ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামলা: কঠোর শাস্তি পাবে কি

এ কে এম শামসুদ্দিন
Thumbnail image

সম্প্রতি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বা জামুকার সুপারিশে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সারা দেশে প্রায় ৮ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করেছে। দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি তাদের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা জামুকায় পাঠায়। যাচাই-বাছাইকালে ভুয়া প্রমাণিত হওয়া ৮ হাজার জনের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০০২ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে যেসব নাম মুক্তিযোদ্ধাদের বেসামরিক গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল, এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের আগে যেসব মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় আসেনি, সরকার তাঁদের আবেদনের সুযোগ দিলে সারা দেশ থেকে অসংখ্য আবেদন জমা পড়ে। সেই আবেদনে আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম তালিকাভুক্তির আবেদন করেছিলেন। ২০১৫-১৬ সালে আবেদনগুলোর যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়েছিল। সেই সময়ও নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ হাজির করতে না পারায় কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতার আবেদন বাতিল করা হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল এমন একটি যুদ্ধ, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সব কার্যক্রম রেকর্ড করার কোনো সুযোগ ছিল না। এ ধরনের যুদ্ধে এমনই হয়ে থাকে। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে কতজন অংশগ্রহণ করেছিলেন, এর প্রকৃত হিসাব রাখা সম্ভব হয়নি। তবে যুদ্ধে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর স্বাক্ষরযুক্ত সনদ তাঁদের দেওয়া হয়েছিল। তখন সনদ ছিল, কিন্তু কোনো ভাতা ছিল না। ২০১৪ সাল থেকে ভাতা দেওয়া শুরু হয়েছে। এই ভাতা ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বর্তমান সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জারি করা এক আদেশে বলা হয়েছিল, ‘মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সংগঠিত দলের সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।’ কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন এমন মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন প্রবাসী সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিতে যেসব শিল্পী-সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অবদান রাখা ব্যক্তিরাও। ফলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে। এ পর্যন্ত ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞাও নির্ধারণ করা হয়েছে অনেকবার। তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়সের সীমাও কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে।

মিথ্যা তথ্য হাজির করা, এনআইডি সংশোধন, মা-বাবার নাম পরিবর্তন, বয়স ও যুদ্ধক্ষেত্রের সাক্ষ্যে কারসাজি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের দ্বারা সুপারিশসহ নানা ধরনের ছলচাতুরী করে কৌশলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠিয়ে ধরা পড়া এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সব ভুয়া সনদসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। এত দিন যে মাসিক ভাতা পেতেন, তা-ও কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হলেও মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন ও প্রতারণা করে সনদ নেওয়ার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে এত দিন কোনো মামলা হয়নি। এমনকি এত দিন তাঁরা যে সরকারি নানা সুবিধাসহ ভাতা নিয়েছেন, তা ফেরত নেওয়ার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী জানিয়েছেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

মামলা হলেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এত দিন যে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন, তা আদায়ের বিষয়ে সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত আমরা জানতে পারিনি। তাঁরা যে সরকারের কাছ থেকে ভাতা নিয়েছেন, সেই অর্থও ফেরত আনতে হবে। এমনকি এসব প্রতারকের মধ্যে কেউ মারা গিয়ে থাকলে তাঁদের পরিবারের সুবিধাভোগী সদস্যদের কাছ থেকে সেই অর্থ আদায়ে ব্যবস্থাও করতে হবে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে তাঁদের যেসব ছেলেমেয়ে বা পরিবারের সদস্যরা সরকারি কোনো সুবিধা নিয়েছেন বা চাকরি করছেন, তাঁদের সেই সুবিধা দেওয়া বন্ধসহ চাকরি থেকে বের করে দিত হবে। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধ না করেও কীভাবে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় এলেন, এর সঙ্গে কারা জড়িত, তাঁদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

২০১৪ সালেই পাঁচজন সচিবের মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়। এই পাঁচ আমলা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায়, তখন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। তদন্ত শেষে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত এই পাঁচ সচিবের সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক। দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, যাঁদের বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, তাঁরা কেউই সঠিক নিয়মে সনদ নেননি। দুদক অবশ্য ভুয়া এই মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছিল। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার কোনো সুপারিশ করা হয়নি। মামলার সুপারিশ না করার পেছনে দুদক তখন এক অদ্ভুত যুক্তি উপস্থাপন করেছিল। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক থেকে তখন বলা হয়েছিল, ‘দোষী সাব্যস্ত এসব সচিব সঠিক নিয়মে মুক্তিযোদ্ধা সনদ না নেওয়ার প্রমাণ মিললেও তাঁরা যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, সে বিষয়ে প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি।’ 

প্রশ্ন হচ্ছে, সঠিক নিয়মে সনদ না নিলে সেই সনদ হয়তো বাতিল হতে পারে; কিন্তু তাঁরা যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাই হতেন, তাহলে তো তাঁদের মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় বাতিল হতে পারে না। পরে পুনরায় আবেদন করে সঠিক নিয়মেই তাঁরা মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিতে পারতেন। এ ঘটনা নিয়ে যখন চারদিকে আলোচনা চলছিল, তখন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাই বলেছিলেন, সেই সময় এসব সচিব সরকারের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন বিধায় দুদক তাঁদের ইজ্জত রক্ষার্থে এমন অদ্ভুত বক্তব্য দিয়েছিল। আসলে দুদক ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র চেষ্টা করছিল। অথচ তখন জামুকার সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, ‘এই শীর্ষ পাঁচ সরকারি কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারেননি। যে চার ক্যাটাগরির ভিত্তিতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত করা হয়, সেগুলোর আওতায়ও তাঁরা পড়েননি।’ শোনা যাচ্ছে, এসব ব্যক্তির অনেকেই বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রণালয় কি এখন তাঁদের বিরুদ্ধেও মামলা করবে? তাঁরা যদি বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করে থাকেন, তাহলে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিয়ে তাঁরা যে বর্ধিত সময় সরকারি চাকরি করেছেন, সরকারের যে বেতন-ভাতা নিয়েছেন, তা আদায় হবে কীভাবে?

প্রতারণা ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারি সুবিধা ভোগ করা অপরাধ। ফৌজদারি আইনের ৪১৬ ধারা অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিলে তা-ও ফৌজদারি অপরাধ। এ জন্য নির্ধারিত শাস্তির বিধানও আছে। মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য ৩ বছরের কারাবাস এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলে ৭ বছর পর্যন্ত কারাবাস হতে পারে। একই সঙ্গে অর্থদণ্ডও দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের আদালতগুলো এমনিতেই মামলার ভারে এক জটিল অবস্থার মধ্যে আছেন। এ কারণে যেকোনো মামলার চূড়ান্ত রায় পেতে পেতে অনেক সময় চলে যায়। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এর চূড়ান্ত মীমাংসা পেতে অনেক সময় লেগে যাবে। এ কারণে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি যে সুবিধা ভোগ করেছেন, তা ফেরত পেতেও অনেক সময় লাগবে।

এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাঁরা নিজের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাতে পারেননি; বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকেই এই তালিকায় নাম লেখাতে পারেননি। ফলে সরকারের দেওয়া ভাতাসহ সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কোনো চিন্তাভাবনা আছে কি না, জানা যায়নি। একাত্তরের অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাই আজ বয়সের ভারে সুষ্ঠু জীবন ধারণ করতে পারছেন না। অবহেলা, অনাদর ও মর্যাদাহীন জীবন যাপন করছেন। অথচ তাঁদের স্বপ্নে, সাহসে আর ত্যাগ ও অবদানে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন যাঁরা চেতনার কথা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বলে স্বাধীনতার সুফলভোগীরা একবারও কি ভেবে দেখেছেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ তাঁরা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁদের কাছে নিবেদন, যেসব ব্যক্তি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যেন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। তাহলেই তাঁদের প্রতি প্রকৃত সম্মান জানানো হবে।

লেখক: এ কে এম শামসুদ্দিন,অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত