প্রসঙ্গ: শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

সিদ্দিক বেলাল
প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০: ১৬

স্বাধীনতার অর্ধ শতবর্ষ উদ্‌যাপনের পরেও আমরা সাধারণ মানুষ নিজ দেশে চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন বলতে পদ্মা সেতু বা মেট্রোরেল ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাই না। সরকার বা সমাজ থেকে কিছু না পেতে পেতে কিছু আশা না করায় আমরা অভ্যস্ত। ইতিবাচক ও নেতিবাচক চিন্তা করতে পারার ক্ষমতা সব মানুষেরই কম-বেশি থাকে। তবে রাষ্ট্র ও সরকারের ভালো কোনো উদ্যোগে কোনো সম্ভাবনার আলো না খুঁজে আমরা চ্যালেঞ্জ ও আশঙ্কার দিকগুলোই খুঁজতে থাকি। অন্যদিকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বিশেষ করে বিরোধীদলীয় রাজনীতি সর্বদাই নেতিবাচক মনোভাব উসকে দেয়। সরকারের বড় ধরনের বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা আমরা বিশ্বাসই করি না, ছোটখাটো কোনো ভালো কাজও আমরা সন্দেহের চোখে দেখি।

সমাজের অগ্রগামী, জ্ঞানী ও প্রগতির পক্ষের মানুষও যখন ভালো কাজগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখেন, তখন এই সব কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। তাঁদের মধ্যে কারোর আবার ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডা থাকে, থাকে নিজ ক্যারিয়ার কিংবা রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক দলীয় স্বার্থচিন্তা। সরকারের বড় কোনো উদ্যোগে আমজনতার আস্থাহীনতায় কাজটি বাধাগ্রস্ত হয় না। কিন্তু ‘জ্ঞানীজন’দের বিরূপ ভাবনা তো কেবল তাঁদের নিজ নিজ ভাবনায় সীমাবদ্ধ থাকে না। সমালোচনা ছিদ্রানুসন্ধানে রূপ নেয়, সমাজে সক্রিয় বিরুদ্ধ পক্ষ তৈরি হয়। কিছু মানুষ যখন সবাইকে ভালো কোনো পথের সন্ধান দিতে রাস্তায় নামেন, তখন এই পক্ষ এগিয়ে চলার রাস্তা নানাভাবে কণ্টকাকীর্ণ করতে থাকে। সাধারণ মানুষের সন্দেহ বা অসহযোগ হয়তো সম্ভাবনাময় পরিকল্পনাটির বাস্তবায়নকালকে প্রলম্বিত করে, আর প্রগতিবাদী নামধারী বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিদের অবিশ্বাস বাস্তবায়নকে দুর্গম বা অসম্ভব করে তোলে।

গত এক শতাব্দীতে সারা বিশ্বেই অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি মানব সংস্কৃতির ভিন্ন দিকে মোড় নেওয়ার কথাও শোনা যায়। এই যুগ ফেসবুক, ইউটিউব এবং মানবসভ্যতার নিয়ামক-নিয়ন্ত্রক হলো ভোক্তা। কৌতুক আর ভাঁড়ামিতে (বিকৃত বা অশ্লীলতাপূর্ণ হলেও) কোনো পার্থক্য নেই, সেবামূলক বা সমাজসংস্কারের কাজগুলোও এখন ব্যক্তির জীবিকার উপায়। ফলে বড় কোনো লক্ষ্যে এগিয়ে চলায় বিপদের ধরনটা একটু আলাদা প্রকারের।

এ বছর সারা দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশের গণশিক্ষায় গুণগত পরিবর্তনের যে সম্ভাবনা তৈরি হলো, তার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা থামিয়ে দেওয়ার, অন্তত কিছু হলেও ক্ষতি করার সামাজিক উদ্যোগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পত্রপত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং টেলিভিশনের পর্দায়। সঙ্গে আছে বরাবরের মতো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির ধর্মকে হীন দলীয় স্বার্থে কাজে লাগানোর বহুরূপী চেহারার ষড়যন্ত্র।

নতুন এই শিক্ষাক্রমের প্রধান দিক হলো লার্নিং-টিচিং কর্মকাণ্ডে শিক্ষকনির্ভরতা অনেক কম, পাঠ্যপুস্তকনির্ভরতাও কম। এই শিক্ষাক্রমকে তিনটি ধাপে দেখা হলে এ কথার অর্থ স্পষ্ট হতে পারে।

প্রথম ধাপটি হলো পদ্ধতির দিক থেকে এই শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক—প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি পাঠ নির্দিষ্ট হয় পূর্বনির্ধারিত একটি পারদর্শিতার লক্ষ্য অর্জনের ভিত্তিতে। এখানে যোগ্যতার অর্থ জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি। লক্ষণীয় যে কেবল জ্ঞান বা কেবল দক্ষতা নয়, কিংবা জ্ঞান-দক্ষতা নয়, আরও কিছু। দ্বিতীয়ত, শিক্ষণ-শিখন-প্রক্রিয়া অভিজ্ঞতানির্ভর। যে যোগ্যতাকে লক্ষ্য করে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ ও অ্যাকটিভিটি নির্দিষ্ট হয়, তা সরাসরি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী আত্মস্থ করবে। শিক্ষক এখানে ‘শিক্ষাকর্মী’ বা ফ্যাসিলিটেটর, তিনি কেবল শিক্ষার্থীকে অভিজ্ঞতার মধ্যে ফেলে দেওয়ার আয়োজন করবেন। ফলে শিশু পাঠ (পড়ার চেয়ে করা বেশি) মুখস্থ না করে অনুধাবন ও ধারণ করতে পারবে। এককথায় পরিবর্তনটা মৌলিক, শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষালয়ের শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষালয়ের রূপান্তর। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী শেখার চেয়ে শিখতে শেখে অনেক বেশি। এভাবে একটি একটি করে যোগ্যতা ধরে সারা বছরের শিখন-প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে। তৃতীয়ত, মূল্যায়নপদ্ধতির লক্ষ্য শিক্ষার্থী, কিন্তু বিষয় হলো সিস্টেম। যোগ্যতাগুলোর কতটুকু শিক্ষার্থী অর্জন করতে পেরেছে, তা বহুমাত্রিক নির্দেশকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। সেই মূল্যায়নপত্র লেখা হবে কথায়, যেখানে কোনো নম্বর বা গ্রেডিং থাকবে না। পরিকল্পনা রয়েছে এই পদ্ধতির মাধ্যমে পুরো সিস্টেমের (শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাব্যবস্থার আয়োজক প্রতিষ্ঠান ও অধিদপ্তর, এমনকি মন্ত্রণালয় অবধি) মূল্যায়ন করার আয়োজন থাকবে।

একটা কথা প্রায়ই ঢালাওভাবে বলা হয়, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা কিছুদিন পর পর বদলানো হয়, শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো হয়। প্রকৃতপক্ষে পাঠ্যের পরিবর্তন হয়েছে, শ্রেণিবিন্যাসের পরিবর্তন হয়েছে, প্রশাসনিক পরিবর্তন হয়েছে বিস্তর কিন্তু পদ্ধতিগত পরিবর্তন মোটেই হয়নি। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি গুরুগৃহ, টোলপদ্ধতি ইত্যাদি বাদ দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রচলন করেছিল। সেই থেকেই গণশিক্ষার যাত্রা। প্রায় ২০০ বছরের ওই পদ্ধতির কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি, অন্তত প্রারম্ভিক থেকে প্রাক্‌-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত। অক্ষর ও গণনা শিখে নির্দিষ্ট কতগুলো পাঠ মুখস্থ করে বছর শেষে উত্তরপত্রে উদ্‌গিরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশপত্র সংগ্রহ অথবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি টানাই আমাদের দেশের গণশিক্ষা। এর একটি সহজ দৃষ্টান্ত হলো—কিছুকাল আগে প্রবর্তিত সৃজনশীল পদ্ধতি। শিক্ষাপদ্ধতি বা শিক্ষাক্রমের সামগ্রিক পরিবর্তন না করে তা চালু করা হয়েছিল। পাঠ ও মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিক রেখে কেবল প্রশ্ন তৈরি করার পদ্ধতিগত পরিবর্তন করা হয়েছিল। আর ব্যর্থ হয়েছে সে কারণেই, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে নয়। মনে রাখতে হবে, চলমান শিক্ষাব্যবস্থা জাদুঘরে সংরক্ষণের পর্যায়ে—অ্যান্টিক বিবেচনায় জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করে রক্ষা করার বিষয়, কিন্তু এতে জাতি শিক্ষিত হবে না। এই পদ্ধতিতে এনরোলমেন্ট বাড়িয়ে ও ঝরে পড়া বন্ধ করে সমগ্র জাতিকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে। এত দিন রাষ্ট্রীয় অ্যাজেন্ডা এই পর্যায়েই ছিল। শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন ছাড়া এসডিজি অর্জনে আর কোনো পথ খোলা নেই। চলমান শিক্ষাপদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলে নতুন করে গড়তে হবে, আমরা বলব শিক্ষায় রূপান্তর, পরিমার্জন-পরিশোধন নয়—স্থাপনাটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ, মেরামত নয়।

নানা ধরনের প্রচারের মাধ্যমে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জের প্রসঙ্গ আলোচিত হওয়া প্রয়োজন। পাঠ্যবইয়ের ভুল ধরার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন শিক্ষকের নিরুদ্বিগ্ন জীবনযাপনের নিশ্চয়তা, একটি ভালো স্কুলঘর, উপকরণসমৃদ্ধ ক্লাসরুম আর চল্লিশ জনে একজন হিসাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত। নতুন বইগুলোর ভুল নিয়ে যে তোলপাড় চলছে, তার অনেকটাই সোশ্যাল মিডিয়ার বৈশিষ্ট্যজনিত কারণে। রাজনৈতিক বা দলীয় স্বার্থ জড়িয়ে থাকে অনেক সময়, থাকে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিগত বৈচিত্র্য। এখন পর্যন্ত কোনো ভুলই মৌলিক ভুল নয়, অনৈতিকতার প্রশ্ন জড়ানোর মতো নয়। আমরা সবাই কি ভাবতে পারি না, একটা কাজ তো শুরু হলো, আমরা আর কী কী ভাবে এই কাজটাকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখতে পারি?

সিদ্দিক বেলাল, শিক্ষক, সহজপাঠ উচ্চবিদ্যালয় এবং লেখক দলের সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত