নিরাপদ প্রজননক্ষেত্র নেই হক্সবিল-গ্রিন কচ্ছপের

মাইনউদ্দিন শাহেদ, কক্সবাজার
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪, ০৮: ৫৯

বঙ্গোপসাগরের পাঁচ প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে বিচরণ আছে তিন প্রজাতির। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই তিন প্রজাতির মধ্যেও অলিভ রিডলি বা জলপাইরঙা কচ্ছপ ছাড়া হক্সবিল বা ভূত কচ্ছপ এবং গ্রিন টার্টল বা সবুজরঙা কচ্ছপের দেখা মিলছে না। 

চলতি প্রজনন মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ) সৈকতের বালিয়াড়িতে শুধু অলিভ রিডলিরই ডিম পাড়তে আসার তথ্য রয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছে। সমুদ্রবিজ্ঞানী ও গবেষকেরা মনে করছেন, কক্সবাজারসহ দেশের সমুদ্র উপকূলে কচ্ছপের প্রজননক্ষেত্র অনিরাপদ ও ধ্বংস হওয়া এবং ওই দুই প্রজাতির আচরণ ভিন্ন হওয়ায় এরা আর আসছে না। 

সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও গবেষণায় জড়িত সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবশেষ ছয় বছর আগে মহেশখালীর মাতারবাড়ী উপকূলে একটি হক্সবিল এবং তিন বছর আগে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি গ্রিন টার্টল দেখা গেছে। এর মধ্যে এ দুই প্রজাতির কচ্ছপ সৈকতে ডিম পেড়েছে কি না, তা-ও সংশ্লিষ্টদের জানা নেই। হক্সবিল ও গ্রিন টার্টল নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো গবেষণাও দেশে হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা। 

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে ৯৫টি মৃত কচ্ছপ ভেসে এসেছে। আর চলতি প্রজনন মৌসুমে জীবিত আসা ১১৬টি স্ত্রী কচ্ছপ থেকে প্রায় ১৪ হাজারের মতো ডিম সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে ফোটানোর জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। সব কটিই অলিভ রিডলি প্রজাতির। জরিপ অনুযায়ী তিন প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে অলিভ রিডলি ৯৮ শতাংশ।

ছয় বছরের মধ্যে জীবিত কোনো হক্সবিল দেখা যাওয়ার তথ্য নেই জানিয়ে তরিকুল ইসলাম বলেন, ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি সুন্দরবনের দুবলার চরে এবং ১৪ জানুয়ারি সেন্ট মার্টিনে দুটি মৃত হক্সবিল ভেসে এসেছিল।

কক্সবাজার উপকূলে ২০ বছর ধরে কচ্ছপ সংরক্ষণে কাজ করছে নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। নেকমের উপপ্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমানও একই তথ্য জানিয়ে বলেন, হক্সবিল ও গ্রিন টার্টলের ডিম পাড়ার রেকর্ড তাঁদের কাছে নেই। 

দীর্ঘদিন ধরে গ্রিন টার্টল ও হক্সবিল কেন দেশের সমুদ্র উপকূলে ডিম পাড়তে আসছে না, তা নিয়ে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, হক্সবিল ও গ্রিন টার্টলের আচরণ ভিন্ন। এই দুই প্রজাতির কাছিম যেখানে বাসা তৈরি নিরাপদ মনে করে, সেই সৈকতেই ডিম পাড়তে যায়। 

বেলাল হায়দর বলেন, অপরিকল্পিত পর্যটন ও স্থাপনা, বনায়ন, কুকুর-শিয়ালের আক্রমণ, বালিয়াড়ি ধ্বংস, সমুদ্রতীরে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহারসহ মানুষের নানা অসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে কাছিমের নিরাপদ ডিম পাড়ার স্থান বিনষ্ট ও হুমকির মুখোমুখি হয়েছে।

তা ছাড়া সাগরে টানা জাল, ভাসান জাল, কারেন্ট জাল এবং ঘোস্ট নেট বা পরিত্যক্ত জালের কারণে প্রজননক্ষেত্র অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। অলিভ রিডলিকে প্রাকৃতিক কারণেই নিজ জন্মভূমিতে ডিম পাড়তে আসতে হয় বলেই সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে এই উপকূলে এসে ডিম পাড়ে। কিন্তু হক্সবিল ও গ্রিন টার্টলের এই প্রবণতা নেই বলে তারা অনিরাপদ পরিবেশ এড়িয়ে চলে। 

বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে সামুদ্রিক জলজ প্রাণীও দেখভালের দায়িত্ব বন বিভাগের। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সারওয়ার আলম বলেন, হক্সবিল ও গ্রিন টার্টল বিপন্ন প্রাণী হিসেবে সংরক্ষিত। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে এদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিপন্ন সামুদ্রিক প্রাণী রক্ষায় আরও যত্নশীল ও গভীরে গিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। 

সম্প্রতি ব্যাপকভাবে সামুদ্রিক কচ্ছপ মারা পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এই সমুদ্রবিজ্ঞানী বলেন, কচ্ছপের বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র এবং বাধাগুলো চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানো ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে হক্সবিল ও গ্রিন টার্টল এই উপকূলে বাধা পেয়ে অন্য কোনো উপকূল বেছে নিয়েছে কি না, তা-ও অনুসন্ধান করে দেখা দরকার বলে মনে করেন ড. ওয়াহিদুল আলম।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত