয়াস নিতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
৪. বৃহৎ এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও অনেক কিছুই ধরে ধরে বলার থাকতে পারে। কিন্তু আজকের আলোচনায় সেদিকে যাব না। গণতন্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায় যে আপদটি বড় করে বাসা বেঁধেছে, তা নিয়েই এখন বলব। ওপরে যা বলা হলো, তার কারণগুলো হয়তো এই আলোচনায় পাওয়া যেতেও পারে। এই আলোচনা আমাদের গণতন্ত্রের দৈন্যদশা নিয়ে খানিকটা ভাবতে সাহায্য করবে বলে আমার ধারণা।
দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তান পর্যায়ের নিরন্তর আন্দোলনের কথা কমবেশি সবাই জানেন। সেই সময়টা পেরিয়ে এসে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যখন জন্ম হলো, তখন যা দেখা গেল, তা থেকেই কথার শুরু হোক। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দেশের নাম পরিবর্তন হয়ে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলো, তা ছিল অর্থনৈতিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত এক দেশ। ভেঙে পড়া অর্থনীতির দেশটার হাল ধরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিছুদিন বাদেই ছাত্রলীগে এল ভাঙন, তৈরি হলো জাসদ। ডান-বামের প্রবল বিরোধিতার মধ্য দিয়ে পথ কেটে এগিয়ে যেতে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারকে। পাকিস্তানি দালালেরাও করছিল সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র।
এই বিভিন্ন আক্রমণের মধ্যেই আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগেও নৈতিক স্খলন দেখা গেছে। দিনে দিনে বঙ্গবন্ধু একা হয়ে যেতে থাকলেন। শেখ মুজিব-তাজউদ্দীন বন্ধনটিও থাকল না। সে এক অস্থির সময়ে সমাজতান্ত্রিক পথ বেছে নিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বাকশাল গঠনের পরপরই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে তিনি নিহত হলেন।
এই ইতিহাস নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার কারণ হলো, সামরিক সরকার দেশের ক্ষমতা নেওয়ার পর জিয়াউর রহমানের সরকার নব্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা শুরু করেছিল। একধরনের পুঁজিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল তাতে। অনভ্যস্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে এই নতুন পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছিল শক্ত। তার ফল হয়েছিল কী?
৫. পুঁজিবাদের উত্থান মানেই বিপুল নগরায়ণ বা নগরসভ্যতার দিকে যাওয়া। ইউরোপে দেখা গেছে, নগরায়ণের ফলে গ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ শহরে চলে আসে। কাজ নেয় কারখানায়। তাদের মনে গ্রামীণ সংস্কৃতির জায়গায় শহুরে সংস্কৃতি জায়গা করে নিতে থাকে।
নগরসভ্যতা হচ্ছে শিল্প বিকাশের সঙ্গে যুক্ত জীবনধারার শৈল্পিক রূপ। চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রেও শীলিত পরিবর্তন আসে তাতে। শিল্পের উন্নতিকে বাধাহীন করতে হলে প্রয়োজন পড়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের। রক্ষণশীল পশ্চাৎপদ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার দরকার হয়। ফলে তখন গড়ে তুলতে হয় নয়া নয়া জ্ঞানকেন্দ্র। গড়ে তুলতে হয় শিক্ষাব্যবস্থা। যে শিক্ষা জীবনে কাজে লাগে, সেই শিক্ষাকেই তুলে আনতে হয়। আর শহুরে মানুষের বিনোদনের খোরাক হিসেবে গড়ে তুলতে হয় শিল্পকেন্দ্র। সংগীত, নৃত্য, ভাস্কর্য, নাটক ইত্যাদি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু এগুলো গড়ে তুলতে হলে দেশজ উপাদানের ওপর গড়ে তুলতে হয় ভিত্তিমূল। আমাদের এই নগরায়ণ দেশীয় না হয়ে বহুজাতিক করপোরেশন ও কোম্পানির শিকড়ে বাঁধা পড়েছে। ফলে লোকজ, দেশীয় উপাদানের অভাবে সেই সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে শিকড়বিহীন। এই আধ্যাত্মিকভাবে শিকড়হীন মানুষের পক্ষে দেশপ্রেম, উন্নত নৈতিক অবস্থা, রুচিবোধের জন্ম দেওয়া কঠিন।
সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সাধারণ মানুষের জীবনে সাম্যের একটা স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে পারত। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সেটি ধাক্কা খাওয়ার পর গণতান্ত্রিক আচরণও স্বৈরাচারী আচরণের দিকে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বলে রাখা ভালো, পাকিস্তান আমলে যে স্বাধিকার আন্দোলন হয়েছে, তাতে রাজনীতি আর সংস্কৃতি চলেছে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে। এরপর তা কোথায় হারিয়ে গেল, চলে গেল সবার অগোচরে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক শক্তি কি কিছু ভাবে?
৬. অর্থাৎ শিকড়বিহীন একটা সমাজ গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। প্রশাসনে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখে আসছেন, উপরি পাওনাটা জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নিজ দল ক্ষমতায় থাকার ফলে প্রতিভাবান কর্মীরা দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা এবং মানবসেবার বদলে বেছে নিচ্ছেন ঠিকাদারি। কারণ, তাঁরা জানেন, ভাগ্য ভালো থাকলে এই পেশায় এক নিমেষে কোটিপতি হয়ে যাওয়া সম্ভব।
আমাদের দেশের সরকারি কেনাকাটায় একটা ৫০০ টাকার বালিশের দাম ২২ হাজার টাকা হওয়াটা তাই কোনো ব্যাপার নয়। আমরা যে নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে থাকি, তা ব্যক্তিজীবনেই পালন করি না বলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের চিন্তার ফাঁকফোকরগুলো ধরে ফেলে। তাই পূর্ব-প্রজন্মের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা থাকে না। তারা বুঝতে পারে, নৈতিকভাবে অবক্ষয়িত এই পূর্ব-প্রজন্ম তাদের নৈতিক শক্তি দিতে পারে না। কিন্তু যে বলয়ের মধ্যে বসবাস, সেই বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকলে ওই ঘুষ আর দুর্নীতির পথই বেছে নিতে হয় তাদেরও। এই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২২ মিনিট আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগে