Ajker Patrika

পয়লা বৈশাখের মুক্তি চাই

স্বপ্না রেজা
আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০৯: ৪২
পয়লা বৈশাখের মুক্তি চাই

পয়লা বৈশাখ বাংলা ও বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব। সব ধর্মের মানুষের কাছে এটি একটি সর্বজনীন উৎসব। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবারই থাকে বিশেষ প্রস্তুতি উৎসব উদ্‌যাপনে। বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক যেন এই দিনটি। বিশেষত দিনটি রঙিন হয়ে ওঠে বাঙালি পোশাকে-আশাকে, আয়োজনে এবং আপ্যায়নে।

বাংলা বছরের এই দিনে জ্ঞানে, অজ্ঞানে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই যেন বাঙালি হয়ে ওঠে। বাহারি রঙের মোড়কে আবৃত হয়। বিষয়টি উৎসবভিত্তিক হলেও বাঙালিয়ানার এতটা স্বাক্ষর বা দৃশ্যমান নমুনা থাকে যে, বছরের অন্য দিনগুলোতে কিংবা অন্য কোনো উৎসবে তা খুঁজে পাওয়া যায় না। এককথায়, অন্যান্য উৎসব থেকে পয়লা বৈশাখ স্বাদে, বর্ণে, রূপে আলাদা। বাঙালি জাতির স্বকীয়তার সব রূপ, গন্ধ ও মহিমা একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া যায় এই পয়লা বৈশাখে। মাটির কাছে, নিজস্বতার কাছে ছুটে যাওয়ার এক মধুর মাদকতার জন্ম হয়। বেজে ওঠে সুরমূর্ছনা—আমি বাঙালি, বাংলা আমার মা! কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে পয়লা বৈশাখ বিধিনিষেধের কারাবন্দী। তার অপরাধ, পুরোটাই বাংলা সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য; যা কারও কারও কাছে অসহনীয়।

কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক, এটা সত্য যে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নেপথ্যে বাংলা সংস্কৃতির উদার চর্চার দাবি বড় ভূমিকা রেখেছিল। স্বাধীনতার তীব্র বাসনাই ছিল বাংলা ও বাঙালির মুক্তি। পয়লা বৈশাখ যেন বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশের সব মানুষকে একই সারিতে এনে দাঁড় করায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালিপনায় উচ্ছ্বসিত হওয়ার আহ্বান জানায়। যারা পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন করে অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গুরুত্ব দেয় না, তাদের বড় ভুলটা যেন এখানেই হয়।

কারণ, পয়লা বৈশাখ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কমবেশি প্রায় সবাই অবগত যে বাংলাদেশে বাংলাবিরোধী একটা শ্রেণি আজও রয়ে গেছে, যারা কখনোই চায়নি বাঙালি জাতি একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে বসবাস করুক। তাদের কাছে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের ব্যাখ্যা ভিন্নতর। এককথায়, ধর্মীয়ভাবে তারা পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনকে দীর্ঘদিন ধরে নিরুৎসাহিত করে আসছে। রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণার মতো। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাঙালি পোশাকে আবৃত হয়ে মনে-প্রাণে অবাঙালি একটা শ্রেণি পয়লা বৈশাখের বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে এবং তা-ও আবার রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়।

এই শ্রেণি-গোষ্ঠী প্রচার করে—পয়লা বৈশাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব! ইসলামের ধর্মীয় লেবাসে এমন প্রচারণায় বিভিন্ন সময়ে তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।নাশকতার ঘটনা ঘটায়। সমাজে, জনমনে ভীতি সঞ্চার করার কৌশল অবলম্বন করে। যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, তারা তো এমন কৌশল অবলম্বন করবেই, অনেকে সেটাই মনে করে। কিন্তু রাষ্ট্র কেন এই উৎসব উদ্‌যাপনে বিধিনিষেধ আরোপ করবে? মঙ্গল শোভাযাত্রা পয়লা বৈশাখের একটা অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ও বৈশিষ্ট্য, যার মূলে রয়েছে শান্তি আর ঐক্যের বারতা। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়েও কম সমালোচনা ও বিরোধিতা হয়নি।

আজও হচ্ছে। আর রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব বাংলা ও বাঙালিয়ানার চেতনাকে কতটা সমৃদ্ধ ও শক্তি জুগিয়ে আসছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি বাঙালি, বাংলা আমার মাতৃভাষা—এমন সত্য বুকে ধারণ করে মানুষ তাই ছুটে যায় রমনার বটমূলে। বিরোধিতাকারীরা তাই ছায়ানটের উৎসবে বোমা বিস্ফোরণের নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছিল। বাংলা ও বাঙালি জাতিসত্তার বিরোধিতাকারীরাই যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, এ কথা আর কারও কাছে অস্পষ্ট নেই।

দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার এই অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করার অজুহাতে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনে সর্বসাধারণের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে দিয়েছে। কিন্তু এই বিধিনিষেধে কার বিজয় হলো বা হচ্ছে, তা কেউ ভাবল না। একদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, জঙ্গিবাদের প্রতি জিরো টলারেন্স ঘোষণা, অন্যদিকে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ—‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ যেন। স্ববিরোধী তো বটেই।

অথচ এই উৎসবে বাঙালি তার প্রাণের সব উচ্ছ্বাস ঢেলে দেবে এবং তা যতক্ষণ তার ইচ্ছা থাকে, স্বপ্ন থাকে, তাতে কেন বিধিনিষেধের যতিচিহ্ন টেনে দিতে হবে? পায়ে বেড়ি বেঁধে দেওয়া কেন? এটা কী অপশক্তির ভয়, নাকি অপশক্তির অস্তিত্বকে মেনে নেওয়ার পাঁয়তারা কিংবা নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার অজুহাত? যদি ভয় হয়, তাহলে কীই-বা বলার থাকে? শুধু বলা যায়, সাহসীরা সম্পৃক্ত হোক। আর যদি অপশক্তির অস্তিত্বকে মেনে নেওয়ার পাঁয়তারা হয়, তাহলে বলতে হয়, সরকারের ভেতরেই হয়তো একটা শ্রেণি ঘাপটি মেরে রয়েছে, যারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, ধর্মীয় উগ্রপন্থী। সম্ভবত কারও কাছে সেই বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠছে না কিংবা হলেও গায়ে মাখছে না। আর যদি নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার অজুহাত হয়, তাহলে বলতেই হয়, অপশক্তির ঝুঁকির চেয়েও এই অজুহাতের ঝুঁকি বেশি ভয়াবহ ও ক্ষতিকর এবং সেটা অস্তিত্বের বিপন্নতার শামিল।

জাতির নিরাপত্তা দেওয়ার অজুহাতে নিজস্ব সংস্কৃতির আচার, অনুষ্ঠান ও উৎসব জাতি তার যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণ করতে পারবে না—এমন বিধিনিষেধ আরোপ জাতির সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে বৈকি। পয়লা বৈশাখ তো আর থার্টি ফার্স্ট নাইট নয়, যেখানে পাশ্চাত্যের উচ্ছৃঙ্খলতার আদলে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সুযোগ বা আশঙ্কা থাকে। অনেকের মনে প্রশ্ন, এই বিধিনিষেধ আদতে কাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে? তাদের নয় কি, যারা চায় না বাঙালি সংস্কৃতি কিংবা বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অটুট থাকুক? এতে কি রাষ্ট্রে এ-জাতীয় অপশক্তি জিইয়ে রাখতে সহায়ক হচ্ছে না? হয়তো হচ্ছে এবং সবাই কিন্তু তা কমবেশি বুঝি।

এই অপশক্তি নির্মূলে বিধি অস্ত্র নয়। অস্ত্র দিয়েও নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়; কিংবা আইন প্রণয়ন, প্রয়োগে নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করার চেষ্টাও নয়। বরং বাংলা সংস্কৃতির চর্চা বিস্তৃত ও অব্যাহত রাখার চেষ্টাই উত্তম ও অতি জরুরি। সেই সঙ্গে চেতনার জোয়ার চাই। সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি নাগরিক যাতে অবাধে বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে এবং তা শুদ্ধভাবে, তেমন একটি অনুকূল পরিবেশ চাই। সংস্কৃতিচর্চার অনুকূল পরিবেশই পারে অপশক্তিকে রুখতে। উপযুক্ত শিক্ষা, চেতনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছাই হবে অপশক্তি নির্মূলের অন্যতম হাতিয়ার।

নিরীহ মানুষের পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়ে অপশক্তিকে প্রতিহত করার চিন্তাটা কিংবা নিরীহ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রচেষ্টা নিতান্তই হাস্যকর এবং দুঃখজনকও বটে। পয়লা বৈশাখকে বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানাই। হয়তো একদিন এই বৈশাখই অপশক্তিকে রুখতে নতুন আহ্বান জানাবে জাতিকে। আমরা পয়লা বৈশাখের মুক্তি চাই! 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আমিনুল ইসলাম নন, শিক্ষা উপদেষ্টা হচ্ছেন অধ্যাপক আবরার

গণপিটুনিতে নিহত জামায়াত কর্মী নেজাম ও তাঁর বাহিনী গুলি ছোঁড়ে, মিলেছে বিদেশি পিস্তল: পুলিশ

উপদেষ্টা হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

বসুন্ধরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ২ বিদেশি নাগরিককে মারধর

বিএনপির দুই পেশাজীবী সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত