Ajker Patrika

শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ক্রমাগত অবহেলা

মামুনুর রশীদ
শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ক্রমাগত অবহেলা

প্রতিনিয়ত সংবাদপত্রে বিদেশে টাকা পাচার করার সব আশ্চর্য ঘটনা প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু এর বিহিত হিসেবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী বিদেশে নিজেদের সন্তানসন্ততিদের লেখাপড়া ছাড়াও অনেক ধরনের বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত।

শিক্ষার প্রতি প্রথম থেকেই একটা সামাজিক অবহেলা লক্ষ করা যায়। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর দেখা যায় বছরের পর বছর স্কুলের শিক্ষকেরা বেতন পাননি এবং ভাষার প্রশ্নে যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষক এই আন্দোলনে যুক্ত হন। তখন মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সামন্তবাদী চিন্তায় দেখা যায় শিক্ষাকে সংকোচন করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ইসলামি শিক্ষা এবং সেই সঙ্গে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্রে মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করার একটা ভাবনা দেখা যায়।

আটচল্লিশ সালে এই চিন্তা বাস্তবে রূপ পায়। সেই বাস্তবতায় পাকিস্তানের একনায়কতান্ত্রিক নির্দেশাবলি শিক্ষাকে আরও সংকুচিত করে ফেলে। ষাটের দশকের শরীফ কমিশন এবং হামুদুর রহমান কমিশনে তার আরও জোরালো প্রতিফলন ঘটে। ভাষা আন্দোলন সফল হলেও পাকিস্তানি শাসকেরা শিক্ষাকে সংকুচিত করার নীতি প্রবলভাবে গ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের পরে পরে স্কুলগুলো কোনো সরকারি সাহায্য ছাড়া জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে চলছিল। শুধু সরকারি স্কুলগুলো খুব অল্প বেতনে চালানো হচ্ছিল, কিন্তু সামাজিক প্রণোদনায় যে স্কুলগুলো চলছিল, সেগুলোতে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির চর্চাও চলতে থাকে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষকদের ভাগ্যের তেমন একটা উন্নতি দেখা যায় না। তবে এ সময়ে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন বাংলা ভাষায় শিক্ষাদানের প্রশ্নে ব্যাপক কার্যক্রমের সূচনা করার প্রস্তাব দেয়। যদিও এ সময়ে পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসন এসে শিক্ষাকে বহুমুখী করে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। সামরিক শাসক এরশাদের আমলে শিক্ষার এই বিশৃঙ্খলা মজিদ খান শিক্ষানীতির মাধ্যমে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সময়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থা শিক্ষার ক্ষেত্রে নানা ধরনের সংস্কারের কথা বলে। সরকার সেই সংস্কারগুলো মেনেও নেয়। কারণ, বিনিময়ে সামান্য কিছু অর্থেরও জোগান হয়।

সবচেয়ে বেশি অবহেলার স্বীকার হয় প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা একজন মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একসময় হাতেখড়ি নেওয়ার বিষয়টি প্রাচীন সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হতো। সে সময়ে সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে সমাজনেতারা শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রতি একটা গভীর যত্ন নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করতেন।

সামরিক শাসন ও তার পরবর্তী সময়ে স্কুলগুলোতে অবকাঠামো গড়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়, ঠিকাদারি সংস্থা এবং প্রকৌশলীরা মিলে অত্যন্ত নিম্নমানের পরিকল্পনা ও নির্মাণকাজ করে খুব অল্পদিনের মধ্যেই তা ধ্বংসের সম্মুখীন করেছেন। সামাজিক উদ্যোগে যে স্কুল-কলেজগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার মধ্যে একটা পরিবেশচেতনাও ছিল।

সেই পরিবেশকে ভেঙে দিয়ে নতুন যে ব্যবস্থা আনা হয়েছিল, তা একেবারেই শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী ছিল না। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের বেতনকাঠামো একেবারেই এত নিচুতে ছিল যে একজন শিক্ষকের বেতন সরকারি অফিসের পিয়নের সমান করা হয়েছিল। ফলে নিম্নমানের একজন মেধাবী ছাত্র প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের চাকরিতে আসত না। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষার মান ধসে যেতে থাকল। শিক্ষকদের চাকরি সার্বক্ষণিক হলেও যেহেতু তাঁর বেতন জীবনধারণের জন্য একেবারেই অপ্রতুল, তাই অন্য কোনো কাজ করে তাঁরা মূল কাজ শিক্ষাকে অবহেলাই করতেন। কালক্রমে শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর চেয়ে জীবনধারণের জন্য কোচিং সেন্টারগুলো প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। এ নিয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকেরা বারবার রাজপথে আন্দোলনও করতে থাকেন। কিন্তু কোনো সরকারই বিষয়টির গুরুত্ব দেয় না। বর্তমানে বেকারত্ব নিরসনের কারণে মাস্টার্স পাস করা ব্যাপকসংখ্যক তরুণ-তরুণী প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকতার জন্য প্রতিযোগিতা করতে শুরু করে। অনেক দেনদরবার ও আন্দোলনের পর বর্তমানে যে বেতনকাঠামো দাঁড়িয়েছে, তাতে এসএসসি পাস করা এবং তার আগে অষ্টম শ্রেণি পাস পিয়নের তুলনায় তার বেতনকাঠামোর সামান্য উন্নতি দেখা যায়। বর্তমান যুগে তা মাত্র তিন হাজার টাকা। আবার এই চাকরি পেতে হলে প্রবল দুর্নীতির মুখোমুখি হতে হয়। লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে দালালদের মাধ্যমে এই চাকরি নিয়ে শিক্ষকেরা নানা ধরনের অবৈধ পন্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। কোচিং-ব্যবসা, দোকানদারি, ঠিকাদারি, স্থানীয় প্রভাবশালী লোকের উমেদারি, নির্বাচনে টুকটাক কাজকর্ম করে কিছু অর্থ রোজগার ইত্যাদিতে তাঁরা নিয়োজিত হতে থাকেন।

সাম্প্রতিককালে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল সরবরাহ—এমনকি সাদা খাতায় পুরোপুরি পরীক্ষা দিয়ে ছাত্রদের পাস করার কাজটিও করে থাকেন তাঁরা। এর মধ্যে যেটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা হলো—সংস্কৃতি। সুস্থ, বৈধ এবং মূল্যবোধ নিয়ে যে জীবনযাপন, তা অতীতের মতোই দুরূহ হয়ে ওঠে। একসময় শিক্ষকেরা খেয়ে না খেয়ে মূল্যবোধটাকে বুকে সম্বল করে এই পবিত্র কাজটি করে যেতেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের প্রবল চাপে সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই অবৈধ পথ খোলা থাকলে তাকেই আঁকড়ে ধরছেন তাঁরা। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে শিক্ষার প্রতি বাংলায় একটা গুরুত্ব দেওয়ার সামাজিক তাগিদ আমরা অনুভব করতে দেখি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কালে শিক্ষা ও সংস্কৃতি একাকার হয়ে নতুন নতুন সংস্কারকাজে শিক্ষক ও ছাত্রদের ধাবিত হতে দেখা যায়। এই সময়ে বেশ কিছু নিয়মকানুন, আচার-আচরণে সংস্কারও দেখা যায়। আদর্শবান শিক্ষকের প্রেরণায় ছাত্ররাও মূল্যবোধ এবং আদর্শকে আঁকড়ে ধরে দেশপ্রেমের দিকে এগিয়ে যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শিক্ষাকে দেশপ্রেমের সমার্থক বলে বিবেচনা করতে দেখা যায়। কোনো শিক্ষার্থীকে যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হতো তাহলে সে উত্তরে বলত, শিক্ষা হচ্ছে দেশের কাজ করার জন্য। সত্যবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, বিজ্ঞানচিন্তা এবং মানুষের প্রতি গভীর মমতাবোধই শিক্ষার উদ্দেশ্য। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নেও অনেক বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করতে তরুণেরা উদ্বুদ্ধ হয়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এই ব্যবস্থা ক্রমাগত ভেঙে যেতে থাকে। পাকিস্তানে বিষয়টি গুরুতর সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু ভারতবর্ষে শিক্ষার গুরুত্বকে নতুনভাবে বিন্যাস করার প্রচেষ্টা দেখা দেয়। যে প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। শিক্ষায় কোনো দুর্নীতি সেখানে এখনো সহ্য করা হয় না। বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীরা দুর্নীতির কারণে কারাবাস করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের একজন মন্ত্রী এখনো জেলে অবস্থান করছেন। অবৈধভাবে শিক্ষকের চাকরি নেওয়ার পর তাঁকে বিপুল পরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। একজন শিক্ষক যদি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হন, তাহলে তা শিক্ষার্থীদের মাঝেও সংক্রমিত হবে—এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের সন্তানদের সাধারণ স্কুলে পড়ান না এবং অভিবাসনমুখী, তাই এর গুরুত্ব তাঁদের কাছে খুব সামান্যই। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয় না, অর্থ পাচারকে নানাভাবে প্রশ্রয় দেয়, সেখানে শিক্ষার বিষয়টি একেবারেই গৌণ হয়ে যায়। এ কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আসা শিক্ষার্থীরাই দেশের প্রশাসনে ও শিক্ষায় যুক্ত হয়। ফলে প্রশাসনও দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

বর্তমানে সরকারি অফিসগুলোতে উৎকোচ ছাড়া কোনো কাজ হয় না এবং সেই উৎকোচের পরিমাণও লক্ষকোটি টাকা। প্রতিনিয়ত সংবাদপত্রে বিদেশে টাকা পাচার করার সব আশ্চর্য ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু এর বিহিত হিসেবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী বিদেশে নিজেদের সন্তানসন্ততিদের লেখাপড়া ছাড়াও অনেক ধরনের বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত। এসবের উৎসই হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার বড় ধরনের ত্রুটি। এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না যে শিক্ষায় একটা ধস নেমেছে। পাশের দেশ পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের যে বেতনকাঠামো, তার অর্ধেক অর্থও আমাদের শিক্ষকেরা পান না। বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনকাঠামোতে এত বড় অসাম্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমাদের দেশের মন্ত্রী-আমলাদের আচরণ দেখে মনে হয় তাঁরা কখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেননি। তাঁরা দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তার কথা ভাবার কোনো সময় পান না। সারা দিন অফিস-আদালতের ফাইলপত্রে এবং মিটিংয়ে তাঁদের সময় কাটে। এই মিটিংগুলোতে সাধারণ মানুষের স্বপ্নের কতটা প্রতিফলন হয়, তা একেবারেই স্পষ্ট নয়। কিন্তু কিছু মানুষ যে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় তার প্রমাণ সর্বত্র পাওয়া যায়। তার পরও একটা বিদ্যোৎ, হিতকরী এবং স্বপ্ন দেখা মানুষের সমাজ আছে, তাঁদের সচেতনতার ওপরই আমাদের ভরসা রাখতে হচ্ছে।

লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত