সেলিম জাহান
২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের। সে স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে।
আজ ২০২১-এ এসে যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন দেখি অর্জন আমাদের অনেক, বিশেষত আর্থসামাজিক অঙ্গনে। ৫০ বছর আগে ধ্বংসস্তূপের ভস্ম থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ।
তারপর সে আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। গত অর্ধশতাব্দীতে দেশটির অনন্য সাফল্যের কারণে বিশ্ব তাকে চিহ্নিত করেছে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে।
৫০ নয়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ–৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৫০ বিলিয়ন। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩০০ ডলার থেকে ২ হাজার ৬৪ জলারে। মধ্য-নব্বইয়ের দশকে যেখানে দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, আজ সেখানে মাত্র ২১ শতাংশ। বয়স্ক সাক্ষরতার হার ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৩৫ শতাংশ, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে।
প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্তির হার ১৯৯০-২০১৯ সাল নাগাদ ৭৫ থেকে ৯৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাদ্বয় হচ্ছে যথাক্রমে ২০ ও ৬৬ শতাংশ। ওই সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২১-এ নেমে এসেছে এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি এক লাখে ৫৯৪ থেকে ১৬৫-তে হ্রাস পেয়েছে।
আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ অগ্রগতি বিস্ময়কর। আসলে সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু আজ ৭৩ বছর, ভারতে যেখানে ৭০ বছর, পাকিস্তানে ৬৭ বছর। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশ প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে ৩৫ এবং পাকিস্তানে ৬৭।
কিন্তু এসব অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি আর্থসামাজিক অন্তরায় আমাকে ভাবিত করে। প্রথমত, সমাজের ক্রমবর্ধমান অসমতা-ফলাফলের ক্ষেত্রে এবং সেই সঙ্গে সুযোগের ক্ষেত্রেও। আয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার উচ্চতম ১০ শতাংশ যেখানে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ ভোগ করেছে, সেখানে জনসংখ্যার নিম্নতম ৪০ শতাংশ দেশজ আয়ের ১৩ শতাংশ পেয়েছে। বরিশালে বয়স্ক সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সেখানে সিলেটে সে হার ৬০ শতাংশ। শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ।
অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসমতা লক্ষণীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্তই প্রান্তিক। বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য লক্ষণীয়–দরিদ্র মানুষজন সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। ঢাকা শহরেই বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্য এলাকার জীবনযাত্রার মানের কোনো মিল নেই। ধনী-দরিদ্রের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কথাও সর্বজনবিদিত।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতা আমাকে ভাবিত করে। আমরা আমাদের ভাবনাতেই মগ্ন—আমার নাম, আমার অর্থবিত্ত, আত্মপ্রচার। আমরা ভুলে গেছি, আমাদের সব অর্জন কিন্তু যূথবদ্ধতার ফসল। আমরা যৌথভাবে আন্দোলন করেছি, সবাই মিলে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সমাজের মূলশক্তিই ছিল যূথবদ্ধতা। কিন্তু আজ আমরা ভুলে গেছি যে, আমাদের প্রত্যেকের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা আমাদের একার ওপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে যে বৃহত্তর কাঠামোর আমরা অংশ, তার ওপর। মনে রাখা দরকার, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও তা থেকে রক্ষা পায় না।
আমাদের আর্থিক সাফল্যকেই আমরা একজন সফল মানুষের নির্ণায়ক বলে মেনে নিয়েছি। বিত্তের মাপকাঠিতেই আজ আমরা মানুষের মূল্যায়ন করছি। শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, ভদ্রতা-শোভনতা আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমার বৃত্তিকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি–তাদের অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন করে ফেলেছি।
তৃতীয়ত, সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার ব্যাপ্ত বিস্তৃতি ঘটেছে। আমাদের সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতেও আমরা ভুলে যাই। যেকোনো মতভেদ, মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমরা আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করি—পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তি। তার পথ ধরেই এসেছে অস্ত্রায়ন, সহিংসতা আর সন্ত্রাস। যেকোনো মতবিরোধ, মতানৈক্য আর মতভেদে আমরা আশ্রয় নিই সহিংসতা আর সন্ত্রাসের। সহিংসতা আজ আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সংস্কৃতি।
চতুর্থত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর জনগণের সার্বিক মুক্তির চালচিত্রকে মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল–জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সর্বপ্রকার সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
আজ বাংলাদেশ এ মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’ এমন ধুয়া তুলে আমাদের বাঙালিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদী অপশক্তিকে আশকারা দিয়ে উদারপন্থী বাঙালিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ শঙ্কাক্রান্ত। আমরা ভুলে গেছি, গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র।
সামাজিক ন্যায্যতা আজ মুখে মুখেই আমরা বলি, আমাদের কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। সুতরাং আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে, অসমতা আছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। আমাদের চিন্তায়, কাজে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
পঞ্চমত, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আবার জেঁকে বসেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে। এদেরই পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যার দোসর হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃত করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং যেকোনো মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এই অপশক্তি এক বিরাট হুমকি। এ এক অশনিসংকেত এবং এ আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম।
এসব কাঠামোগত অন্তরায় আর প্রতিবন্ধকতা-গুলো জয় করতে হলে আমরা সবাই মিলে এগুলোর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, সব সমাধান আমাদের একার হাতে নেই এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা এই সব কটির সমাধানও করতে পারব না। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় আমরা এখনই চিন্তাভাবনা করতে পারি।
যেমন, আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকা নিতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের। অপশক্তি নির্মূলেও অগ্রগণ্য ভূমিকা রাষ্ট্রের। অসমতা দূরীকরণে অন্তর্ভূত প্রবৃদ্ধি নীতিমালা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, করনীতি সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতা ও সন্ত্রাস বন্ধে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি ভূমিকা আছে সামাজিক আন্দোলনের। সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগতভাবে বহু কিছু করার আছে। মনে রাখা দরকার, ‘এর দায়ভাগে আমরা সমান অংশীদার, অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার’।
আমাদের যাত্রাপথে আমরা একটি ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছি। পার করেছি স্বাধীনতার ৫০ বছর! সামনে পড়ে আছে এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এই ক্রান্তিলগ্নে এসে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাগুলো, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে যাত্রাপথে: ‘আমার এ পথযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর পথে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পথে, একাকিত্ব থেকে আশার পথে।’ সেই সুরে আমি বলি, আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের পথযাত্রা হবে বঞ্চনা থেকে প্রাচুর্যের পথে, প্রতিবন্ধকতা থেকে সুযোগের দিকে, দিগ্দর্শন থেকে কর্মকাণ্ডের দিকে।
অর্জন আর অন্তরায়ের কথা পেরিয়ে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর আমাদের মনে রাখা দরকার, একটি অন্তর্নিহিত মাত্রিকতা আছে; কিন্তু স্বাধীনতা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। অন্যদিকে বিজয়েরও একটি বহির্মাত্রা আছে; কিন্তু বিজয় তো বোধের। সুতরাং বিজয় বা স্বাধীনতা শুধু উদ্যাপনের নয়, চেতনারও। এবং সে চেতনা ধারণ করতে হবে বর্ষব্যাপী, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে; যারা ১৯৭১ দেখেছি তাদের এবং যারা দেখেনি তাদেরও।
আমরা যারা স্বাধীনতা দেখেছি, তাদের একটি অংশ সেই চেতনাকে ধারণ করে রাখতে পেরেছি। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও তো সত্য, আমরা অনেকেই সেই চেতনা বিস্মৃত হয়েছি এবং আমাদের কেউ কেউ বেপথুও তো হয়েছি। স্বাধীনতাসংগ্রাম দেখেছেন; কিন্তু স্বীকার করেননি, তাঁদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের চেতনাকে, আমরা যারা স্বাধীনতাসংগ্রামের সাক্ষী, তাদের জন্য নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আসলে পুরো প্রেক্ষাপট অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ আমাদের তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যারা স্বাধীনতা দেখেনি। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছে, কিন্তু দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে হয়তো একটি কল্পকাহিনি, বিজয় তাদের কাছে সুদূর অতীতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তরুণ প্রজন্মের আবেগী কিংবা বস্তুনিষ্ঠ যোগ সব সময় না-ও থাকতে পারে। কারণগুলো সংগতই; হয়তো কেউ তাদের বিষয়টি ঠিকভাবে বলেনি কিংবা তাদের পাঠ্যক্রমে তা অনুপস্থিত থেকেছে বা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ অবস্থায় বিভ্রান্তিমূলক ধারণারও জন্ম হতে পারে সহজেই।
বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, আজকের বাংলাদেশে এ অবস্থাটির কমতি নেই এবং সেটা শঙ্কাজনক। এ প্রবণতা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধারণ করবে-না বিজয়ের সত্যিকারের চেতনা, জানবে-না মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। ভবিষ্যতের দিনগুলোয় আমাদের জাতিসত্তার অহংকার, আমাদের ঐতিহ্যের ইতিহাস, আমাদের চেতনার ভিত্তি বিলুপ্তির পথ এ প্রক্রিয়া প্রশস্ত করে দেবে।
১৯৭১-এর ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শেষ করেছিলেন এই বলে: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের সংগ্রামের মূলমন্ত্রটি ওই ডাকটির মধ্যেই নিহিত। বঙ্গবন্ধু ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ শব্দ দুটোকে সুচিন্তিতভাবে আলাদা করে উচ্চারণ করেছিলেন। কারণ, বাঙালির সংগ্রামকে তিনি দুটি পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখেছিলেন। একটি দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাই একটি সংগ্রামের শেষ কথা নয়, তার জনগণের সার্বিক মুক্তিই হচ্ছে সে সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য। রাজনৈতিক স্বাধীনতা সার্বিক মুক্তির আবশ্যিক শর্ত; কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলা শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটজনকে নৃশংসভাবে হত্যার পর রাষ্ট্রযন্ত্র এসব মূল্যবোধকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বেপথু করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
এই সব কিছুর কারণে পরবর্তী সময়ে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে স্বদেশে। এক. যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্থান আরও সংহত হয়েছে। দুই. আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সার্বক্ষণিক উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হইনি, বেপথুও তো হয়েছি। তিন. জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে, নয়তো বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে। সে লড়াই বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধকে সংহত করার। এ লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই—এ লড়াই জিততে হবে।
২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের। সে স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে।
আজ ২০২১-এ এসে যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন দেখি অর্জন আমাদের অনেক, বিশেষত আর্থসামাজিক অঙ্গনে। ৫০ বছর আগে ধ্বংসস্তূপের ভস্ম থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ।
তারপর সে আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। গত অর্ধশতাব্দীতে দেশটির অনন্য সাফল্যের কারণে বিশ্ব তাকে চিহ্নিত করেছে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে।
৫০ নয়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ–৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৫০ বিলিয়ন। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩০০ ডলার থেকে ২ হাজার ৬৪ জলারে। মধ্য-নব্বইয়ের দশকে যেখানে দেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, আজ সেখানে মাত্র ২১ শতাংশ। বয়স্ক সাক্ষরতার হার ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৩৫ শতাংশ, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে।
প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্তির হার ১৯৯০-২০১৯ সাল নাগাদ ৭৫ থেকে ৯৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাদ্বয় হচ্ছে যথাক্রমে ২০ ও ৬৬ শতাংশ। ওই সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২১-এ নেমে এসেছে এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি এক লাখে ৫৯৪ থেকে ১৬৫-তে হ্রাস পেয়েছে।
আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ অগ্রগতি বিস্ময়কর। আসলে সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু আজ ৭৩ বছর, ভারতে যেখানে ৭০ বছর, পাকিস্তানে ৬৭ বছর। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশ প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে ৩৫ এবং পাকিস্তানে ৬৭।
কিন্তু এসব অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি আর্থসামাজিক অন্তরায় আমাকে ভাবিত করে। প্রথমত, সমাজের ক্রমবর্ধমান অসমতা-ফলাফলের ক্ষেত্রে এবং সেই সঙ্গে সুযোগের ক্ষেত্রেও। আয়ের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার উচ্চতম ১০ শতাংশ যেখানে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ ভোগ করেছে, সেখানে জনসংখ্যার নিম্নতম ৪০ শতাংশ দেশজ আয়ের ১৩ শতাংশ পেয়েছে। বরিশালে বয়স্ক সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সেখানে সিলেটে সে হার ৬০ শতাংশ। শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ।
অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসমতা লক্ষণীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্তই প্রান্তিক। বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য লক্ষণীয়–দরিদ্র মানুষজন সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। ঢাকা শহরেই বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্য এলাকার জীবনযাত্রার মানের কোনো মিল নেই। ধনী-দরিদ্রের সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কথাও সর্বজনবিদিত।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতা আমাকে ভাবিত করে। আমরা আমাদের ভাবনাতেই মগ্ন—আমার নাম, আমার অর্থবিত্ত, আত্মপ্রচার। আমরা ভুলে গেছি, আমাদের সব অর্জন কিন্তু যূথবদ্ধতার ফসল। আমরা যৌথভাবে আন্দোলন করেছি, সবাই মিলে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সমাজের মূলশক্তিই ছিল যূথবদ্ধতা। কিন্তু আজ আমরা ভুলে গেছি যে, আমাদের প্রত্যেকের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা আমাদের একার ওপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে যে বৃহত্তর কাঠামোর আমরা অংশ, তার ওপর। মনে রাখা দরকার, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও তা থেকে রক্ষা পায় না।
আমাদের আর্থিক সাফল্যকেই আমরা একজন সফল মানুষের নির্ণায়ক বলে মেনে নিয়েছি। বিত্তের মাপকাঠিতেই আজ আমরা মানুষের মূল্যায়ন করছি। শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, ভদ্রতা-শোভনতা আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমার বৃত্তিকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি–তাদের অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন করে ফেলেছি।
তৃতীয়ত, সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার ব্যাপ্ত বিস্তৃতি ঘটেছে। আমাদের সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতেও আমরা ভুলে যাই। যেকোনো মতভেদ, মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমরা আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করি—পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তি। তার পথ ধরেই এসেছে অস্ত্রায়ন, সহিংসতা আর সন্ত্রাস। যেকোনো মতবিরোধ, মতানৈক্য আর মতভেদে আমরা আশ্রয় নিই সহিংসতা আর সন্ত্রাসের। সহিংসতা আজ আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সংস্কৃতি।
চতুর্থত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর জনগণের সার্বিক মুক্তির চালচিত্রকে মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল–জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সর্বপ্রকার সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
আজ বাংলাদেশ এ মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’ এমন ধুয়া তুলে আমাদের বাঙালিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদী অপশক্তিকে আশকারা দিয়ে উদারপন্থী বাঙালিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ শঙ্কাক্রান্ত। আমরা ভুলে গেছি, গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র।
সামাজিক ন্যায্যতা আজ মুখে মুখেই আমরা বলি, আমাদের কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। সুতরাং আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে, অসমতা আছে জীবনের নানা ক্ষেত্রে। আমাদের চিন্তায়, কাজে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
পঞ্চমত, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আবার জেঁকে বসেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে। এদেরই পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যার দোসর হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃত করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ এবং যেকোনো মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এই অপশক্তি এক বিরাট হুমকি। এ এক অশনিসংকেত এবং এ আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম।
এসব কাঠামোগত অন্তরায় আর প্রতিবন্ধকতা-গুলো জয় করতে হলে আমরা সবাই মিলে এগুলোর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, সব সমাধান আমাদের একার হাতে নেই এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা এই সব কটির সমাধানও করতে পারব না। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় আমরা এখনই চিন্তাভাবনা করতে পারি।
যেমন, আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকা নিতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের। অপশক্তি নির্মূলেও অগ্রগণ্য ভূমিকা রাষ্ট্রের। অসমতা দূরীকরণে অন্তর্ভূত প্রবৃদ্ধি নীতিমালা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, করনীতি সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে এবং সহিংসতা ও সন্ত্রাস বন্ধে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি ভূমিকা আছে সামাজিক আন্দোলনের। সেই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগতভাবে বহু কিছু করার আছে। মনে রাখা দরকার, ‘এর দায়ভাগে আমরা সমান অংশীদার, অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার’।
আমাদের যাত্রাপথে আমরা একটি ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছি। পার করেছি স্বাধীনতার ৫০ বছর! সামনে পড়ে আছে এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এই ক্রান্তিলগ্নে এসে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাগুলো, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে যাত্রাপথে: ‘আমার এ পথযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর পথে, বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পথে, একাকিত্ব থেকে আশার পথে।’ সেই সুরে আমি বলি, আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের পথযাত্রা হবে বঞ্চনা থেকে প্রাচুর্যের পথে, প্রতিবন্ধকতা থেকে সুযোগের দিকে, দিগ্দর্শন থেকে কর্মকাণ্ডের দিকে।
অর্জন আর অন্তরায়ের কথা পেরিয়ে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর আমাদের মনে রাখা দরকার, একটি অন্তর্নিহিত মাত্রিকতা আছে; কিন্তু স্বাধীনতা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। অন্যদিকে বিজয়েরও একটি বহির্মাত্রা আছে; কিন্তু বিজয় তো বোধের। সুতরাং বিজয় বা স্বাধীনতা শুধু উদ্যাপনের নয়, চেতনারও। এবং সে চেতনা ধারণ করতে হবে বর্ষব্যাপী, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে; যারা ১৯৭১ দেখেছি তাদের এবং যারা দেখেনি তাদেরও।
আমরা যারা স্বাধীনতা দেখেছি, তাদের একটি অংশ সেই চেতনাকে ধারণ করে রাখতে পেরেছি। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও তো সত্য, আমরা অনেকেই সেই চেতনা বিস্মৃত হয়েছি এবং আমাদের কেউ কেউ বেপথুও তো হয়েছি। স্বাধীনতাসংগ্রাম দেখেছেন; কিন্তু স্বীকার করেননি, তাঁদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের চেতনাকে, আমরা যারা স্বাধীনতাসংগ্রামের সাক্ষী, তাদের জন্য নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আসলে পুরো প্রেক্ষাপট অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ আমাদের তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যারা স্বাধীনতা দেখেনি। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছে, কিন্তু দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে হয়তো একটি কল্পকাহিনি, বিজয় তাদের কাছে সুদূর অতীতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তরুণ প্রজন্মের আবেগী কিংবা বস্তুনিষ্ঠ যোগ সব সময় না-ও থাকতে পারে। কারণগুলো সংগতই; হয়তো কেউ তাদের বিষয়টি ঠিকভাবে বলেনি কিংবা তাদের পাঠ্যক্রমে তা অনুপস্থিত থেকেছে বা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ অবস্থায় বিভ্রান্তিমূলক ধারণারও জন্ম হতে পারে সহজেই।
বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, আজকের বাংলাদেশে এ অবস্থাটির কমতি নেই এবং সেটা শঙ্কাজনক। এ প্রবণতা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধারণ করবে-না বিজয়ের সত্যিকারের চেতনা, জানবে-না মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। ভবিষ্যতের দিনগুলোয় আমাদের জাতিসত্তার অহংকার, আমাদের ঐতিহ্যের ইতিহাস, আমাদের চেতনার ভিত্তি বিলুপ্তির পথ এ প্রক্রিয়া প্রশস্ত করে দেবে।
১৯৭১-এর ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শেষ করেছিলেন এই বলে: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের সংগ্রামের মূলমন্ত্রটি ওই ডাকটির মধ্যেই নিহিত। বঙ্গবন্ধু ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ শব্দ দুটোকে সুচিন্তিতভাবে আলাদা করে উচ্চারণ করেছিলেন। কারণ, বাঙালির সংগ্রামকে তিনি দুটি পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখেছিলেন। একটি দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাই একটি সংগ্রামের শেষ কথা নয়, তার জনগণের সার্বিক মুক্তিই হচ্ছে সে সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য। রাজনৈতিক স্বাধীনতা সার্বিক মুক্তির আবশ্যিক শর্ত; কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলা শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটজনকে নৃশংসভাবে হত্যার পর রাষ্ট্রযন্ত্র এসব মূল্যবোধকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বেপথু করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
এই সব কিছুর কারণে পরবর্তী সময়ে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে স্বদেশে। এক. যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্থান আরও সংহত হয়েছে। দুই. আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সার্বক্ষণিক উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হইনি, বেপথুও তো হয়েছি। তিন. জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে, নয়তো বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে। সে লড়াই বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধকে সংহত করার। এ লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই—এ লড়াই জিততে হবে।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে