Ajker Patrika

জনগণই রাজনীতিতে শিষ্টাচার আনুক

স্বপ্না রেজা
আপডেট : ২৬ মে ২০২৩, ১০: ০৭
জনগণই রাজনীতিতে শিষ্টাচার আনুক

আবু সাইদ চাঁদ রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক। সম্ভবত বয়সের দিক থেকে মধ্য বয়সে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছেন। কিংবা তার বেশিও হতে পারে। অভিজ্ঞতাও কম হবে না বলে মনে হয়। আগে তাঁর নামটা কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তা ছাড়া ঢাকায় বসবাস করে তাঁর নাম জানাটাও সম্ভব নয়। যাঁরা সরাসরি রাজনীতি করেন না, তাঁরা সাধারণত রাজনীতি করেন এমন অনেকের নামই জানেন না। হয়তো জানার প্রয়োজন বোধ করেন না। তা ছাড়া এত এত রাজনীতিবিদ দেশের অলিতে-গলিতে যে, কয়টা নামই বা মানুষ জানতে আর মনে রাখতে পারে! 
আবার উল্টোটাও আছে। যেমন—চেনা নেই, জানা নেই এমন কেউ রাতারাতি এমন সব ঘটনা ঘটায় যে নিমেষে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে তিনি বা তারা বেশ পরিচিতি হয়ে ওঠে। এই পরিচয় সুপরিচয় নয়। বরং তার বা তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে সাধারণ মানুষ কৌতূহল বোধ করে। ফলে লোকমুখে তাদের নাম একটা সময়ে বেশ ঘোরাঘুরি করে। আবু সাইদ চাঁদ তেমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি, যাঁর নাম এখন লোকমুখে, সংবাদপত্রে, রাজপথে, ব্যানারে, ফেস্টুনে, প্রতিবাদের স্লোগানে, চায়ের টেবিলে, নানান জায়গায় এবং নানান গল্পে। যদিও রাজনৈতিক দলের কারও নাম জানাটা অরাজনৈতিক ব্যক্তির জন্য কোনো ফরজ বা সুন্নত কাজ নয়, তার পরও আবু সাইদের নাম ও তাঁকে জানাটা এখন অনেকটা ফরজ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সেটা তাঁর রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত ও ধৃষ্টতামূলক বক্তব্যের জন্য। যেমন—তাঁর বক্তব্য শুনে আমার কৌতূহল জেগেছে, লোকটা কে?

আমাদের দেশে রাজনীতি করা সহজ কাজ। যে কেউ যখন-তখন স্বল্প শিক্ষায়, অশিক্ষায়, অসচেতনভাবে রাজনীতি করতে পারে, করছেও। হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিশোধপরায়ণতাই এখন যেন রাজনীতির উপজীব্য উপাদান এবং যেটা ক্ষমতায় উপবিষ্ট হওয়ার অবলম্বন বলেই মনে করে রাজনৈতিক দলগুলো। জনগণের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টার চেয়ে প্রতিশোধমূলক কাজ ও বক্তব্য প্রদানে দলের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টাই চলে। অথচ একটা সময় ছিল যখন পড়ে, বুঝে ও নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে মানুষ রাজনীতিতে আসত। মহান ব্রত ও আদর্শ রাজনীতিবিদদের নিত্য সময়ের সঙ্গী হতো। শব্দচয়নে যেমন মন্ত্রমুগ্ধতার বিষয়টি প্রাধান্য পেত, তেমন গুরুত্ব পেত আচার-আচরণে ও পোশাকে। জ্ঞানের ঐশ্বর্য দিয়ে জনগণের মনে ঠাঁইয়ের চেষ্টা চলত।

সম্প্রতি আবু সাইদ ওরফে চাঁদ রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য প্রদান করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে ‘কবরস্থানে পাঠানো’র হুমকি দেওয়া হয়েছে। যার মানে, হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কবরস্থানে তো মৃতদেহই যায়। মৃত্যুর পর মুসলমানকে কবরে দাফন করা হয়। শেখ হাসিনা যদি অন্য ধর্মাবলম্বী হতেন, তাহলে সম্ভবত আবু সাইদ তাঁকে সেই ধর্মের নিয়ম অনুসারে শেষ ঠিকানার কথাই বলতেন। এটা পরিষ্কার যে, কবরস্থানে পাঠানোর এক দফা দাবি মূলত তাঁর প্রাণনাশেরই কথা বলা হয়েছে। কেউ কেউ ধরে নিয়েছে যে বিএনপির সব দাবি এখন এক দফায় পরিণত হয়েছে, আর সেটা হলো শেখ হাসিনাকে কবরস্থানে পাঠানো। শেখ হাসিনা যে বিএনপির টার্গেট হয়ে আছেন, সেটা আবারও স্পষ্ট হয়েছে। বিএনপির আড়ালে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। কারণ, প্রতিশোধপরায়ণতাকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যে নিবৃত্ত করে রেখেছে, তা কিন্তু ভাবা যায় না, ভাবা উচিতও নয়। বিভিন্ন সময়ে শেখ হাসিনার ওপর প্রাণনাশের যে হামলা, তা কিন্তু অনেক অপ্রিয় সত্যকে উন্মোচন করে।

একটি স্যাটেলাইট চ্যানেল আবু সাইদ ওরফে চাঁদকে চেনাল। শোনাল তাঁর হুমকি। একটা স্বাধীন দেশে এমন রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য, হুমকি দেশকে কতটা ভয়াবহ ও অস্থিতিশীল করতে পারে এবং রাজনীতিকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে, তা অনুমেয়। হুমকি দিয়ে ব্যক্তিকে হত্যা করা আর অস্ত্র দিয়ে ব্যক্তিকে হত্যা করার মধ্যকার তফাতই-বা কী? দুটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেশের প্রচলিত আইনে আশা করি আইনসংশ্লিষ্টরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন। আর যারা এমন হুমকিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, তারাও কিন্তু হত্যার সহযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়। দলীয় রাজনীতি করার মানে এই নয় যে, ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ দেখিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার অধিকার কারও আছে।

আবার দেখা গেল, আরেকজন বিএনপি নেতা অন্য একটি অঞ্চলে বক্তৃতায় বলছেন, ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার!’ জানতে ইচ্ছে হলো, পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্টের পুনরাবৃত্তি চাইছে কি বিএনপি? জনগণ কি এমন স্লোগানে তাহলে ধরে নিতে পারে যে, বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার পেছনে সরাসরি বিএনপি যুক্ত বা দায়ী? এতে কি ধরে নেওয়া ভুল হবে যে, বিএনপি হত্যার রাজনীতির রূপকার হিসেবে নিজেদের স্বীকৃতি দিয়ে ফেলছে? রাজনৈতিক বক্তব্য বিচার-বিশ্লেষণ করলে তো এমনই সত্য বের হয়ে আসে, তাই না? বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীকে কিন্তু জিয়া হত্যার বিচার চাইতে কখনো তেমন মরিয়া হতে দেখা যায়নি। এর পেছনে নানা জনের নানান গল্প আছে।

যাই হোক, এখন সময় এসেছে বুঝে নেওয়ার—সাধারণ জনগণ কেমন রাজনৈতিক দর্শন, আচার-আচরণকে পছন্দ করবে; কতটা মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতাসম্পন্ন রাজনীতিক তারা দেখতে চাইবে। এই সময়কে অর্থবহ করে তোলা সম্ভব না হলে ভবিষ্যৎ পরিণতি ভালো হওয়ার নয়। যে কেউ, যেনতেনভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া রাজনৈতিক দলের যেমন ঝুঁকি বাড়ায়, তেমনি ঝুঁকি বাড়ায় রাষ্ট্রের। উন্নত বিশ্ব বা পার্শ্ববর্তী দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে শিক্ষিত, মেধাসম্পন্ন, যোগ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধরাই সাধারণত রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তাঁরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনগণের স্বার্থ দেখেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা যেন উল্টো। ধনী ও বিত্তবান হওয়ার বাসনা নিয়েই এখন ঘরে ঘরে রাজনীতিক। শিক্ষা-দীক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর সেভাবে আছে বলে মনে হয় না।

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫২ বছর। তরুণ সমাজকে এ দেশের তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে বিবেচনা করা যায় সময়ের আলোকে। তরুণ সমাজের একটা অংশ যথেষ্ট আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক নিঃসন্দেহে। তাদের হাতেই এ দেশের ভবিষ্যৎ। আবার তারাই জীবনের একপর্যায়ে এসে দেশের দায়িত্ব তুলে দেবে আরেক প্রজন্মের হাতে। রাজনীতিকেরা যেন যাচ্ছেতাইভাবে সক্রিয় না হতে পারে, সে জন্য সচেতন তরুণ সমাজের কাজ করা জরুরি। তারা আরও ১০ জনকে সচেতন করতে পারে, যেন রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়টি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। নেতিবাচক কথা না শোনার অভ্যাসটা তৈরি হয়ে গেলে সমাজে ইতিবাচক কথা জায়গা পাবে। ইতিবাচক কথা বলতে মানুষ, বিশেষ করে রাজনীতিকেরা অভ্যস্ত হবেন।

মানুষ যা ভাবে প্রতিনিয়ত, সেটাই একসময় তার মুখ থেকে বের হয়ে আসে। হতে পারে সেটা সচেতনভাবে অথবা অবচেতনে। আবু সাইদ চাঁদ যেটা বলেছেন, সেটা তাঁর প্রতিনিয়ত চিন্তার ফলাফল এবং যার একটা পটভূমি রয়েছে। এসব সমাজবিরোধী ও রাষ্ট্রবিরোধী আচরণ। সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সংকট তৈরি হয় এমন আচরণ দ্বারাই। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত