Ajker Patrika

নির্বাচনী খবরের আগাম ময়নাতদন্ত

পলাশ আহসান
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০: ৩৩
নির্বাচনী খবরের আগাম ময়নাতদন্ত

লেখাটি সাংবাদিকতা নিয়ে। পাঠকও লেখাটি থেকে ভাববার খোরাক পেলে ভালো লাগবে।

আগামী সংসদ নির্বাচনের বাকি এখনো বছরখানেক। কেউ কেউ বলতে পারেন এখনই এ রকম শিরোনামের একটি লেখা একটু বাড়াবাড়ি রকম আগে হয়ে গেল। আমি অবশ্য নানা অজুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারি। বলতে পারি, নানা ধরনের নির্বাচন তো সারা বছর লেগেই থাকে। নির্বাচনী সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ তো সব নির্বাচনে একই রকম। হ্যাঁ, সেটা ঠিক। তবু আমি বলছি, এ লেখাটি আমাদের আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই লিখছি। কারণ, নির্বাচন যখন জাতীয়, তখন সেটা সব দিক দিয়ে আলাদা গুরুত্ব পায়। জাতীয় নির্বাচন কাভার করার অভিজ্ঞতা যার আছে, তার কাছে অন্য যেকোনো নির্বাচন জলের মতো সহজ হওয়ার কথা।

দীর্ঘদিন নির্বাচনী খবর প্রচারের ধারাবাহিকতায় আমাদের নির্বাচনী সংবাদের ভাগ প্রধানত তিনটি। এই তিন ভাগেই কোথাও ভুল তথ্য প্রচার করলে বিপর্যয়ের ভয় সমান মাত্রায়। সাংবাদিকতায় প্রি-ইলেকশন রিপোর্ট বলে যে ধরনটা আছে, সেটা আসলে নির্বাচনী সাংবাদিকতার প্রথম ধাপ। যেটা শুরু হয়ে গেছে কোনো কোনো গণমাধ্যমে। এই প্রি-ইলেকশন রিপোর্টিংও সাংবাদিকের জন্য কম গুরুত্বের নয়। কারণ, যেকোনো দলের প্রার্থী মনোনয়নে এ

রিপোর্টগুলো প্রভাব ফেলে। যে কারণে নির্বাচনী সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছেন সাংবাদিকেরা। আবার ঘুরিয়ে যদি বলি, নির্বাচন সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জের মধ্যেই আছেন সাংবাদিকেরা।
কেউ যদি প্রশ্ন করেন সাংবাদিকতার অন্য শাখা কি চ্যালেঞ্জমুক্ত? উত্তর হচ্ছে, না। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে কাজ করার ফলাফল খুবই তাৎক্ষণিক। আর এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে সেই চ্যালেঞ্জ বেড়েছে কয়েক গুণ।

পাঠক, চলুন, আমরা দেখে নিই প্রি-ইলেকশন রিপোর্টিং নিয়ে কেমন ঝুঁকির মুখে থাকেন সাংবাদিকেরা। যেকোনো নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতিসংক্রান্ত তথ্য প্রচার শুরু হয় নির্বাচনের অন্তত সাত-আট মাস আগে থেকে। প্রথম দিকে সংবাদের বিষয় থাকে—কারা প্রার্থী হচ্ছেন, কীভাবে প্রার্থীরা দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এই রিপোর্টিং এসে দাঁড়ায় নির্বাচনী তফসিল, কারা মনোনয়ন পেলেন, কারা পেলেন না—এই সবে। 
প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত সংবাদ থাকে প্রচার এবং প্রচারের নানা অনিয়ম নিয়ে।

এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী অপপ্রচার বা অপকৌশল নিয়ে খবর থাকে কম। এর দোষ কিন্তু সাংবাদিকদের নয়। কারণ, সাংবাদিককে লিখতে হলে প্রমাণ লাগে। অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ লাগে। 
এ নিয়ে কেউ ঠিক তথ্যটি দিতে চান না। কেউ কথা বললেও বলেন তাঁর দলীয় নিরিখে।

কিন্তু নির্বাচনের স্বার্থে এই অপকৌশলগুলো ধরে ধরে রিপোর্টিং হতে পারে। এই অপপ্রচারগুলো হয় সাধারণত কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত জীবনযাপন অথবা ধর্মকেন্দ্রিক। যে কারণে প্রার্থী তো বটেই, এলাকার বুদ্ধিজীবী শ্রেণির লোকজনও কথা বলেন না। তাঁরা মনে করেন, কী লাভ শত্রুতা বাড়িয়ে!

নির্বাচন যত কাছে আসে, নির্বাচনী খবরের প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে নির্বাচনের আগের রাত। এ সময় নানামুখী খবর ছড়ায়। এর বেশির ভাগই হয় ভোট কেনা নিয়ে। নির্বাচনে টাকা দেওয়ার ঘটনা যে ঘটে না, তা বলছি না। যেগুলো হয়, সেগুলো প্রচার হওয়া উচিত। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কোনটা তথ্য আর কোনটা গুজব, সেটা চিহ্নিত করা নিয়ে। দেখা গেল কোনো প্রার্থী টাকাই দেননি, অথচ প্রচার হলো টাকা দিতে গিয়ে তাঁর সমর্থক আটক। এই তথ্যে পরদিনের নির্বাচনে প্রভাব পড়ার শঙ্কা থাকে। কারণ, বহু ভোটার শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন এবার ভোটটি তাঁরা কাকে দেবেন। এ রকম একটি খবরে ভোটারের মন টলে যেতে পারে। তাই এ-জাতীয় ভুল তথ্য প্রচার হলে ফলাফলেও প্রভাব পড়ার শঙ্কা থেকে যায়।

এরপর আসা উচিত নির্বাচনের দিনের সাংবাদিকতার গল্পে। কিন্তু এর বিস্তার বেশি বলে সেটা পরে আরেক দিন আলোচনা করব। চলে যাচ্ছি নির্বাচন-পরবর্তী সাংবাদিকতার গল্পে। নির্বাচনের পরের সাংবাদিকতায় সাধারণত খবর থাকে নির্বাচনব্যবস্থায় ত্রুটি এবং সংঘর্ষসংক্রান্ত। ইদানীং আরেকটি বিষয় যোগ হয়েছে। সেটি হচ্ছে, বিজয়ী প্রার্থীর কী পরিকল্পনা আছে, সেটা নিয়ে বেশ ফলাও করে প্রচার হয়। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাবধান থাকা দরকার। প্রতি নির্বাচনে পরাজিত পক্ষ কখনোই ফলাফল মানতে পারে না। তারা নানাভাবে বলার চেষ্টা করে নির্বাচন বাতিল করে আবার তফসিল ঘোষণা হোক। তাই এমন কোনো অসাবধানি সংবাদ প্রকাশ হওয়া উচিত নয়, যাতে কোনো কারণ ছাড়াই একটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

নির্বাচন-পরবর্তী সংঘর্ষ আমাদের নির্বাচনী অপসংস্কৃতির একটা অংশ। নির্বাচনের পর এলাকায় কিছুদিন একধরনের উত্তেজনা থাকবেই। এ সময় এমন কোনো তথ্য প্রচার হওয়া উচিত না, যাতে কোনো পক্ষ উসকানি পায়। এ নিয়ে যার যার প্রতিষ্ঠানকে বিস্তারিত জানিয়ে রাখা ভালো। কারণ, এলাকার রসায়ন অফিস জানে না। কোন তথ্য প্রচারে এলাকার ক্ষতি হবে, তা অফিস জানতে পারলে ভুল-বোঝাবুঝি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। বিজয়ী প্রার্থীকে নিয়ে নির্বাচনের পর গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার লক্ষ করা যায়। তিনি নানা পরিকল্পনার কথা জানান সাংবাদিকদের। ওই সব খবরে সাধারণত যে তথ্য থাকে না—তিনি যে পরিকল্পনার কথা বলেছেন, এটি কতটুকু বাস্তবসম্মত অথবা যিনি বিজয়ী হলেন, তিনি এর আগেও বিজয়ী হয়েছিলেন কি না; হলে সেবার কী কী পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন, বাস্তবায়ন করেছেন তার কতটুকু। এ তথ্যগুলো থাকা দরকার।

এবার একটি গল্প বলি। গল্পটি একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের। নির্বাচন শেষ। দুই দিন পর একজন পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী তাঁর লোকজন নিয়ে হানা দিয়েছেন একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানে। সংগঠনের প্রধানকে খুঁজে বের করলেন। বললেন, ‘টাকা ফেরত দে।’ সংগঠনের প্রধান লোকটি বিব্রত। ওই প্রার্থী হিসাব দিলেন, ভোট দেওয়ার জন্য সংগঠনে কত টাকা দিয়েছিলেন। কথা ছিল, স্থানীয় কেন্দ্র থেকে তিনি একটি নির্ধারিত পরিমাণের ভোট পাবেন। কিন্তু এর তিন ভাগের এক ভাগ ভোটও পাননি।

মজার ব্যাপার হলো, ঝগড়ার একপর্যায়ে সংগঠনের প্রধান টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করলেন এবং ফেরতও দিলেন। বললেন, ওই প্রার্থীর কাছে বেশির ভাগ মানুষ ভোট বিক্রি করতে রাজি হননি। সাংবাদিকদের সজাগ থাকতে হবে, নির্বাচনের পর পাড়ায় পাড়ায় এমন নানা মজার ঘটনা ঘটে। এমন খবর, নির্বাচনী শক্ত খবর থেকে দর্শক বা পাঠকের একঘেয়েমি কাটাতে বেশ সহায়তা করে। পাশাপাশি এমন অপতৎপরতা যেন আর না হয়, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে পারে প্রশাসন। তবে সব কথার শেষ কথা—এ খবরগুলোও কিন্তু খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ সামান্য ভুল তথ্যে একজন রাজনীতিকের সারা জীবনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার 
ডুবে যেতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত