গৌতম রায়
কমিউনিস্ট পার্টির প্রথাগত গণ্ডিকে অতিক্রম করে একটা সুসংবদ্ধ রাজনৈতিক অভিশ্রুতির দিকে গোটা জনসংগ্রামকে উত্তোলিত করার ডাক দিয়েছেন সেলিম। এই ডাক কিন্তু মুড়ি-মিছরিকে একদর করে ফেলার ডাক নয়।
শতবর্ষ উত্তীর্ণ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব যখন মহম্মদ সেলিমের হাতে অর্পিত হলো, তখন দলটি একই সঙ্গে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে যে ধরনের সংগ্রাম করতে হয়েছে, বর্তমান সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামের ধরনটি কিন্তু অতীতের সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতাকে অতিক্রম করে একটা নতুন আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের যে পরিসরের মধ্য দিয়ে বিশ শতকের প্রথম লগ্নে কমিউনিস্ট পার্টির প্রসার, সেই পর্যায়ে নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে আজ সাম্রাজ্যবাদের নয়া কৌশল, নয়া উদার অর্থনীতির অন্যতম দোসর ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সাঁড়াশি আক্রমণে
একটা বড় রকমের সংকটময় আবর্তের ভেতরে রয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে যে কৌশলগত রণনীতি গত শতাব্দীতে কমিউনিস্টরা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে তৈরি করতে পেরেছিলেন, সেই রণনীতির প্রয়োগের দ্বারা নয়া উদার অর্থনীতি এবং তার প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলা করা সম্ভবপর হচ্ছে না।
নয়া উদার অর্থনীতির সঙ্গে লড়াইয়ের প্রশ্নে যে আবর্ত তৈরি হয়েছে, সেই আবর্তের অন্যতম ফসল হলো—ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। নয়া উদার অর্থনীতির নাম করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে তৃতীয় বিশ্বের বাজার দখল করছে, তাদের সেই বাজার দখলের দোসরই হলো আরএসএস, বিজেপি থেকে শুরু করে মমতা, অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা ওডিশার নবীন পট্টনায়েকেরা।
এই গোটা পর্যায়ক্রমকে বুঝে কমিউনিস্ট পার্টিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার রণকৌশল নির্ধারণ করে লড়াইয়ের পথে যেতে হচ্ছে। শতবর্ষ উত্তীর্ণ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে সে কাজটির দায়িত্বভার নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই সেলিম যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন, সেটা কেবল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ক্ষেত্রেই একটা আলোকসন্ধানী দিশা দিচ্ছে, তা নয়; ভারত তথা গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নখদন্ত বিস্তারের যে নিত্যনতুন কৌশল ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জাতিভেদের প্রসার, লিঙ্গবৈষম্য, নারীর স্বাধিকারকে কোণঠাসা করা ইত্যাদি বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে নিঃসন্দেহে আগামী দিনে একটা নতুন ইঙ্গিতবাহী পর্যায়ক্রম তৈরি করবে।
প্রমোদ দাশগুপ্তের সময়ের কমিউনিস্টদের লড়াইয়ের যে আঙ্গিক, যা প্রমোদবাবু, জ্যোতিবাবু, হরেকৃষ্ণ কোঙার প্রমুখ একটা সঠিক দিশায় এগিয়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট সরকারকে শাসনকার্য পরিচালনার পটভূমি তৈরি করেছিলেন, আজকের দিনে কিন্তু পটভূমি নির্মাণের সেই আঙ্গিকের সম্পূর্ণ অদলবদল ঘটেছে।
জ্যোতিবাবু তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ লগ্নেই অনুভব করেছিলেন, দেশভাগের সময়কালে যে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন প্রায় মীমাংসিত হয়ে গিয়েছিল, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নয়া কৌশলে ভারতে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ের হাত ধরেই তা আবার নতুন করে কীভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চলেছে। এ পর্যায়টির ভয়াবহ রূপ জ্যোতিবাবু তাঁর জীবনের অন্তিম পর্যায়ে দেখে গেছেন। বারবার তিনি এই জায়গাতে লড়াইয়ের সঠিক দিশা মানুষকে দিয়েছেন। তাঁর উত্তরসূরি, তাঁর দলীয় ক্ষেত্রে অনিল বিশ্বাস, প্রশাসনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করার প্রশ্নে জ্যোতিবাবুর দেখানো সেই পথকেই আরও সময়োপযোগী করে, তীক্ষ্ণ করে তোলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এই সময়কাল থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতে কমিউনিস্টবিরোধী যে ষড়যন্ত্র, তার অঙ্গ হিসেবে কখনো কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে বা কখনো বাইরের নানা ধরনের কায়েমি, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দ্বারা পরিবেশ-পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। এই চেষ্টা যে কেবল ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরাই করেছে, তা নয়। বামপন্থার মুখোশ এঁটে সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতি করে—এমন রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের নেতৃত্ব আর তাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা বিভিন্ন এনজিও এ কাজে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। অপরপক্ষে বামফ্রন্টের ভেতরে সিপিআই (এম)-কে শায়েস্তা করার জন্য বামফ্রন্টভুক্ত অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে আদৌ ইতিবাচক ছিল না।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতির ফসল হলো, বামফ্রন্ট সরকারের ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বদানের প্রশ্নে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্ররা তাঁদের সাধ্যমতো মেধা, পরিশ্রম, মনন প্রয়োগ করে একটা জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের শাসনভার গ্রহণ করার পর থেকেই একেবারেই ফ্যাসিস্ট কায়দায় শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন, যেখানে যথার্থ কোনো বিরোধীকে তিনি এতটুকু মাথা তুলতে দেননি। ফলে ওই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের বুকে কমিউনিস্ট পার্টিকে রাজনীতির ময়দানে সেভাবে দেখার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তির তৈরি করা বহু বাধা ছিল। ভারতের সব ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তির যৌথ ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে এ রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যেই কিন্তু মহম্মদ সেলিম কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী) প্রাদেশিক শাখার দায়িত্ব নেন।
তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার আগে দুই বছর কোভিড পরিস্থিতির কারণে, তার দোহাই দিয়ে কার্যত গোটা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকেই একেবারে ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করেছিল যৌথভাবে দিল্লির শাসক বিজেপি এবং পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে দলের প্রায় সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের পোশাকি বিরোধিতার পথে নয়, একেবারে মাঠে-ময়দানে শান্তিপূর্ণ অথচ দৃঢ়প্রতিরোধের সংগ্রামে অবতীর্ণ করার অসামান্য সাফল্য সেলিমের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে।
যেকোনো ঘটনাক্রমে দলের প্রাদেশিক শাখা সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে একেবারে আমজনতার মতো, বাসে-ট্রামে-ট্রেনে করে, এমনকি গেরিলা কায়দায় মোটরবাইকে চড়ে, প্রশাসনের চোখে কার্যত ধুলো দিয়ে, অকুস্থলে সেলিমের পৌঁছে যাওয়া, সেটা কেবল প্রচারমাধ্যম নয়, সেটা কেবল কমিউনিস্ট পার্টির দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নয়, রাজ্য বা কেন্দ্রে শাসক বিজেপি বা তৃণমূলের ভেতরে যাঁরা নানা ধরনের অনাচার ঘিরে ক্রমেই শাসক শিবিরের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছেন, তাঁদের মধ্যেও ঘোরতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আর শাসক শিবির তো বিরোধীদের ফেসবুক-টুইটারে নিশ্চিন্ত নিরাপদ আবেষ্টনীতে সুখে রাজ্যপাট চালিয়ে যাওয়ার সুখনিদ্রা ভেঙে সেলিম-আতঙ্কে রীতিমতো আতঙ্কিত।
কমিউনিস্ট পার্টির প্রথাগত গণ্ডিকে অতিক্রম করে একটা সুসংবদ্ধ রাজনৈতিক অভিশ্রুতির দিকে গোটা জনসংগ্রামকে উত্তোলিত করার ডাক দিয়েছেন সেলিম। এই ডাক কিন্তু মুড়ি-মিছরিকে একদর করে ফেলার ডাক নয়। বহুদিন ধরেই বিরোধী আসনে থাকাকালে কিছু কিছু কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্বের ভেতর থেকে মাঠ বড় করার কথা শুনতে পাওয়া যায়। সেই বড় মাঠে এমন অনেক মানুষকে দেখতে পাওয়া যায়, যাঁরা ধারাবাহিকভাবে বামফ্রন্ট সরকারকে উচ্ছেদ করার জাতীয়, আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সঙ্গে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়েও কৃতকর্মের জন্য কোনো রকম লজ্জা, ক্ষমা ইত্যাদির ধারপাশ দিয়ে না হেঁটে নিজেদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা বাড়ানোর লক্ষ্যে আবার চেষ্টা করেছেন কমিউনিস্ট শিবিরের মধ্যে ভিড়তে।
এ ধরনের মানুষদের উদ্দেশে সেলিমের যে স্পষ্ট বার্তা, তাঁরা ভিড়তে চাইলে সালকো সরেনের লাশ দেখিয়ে দেওয়া, এমন স্পষ্ট কথা বলার ভেতর দিয়েই সেলিম বুঝিয়ে দিয়েছেন; শতবর্ষ উত্তীর্ণ কমিউনিস্ট পার্টিকে দিনবদলের হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরার লক্ষ্যে কোনো রকম বেইমানিকে তিনি বা তাঁর সহযোদ্ধারা একটিবারের জন্য বরদাশত করবেন না। নন্দীগ্রাম পর্বের ভয়াবহ চক্রান্তে অপর্ণা সেনের মতো নামজাদা অভিনেত্রী শহীদ বেদিতে লাথি মেরে কমিউনিস্টদের প্রতি নিজের রাগ দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও এই অপর্ণা সেনই নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজন, তা পারিবারিক সমস্যাই হোক বা চিত্রনাট্য উদ্ধারই হোক, শ্যামলী গুপ্ত থেকে সেলিম—সবাইকে এককালে তোয়াজ করার কৌশল থেকে নিজেকে কখনো আড়াল করেননি।
এই মানুষেরা, আজ আবার সেলিম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের ত্যাগতিতিক্ষা, আত্মসংযম, সাহস দৃঢ়তার বলে কমিউনিস্ট পার্টি যে নতুন করে পশ্চিমবঙ্গের বুকে দিনবদলের আভাস দিচ্ছে, তা অনুমান করেই আবার প্রগতিশীল সাজার ভান করছেন। তাঁদের মতো লোকদের সম্পর্কে সেলিম যে বার্তা উচ্চারণ করেছেন, তা শুধু বাস্তবের নিরিখেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাঠ বড় করার নাম করে শত্রুশিবিরকে মাঠে অন্তর্ভুক্ত করার, শত্রুশিবিরের প্রতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সবকিছু দেখার যে মানসিকতা তৈরি হয়েছিল কিছু কিছু লোকের মধ্যে, সেই জায়গাতেও কোনো রকম মধ্যপন্থা নয়, কোনো রকম আপসকামী মানসিকতা নয়—একটা স্পষ্ট বার্তা দিয়ে, একটা সঠিক পথ অবলম্বন করে, সেলিম দেখিয়ে দিয়েছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অযথা সময় নষ্ট করে, গোটা রাজনৈতিক কার্যক্রমকে দুর্বল করে দেওয়ার মতো মানসিকতা নিয়ে তিনি রাজনীতি করেন না।
লেখক: গৌতম রায়, ইতিহাসবিদ ও প্রাবন্ধিক
কমিউনিস্ট পার্টির প্রথাগত গণ্ডিকে অতিক্রম করে একটা সুসংবদ্ধ রাজনৈতিক অভিশ্রুতির দিকে গোটা জনসংগ্রামকে উত্তোলিত করার ডাক দিয়েছেন সেলিম। এই ডাক কিন্তু মুড়ি-মিছরিকে একদর করে ফেলার ডাক নয়।
শতবর্ষ উত্তীর্ণ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব যখন মহম্মদ সেলিমের হাতে অর্পিত হলো, তখন দলটি একই সঙ্গে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে যে ধরনের সংগ্রাম করতে হয়েছে, বর্তমান সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামের ধরনটি কিন্তু অতীতের সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতাকে অতিক্রম করে একটা নতুন আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের যে পরিসরের মধ্য দিয়ে বিশ শতকের প্রথম লগ্নে কমিউনিস্ট পার্টির প্রসার, সেই পর্যায়ে নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে আজ সাম্রাজ্যবাদের নয়া কৌশল, নয়া উদার অর্থনীতির অন্যতম দোসর ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সাঁড়াশি আক্রমণে
একটা বড় রকমের সংকটময় আবর্তের ভেতরে রয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে যে কৌশলগত রণনীতি গত শতাব্দীতে কমিউনিস্টরা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে তৈরি করতে পেরেছিলেন, সেই রণনীতির প্রয়োগের দ্বারা নয়া উদার অর্থনীতি এবং তার প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলা করা সম্ভবপর হচ্ছে না।
নয়া উদার অর্থনীতির সঙ্গে লড়াইয়ের প্রশ্নে যে আবর্ত তৈরি হয়েছে, সেই আবর্তের অন্যতম ফসল হলো—ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। নয়া উদার অর্থনীতির নাম করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে তৃতীয় বিশ্বের বাজার দখল করছে, তাদের সেই বাজার দখলের দোসরই হলো আরএসএস, বিজেপি থেকে শুরু করে মমতা, অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা ওডিশার নবীন পট্টনায়েকেরা।
এই গোটা পর্যায়ক্রমকে বুঝে কমিউনিস্ট পার্টিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার রণকৌশল নির্ধারণ করে লড়াইয়ের পথে যেতে হচ্ছে। শতবর্ষ উত্তীর্ণ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে সে কাজটির দায়িত্বভার নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই সেলিম যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন, সেটা কেবল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ক্ষেত্রেই একটা আলোকসন্ধানী দিশা দিচ্ছে, তা নয়; ভারত তথা গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নখদন্ত বিস্তারের যে নিত্যনতুন কৌশল ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জাতিভেদের প্রসার, লিঙ্গবৈষম্য, নারীর স্বাধিকারকে কোণঠাসা করা ইত্যাদি বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে নিঃসন্দেহে আগামী দিনে একটা নতুন ইঙ্গিতবাহী পর্যায়ক্রম তৈরি করবে।
প্রমোদ দাশগুপ্তের সময়ের কমিউনিস্টদের লড়াইয়ের যে আঙ্গিক, যা প্রমোদবাবু, জ্যোতিবাবু, হরেকৃষ্ণ কোঙার প্রমুখ একটা সঠিক দিশায় এগিয়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট সরকারকে শাসনকার্য পরিচালনার পটভূমি তৈরি করেছিলেন, আজকের দিনে কিন্তু পটভূমি নির্মাণের সেই আঙ্গিকের সম্পূর্ণ অদলবদল ঘটেছে।
জ্যোতিবাবু তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ লগ্নেই অনুভব করেছিলেন, দেশভাগের সময়কালে যে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন প্রায় মীমাংসিত হয়ে গিয়েছিল, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নয়া কৌশলে ভারতে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ের হাত ধরেই তা আবার নতুন করে কীভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চলেছে। এ পর্যায়টির ভয়াবহ রূপ জ্যোতিবাবু তাঁর জীবনের অন্তিম পর্যায়ে দেখে গেছেন। বারবার তিনি এই জায়গাতে লড়াইয়ের সঠিক দিশা মানুষকে দিয়েছেন। তাঁর উত্তরসূরি, তাঁর দলীয় ক্ষেত্রে অনিল বিশ্বাস, প্রশাসনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করার প্রশ্নে জ্যোতিবাবুর দেখানো সেই পথকেই আরও সময়োপযোগী করে, তীক্ষ্ণ করে তোলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এই সময়কাল থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতে কমিউনিস্টবিরোধী যে ষড়যন্ত্র, তার অঙ্গ হিসেবে কখনো কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে বা কখনো বাইরের নানা ধরনের কায়েমি, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দ্বারা পরিবেশ-পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। এই চেষ্টা যে কেবল ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরাই করেছে, তা নয়। বামপন্থার মুখোশ এঁটে সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতি করে—এমন রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের নেতৃত্ব আর তাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা বিভিন্ন এনজিও এ কাজে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। অপরপক্ষে বামফ্রন্টের ভেতরে সিপিআই (এম)-কে শায়েস্তা করার জন্য বামফ্রন্টভুক্ত অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে আদৌ ইতিবাচক ছিল না।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতির ফসল হলো, বামফ্রন্ট সরকারের ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বদানের প্রশ্নে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্ররা তাঁদের সাধ্যমতো মেধা, পরিশ্রম, মনন প্রয়োগ করে একটা জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের শাসনভার গ্রহণ করার পর থেকেই একেবারেই ফ্যাসিস্ট কায়দায় শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন, যেখানে যথার্থ কোনো বিরোধীকে তিনি এতটুকু মাথা তুলতে দেননি। ফলে ওই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের বুকে কমিউনিস্ট পার্টিকে রাজনীতির ময়দানে সেভাবে দেখার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তির তৈরি করা বহু বাধা ছিল। ভারতের সব ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ও প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক শক্তির যৌথ ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে এ রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যেই কিন্তু মহম্মদ সেলিম কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী) প্রাদেশিক শাখার দায়িত্ব নেন।
তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার আগে দুই বছর কোভিড পরিস্থিতির কারণে, তার দোহাই দিয়ে কার্যত গোটা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকেই একেবারে ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করেছিল যৌথভাবে দিল্লির শাসক বিজেপি এবং পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে দলের প্রায় সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের পোশাকি বিরোধিতার পথে নয়, একেবারে মাঠে-ময়দানে শান্তিপূর্ণ অথচ দৃঢ়প্রতিরোধের সংগ্রামে অবতীর্ণ করার অসামান্য সাফল্য সেলিমের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে।
যেকোনো ঘটনাক্রমে দলের প্রাদেশিক শাখা সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে একেবারে আমজনতার মতো, বাসে-ট্রামে-ট্রেনে করে, এমনকি গেরিলা কায়দায় মোটরবাইকে চড়ে, প্রশাসনের চোখে কার্যত ধুলো দিয়ে, অকুস্থলে সেলিমের পৌঁছে যাওয়া, সেটা কেবল প্রচারমাধ্যম নয়, সেটা কেবল কমিউনিস্ট পার্টির দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নয়, রাজ্য বা কেন্দ্রে শাসক বিজেপি বা তৃণমূলের ভেতরে যাঁরা নানা ধরনের অনাচার ঘিরে ক্রমেই শাসক শিবিরের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছেন, তাঁদের মধ্যেও ঘোরতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আর শাসক শিবির তো বিরোধীদের ফেসবুক-টুইটারে নিশ্চিন্ত নিরাপদ আবেষ্টনীতে সুখে রাজ্যপাট চালিয়ে যাওয়ার সুখনিদ্রা ভেঙে সেলিম-আতঙ্কে রীতিমতো আতঙ্কিত।
কমিউনিস্ট পার্টির প্রথাগত গণ্ডিকে অতিক্রম করে একটা সুসংবদ্ধ রাজনৈতিক অভিশ্রুতির দিকে গোটা জনসংগ্রামকে উত্তোলিত করার ডাক দিয়েছেন সেলিম। এই ডাক কিন্তু মুড়ি-মিছরিকে একদর করে ফেলার ডাক নয়। বহুদিন ধরেই বিরোধী আসনে থাকাকালে কিছু কিছু কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্বের ভেতর থেকে মাঠ বড় করার কথা শুনতে পাওয়া যায়। সেই বড় মাঠে এমন অনেক মানুষকে দেখতে পাওয়া যায়, যাঁরা ধারাবাহিকভাবে বামফ্রন্ট সরকারকে উচ্ছেদ করার জাতীয়, আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সঙ্গে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়েও কৃতকর্মের জন্য কোনো রকম লজ্জা, ক্ষমা ইত্যাদির ধারপাশ দিয়ে না হেঁটে নিজেদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা বাড়ানোর লক্ষ্যে আবার চেষ্টা করেছেন কমিউনিস্ট শিবিরের মধ্যে ভিড়তে।
এ ধরনের মানুষদের উদ্দেশে সেলিমের যে স্পষ্ট বার্তা, তাঁরা ভিড়তে চাইলে সালকো সরেনের লাশ দেখিয়ে দেওয়া, এমন স্পষ্ট কথা বলার ভেতর দিয়েই সেলিম বুঝিয়ে দিয়েছেন; শতবর্ষ উত্তীর্ণ কমিউনিস্ট পার্টিকে দিনবদলের হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরার লক্ষ্যে কোনো রকম বেইমানিকে তিনি বা তাঁর সহযোদ্ধারা একটিবারের জন্য বরদাশত করবেন না। নন্দীগ্রাম পর্বের ভয়াবহ চক্রান্তে অপর্ণা সেনের মতো নামজাদা অভিনেত্রী শহীদ বেদিতে লাথি মেরে কমিউনিস্টদের প্রতি নিজের রাগ দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও এই অপর্ণা সেনই নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজন, তা পারিবারিক সমস্যাই হোক বা চিত্রনাট্য উদ্ধারই হোক, শ্যামলী গুপ্ত থেকে সেলিম—সবাইকে এককালে তোয়াজ করার কৌশল থেকে নিজেকে কখনো আড়াল করেননি।
এই মানুষেরা, আজ আবার সেলিম ও তাঁর সহযোদ্ধাদের ত্যাগতিতিক্ষা, আত্মসংযম, সাহস দৃঢ়তার বলে কমিউনিস্ট পার্টি যে নতুন করে পশ্চিমবঙ্গের বুকে দিনবদলের আভাস দিচ্ছে, তা অনুমান করেই আবার প্রগতিশীল সাজার ভান করছেন। তাঁদের মতো লোকদের সম্পর্কে সেলিম যে বার্তা উচ্চারণ করেছেন, তা শুধু বাস্তবের নিরিখেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাঠ বড় করার নাম করে শত্রুশিবিরকে মাঠে অন্তর্ভুক্ত করার, শত্রুশিবিরের প্রতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সবকিছু দেখার যে মানসিকতা তৈরি হয়েছিল কিছু কিছু লোকের মধ্যে, সেই জায়গাতেও কোনো রকম মধ্যপন্থা নয়, কোনো রকম আপসকামী মানসিকতা নয়—একটা স্পষ্ট বার্তা দিয়ে, একটা সঠিক পথ অবলম্বন করে, সেলিম দেখিয়ে দিয়েছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অযথা সময় নষ্ট করে, গোটা রাজনৈতিক কার্যক্রমকে দুর্বল করে দেওয়ার মতো মানসিকতা নিয়ে তিনি রাজনীতি করেন না।
লেখক: গৌতম রায়, ইতিহাসবিদ ও প্রাবন্ধিক
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪