Ajker Patrika

একজন কাজল দাস ও সুষম উন্নয়ন

অরুণাভ পোদ্দার
আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২২, ১২: ০২
একজন কাজল দাস ও সুষম উন্নয়ন

চেম্বার শেষ করে প্রতিদিন ঘণ্টাখানেক লোকনাথ দিঘির পাড়ে হাঁটি। তখন ফাগুন মাসের মাঝামাঝি হলেও ঠান্ডাটা পুরোপুরি যায়নি। খেয়াল করলাম, লোকনাথ দিঘির বাঁধানো পাড়ের বেশ কিছুটা অন্ধকার জায়গায় একটি গাছের নিচে পুরোনো একটি ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে বসে থাকেন একজন। শরীরে তেল চিটচিটে একটি পুরোনো সোয়েটার, তার ওপর শরীর থেকে বড় মাপের কোট, লুঙ্গির সঙ্গে এই পোশাক খুবই বেমানান। মাথায় ছেঁড়া একটি পাতলা ওয়ান টাইম ক্যাপ, দিঘির পাড় প্রতিবার প্রদক্ষিণ করার সময় তাঁর পাশ দিয়ে যখন যাই, শুনি তিনি কাশছেন। প্রতিবারই সেই পরিচিত কাশি, মনের অগোচরে শঙ্কা পেয়ে বসে। প্রতিদিন ভাবি, কাছে গিয়ে একটু আলাপ করি, জিজ্ঞেস করি ডাক্তার দেখিয়েছেন কি না। কিন্তু সংকোচ হয় যদি কিছু না বলেন, ভালোভাবে আমাকে গ্রহণ না করেন! সেদিন কাশির মাত্রাটা একটু বেশিই মনে হলো। অবশেষে মধ্যবিত্তের সংকোচ কাটিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। প্রথমে ওজন মেপে নিজের অতিরিক্ত ওজনের জন্য হাপিত্যেশ করে, এ-কথা সে-কথা বলে আলাপ জমাতে চেষ্টা করলাম। প্রথম দিকে তাঁর দিক থেকে কিছুটা জড়তা লক্ষ করলেও ধীরে ধীরে বলতে থাকলেন নিজের কথা। আমার পেশা জানার পর আরও সহজ হয়ে গেলেন।

বয়স সাতান্ন-আটান্ন কিন্তু দারিদ্র্য ও রোগের কারণে বেশি মনে হয়। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা—প্রতিদিনই বসে থাকতে হয় পার্কের নির্দিষ্ট স্থানে এই জীর্ণশীর্ণ শরীরে, প্রায় ততোধিক জীর্ণ একটি ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে। হ্যাঁ, বলছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দানবীর লোকনাথ দিঘির পাড়ে, যেখানে সকাল-সন্ধ্যা শত শত মানুষ হাঁটে ও দৌড়ায় নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে। সেখানেই বিকেল থেকে বসে থাকেন কাজল দাস। শরীরের একদিক প্যারালাইজড। দুবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অথর্ব প্রায়। তবু নিজের চিকিৎসা ও সংসার চালানোর জন্য এই শরীর নিয়েও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভাঙা একচিলতে ভাড়া বাড়িতে দুই ছেলে, ছেলের বউ ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। দুই ছেলে দোকানে কাজ করে যৎসামান্য উপার্জন করে, তাই তাঁকে এই অনিশ্চিত পেশার ওপর নির্ভর করতে হয়। সারা দিনে এই কাজে ১৫০-২০০ টাকা রোজগার করেন, তাই দিয়ে চলে সংসার ও চিকিৎসা। কাগজে কিছু ওষুধ ও ইনভেস্টিগেশন লিখে দিয়ে তাঁর পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু টাকা দিতে চাইলে প্রথমে প্রবল আপত্তি করলেন। বেশি টাকা নেবেন না, পরে জোর করে হাতে গুঁজে দিলাম। ভাবছিলাম, এই ছিন্নমূল অসহায় মানুষগুলো এখনো কতটা সৎ। তাঁর ন্যায্য পাওনার বেশি নিতে চাইলেন না। কিন্তু আমরা শিক্ষিত লোকজন হচ্ছি লোভী। আমাদের টাকা চাই, আরও টাকা চাই। যাঁর একটি বাড়ি আছে, তাঁর চাই আরও বাড়ি, আলিশান ফ্ল্যাট, নিত্যনতুন মডেলের গাড়ি, বাগানবাড়ি কত-কী!

এদিকে উন্নয়নশীল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সামনে, মাথাপিছু আয়েও আমরা এগিয়েছি। কিন্তু আমজনতার ভাগ্য কি তাতে পরিবর্তিত হয়েছে? লাখ লাখ কাজল দাসেরা আমাদের সমাজে অনাহারে, অর্ধাহারে, বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত এখন মুখ ঢেকে টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছে। আর সম্পদের বিশাল অংশ জমা হচ্ছে গুটিকয়েক পরিবারে। দুর্নীতি, ঘুষ, ব্যাংকের টাকা মেরে, ধান্দাবাজি করে একটি ক্ষুদ্র শ্রেণির হাতে কোটি কোটি টাকা। শোনা যায়, পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবার থেকে এখন নাকি ২২০০ পরিবার হয়েছে, যাদের হাতে দেশের অধিকাংশ সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক, বিমা, শিল্পকারখানা, রাজনীতি, মিডিয়া—সবকিছু। এটাই হয়তো উন্নয়ন। সারা বিশ্বেই এই অসম বণ্টন। সমাজতন্ত্রের (যদিও প্রকৃত অর্থে তা পৃথিবীতে কখনোই ছিল না) পতনের পর দ্রুত বিশ্বের ৫০ ভাগ সম্পদ কুক্ষিগত করেছে মাত্র ১ ভাগ লোক। এই বৈষম্য শুধু অন্যায় নয়, অপরাধ এবং চরম অশ্লীল।

এই বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা কী? এই বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? সাম্যবাদ, ওয়েল ফেয়ার স্টেট, গণতন্ত্র, নাকি অন্য কিছু। এই ভয়াবহ বৈষম্য সমাজে একটি বিস্ফোরণোন্মুক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। যেকোনো সময় এর বিস্ফোরণ সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা নিয়ে আসবে। আমাদের চাই সমাজের প্রতি স্তরে সুষম উন্নয়ন। একদিকে শতাব্দীর ভয়াবহ করোনা মহামারির ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি এমনিতেই নাজুক, তার ওপর গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তাকে আরও নাজুক করে তুলবে নিঃসন্দেহে। তার প্রভাবে কাজল দাসেরা নিঃশেষিত হয়ে যাবে। সেই চিন্তা করতে করতে দিঘির চারদিকের বাঁধানো রাস্তায় হাঁটছি। সংবিৎ ফিরে পেলাম কাজল দাসের সেই কাশিতে।

জানি না, এই কাশি তাঁর শরীরে বাসা বাঁধা ক্ষয়রোগের না আমাদের সমাজের অবক্ষয়ের লক্ষণ।

লেখক: চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত