Ajker Patrika

শুধু চা-নাস্তায় খরচ সোয়া কোটি টাকা

আবু বকর ছিদ্দিক, চট্টগ্রাম
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪: ৪২
শুধু চা-নাস্তায় খরচ সোয়া কোটি টাকা

দেশে সার উৎপাদনের বড় প্রতিষ্ঠান চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডে (সিইউএফএল) গেল বছর ৩৫ দিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণ হয়েছে। এই ৩৫ দিনে প্রতিষ্ঠানটির ২১৫ জন কর্মী শুধু চা-নাস্তা খেয়েছেন ১ কোটি ২৮ লাখ টাকার। খরচের এখানেই শেষ নেই। আরও আছে খাট-পালঙ্ক, বেডশিট, বালিশ কেনা এবং রেস্টহাউস মেরামতের ব্যয়। এতে খরচ দেখানো হয়েছে আরও ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির নিজের খরচের হিসাব থেকেই এ তথ্য মিলেছে।

সিইউএফএলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছরের ২৬ জুন থেকে ৩১ জুলাই—এই ৩৫ দিন চলে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। এতে মোট খরচ দেখানো হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। এত টাকা ব্যয়ের পর মাত্র চার মাস চলেছে কারখানাটি। এরপর ৩ ডিসেম্বর আবার বন্ধ হয়ে যায় সার উৎপাদন। ৭৯ দিন উৎপাদন বন্ধ থাকার পর ২০ ফেব্রুয়ারি আবার শুরু হয় উৎপাদন। এই ৭৯ দিনে শুধু সার উৎপাদনে ক্ষতি হয়েছে ন্যূনতম ১৩২ কোটি টাকা। এ ছাড়া অ্যামোনিয়া উৎপাদনের ক্ষতিও আছে। এর পাশাপাশি সিইউএফএল বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারদরে কাফকো থেকে সার কিনতে হয়েছে সরকারকে। ফলে সরকারের ক্ষতি ছিল ত্রিমুখী।

সিইউএফএলের এই রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরুর সময় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে ছিলেন মো. আবদুর রহিম। যোগাযোগ করা হলে আবদুর রহিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি এখন চাকরিতে নাই। রক্ষণাবেক্ষণের নামে কী হয়েছে, যাঁরা দায়িত্বে আছেন তাঁরাই বলবেন। আমি কিছু বলতে পারব না।’

বর্তমান এমডি আকতারুজ্জামানের দাবি, ‘এই সবকিছু আমার আগের এমডি সাহেবের আমলের। আমি দায় নেব কেন?’ তাঁদের বক্তব্য, সিইউএফএলের যন্ত্রপাতি পুরোনো ও অকেজো হয়ে গেছে। ফলে এ রকম সমস্যা চলতেই থাকবে। তবে এই পুরোনো ও অকেজো জিনিস ঠিক করার জন্য আড়াই শ কোটি টাকা খরচ কেন করা হলো, তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা সিইউএফএলের কর্তারা দিতে পারেননি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রক্ষণাবেক্ষণকাজের জন্য দেশি-বিদেশি ২৬০ বিশেষজ্ঞ ও টেকনিশিয়ান নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো বিদেশি বিশেষজ্ঞ আসেননি। দেখা গেছে, বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ৫৩ জন দেশের বিভিন্ন কারখানা থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা। এ ছাড়া বাইরে থেকে চার শ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়, যাঁদের দৈনিক মজুরি গড়ে ৬০০ টাকা। এই খাতে খরচ হয়েছে দেড় কোটি টাকার বেশি। অথচ রক্ষণাবেক্ষণের ৩৫ দিনে সিইউএফএলের ৭২৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবাই কর্মরত ছিলেন।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, সিইউএফএলের অভিজ্ঞ ও স্থায়ী ৭২৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার পরও বহিরাগত ৬৬০ জনকে কেন নিতে হলো? আদৌ কী তাঁরা ছিলেন? নাকি এর অনেক কিছুই খাতা-কলমে? এর জবাবে সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আকতারুজ্জমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এগুলো সব সময় হয়। আগের এমডিও তা-ই করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘এ ফ্যাক্টরির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এ ছাড়া এটা কোনো সাধারণ ফ্যাক্টরি নয়, এটি কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি। এখানে প্রায় এক শ কর্মকর্তার পদ শূন্য রয়েছে। হয়তো সে জন্য এত বিশেষজ্ঞ ও টেকনিশিয়ান প্রয়োজন হতে পারে।’

এত খরচ
সিইউএফএলের খরচের হিসাবে দেখা যায়, রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা না আসায় তাঁদের জন্য বরাদ্দের ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা খরচ হয়নি। তবে দেশের ৬৬০ জনের দৈনিকভিত্তিক মজুরি, ভাতা, টিফিন ও অধিকাল ভাতা (ওভারটাইম অ্যালাউন্স) খাতে খরচ করা হয় ১৬ কোটি ৯৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় ১৪ জন বিশেষজ্ঞ ও ৫৩ জন অবসরপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ানের দৈনিক মজুরির বাইরে খাওয়া ও সার্ভিস খাতে ব্যয় দেখানো হয় ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার মনে করেন সিইউএফএলের অনেক কর্মকর্তা।

বন্ধ কারখানার জন্য এই রিফ্রেশমেন্ট অ্যালাউন্স যৌক্তিক কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সিইউএফএলের হিসাব বিভাগের একজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, আসলে অ্যালাউন্স হিসাবে জনপ্রতি দিনে ২ হাজার টাকা করে তাঁরা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন। সিইউএফএলের হিসাব শাখার উপপ্রধান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন অবশ্য এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একই শাখার আরেক উপপ্রধান মোবারক হোসেন অবশ্য বলেছেন, রক্ষণাবেক্ষণের নামে যেসব খাতে টাকা খরচ দেখানো হয়েছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা তাঁর কাছে নেই।

বিশেষজ্ঞের তালিকায় সাবেক এমডি
স্থানীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেখানো হয়, অভিযোগ আছে, তাঁদের প্রায় সবাই সাবেক এমডি মো. আবদুর রহিমের ঘনিষ্ঠ। দিনে আট ঘণ্টার জন্য ৮ হাজার টাকা অর্থাৎ মাসে ১০ দিন ডিউটির চুক্তিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ করা হয় মো. মনিরুল হককে। বছর দেড়েক আগে তিনি সিলেটের শাহজালাল সার কারখানার এমডি হিসেবে অবসরে যান। মনিরুল হকের বাড়ি ঢাকায় হলেও তিনি বিয়ে করেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়। সাবেক এমডি আবদুর রহিমের গ্রামের বাড়িও বাঁশখালীতে। যোগাযোগ করা হলে মনিরুল হক এই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

সার রক্ষার উদ্যোগ নেই
কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, ঢোকার মুখে সার মজুত রাখার জরাজীর্ণ বাল্ক গোডাউনের চালার টিন ফুটো হয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে। এতে মজুত সার নষ্ট হচ্ছে। অথচ রক্ষণাবেক্ষণের সময় রেস্টহাউস মেরামত, খাট-পালঙ্ক কেনা বা ভালো খাবারের খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এ সময় ফুটো টিন পরিবর্তনে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। এ বিষয়ে এমডি আকতারুজ্জমান বলেন, সেনাকল্যাণ সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে, শিগগিরই মেরামতকাজ শুরু হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত