Ajker Patrika

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আব্দুর রাজ্জাক
আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮: ২৯
আমরা কোথায় যাচ্ছি?

২০১৭ সালের প্রথম দিক থেকে ১৮ সালের শেষ অবধি আমি আমার নির্বাচনী এলাকা বানারীপাড়া-উজিরপুর, বরিশাল-২ এলাকায় নিবিড়ভাবে ঘুরেফিরে পর্যবেক্ষণ করেছি, মানুষের মনোভাব, চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে চেষ্টা করেছি। আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার।

আমি একা অথবা কোনো সময় এক থেকে দুজন সঙ্গী নিয়ে ভ্যানে করে, রিকশায় করে, বড়জোর একটি মোটরসাইকেলে করে নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ঘুরেছি পরিচয় দিয়ে বা না দিয়ে, মতবিনিময় করেছি।

পরিচয় দেওয়ার পরে, আমার উদ্দেশ্যের কথা বলার পরে, সবাই একটি কথা প্রথমে বলেছে, আমি কত টাকা খরচ করতে পারব? কত টাকার বাজেট নিয়ে ইলেকশন করতে এসেছি।

কৌতূহলবশত শুনেছি আপনারা কত টাকার আশা করেছেন? কত টাকা হলে ইলেকশন করা যায়। কোনো ব্যক্তি ৫ কোটি টাকার নিচে বলেননি। বহু লোক আমাকে কটাক্ষ করে বলেছেন, দুজন সঙ্গী নিয়ে রিকশায়, ভ্যানে চড়ে ঘুরে বেড়িয়ে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন না, আপনি ইলেকশন করতে পারবেন না। এই দরিদ্র হালে আপনার সঙ্গে কেউ খুব একটা কথাও বলবে না। এলাকার সব মানুষ, এমনকি আমার পরিবারের সদস্য, আমার মাসহ সবাই টাকার প্রশ্ন তুলেছেন।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম, অনেক টাকা না থাকলে নির্বাচনের কথা মুখে আনা ঠিক নয়; অর্থাৎ সৎ থেকে আপনি যত ভালো কাজ করেন, ভালো কথা বলেন, উদ্দেশ্য যতই মহৎ থাকুক, আপনি সবকিছু করতে পারবেন, কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হতে পারবেন না, যদি আপনার টাকা খরচ করার সামর্থ্য না থাকে। তবে ব্যতিক্রম আছে। হয়তো কিছু ব্যক্তি আছেন আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই, তাঁরা সপ্রতিভায় উদ্ভাসিত, সেই সব সম্মানিত ব্যক্তি সাধারণের ঊর্ধ্বে।

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাস্টমস কমিশনার, খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদে বর্তমানে পদায়ন আছেন। আমার বন্ধু দুঃখ করে বললেন, ‘আমি এই অফিসে সর্বোচ্চ আসনে খুবই সৎভাবে আমার কাজটি করি। এই সুযোগে আমার অধীন কর্মকর্তারা মানুষকে ভোগান্তি বেশি করে, ঘুষের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। নিচের অফিসাররা বলে, আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন, ওপরে গেলে কিন্তু খবর আছে, স্যার কোনো পয়সা নেন না, তবে আপনি কোনো অন্যায় বেনিফিট পাবেন না। এই ভয় দেখিয়ে তাদের প্রাপ্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।’

আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু প্রাথমিক পর্যায়ের একজন ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তার কাছে কাজে গেলেন, কাজটি তাঁর আওতাভুক্ত। ক্যাডারভুক্ত ওই কর্মকর্তা ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করলেন। ব্যবসায়ী বন্ধু একটু বয়স্ক ভদ্রলোক ইঞ্জিনিয়ার, বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে চেনেন; অর্থাৎ ছাত্রজীবনে ব্যবসায়ী বন্ধুর সহপাঠী ছিলেন। পদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী বন্ধুকে তাঁর সঙ্গের তিনজন অধীন কর্মকর্তার সামনে বললেন, ‘আমি আমার কলিগদের সামনে বলছি, আমার ওপরেও কর্মকর্তারা আছেন, এই টাকা সবাই মিলে নেব।’ আরও বললেন, ‘জানি, আমাদের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা আপনার বন্ধু, সেটা কোনো ব্যাপার নয়, আমরা তাতে মনে করি না, সিনিয়র কর্মকর্তারাও যখন এই চেয়ারে ছিলেন, আমাদের মতো এ কাজ করেছেন। অতএব ওপরে গেলে কোনো লাভ হবে না।’

আমার এক পরিচিত ব্যক্তি সরকারি অফিসে একটি কাজের জন্য এক কর্মকর্তার কাছে যাবেন, ভদ্রলোক যে কর্মকর্তার কাছে যাবেন, তাঁর ব্যাচমেট কর্মকর্তার মাধ্যমে টেলিফোন করিয়ে গেলেন।

কাজ শেষে আবার ফিরে এলেন পরিচিত কর্মকর্তার কাছে। পরিচিত কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাজ হয়েছে? কোনো টাকাপয়সা লেগেছে?’ পরিচিত ভদ্রলোকের উত্তর, ‘কাজ হয়েছে, তবে ৫০ হাজার টাকা লেগেছে।’

ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ব্যাচমেটের কাছে প্রশ্ন করলেন, ‘একটি লিগ্যাল কাজের জন্য ৫০ হাজার টাকা নিলে কেন?’ কর্মকর্তার উত্তর, ‘এ ধরনের কাজে এক লাখ টাকা নিই, তুমি টেলিফোন করেছ বলে অর্ধেক নিয়েছি, এখন তুমি ধন্যবাদের পরিবর্তে আমাকে তিরস্কার করছ কেন?’

এ রকম আরও কিছু ঘটনা আমি জানি। ক্রমান্বয়ে তা প্রকাশ করব। আমরা যে একটা জায়গায় বড় রকমের হোঁচট খেয়েছি, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। জায়গাটা হলো—সততা!

আব্দুর রাজ্জাক: প্রকৌশলী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত