Ajker Patrika

কারচুপি

কারচুপি

বাংলা ভাষার একটি সুপরিচিত শব্দ হলো কারচুপি। আমাদের যাপিত জীবনে কারচুপি শব্দটি নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

আবার এই নেতিবাচক অর্থটি অধিকতর পরিস্ফুট করতে শব্দটির আগে ‘সূক্ষ্ম’ শব্দটিও আমরা যুক্ত করছি। সাধারণত যেকোনো ধরনের নির্বাচনের পরে পরাজিত দলের অনিবার্য ভাষ্য, ‘নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে।’ কিন্তু আমরা কি জানি কারচুপি শব্দের মূল অর্থ কী? এর মূল অর্থটি কি প্রথম থেকেই নেতিবাচক অর্থে প্রয়োগ হয়ে এসেছে? নাকি শব্দটি ভাষাভাষী সমাজে শুরু থেকে ইতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হতো? তবে চলুন, চুপিচুপি জেনে নিই কারচুপি শব্দের কারসাজি।

শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, বাংলা ভাষায় ‘কার’ এবং ‘চুপি’ শব্দদ্বয়ের আলাদাভাবে অস্তিত্ব থাকলেও এর সঙ্গে ‘কারচুপি’ শব্দের কোনো যোগসূত্র নেই। মূলত ফারসি ‘কারচুবি’ শব্দ থেকে বাংলা ‘কারচুপি’ শব্দটি তৈরি হয়েছে লোকনিরুক্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কারচুপি শব্দের অর্থ হলো চাতুরী, চালাকি; কৌশল, ফন্দি; কাপড় বা অন্য কিছুর ওপর জরির কারুকার্য বা নকশা তোলার কাজ। শেষোক্ত অর্থটিই কারচুপি শব্দের মূল অর্থ। সচরাচর উন্নতমানের কাপড়ের (ক্ষেত্রবিশেষে রেশমি কাপড়) ওপর সুই-সুতার সাহায্যে নকশা করে ফুল, লতাপাতা, জরির উঁচু উঁচু কারুকার্যগুলো করার নামই যে ছিল কারচুপি, এটি বর্তমানে কাউকে বিশ্বাস করানোই এখন কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কেননা বাগর্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কারচুপি শব্দের অর্থের ব্যাপক অবনতি সাধিত হয়েছে।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একসময় পুরো উপমহাদেশে ঢাকার বিহারি ক্যাম্প এবং চট্টগ্রামের বিহারিরা কারচুপির কাজে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাঁরা নিপুণ হাতের কারুকাজে যেকোনো কারচুপির কাজ শাড়ির গায়ে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। কাপড়ে সুই-সুতায় হাতের নিপুণ কারুকাজে জরি, চুড়ি, চুমকি বসিয়ে মোহনীয় নকশা ফুটিয়ে তুলতেন অনায়াসে। নকশাকারদের ঘরের সামনে বসানো থাকত কাঠের তৈরি ফ্রেম। কাঠের ফ্রেমে শাড়ি, ওড়না প্রভৃতি আটকে তাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে পুঁতি, জরি, চুমকি ও পাথর বসানোর কাজ চলত। কারিগরের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হতো নানা রকম নকশাদার জরির শাড়ি, ওড়না, থ্রিপিস ও ব্লাউজ। সুদক্ষ হাতের এই কারচুপির কাজই সাধারণ মানের শাড়িকে করে তুলত জাঁকজমকপূর্ণ।

কারচুপির কাজের প্রায় সহোদর আরেকটি কাজ হলো, জারদৌসির কাজ। মোগল আমলের মিনার, কলকি জারদৌসি কাজের মূল মোটিফ। আড়ি, রেশম, চুমকি ও জরির সংমিশ্রণে জারদৌসির কাজে মোগল মোটিফ তুলে ধরা হয়। যেকোনো কাপড়ে জারদৌসি-কারচুপির কাজ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন জুতসই কাপড়। মূলত পিওর সিল্ক, মসলিন, জর্জেট ও ভেলভেটের কাপড়ে এই কাজগুলো ফুটে ওঠে পরিপূর্ণরূপে। উল্লিখিত দুটো নকশাদার কাজের সৃজনশীলতা এবং হস্তচালনার কৌশলের ওপর তুলনামূলক বিশ্লেষণপূর্বক বলা যায়, জারদৌসির চেয়ে কারচুপির কাজে পরিশ্রম কিছুটা কম। তারপরও কারচুপির কাজের মান আর দক্ষতার কারণে কারিগরদের মজুরিও ছিল বেশ চড়া। কিন্তু শাড়ির ডিজাইনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিদেশি কাপড়ের আধিপত্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে কারচুপির এসব নান্দনিক কাজ।

এখন প্রশ্ন হলো, এমন নান্দনিক, শ্রমসাধ্য এবং প্রশংসাবাচক কর্মের সংজ্ঞাজ্ঞাপক শব্দটি কীভাবে এমন নেতিবাচক অর্থে বাংলা ভাষায় পরিগ্রহ করেছে? যদিও শব্দের অর্থের কালানুক্রমিক বিবর্তনের ধারায় যথাযথ কার্যকারণ ছাড়া কোনো শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয় না। সে সূত্রেই বলা যায়, কারচুপির বর্তমান নেতিবাচক অর্থে যেমন আড়ালে বা চুপিসারে কর্মটি সম্পাদনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তেমনি সূচিকর্মে কারচুপির নিপুণ কাজটিও কিন্তু সম্পন্ন করতে হয় নিশ্চুপে বা নিভৃতে। এর পাশাপাশি আরেকটি যোগসূত্রও আমরা পর্যবেক্ষণে নিতে পারি সেটি হলো, অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের কাপড় বা ছিঁড়ে যাওয়া কাপড়ে কোনো সূচিকর্ম বা কারুকলা করে তার প্রকৃত রূপ ও মান গোপন করার প্রবণতা; যা প্রকারান্তরে সূক্ষ্ম কারচুপিরই নামান্তর!

লেখক: রাজীব কুমার সাহা, আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত