বিভুরঞ্জন সরকার
দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষের দৃষ্টি এখন আওয়ামী লীগের সম্মেলনের দিকে। ক্ষমতাসীন এই দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলন আগামী ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে। ৪ নভেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সম্মেলনের এই তারিখ চূড়ান্ত করা হয়। দুই দিনব্যাপী সম্মেলন করার রেওয়াজ থাকলেও এবার জাতীয়-আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে খরচ কমাতে এবং সমালোচনা এড়াতে এক দিনেই শেষ করা হবে। সম্মেলনে কোনো ধরনের জাঁকজমক হবে না। তবে সম্মেলন সফল করতে ১১টি উপকমিটি গঠনের মাধ্যমে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছে দলটি। কাউন্সিলর ও ডেলিগেট তালিকা তৈরি করতে চিঠি পাঠানো হয়েছে জেলাগুলোতে। গঠনতন্ত্র মেনে জনসংখ্যার হার অনুযায়ী কাউন্সিলর ও ডেলিগেটের তালিকা করে আওয়ামী লীগ।
জেলার প্রতি ২৫ হাজার জনসংখ্যার জন্য একজন করে কাউন্সিলর এবং এর দ্বিগুণ ডেলিগেট হবেন। এবার সম্মেলনে ৮ হাজার কাউন্সিলর ও ১৬ হাজার ডেলিগেট থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া যথেষ্টসংখ্যক ‘সম্মানিত অতিথি’ উপস্থিত থাকবেন।
সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্মেলন করছে আওয়ামী লীগ। দলের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে সম্মেলন হয়েছে ৪৪টির। এর মধ্যে অনেক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়েছে। জাতীয় সম্মেলনের আগে সব সাংগঠনিক জেলাসহ সহযোগী সংগঠনের মধ্যে মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের সম্মেলন করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম এই রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বলেই এই দলকে নিয়ে ভিন্ন ধরনের আবেগ কাজ করে অনেকের মধ্যে। এটা বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ইতিহাসও একীভূত হয়ে আছে। তবে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এক কি না, সে প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি এটাও অনেকের জিজ্ঞাসা যে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও আমাদের দেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল কেন গড়ে উঠল না? কেন রাজনীতিটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে?
আহমদ ছফার একটি কথা আছে: আওয়ামী লীগ যখন জেতে, তখন শেখ হাসিনা তথা কিছু মুষ্টিমেয় নেতা জেতেন, আর আওয়ামী লীগ যখন হারে, গোটা বাংলাদেশ তখন পরাজিত হয়। আহমদ ছফার এই বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন না, আবার সব মানুষ বিএনপিরও সমর্থক নন। এই দুই দলের বাইরেও রাজনৈতিক দল আছে এবং সেসব দলেরও কমবেশি সমর্থকগোষ্ঠী আছে। তবে মোটাদাগে, দেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৃত্তে বন্দী হলেও এই দুই দলের জয়-পরাজয়ের তাৎপর্য আবার এক নয়।
বিএনপি বহু বছর ক্ষমতার বাইরে কিন্তু তাদের এই ক্ষমতায় না থাকার ক্ষতি শুধু তাদেরই। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে বলে আওয়ামী বৃত্তের কিছু মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার কথা যেমন সত্য, তেমনি গোটা দেশের অগ্রগতি যে হয়েছে, সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। উন্নতি সুষম হয়নি। দেশে ধনবৈষম্য দৃষ্টিকটুভাবেই বেড়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দেশে কি বড় রকম কোনো সমস্যা দেখা দেবে? যদি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতে, অর্থনৈতিক নীতিতে বড় কোনো তফাত না থাকে, তাহলে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ, না বিএনপি—সেটা কি বড় প্রশ্ন হওয়ার কথা?
বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা। এক বছর পর দেশে আরও একটি নির্বাচন হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী নির্বাচনেও কি আওয়ামী লীগ জিতবে, নাকি আওয়ামী লীগ হেরে গোটা বাংলাদেশকে হারাবে?
যাঁরা বাংলাদেশের পরাজয় দেখতে চান না, তাঁরা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের দিকে কৌতূহলের সঙ্গে নজর রাখছেন এই কারণে, দলটি পরবর্তী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য কাদের ওপর নির্ভর করবে, তা ঠিক হবে এই সম্মেলনে নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে তিন বছর মেয়াদের জন্য নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। আগের তিন বছর দলটি কেমন চলল, সেটা নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা হওয়ার কথা। সেখানে প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনার পর কাউন্সিলররা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পারফরম্যান্স এবং দলের সমর্থক ভোটার, স্থানীয় ও জাতীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নতুন নেতৃত্বকে নির্বাচিত করবেন—এটাই রীতি। কিন্তু সম্মেলনে এই রীতি কি মেনে চলা হবে?
ভোটের মাধ্যমে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয় না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নির্বাচন যেভাবে হয়, তাকে গণতান্ত্রিক বলা চলে না। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামত উপেক্ষিত হয়। নবীন-প্রবীণের সংমিশ্রণে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়। প্রবীণের অভিজ্ঞতা ও নবীনের উদ্যমই যেকোনো রাজনৈতিক দলের বড় সম্পদ বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কমিটি গঠনের সময় কি এই বিবেচনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়?
আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন নেই, এমন নেতাদেরই কমিটিতে প্রাধান্য দেখা যায়। যৌথ নেতৃত্বের কথা বলা হয়। কার্যত তা হয় না। এতে চাপ বাড়ে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার ওপর। একজনের ওপর সব বিষয়ে নির্ভরতা ভালো নয়।
নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণে রাজনৈতিক দলগুলোর অনীহার কারণ কী—সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দল। এই দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হলে তা অন্য দলকেও প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি ‘হাত তোলা’ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখে এবং সব ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এককভাবে সভাপতির ওপর অর্পিত হতে থাকে, তাহলে একে কি সত্যিকার গণতন্ত্রচর্চার প্রতিফলন বলে মেনে নেওয়া যায়? শেখ হাসিনা যাঁদের বিশ্বস্ত এবং কাজের লোক মনে করেন, তাঁদেরই নির্বাচনের মাধ্যমে জিতিয়ে আনলে অসুবিধা কোথায়? বলা হবে যে কাউন্সিলররা ভোটাভুটিতে যেতে না চাইলে বা কেউ স্বেচ্ছায় কোনো পদের জন্য প্রার্থী হতে না চাইলে কী করার থাকে? এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলা যায় যে শেখ হাসিনা নিজে ভোটাভুটি চাইলে কাউন্সিলররা তাতে দ্বিমত করবেন—এটা কেমন যেন অস্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয়। নেতৃত্ব নির্বাচনে যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা না হলে আগামী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে কতটুকু লাভবান হবে, তা বলা মুশকিল।
নেতৃত্ব নির্বাচন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও রাজনীতিসচেতন মহল এ ব্যাপারে নিস্পৃহ থাকতে পারে না। দলটির রাজনীতি দেশের রাজনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে থাকে। সে জন্যই আওয়ামী লীগের নিজস্ব বিষয়েও মানুষের আগ্রহ-কৌতূহল বেশি।
২০০৯ সালে দলীয় এক সভায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ভোগে নয়, ত্যাগে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ সরকার শাসক নয়, জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করতে চায়। দলের কোনো পর্যায়ের কোনো নেতা-কর্মীর ব্যক্তিগত লোভ-লালসা বা অন্যায় আচরণের কারণে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। অসৎ পথে অর্জিত অর্থসম্পদ কিছুকাল ভোগ করা যায়। কিন্তু জনগণের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। আমাদের আগে যে দল ক্ষমতায় ছিল তারা মনে করত লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা অর্জন করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা যাবে, সুখ কেনা যাবে। যে কারণে জনগণের কথা না ভেবে অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করেছিল। তা কি তাদের কাজে লেগেছে? কাজে লাগেনি। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। (সংবাদ, ২৫ জুলাই ২০০৯) দলের সভাপতির এই বক্তব্য কর্মী-সমর্থকেরা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন বলে কি এখন মনে হয়? ভালো কথা বলাটাই শেষ কথা নয়। কথা অনুযায়ী কাজ হয় কি না, সেটাও দেখার বিষয়। ভালো কথার মূল্য ক্ষণস্থায়ী, ভালো কাজের মূল্য দীর্ঘস্থায়ী।
২০০৯ সালের অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক সভায় বলেছিলেন, ‘দুর্নীতিকে আশ্রয় দিয়ে দিনবদল সম্ভব নয়। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত দিনবদলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে দুর্নীতিকে চিরদিনের জন্য “না” বলতে হবে। আমরা অতীতের হানাহানি ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতিতে ফিরে যেতে চাই না। অতীতের মতো একটি ভবন বানিয়ে দুর্নীতিকে প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক রূপ দিতে চাই না। আমরা বাংলাদেশকে বদলে দিতে চাই।’
আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের শাসন বাংলাদেশকে সত্যি কতটুকু বদলে দিয়েছে, তার একটি হিসাব-নিকাশ কি আগামী সম্মেলনে করা হবে?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষের দৃষ্টি এখন আওয়ামী লীগের সম্মেলনের দিকে। ক্ষমতাসীন এই দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলন আগামী ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে। ৪ নভেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সম্মেলনের এই তারিখ চূড়ান্ত করা হয়। দুই দিনব্যাপী সম্মেলন করার রেওয়াজ থাকলেও এবার জাতীয়-আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে খরচ কমাতে এবং সমালোচনা এড়াতে এক দিনেই শেষ করা হবে। সম্মেলনে কোনো ধরনের জাঁকজমক হবে না। তবে সম্মেলন সফল করতে ১১টি উপকমিটি গঠনের মাধ্যমে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছে দলটি। কাউন্সিলর ও ডেলিগেট তালিকা তৈরি করতে চিঠি পাঠানো হয়েছে জেলাগুলোতে। গঠনতন্ত্র মেনে জনসংখ্যার হার অনুযায়ী কাউন্সিলর ও ডেলিগেটের তালিকা করে আওয়ামী লীগ।
জেলার প্রতি ২৫ হাজার জনসংখ্যার জন্য একজন করে কাউন্সিলর এবং এর দ্বিগুণ ডেলিগেট হবেন। এবার সম্মেলনে ৮ হাজার কাউন্সিলর ও ১৬ হাজার ডেলিগেট থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া যথেষ্টসংখ্যক ‘সম্মানিত অতিথি’ উপস্থিত থাকবেন।
সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্মেলন করছে আওয়ামী লীগ। দলের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে সম্মেলন হয়েছে ৪৪টির। এর মধ্যে অনেক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়েছে। জাতীয় সম্মেলনের আগে সব সাংগঠনিক জেলাসহ সহযোগী সংগঠনের মধ্যে মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের সম্মেলন করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম এই রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বলেই এই দলকে নিয়ে ভিন্ন ধরনের আবেগ কাজ করে অনেকের মধ্যে। এটা বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ইতিহাসও একীভূত হয়ে আছে। তবে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এক কি না, সে প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি এটাও অনেকের জিজ্ঞাসা যে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও আমাদের দেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল কেন গড়ে উঠল না? কেন রাজনীতিটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে?
আহমদ ছফার একটি কথা আছে: আওয়ামী লীগ যখন জেতে, তখন শেখ হাসিনা তথা কিছু মুষ্টিমেয় নেতা জেতেন, আর আওয়ামী লীগ যখন হারে, গোটা বাংলাদেশ তখন পরাজিত হয়। আহমদ ছফার এই বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন না, আবার সব মানুষ বিএনপিরও সমর্থক নন। এই দুই দলের বাইরেও রাজনৈতিক দল আছে এবং সেসব দলেরও কমবেশি সমর্থকগোষ্ঠী আছে। তবে মোটাদাগে, দেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৃত্তে বন্দী হলেও এই দুই দলের জয়-পরাজয়ের তাৎপর্য আবার এক নয়।
বিএনপি বহু বছর ক্ষমতার বাইরে কিন্তু তাদের এই ক্ষমতায় না থাকার ক্ষতি শুধু তাদেরই। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে বলে আওয়ামী বৃত্তের কিছু মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার কথা যেমন সত্য, তেমনি গোটা দেশের অগ্রগতি যে হয়েছে, সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। উন্নতি সুষম হয়নি। দেশে ধনবৈষম্য দৃষ্টিকটুভাবেই বেড়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দেশে কি বড় রকম কোনো সমস্যা দেখা দেবে? যদি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতে, অর্থনৈতিক নীতিতে বড় কোনো তফাত না থাকে, তাহলে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ, না বিএনপি—সেটা কি বড় প্রশ্ন হওয়ার কথা?
বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা। এক বছর পর দেশে আরও একটি নির্বাচন হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী নির্বাচনেও কি আওয়ামী লীগ জিতবে, নাকি আওয়ামী লীগ হেরে গোটা বাংলাদেশকে হারাবে?
যাঁরা বাংলাদেশের পরাজয় দেখতে চান না, তাঁরা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের দিকে কৌতূহলের সঙ্গে নজর রাখছেন এই কারণে, দলটি পরবর্তী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য কাদের ওপর নির্ভর করবে, তা ঠিক হবে এই সম্মেলনে নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে তিন বছর মেয়াদের জন্য নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। আগের তিন বছর দলটি কেমন চলল, সেটা নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা হওয়ার কথা। সেখানে প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনার পর কাউন্সিলররা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পারফরম্যান্স এবং দলের সমর্থক ভোটার, স্থানীয় ও জাতীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নতুন নেতৃত্বকে নির্বাচিত করবেন—এটাই রীতি। কিন্তু সম্মেলনে এই রীতি কি মেনে চলা হবে?
ভোটের মাধ্যমে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয় না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নির্বাচন যেভাবে হয়, তাকে গণতান্ত্রিক বলা চলে না। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামত উপেক্ষিত হয়। নবীন-প্রবীণের সংমিশ্রণে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়। প্রবীণের অভিজ্ঞতা ও নবীনের উদ্যমই যেকোনো রাজনৈতিক দলের বড় সম্পদ বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কমিটি গঠনের সময় কি এই বিবেচনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়?
আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন নেই, এমন নেতাদেরই কমিটিতে প্রাধান্য দেখা যায়। যৌথ নেতৃত্বের কথা বলা হয়। কার্যত তা হয় না। এতে চাপ বাড়ে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার ওপর। একজনের ওপর সব বিষয়ে নির্ভরতা ভালো নয়।
নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণে রাজনৈতিক দলগুলোর অনীহার কারণ কী—সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দল। এই দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হলে তা অন্য দলকেও প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি ‘হাত তোলা’ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখে এবং সব ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এককভাবে সভাপতির ওপর অর্পিত হতে থাকে, তাহলে একে কি সত্যিকার গণতন্ত্রচর্চার প্রতিফলন বলে মেনে নেওয়া যায়? শেখ হাসিনা যাঁদের বিশ্বস্ত এবং কাজের লোক মনে করেন, তাঁদেরই নির্বাচনের মাধ্যমে জিতিয়ে আনলে অসুবিধা কোথায়? বলা হবে যে কাউন্সিলররা ভোটাভুটিতে যেতে না চাইলে বা কেউ স্বেচ্ছায় কোনো পদের জন্য প্রার্থী হতে না চাইলে কী করার থাকে? এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলা যায় যে শেখ হাসিনা নিজে ভোটাভুটি চাইলে কাউন্সিলররা তাতে দ্বিমত করবেন—এটা কেমন যেন অস্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয়। নেতৃত্ব নির্বাচনে যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা না হলে আগামী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে কতটুকু লাভবান হবে, তা বলা মুশকিল।
নেতৃত্ব নির্বাচন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও রাজনীতিসচেতন মহল এ ব্যাপারে নিস্পৃহ থাকতে পারে না। দলটির রাজনীতি দেশের রাজনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে থাকে। সে জন্যই আওয়ামী লীগের নিজস্ব বিষয়েও মানুষের আগ্রহ-কৌতূহল বেশি।
২০০৯ সালে দলীয় এক সভায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ভোগে নয়, ত্যাগে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ সরকার শাসক নয়, জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করতে চায়। দলের কোনো পর্যায়ের কোনো নেতা-কর্মীর ব্যক্তিগত লোভ-লালসা বা অন্যায় আচরণের কারণে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। অসৎ পথে অর্জিত অর্থসম্পদ কিছুকাল ভোগ করা যায়। কিন্তু জনগণের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। আমাদের আগে যে দল ক্ষমতায় ছিল তারা মনে করত লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা অর্জন করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা যাবে, সুখ কেনা যাবে। যে কারণে জনগণের কথা না ভেবে অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করেছিল। তা কি তাদের কাজে লেগেছে? কাজে লাগেনি। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। (সংবাদ, ২৫ জুলাই ২০০৯) দলের সভাপতির এই বক্তব্য কর্মী-সমর্থকেরা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন বলে কি এখন মনে হয়? ভালো কথা বলাটাই শেষ কথা নয়। কথা অনুযায়ী কাজ হয় কি না, সেটাও দেখার বিষয়। ভালো কথার মূল্য ক্ষণস্থায়ী, ভালো কাজের মূল্য দীর্ঘস্থায়ী।
২০০৯ সালের অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক সভায় বলেছিলেন, ‘দুর্নীতিকে আশ্রয় দিয়ে দিনবদল সম্ভব নয়। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত দিনবদলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে দুর্নীতিকে চিরদিনের জন্য “না” বলতে হবে। আমরা অতীতের হানাহানি ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতিতে ফিরে যেতে চাই না। অতীতের মতো একটি ভবন বানিয়ে দুর্নীতিকে প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক রূপ দিতে চাই না। আমরা বাংলাদেশকে বদলে দিতে চাই।’
আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের শাসন বাংলাদেশকে সত্যি কতটুকু বদলে দিয়েছে, তার একটি হিসাব-নিকাশ কি আগামী সম্মেলনে করা হবে?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪