মোনায়েম সরকার
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে ‘গাফ্ফার ভাই’ বলেই ডাকতাম। বয়সে অনেক ছোট যারা, তারাও তাঁকে ‘গাফ্ফার ভাই’ বলে সম্বোধন করত। তিনিও এটা আনন্দের সঙ্গে নিতেন। উদারমনা মানুষ ছিলেন তিনি। আমি তাঁর চেয়ে প্রায় ১০ বছরের ছোট। তা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব। তিনি আমাকে ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করতেন; কিন্তু তার আড়ালে অনুভব করতাম আমার প্রতি তাঁর গভীর স্নেহ। রাজনৈতিক সম্পর্কের বাইরেও গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার। এটা গড়িয়েছিল পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে। জীবনের শেষ দিকে যখন ঢাকায় আসতেন, আমাদের শান্তিনগরের চামেলীবাগের বাসায় না এসে থাকতে পারতেন না। একেবারে শেষ দিকে গাফ্ফার ভাই ও তাঁর কন্যারা আমার অফিস কাম বাসাতেই এসে থাকতেন।
তিনি কি রাজধানীর কোনো অভিজাত হোটেলে থাকতে পারতেন না? কিংবা অন্য কোথাও চাইলে কি থাকতে পারতেন না? কিন্তু না, অনিবার্যভাবেই যেন তিনি চামেলীবাগে এসে উঠতেন। আর সে কারণে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও এখানে চলে আসতেন গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। গাফ্ফার ভাই একটা সময়ে প্রায় প্রতিদিনই লিখতেন কোনো না কোনো সংবাদপত্রে। সাধারণত বাংলায় লিখলেও মাঝে মাঝে ইংরেজিতেও লিখতেন। এর জন্য অনেক সম্মানী পেতেন। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে লেখালেখিই হয়ে ওঠে তাঁর জীবিকা। এসব লেখার কিছু চেক ও নগদ টাকা আমার সহকারীর কাছে এসে পৌঁছাত। সম্পর্ক এত গভীর হয়ে উঠেছিল যে, এসব ব্যাপারেও তিনি আমার ওপর নির্ভর করতেন। গাফ্ফার ভাইয়ের ৮০ বছর পূর্তিতে বাংলা একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে স্বভাবতই আমার কিছুটা ভূমিকা ছিল। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিই, তাঁকে ২১ অথবা ৫২ লাখ টাকা জন্মদিনের উপহার হিসেবে প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি নূরুল ফজল বুলবুল বিশেষ সহায়তা জুগিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমরা তাঁকে প্রায় ৫২ লাখ টাকাই সংগ্রহ করে দিয়েছিলাম বলে মনে পড়ছে। ঘটনাটি উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে গাফ্ফার চৌধুরীর নাম। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র মতো গান যিনি ওই বয়সে লিখে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সেই অবদানকে অবশ্য কোনো আর্থিক মানদণ্ডে বিচার করা যাবে না। সেটা ছিল তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসারই প্রকাশ।
এই সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, কলকাতায়। আমরা প্রকাশ করতাম ন্যাপের পার্টি পত্রিকা নতুন বাংলা আর গাফ্ফার ভাই কাজ করতেন জয় বাংলা পত্রিকায়। কাছাকাছি অফিস। আমাদের মাঝে মাঝেই দেখা হতো, আড্ডা হতো। তখন শুধু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী নয়, সম্পর্ক তৈরি হয় সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, লেখক শওকত ওসমান, শিল্পী কামরুল হাসানসহ অনেকের সঙ্গে। তাঁরা সবাই আমার চেয়ে বয়সে বড়। কিন্তু ইতিহাসের একটি বিশেষ সময়ে আমরা হয়ে উঠি পরস্পরের বন্ধু। সবার লক্ষ্য এক—স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন এবং সেখানে আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। গাফ্ফার ভাই তো তখন থেকেই সক্রিয় কলমযোদ্ধা। তাঁর লেখার হাত দারুণ।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া সেই সম্পর্ক পরে আরও নিবিড় হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আমি স্বেচ্ছানির্বাসনে যাই এবং ভারতে অবস্থান করি প্রায় চার বছর। দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের বিরুদ্ধে প্রচারণা জোরদার করতে আমি কিছু ভূমিকা রাখি। গাফ্ফার ভাই আগে থেকেই লন্ডনে অবস্থান করছিলেন মূলত স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর তিনি স্বভাবতই আমাদের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হন এবং খুনিদের বিরুদ্ধে তুলে নেন তাঁর জোরালো কলম। সেই কঠিন সময়ে, যখন স্বদেশ থেকে একপ্রকার বিতাড়িত, তখন আমরা প্রকাশ করছি বাংলার ডাক, বজ্রকণ্ঠ, সোনার বাংলা (দ্বিভাষিক), সানরাইজ প্রভৃতি পত্রিকা এবং তাতে ক্লান্তিহীনভাবে লিখে চলেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। সেসব লেখা সংবলিত পত্রিকা গোপনীয়তার সঙ্গে পাঠানো হতো দেশে, এমনকি জেলখানায় তা পৌঁছানো হতো। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে গভীরভাবে শোকাহত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ সেই সব পত্রিকা পড়ে নতুন আশায় বুক বাঁধত। আজ গাফ্ফার ভাইয়ের চলে যাওয়ার প্রথম বার্ষিকীতে ওই সব দিনের কথা বেশি করে মনে পড়ছে।
মনে পড়ছে প্রায় প্রতিদিন লন্ডন থেকে দিনের শুরুতেই, কখনো কখনো ভোরবেলায় তাঁর ফোন পাওয়ার কথা। দেশের পরিস্থিতি জানতে, বুঝতে তিনি আরও অনেকের সঙ্গেই হয়তো কথা বলতেন। আমার সঙ্গেও বলতেন। একটা সময়ে তিনি এত লিখতেন যে, মাঝে মাঝে লেখার উপযুক্ত বিষয় খুঁজে পেতেন না। তখন অনেক ক্ষেত্রে আমাকে ফোন দিতেন। আমি হয়তো কোনো প্রসঙ্গ তুলে বলতাম, আপনি এ বিষয়ে লিখতে পারেন অথবা মানুষ খুশি হবে এ বিষয়ে আপনি কিছু লিখলে। গোটা জাতির বা পিছিয়ে পড়া কোনো জনগোষ্ঠীর উপকার হবে এমন বিষয়ে গাফ্ফার ভাই আনন্দের সঙ্গে লিখতেন। আমরাও হয়তো কোনো বিষয়ে তদবির করতাম। সেটা যুক্তিপূর্ণ হলে তিনি অবশ্যই কলম ধরতেন। গাফ্ফার ভাইয়ের গদ্য এত সুন্দর ছিল, যে কোনো বিষয়ে তাঁর লেখা হয়ে উঠত আকর্ষণীয়।
অনেকে মনে করেন, কবিতা, গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি বেশি কাজ করলে সেগুলোও শক্তিশালী সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠত। এ কথাও ঠিক, দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তাঁকে রাজনীতি নিয়ে লেখাতেই বেশি মাতিয়ে তুলেছিল। রাজনৈতিক কর্তব্যবোধ তাড়িত করেছে তাঁকে সারা জীবন। তাঁর লেখায় তথাকথিত নিরপেক্ষতা ছিল না; ছিল স্পষ্ট পক্ষপাত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বিচ্যুত হননি একদিনের জন্যও। সে জন্য প্রতিপক্ষের দিক থেকে অনেক গালাগাল ও শত্রুতা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। লন্ডনে অবস্থান করেও তিনি মাঝে মাঝে ভুগেছেন নিরাপত্তাহীনতায়। কিন্তু সত্য প্রকাশে কখনো কুণ্ঠিত হননি। যখন যে বিষয়ে যা উচিত মনে হয়েছে, তিনি তা লিখে প্রকাশ করেছেন। এই পত্রিকা না ছাপলে তিনি ঠিকই অন্য পত্রিকায় তাঁর মনের কথা লিখে পাঠকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। সব সময় যে তাঁর অবস্থান সবার পছন্দ হয়েছে, তা নয়। আমারও মাঝে মাঝে খারাপ লেগেছে তাঁর কোনো কোনো অবস্থান। সেটা নিয়ে আমরা ফোনালাপও করেছি। পরবর্তী লেখায় তার প্রতিফলনও দেখতে পেয়েছি। তখন ভেবেছি, গণতন্ত্রমনা মানুষের এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। মানুষ তার মতামত প্রয়োজনে সংশোধন করবে, এটাই কাম্য। গাফ্ফার ভাইয়ের অবস্থান অনেক সময় আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়েও সমালোচিত হয়েছে। তাতে বিচলিত না হয়ে নিজের মতে তিনি দৃঢ় থেকেছেন। এ ক্ষেত্রে গভীর আদর্শবোধ তাঁকে জুগিয়ে চলেছে শক্তি।
বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে গ্রেনেড হামলায় নিহত সাবেক অর্থমন্ত্রী শামস কিবরিয়ার সঙ্গেও আমার গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিএফডিআর)। আমরা প্রকাশ করি সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ বলে একটি পত্রিকা। তাতে গাফ্ফার ভাই আনন্দের সঙ্গে লিখতেন। এতে সম্পাদক কিবরিয়া সাহেব এবং আমিও নিয়মিতভাবে লিখতাম। ওই সময়ে আমাদের তিনজনের আলাদা একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিবরিয়া সাহেব খুব পছন্দ করতেন গাফ্ফার ভাইয়ের লেখা। কোনো সংখ্যায় তাঁর লেখা যাবে না, এটা মানতে পারতেন না। লেখার সম্মানী বাবদ যা প্রদান করা হতো, সেটা সময়মতো পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিরিয়াস। কিবরিয়া ভাইয়ের মতো দেশদরদি মানুষ, গুণী আমলা ও রাজনীতিক এবং বিশিষ্ট ভদ্রলোক গ্রেনেড হামলায় মারা গেলে গাফ্ফার ভাই মুষড়ে পড়েছিলেন। ব্যক্তিগত আলাপে তিনি ওই ঘটনায় গভীর বেদনার কথা বলতেন এবং ঘৃণা প্রকাশ করতেন খুনিদের বিষয়ে। আজ তাঁরা দুজনই প্রয়াত।
গাফ্ফার ভাই অকালে প্রয়াত হয়েছেন, তা বলা যাবে না। বরং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এত সক্রিয় ছিলেন যে, তাঁকে প্রবীণ মনে হতো না। মনে হতো, তিনি আরও কমপক্ষে ১০ বছর বাঁচবেন। মারা যাওয়ার আগের দিনও, ১৮ মে বিকেলে তাঁর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা কথা হয়। তিনিই ফোন করেছিলেন। নানান কথার মধ্যে বললেন, ‘বহুবার আপনি আমাকে আত্মজীবনী লিখতে অনুরোধ করেছেন। এবার ভাবছি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরলে আর কলাম লিখব না, শুধু আত্মজীবনী লিখব।’ সেই সুযোগ আর হয়নি। ২০২২ সালের ১৯ মে তিনি আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান অনন্তলোকে।
বঙ্গবন্ধুর সহচর, বরেণ্য সাংবাদিক, কলাম লেখক, সাহিত্যিক ও গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন আমাদের বিশিষ্ট অভিভাবক। তাঁর সঙ্গে আমার এত স্মৃতি যে, এমন দু-চারটি লেখায় তা তুলে ধরা যাবে না। আর জাতির জীবনে আলো জ্বালাতেই তিনি ব্যয় করেছেন পুরোটা জীবন। এমন মানুষ সহজে মেলে না। পরিণত বয়সে হারালেও গাফ্ফার ভাইয়ের বিয়োগব্যথা অপরিমেয়।
মোনায়েম সরকার: রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে ‘গাফ্ফার ভাই’ বলেই ডাকতাম। বয়সে অনেক ছোট যারা, তারাও তাঁকে ‘গাফ্ফার ভাই’ বলে সম্বোধন করত। তিনিও এটা আনন্দের সঙ্গে নিতেন। উদারমনা মানুষ ছিলেন তিনি। আমি তাঁর চেয়ে প্রায় ১০ বছরের ছোট। তা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব। তিনি আমাকে ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করতেন; কিন্তু তার আড়ালে অনুভব করতাম আমার প্রতি তাঁর গভীর স্নেহ। রাজনৈতিক সম্পর্কের বাইরেও গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার। এটা গড়িয়েছিল পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে। জীবনের শেষ দিকে যখন ঢাকায় আসতেন, আমাদের শান্তিনগরের চামেলীবাগের বাসায় না এসে থাকতে পারতেন না। একেবারে শেষ দিকে গাফ্ফার ভাই ও তাঁর কন্যারা আমার অফিস কাম বাসাতেই এসে থাকতেন।
তিনি কি রাজধানীর কোনো অভিজাত হোটেলে থাকতে পারতেন না? কিংবা অন্য কোথাও চাইলে কি থাকতে পারতেন না? কিন্তু না, অনিবার্যভাবেই যেন তিনি চামেলীবাগে এসে উঠতেন। আর সে কারণে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও এখানে চলে আসতেন গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। গাফ্ফার ভাই একটা সময়ে প্রায় প্রতিদিনই লিখতেন কোনো না কোনো সংবাদপত্রে। সাধারণত বাংলায় লিখলেও মাঝে মাঝে ইংরেজিতেও লিখতেন। এর জন্য অনেক সম্মানী পেতেন। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে লেখালেখিই হয়ে ওঠে তাঁর জীবিকা। এসব লেখার কিছু চেক ও নগদ টাকা আমার সহকারীর কাছে এসে পৌঁছাত। সম্পর্ক এত গভীর হয়ে উঠেছিল যে, এসব ব্যাপারেও তিনি আমার ওপর নির্ভর করতেন। গাফ্ফার ভাইয়ের ৮০ বছর পূর্তিতে বাংলা একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে স্বভাবতই আমার কিছুটা ভূমিকা ছিল। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিই, তাঁকে ২১ অথবা ৫২ লাখ টাকা জন্মদিনের উপহার হিসেবে প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি নূরুল ফজল বুলবুল বিশেষ সহায়তা জুগিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমরা তাঁকে প্রায় ৫২ লাখ টাকাই সংগ্রহ করে দিয়েছিলাম বলে মনে পড়ছে। ঘটনাটি উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে গাফ্ফার চৌধুরীর নাম। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র মতো গান যিনি ওই বয়সে লিখে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সেই অবদানকে অবশ্য কোনো আর্থিক মানদণ্ডে বিচার করা যাবে না। সেটা ছিল তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসারই প্রকাশ।
এই সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, কলকাতায়। আমরা প্রকাশ করতাম ন্যাপের পার্টি পত্রিকা নতুন বাংলা আর গাফ্ফার ভাই কাজ করতেন জয় বাংলা পত্রিকায়। কাছাকাছি অফিস। আমাদের মাঝে মাঝেই দেখা হতো, আড্ডা হতো। তখন শুধু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী নয়, সম্পর্ক তৈরি হয় সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, লেখক শওকত ওসমান, শিল্পী কামরুল হাসানসহ অনেকের সঙ্গে। তাঁরা সবাই আমার চেয়ে বয়সে বড়। কিন্তু ইতিহাসের একটি বিশেষ সময়ে আমরা হয়ে উঠি পরস্পরের বন্ধু। সবার লক্ষ্য এক—স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন এবং সেখানে আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। গাফ্ফার ভাই তো তখন থেকেই সক্রিয় কলমযোদ্ধা। তাঁর লেখার হাত দারুণ।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া সেই সম্পর্ক পরে আরও নিবিড় হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আমি স্বেচ্ছানির্বাসনে যাই এবং ভারতে অবস্থান করি প্রায় চার বছর। দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের বিরুদ্ধে প্রচারণা জোরদার করতে আমি কিছু ভূমিকা রাখি। গাফ্ফার ভাই আগে থেকেই লন্ডনে অবস্থান করছিলেন মূলত স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর তিনি স্বভাবতই আমাদের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হন এবং খুনিদের বিরুদ্ধে তুলে নেন তাঁর জোরালো কলম। সেই কঠিন সময়ে, যখন স্বদেশ থেকে একপ্রকার বিতাড়িত, তখন আমরা প্রকাশ করছি বাংলার ডাক, বজ্রকণ্ঠ, সোনার বাংলা (দ্বিভাষিক), সানরাইজ প্রভৃতি পত্রিকা এবং তাতে ক্লান্তিহীনভাবে লিখে চলেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। সেসব লেখা সংবলিত পত্রিকা গোপনীয়তার সঙ্গে পাঠানো হতো দেশে, এমনকি জেলখানায় তা পৌঁছানো হতো। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে গভীরভাবে শোকাহত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ সেই সব পত্রিকা পড়ে নতুন আশায় বুক বাঁধত। আজ গাফ্ফার ভাইয়ের চলে যাওয়ার প্রথম বার্ষিকীতে ওই সব দিনের কথা বেশি করে মনে পড়ছে।
মনে পড়ছে প্রায় প্রতিদিন লন্ডন থেকে দিনের শুরুতেই, কখনো কখনো ভোরবেলায় তাঁর ফোন পাওয়ার কথা। দেশের পরিস্থিতি জানতে, বুঝতে তিনি আরও অনেকের সঙ্গেই হয়তো কথা বলতেন। আমার সঙ্গেও বলতেন। একটা সময়ে তিনি এত লিখতেন যে, মাঝে মাঝে লেখার উপযুক্ত বিষয় খুঁজে পেতেন না। তখন অনেক ক্ষেত্রে আমাকে ফোন দিতেন। আমি হয়তো কোনো প্রসঙ্গ তুলে বলতাম, আপনি এ বিষয়ে লিখতে পারেন অথবা মানুষ খুশি হবে এ বিষয়ে আপনি কিছু লিখলে। গোটা জাতির বা পিছিয়ে পড়া কোনো জনগোষ্ঠীর উপকার হবে এমন বিষয়ে গাফ্ফার ভাই আনন্দের সঙ্গে লিখতেন। আমরাও হয়তো কোনো বিষয়ে তদবির করতাম। সেটা যুক্তিপূর্ণ হলে তিনি অবশ্যই কলম ধরতেন। গাফ্ফার ভাইয়ের গদ্য এত সুন্দর ছিল, যে কোনো বিষয়ে তাঁর লেখা হয়ে উঠত আকর্ষণীয়।
অনেকে মনে করেন, কবিতা, গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি বেশি কাজ করলে সেগুলোও শক্তিশালী সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠত। এ কথাও ঠিক, দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তাঁকে রাজনীতি নিয়ে লেখাতেই বেশি মাতিয়ে তুলেছিল। রাজনৈতিক কর্তব্যবোধ তাড়িত করেছে তাঁকে সারা জীবন। তাঁর লেখায় তথাকথিত নিরপেক্ষতা ছিল না; ছিল স্পষ্ট পক্ষপাত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বিচ্যুত হননি একদিনের জন্যও। সে জন্য প্রতিপক্ষের দিক থেকে অনেক গালাগাল ও শত্রুতা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। লন্ডনে অবস্থান করেও তিনি মাঝে মাঝে ভুগেছেন নিরাপত্তাহীনতায়। কিন্তু সত্য প্রকাশে কখনো কুণ্ঠিত হননি। যখন যে বিষয়ে যা উচিত মনে হয়েছে, তিনি তা লিখে প্রকাশ করেছেন। এই পত্রিকা না ছাপলে তিনি ঠিকই অন্য পত্রিকায় তাঁর মনের কথা লিখে পাঠকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। সব সময় যে তাঁর অবস্থান সবার পছন্দ হয়েছে, তা নয়। আমারও মাঝে মাঝে খারাপ লেগেছে তাঁর কোনো কোনো অবস্থান। সেটা নিয়ে আমরা ফোনালাপও করেছি। পরবর্তী লেখায় তার প্রতিফলনও দেখতে পেয়েছি। তখন ভেবেছি, গণতন্ত্রমনা মানুষের এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। মানুষ তার মতামত প্রয়োজনে সংশোধন করবে, এটাই কাম্য। গাফ্ফার ভাইয়ের অবস্থান অনেক সময় আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়েও সমালোচিত হয়েছে। তাতে বিচলিত না হয়ে নিজের মতে তিনি দৃঢ় থেকেছেন। এ ক্ষেত্রে গভীর আদর্শবোধ তাঁকে জুগিয়ে চলেছে শক্তি।
বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে গ্রেনেড হামলায় নিহত সাবেক অর্থমন্ত্রী শামস কিবরিয়ার সঙ্গেও আমার গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিএফডিআর)। আমরা প্রকাশ করি সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ বলে একটি পত্রিকা। তাতে গাফ্ফার ভাই আনন্দের সঙ্গে লিখতেন। এতে সম্পাদক কিবরিয়া সাহেব এবং আমিও নিয়মিতভাবে লিখতাম। ওই সময়ে আমাদের তিনজনের আলাদা একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিবরিয়া সাহেব খুব পছন্দ করতেন গাফ্ফার ভাইয়ের লেখা। কোনো সংখ্যায় তাঁর লেখা যাবে না, এটা মানতে পারতেন না। লেখার সম্মানী বাবদ যা প্রদান করা হতো, সেটা সময়মতো পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিরিয়াস। কিবরিয়া ভাইয়ের মতো দেশদরদি মানুষ, গুণী আমলা ও রাজনীতিক এবং বিশিষ্ট ভদ্রলোক গ্রেনেড হামলায় মারা গেলে গাফ্ফার ভাই মুষড়ে পড়েছিলেন। ব্যক্তিগত আলাপে তিনি ওই ঘটনায় গভীর বেদনার কথা বলতেন এবং ঘৃণা প্রকাশ করতেন খুনিদের বিষয়ে। আজ তাঁরা দুজনই প্রয়াত।
গাফ্ফার ভাই অকালে প্রয়াত হয়েছেন, তা বলা যাবে না। বরং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এত সক্রিয় ছিলেন যে, তাঁকে প্রবীণ মনে হতো না। মনে হতো, তিনি আরও কমপক্ষে ১০ বছর বাঁচবেন। মারা যাওয়ার আগের দিনও, ১৮ মে বিকেলে তাঁর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা কথা হয়। তিনিই ফোন করেছিলেন। নানান কথার মধ্যে বললেন, ‘বহুবার আপনি আমাকে আত্মজীবনী লিখতে অনুরোধ করেছেন। এবার ভাবছি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরলে আর কলাম লিখব না, শুধু আত্মজীবনী লিখব।’ সেই সুযোগ আর হয়নি। ২০২২ সালের ১৯ মে তিনি আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান অনন্তলোকে।
বঙ্গবন্ধুর সহচর, বরেণ্য সাংবাদিক, কলাম লেখক, সাহিত্যিক ও গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন আমাদের বিশিষ্ট অভিভাবক। তাঁর সঙ্গে আমার এত স্মৃতি যে, এমন দু-চারটি লেখায় তা তুলে ধরা যাবে না। আর জাতির জীবনে আলো জ্বালাতেই তিনি ব্যয় করেছেন পুরোটা জীবন। এমন মানুষ সহজে মেলে না। পরিণত বয়সে হারালেও গাফ্ফার ভাইয়ের বিয়োগব্যথা অপরিমেয়।
মোনায়েম সরকার: রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে