Ajker Patrika

আগস্ট-কলঙ্ক থেকে জাতির মুক্তি কোন পথে

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
আগস্ট-কলঙ্ক থেকে জাতির মুক্তি কোন পথে

কোনো মাসকে এভাবে অভিহিত না করতে চাইলেও আগস্ট মাসের অভিজ্ঞতা আমাদের জাতীয় জীবনে অন্তত ৭৫ বছর কলঙ্কের তিলকই একে একে পরিয়ে দিয়েছে। প্রথম দিকের তিলক কলঙ্ক ঘোচাতে সক্ষম হলেও পঁচাত্তর-উত্তরকালে দগ্ধ ক্ষত যেন একেবারে নিরাময়যোগ্য নয় বলে মনে হচ্ছে।

সে জন্য মাস হিসেবে আগস্টকে দায়ী না করলেও ঘটনাচক্রে এ মাসেই এমন সব তিলক আর কলঙ্ক জাতীয় ইতিহাসে ঘটেছে, যা থেকে মুক্তির কামনাই শুধু মুক্ত করবে বলে মনে করি না। রাজনীতি ও ইতিহাস সচেতনতা যত দিন নির্মিত না হবে, তত দিন এই ক্ষত কিছুতেই শুকাবে না।

১৯৪৭ সালে আমাদের জাতীয় জীবনে যখন আগস্ট মাস উপনীত হয়েছিল, তখন অনেকে এটিকে ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘মুক্তির’ সঙ্গে একাকার করে ভেবেছিলেন। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তিলাভ করলেও সেদিন থেকেই আমাদের জাতি পাকিস্তানের খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে গেল। ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইন ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ পাস হয়।

সেভাবেই ১৫ আগস্ট ভারত এবং পাকিস্তান ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়। পাকিস্তান লাভের এক বছর পূর্তিতে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ইত্তেহাদ পত্রিকায় দেওয়া এক বিবৃতিতে লিখেছিলেন, ‘১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আমরা যে “আজাদী” লাভ করিয়াছি, সেটা যে গণ আজাদী নয়, তা গত একটি বছরে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে।’ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ‘আমরা শেষ হয়ে গেছি। নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হবে।’

তবে পূর্ব বাংলার সব মানুষই যে পাকিস্তান সৃষ্টির ঘটনাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তা নয়। সেই উপলব্ধি ঘটতে সময়ের হেরফের হলেও একসময় বেশির ভাগ মানুষই বুঝতে পেরেছিল যে পাকিস্তান অন্তত আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৫ আগস্টের পরিবর্তে ১৪ আগস্টকে ‘পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৯৪৮ সালে। সেই থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান দিবস হিসেবে সরকারি ছুটি ভোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উদ্‌যাপন, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হতো।

পাকিস্তান ক্রমেই পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে এক দানবীয় শক্তিরূপে আবির্ভূত হতে থাকে। এ কারণে ১৪ আগস্ট ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। একসময় পাকিস্তান রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য যখন গণ-অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়, তখন ১৪ আগস্ট আমাদের জাতীয় জীবন থেকে অপসারিত হয়ে যায়। ইতিহাসের বোঝা ইতিহাসের ঘাড় থেকে ফেলে দিয়ে ঝেড়েমুছে মুক্ত হয়ে যায়। জাতীয় ইতিহাস থেকে তখন আমাদের কলঙ্কের তিলক মুছে যায়। ভাবতে পারিনি আগস্টের ভূত আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে কতখানি অদৃশ্যভাবে চেপে ছিল।

পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আর কোনো দিন কলঙ্কজনক আগস্টের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে না। এর জন্য ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। এই বিসর্জন নিশ্চয়ই বৃথা যাবে না। কিন্তু সাতচল্লিশের আগস্ট ছিল এক সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের আগস্ট। এর ভয়াবহ নিগূঢ় ক্ষমতা আমরা খুব কমই উপলব্ধি করতে পেরেছি।

এটি আমাদের জাতীয়তার বোধকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল, ভাষা-সংস্কৃতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলিয়ে দিয়েছিল। এক অন্ধ ইউটোপীয় কাল্পনিক রাষ্ট্রের মোহে সাতচল্লিশের আগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। মাত্র ১০ বছরেই সেই নেতৃত্ব জনসাধারণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শের স্থান থেকে বিচ্যুত করে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে মোহাচ্ছন্ন করেছিল।

সেই মোহভঙ্গ ২৩ বছরে সবার ঘটেছে–এমনটি বলা যাবে না, অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষের তখন যে ঘটেনি, সেটি নির্দ্বিধায় বলা চলে। এত রক্ত, হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসলীলা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরেরা বাঙালি জাতির ওপর সংঘটিত করতে পেরেছিল। তার নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতাও যেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে একচ্ছত্র হয়ে উঠতে পারেনি।

যদি উঠত তাহলে ১৯৭৫ সালে ঠিক ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে পারত না কুলাঙ্গার কিছু পাকিস্তান-মনস্ক বাঙালি সেনাসদস্য, যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিল। তাদেরই হাতে সপরিবারে নিহত হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মণির পরিবারের সদস্যরা।

সেবার ১৫ আগস্ট ভয়ংকর আক্রমণাত্মক ও প্রতিশোধপরায়ণমূলক চরিত্র নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিল। শুধু রাষ্ট্রের পিতা, তাঁর পরিবারের সদস্য, নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজন এবং ৩ নভেম্বর জেলের প্রকোষ্ঠে তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদেরই তারা হত্যা করেনি, গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকেই সরিয়ে নিয়েছিল এবং ১৫ আগস্টের পাকিস্তানি ধারার কাছে ফিরিয়ে নিয়েছিল।

রাজনীতি, প্রশাসন, পাকিস্তানসহ আন্তর্জাতিক বহু পক্ষ এই হত্যাকাণ্ড ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। হত্যা-পরবর্তী সময়ে গোটা সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিনাশ ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের ভাবাদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। সুকৌশলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়। রাষ্ট্র বিনির্মাণের সব উদ্যোগ ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যেন সাতচল্লিশের ১৫ আগস্টের আদর্শের ভয়ংকর রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়, সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৯৬ সালে যখন ১৫ আগস্টকে শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করার উদ্যোগ নেয়, তখনই সাতচল্লিশের ১৫ আগস্টের পরাজিত শক্তিরা নতুনভাবে ১৫ আগস্টকে রাজনৈতিকভাবে তুলে ধরার আয়োজন করে। খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৫ আগস্ট বলে দাবি করা হয়, পালনও করা হয়। অথচ ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর পত্রিকায় প্রকাশিত জীবনীতে তাঁর জন্মদিন ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট দেখানো হয়।

এভাবে ঘটা করে তাঁর জন্মদিন ১৫ আগস্টে নামিয়ে আনার উদ্দেশ্য কী? ১৫ আগস্টকে বিএনপির দলীয় প্রধানের জন্মদিন পালনের মাধ্যমে তাদের দলীয় আদর্শের নতুনভাবে জন্মেরও কোনো ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিল কি? পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসে তারা কেক কেটে ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন সাড়ম্বরে পালন করেছে।

আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার এমন বিভাজিত রাজনৈতিক অবস্থান অনেকটা বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই তৈরি করা হলো। সেটিকে বিএনপি কখনোই রাষ্ট্রের বিয়োগান্ত ঘটনা হিসেবে স্বীকার করেনি। যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা এই দিনটি খালেদা জিয়ার জন্মদিন হিসেবে উৎসবমুখরভাবে পালন করে, জাতীয় শোক দিবসের ছুটি বাতিল করে সেটিকে ঢেকে দেয়। আবার যখন ক্ষমতায় থাকে না, তখনো একসময় একইভাবে পালন করত। তবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে কয়েক বছর নীরবতা পালন করে আসছে।

কিন্তু যে আগস্ট ট্র্যাজেডি ১৯৭৫ সালে আমাদের জাতীয় জীবনে সংঘটিত হয়েছে, এর বিচার বিএনপির শাসনামলে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। নতুন করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের হত্যার একটি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

সৌভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা আর্জেস গ্রেনেড হামলা থেকে রক্ষা পেলেও তাঁকে হত্যা করার জন্য প্রাণপণে গাড়িতে ওঠার মুহূর্তেও পেছন থেকে গুলি ছোড়া হয়েছিল। তাঁর দেহরক্ষী মাহবুব তাতে নিহত হন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এবারও প্রাণে বেঁচে গেলেন। ২১ আগস্টে আর্জেস গ্রেনেডের অন্তত একটিও যদি ট্রাক-মঞ্চে অবস্থান নেওয়া কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর পড়ত, তাহলে কারোরই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল না। বিএনপি-জামায়াত ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, এটি আদালতে প্রমাণিত।

আগস্ট মাসটি কেন বিএনপির এত পছন্দের তা বোঝা গেল না। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের প্রায় সবকটি জেলায় ৫০০-এর অধিক স্থানে জঙ্গিরা একসঙ্গে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। তাতে বেশ কয়েকজন নিহত এবং আহত হলেন। যাঁরা নিহত এবং আহত হলেন, তাঁরা সবাই নিরীহ মানুষ। কিন্তু জঙ্গিরা রাষ্ট্রের কারও না কারও পৃষ্ঠপোষকতায় এমন বিস্ফোরণ উৎসব পালন করতে পেরেছিল। যাঁরা অন্তত আগস্টের এই চারটি ঘটনার মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যে রাজনৈতিক আদর্শ পূর্ব বাংলার জন্য গ্রহণযোগ্য ছিল, তার বিপক্ষ শক্তি আগস্টকে তাদের জন্য ‘শুভ’ মাস হিসেবে মনে হয় বেছে নিয়েছিল।

কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। বাঙালি জাতির জীবনে আগস্টের সব অভিজ্ঞতা সর্বনাশই ডেকে এনেছে। কিন্তু কারও কারও জন্য যে এটি পৌষ মাস, পিঠা খাওয়ার উৎসবের মাস, সেটিও তো ইতিহাসের অভিজ্ঞতা। আমরা একাত্তরে এসে সাতচল্লিশের আগস্টের পৌষ মাসকে বিদায় করতে পারলেও সেটির ভয়ংকর হিংস্রতাকে পঁচাত্তরে এসে ঘটতে দেখে স্তম্ভিত, হতবাক এবং একাত্তরের রাষ্ট্র বিপর্যয়ের বাস্তবতাকে অনুভব করতে শুরু করেছি মাত্র। কিন্তু আগস্ট যে আমাদের পিছু ছাড়ছেই না।

এতগুলো ক্ষত জাতীয়ভাবে বাংলাদেশ যে বহন করে চলছে, সেগুলোর রাজনৈতিক মীমাংসা ও শুকানোর ব্যবস্থা যত দিন রাজনৈতিকভাবে না করা হবে, তত দিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আগস্ট-কলঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারবে না। ইতিহাসের এই অন্তর্নিহিত সত্যটি রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজজীবনে যত দিন ফুটিয়ে তোলা না হবে, বোধ ও বিবেচনায় আগস্টের এত সব কলঙ্ককে মুছে ফেলার মানসিকতা তৈরি না হবে, তত দিন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ রাষ্ট্র আগস্ট মাসকেই কলঙ্কের ও শোকাবহের মাস হিসেবে অভিহিত করবে।

লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত