Ajker Patrika

সৃষ্টির জন্য আবশ্যক সমষ্টিগত স্বপ্ন

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯: ১০
সৃষ্টির জন্য আবশ্যক সমষ্টিগত স্বপ্ন

বছরের এই সময়ে বাঙালির ভাষা সংগ্রাম আর যুদ্ধ বিজয়ের স্মৃতিগুলো ফিরে আসে, বিশেষ করে এই কারণে যে সময় বয়ে যাচ্ছে অথচ অঙ্গীকার আজও অপূর্ণ কিংবা ব্যর্থ। প্রাপ্তি কেবলই স্মৃতির সুখ-দুঃখে বহমান। হ্যাঁ, অর্জন অবশ্যই ঘটেছে, যা জাতি স্বাধীন না হলে ছিল দূর-কল্পনা। যেমন অর্জন হয়েছে নগরায়ণে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, উঁচু বাড়ি আর সুপার মার্কেট। নগরের ধারণক্ষমতার বাইরে নতুন-পুরোনো গাড়ি আমদানি, পরিবেশ বিপর্যয়। মানুষ তো অবশ্যই, নগরের এমন একটি গাছ বা লতাগুল্মের সবুজ পাতা নেই, যা বিষাক্ত গ্যাস, বর্জ্য আর ধুলোয় আচ্ছাদিত নয়। ওরা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের কাজেও স্বাভাবিক স্বাধীনতা হারিয়েছে। আগের তুলনায় জনগণের স্নায়ুর ওপর চাপ যে শত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ অস্থির, দুশ্চিন্তায় পতিত, বলতে গেলে মানসিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় বিব্রত। জাতীয় জীবনে এই যে মানসিক বিপর্যয়, এটি জাতীয় সম্পদের বিনাশের যেকোনো মাত্রার চেয়ে কম ক্ষতিকারক নয়।

আমরা বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। ইতিহাসে ক্রান্তিকালের শেষ নেই। মানুষ সব সময়ই নতুন কালে পৌঁছাতে চায়। সেই পৌঁছাতে পারা না-পারাটাই বড় প্রশ্ন। স্বাধীনতার পরে আমরা কতটা এগিয়েছি, পিছিয়েছি কতটা—সেই জিজ্ঞাসা আমাদের আছে এবং থাকাটা জরুরিও বটে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে মানুষের নিরাপত্তা একেবারেই বাড়েনি। আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থার উন্নতির জন্য পুলিশের পাশাপাশি নামানো হয়েছে র‍্যাব, চিতা, কোবরা ইত্যাদি। সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস নির্মূল করার যে চেষ্টা, তা কোনো দেশে কখনো কার্যকর হওয়ার নয়, হবেও না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ অধ্যাপককে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছিল, জয়পুরহাটে কলেজের একজন অধ্যক্ষকে হত্যা করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল, ‘বাংলা ভাই’ যাকে ইচ্ছা ধরে এনে খুন করেছে, এসব ক্ষেত্রে র‍্যাবের কোনো তৎপরতা শুরুতে ছিল না। পরে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের চাপে সরকার বাধ্য হয়েছিল।

ওদিকে ক্ষমতাসীনেরা রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় রয়েছে। ক্ষমতাপ্রত্যাশী এক দলে তো মা-ছেলের প্রবল প্রতাপ। শাসকশ্রেণির রাজনীতি যে আজ কতটা অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে, এ তারই নতুন প্রমাণ। জনগণ এদের সঙ্গে নেই। কিন্তু জনগণের সামনে কোনো বিকল্পও নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির আসল সংকট এটাই। অনেক হট্টগোল করে সরকার শেষ পর্যন্ত একটি দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশন যে কতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে, তা নিয়ে শুরু থেকেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বস্তুত বর্তমান রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার কোনো কিছুর ওপরই মানুষের আস্থা নেই। তবু যে তারা টিকে আছে তার কারণ, জনগণ সংঘবদ্ধ নয়।

২. বাংলাদেশে সমস্যা অনেক, এর ভেতর একটা হচ্ছে কর্মসংস্থানের। বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং পুরোনো সংকটকে জটিল করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন সংকটের জন্ম দিচ্ছে। দেশে জঙ্গি তৎপরতার মারাত্মক বৃদ্ধির সঙ্গেও এই বেকার সমস্যা যে সরাসরি জড়িত, তার প্রমাণ হাতেনাতেই পাওয়া গেছে। যে জঙ্গিরা ধরা পড়েছিল, তাদের প্রায় সবাই দেখা গেছে হতদরিদ্র ও বেকার। এদের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এদের অল্প পয়সায় ভাড়া করা যায় এবং ইহকালের দৈন্য পরকালে ঘুচবে—এ আশায় এরা বোমা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু কোনো সরকারই কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেয় না। সরকারগুলো সবই অবশ্য দেশের ধনিকশ্রেণির লোকদের নিয়ে গঠিত, যে ধনিকদের প্রধান কাজ দেশের সম্পদ বৃদ্ধি 
নয়, সম্পদ লুণ্ঠন।

সম্পদ বৃদ্ধি করতে হলে বিনিয়োগ দরকার। অনেক কিছুই বাড়ছে, বিনিয়োগ ছাড়া। অবশ্য সব বিনিয়োগই যে শুভ তা নয়, কোনো কোনো বিনিয়োগ রীতিমতো ক্ষতিকর। টাটা কোম্পানি খুব বড় আকারের বিনিয়োগ করতে উৎসাহ দেখিয়েছিল, কিন্তু সেই উৎসাহ দেখে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার বিপরীতে বরং আতঙ্কিত হওয়ার পক্ষে যুক্তি ছিল। কারণ, ওই বিনিয়োগ অত্যন্ত মূল্যবান খনিজ সম্পদ গ্যাস ও কয়লার ক্ষেত্রে ঘটবে, বিদেশিরা গ্যাস ও কয়লা উত্তোলন ও রপ্তানিতে খুবই আগ্রহী দেখা যায় এবং তা স্থানীয় শিল্পোদ্যোগের জন্য ভীষণ রকমের বিপদ ডেকে আনবে। তাদের বিনিয়োগ আমাদের জন্য যে কেমন ভয়ংকর ব্যাপার হতে পারে, তার প্রমাণ গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় দুর্ঘটনা।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক তৎপরতার পরিণাম আমরা ভুলিনি, ভুলিনি স্থানীয় মীরজাফরদের। নানা ধরনের বহুজাতিক কোম্পানির সাম্প্রতিক আনাগোনা যদি ইতিহাসের স্মৃতিকে জাগিয়ে দেয়, তবে দোষ আমাদের নয়, দোষ তাদের, যারা আনাগোনা করছে। আর দোষ মীরজাফরদের, যারা নানাভাবে বিদেশিদের দিকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করছে।

বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগ ঘটছে মাদ্রাসা শিক্ষা ও মৌলবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রেও। ওরা এত টাকা পাচ্ছে কোথায়? পাচ্ছে সেই সব বিদেশি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে, যারা চায় আমাদের দেশ পিছিয়ে থাকুক, এখানে অর্থনৈতিক বিকাশ না ঘটুক, যাতে তারা এই দেশকে নিজেদের অধীনে রাখতে পারে এবং যাতে উৎপাদনব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে গিয়ে দেশটি বিদেশিদের ক্রেতা ও ভৃত্যে ভরপুর থাকে।

জঙ্গিরা কেবল বেকার নয়, মাদ্রাসায় শিক্ষিতও বটে। বেকারত্ব এবং মাদ্রাসাশিক্ষার ভেতর খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। গরিবের ছেলেমেয়েরা মাদ্রাসায় যায়, গিয়ে বেকার হয় এবং তাদেরই একাংশ হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় জঙ্গি তৎপরতায় যোগ দেয়। এই মাদ্রাসাশিক্ষায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ চলছে এবং তার বড় ভাগ আসছে আমাদের বিদেশি শত্রুদের কাছ থেকে। এই বিনিয়োগে স্থানীয়রাও অংশ নেয়; কেউ নেয় না বুঝে, অধিকাংশই নেয় পুণ্য ও সুনামের আকাঙ্ক্ষায়। সরকারগুলোও দেখা যায় মাদ্রাসাশিক্ষায় যত উৎসাহ বোধ করে, মাধ্যমিক শিক্ষার বেলায় ততটা করে না। তাতে পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায় যে এরা আর যা-ই হোক দেশপ্রেমিক নয়। শিক্ষা দেওয়ার নাম করে এরা অনুগত ও পঙ্গু মানুষ উৎপাদনে আগ্রহী।

বর্তমান সরকার অবশ্য আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, তথাকথিত ‘একমুখী’ শিক্ষা প্রবর্তনের নাম করে তারা মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে মাদ্রাসার স্তরে ঠেলে নামিয়ে মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা শিক্ষার একটি ‘সমন্বয়’ ঘটানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রেও মস্ত বড় বিনিয়োগ তারা ঘটিয়েছে।

আমরা একমুখী শিক্ষা অবশ্যই চাই; কিন্তু সেই একমুখী শিক্ষা হচ্ছে ইংরেজি, বাংলা ও মাদ্রাসা যে তিন ধারার শিক্ষা, এদের এক করার এবং সেই একত্রকরণের ভিত্তিতে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থারই প্রথম কথা হওয়া দরকার; আমাদের সংবিধানেও ওই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু যা গড়ে উঠেছে তা হলো, তিনমুখী ব্যবস্থা; সরকার চাইছিল তিনমুখীকে দুইমুখী করতে—যার একটি হবে ইংরেজি মাধ্যমের, অপরটি মাধ্যমিক+মাদ্রাসার। সমাজে যেমন ধনী ও দরিদ্র এই দুই শ্রেণির বিভাজনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে, শিক্ষাক্ষেত্রকেও তেমনি সেই চেষ্টারই অংশ হিসেবে ব্যবহার করাটাই ছিল সরকারের অভিপ্রায়। ওদিকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক সামাজিক বিনিয়োগ ঘটেছে এবং তা ক্রমাগত বাড়ছে। এই শিক্ষা পেয়ে যারা বেরিয়ে আসছে এবং আগামী দেনে আসবে, তারা হবে ফাঁপা ও উৎপাটিত। মা-বাবা পয়সা ঢেলে এই রকমের কৃত্রিম মানুষ তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছেন।

শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার সরকারি প্রচেষ্টাটার হাত থেকে আমরা আপাত রেহাই পেয়েছি। সরকার বলছে স্থগিত করা হয়েছে মাত্র, বাতিল করা হয়নি। বাতিলও হবে, যদি প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। আসল কথা ওইটাই, প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কিন্তু প্রতিরোধ তো যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন নতুন সৃষ্টিরও। সৃষ্টির অংশ হিসেবেই প্রতিরোধ চাই। আর সৃষ্টির জন্য আবশ্যক সমষ্টিগত স্বপ্ন।

লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত