শাইখ সিরাজ
আমি ঢাকা শহরেই বেড়ে উঠেছি এবং বড় হয়েছি। শৈশবের দেখা ঢাকা শহরের সঙ্গে বর্তমানের এই শহরকে মেলানো যায় না। কী অদ্ভুত সুন্দর ছিল এই শহর! আমার শৈশবে ঢাকা ছিল সবুজ এক শহর। সে সময় আমার বসবাসের এলাকা খিলগাঁও ছিল মূলত একটা গ্রাম। বিশ্ব রোডের ধারে বিশাল অরণ্যশোভিত নানা ধরনের বনজ ও ফলদ গাছগাছালির সমারোহে সবুজ এক বসতি ছিল। গাছপালায় এত ঘন ছিল যে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়তেই অন্ধকার নেমে আসত।
বিকেলবেলায় শিয়ালের ডাক শোনা যেত। কাছেই ছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর। বিমান ল্যান্ডিং বা উড়ে যাওয়ার সময় শব্দ শুনে আকাশের দিকে তাকালে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কখনো কখনো ঢাউস আকারের বিমান চোখে পড়ত ঠিকই, কিন্তু গাছের ডালপালা, পাতার কারণে পূর্ণ বিমান দেখাটা কখনো সম্ভব হতো না। গাছপালায় এতটাই ঘন ছিল প্রকৃতি। মনে পড়ে, রাস্তাঘাটে হাঁটার সময় খুব সাবধানে থাকতাম, এই বুঝি কোনো গাছের ডাল থেকে মৌমাছি তেড়ে আসে। প্রাকৃতিকভাবেই নানা ফুলের গাছে ভরা ছিল খিলগাঁও। ফলে মৌমাছি বাসা বাঁধত গাছে গাছে।
আমাদের খিলগাঁও উন্নয়নের ধারায় আসে কমলাপুর রেলস্টেশন নির্মাণের সময়। তখন শুনেছি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রেলস্টেশন হবে কমলাপুর রেলস্টেশন। রেললাইনের পাশাপাশি হবে ১০০ ফুটের বড় রাস্তা। শহর উন্নয়নে সারি সারি গাছ কেটে ফেলা হলো। এভাবেই প্রয়োজনের তাগিদে শহর বড় হতে থাকল। বাড়তে থাকল মানুষ। বাড়তে থাকল স্থাপনা। বুড়িগঙ্গার টলটলে পানি আমরাও দেখেছি।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দূষিত হলো বুড়িগঙ্গা। ধূসর হলো ঢাকা শহর। আমরাই ঢাকাকে নষ্ট করে ফেলেছি। ঢাকাকে ফের বাসযোগ্য করে তুলতে হলে অবশ্যই সবুজ করতে হবে। এখানে যেভাবে বেড়ে উঠছে ইট-কাঠ-পাথরের জঞ্জাল, সেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে না সবুজ।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো অনেক আগে থেকেই সবুজায়নের তাগিদ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন জাপান ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকলের ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব মোকাবিলার জন্য ভবন নির্মাণের সময় ছাদে ও কার্নিশে বাধ্যতামূলক প্রশস্ত বাগান গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়। তারা ছাদে সবুজের চাষ করাটাকে আইন পাস করে বাধ্যতামূলক করেছে। প্রতিটি বাড়ির ছাদে গাছ লাগানোকে করা হয়েছে অপরিহার্য। কারণ বসবাসের শহরটিকে সুরক্ষিত করতে হবে। গড়তে হবে অক্সিজেনের খামার।
মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে সেই পরিবেশটা নেই। আমরা যখন বাড়ি বা অট্টালিকা তৈরি করি, তখন বাড়ির ছাদটা যে সবুজ হওয়া দরকার, এই চিন্তাটা আমাদের থাকে না। দুয়েকজন বাড়ি নির্মাণের সময় ছাদকৃষির বিষয়টি মাথায় রাখেন। বহুমুখী চিন্তা থেকেই তিনি বাড়ি নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে ছাদকৃষিতে সাজিয়ে তোলেন। গত কয়েক বছরে ঢাকাকে সবুজ নগরে পরিণত করতে একটা উদ্যোগ নিয়েছি। চ্যানেল আইয়ে ছাদকৃষি বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে নগরবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি নিরন্তর।
শুধু যে শহর সবুজ হচ্ছে, তা নয়, নিরাপদ খাদ্যের প্রশ্নে অনেকেই ছাদকৃষিতে ভরসা করছেন। ইতিমধ্যে অনেকে ছাদকৃষির মাধ্যমে সফল হয়েছেন। আমি দেখেছি ছাদে লাউ, ঝিঙে, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজরসহ বিভিন্ন সবজিসহ আম, পেয়ারা, মাল্টা, আখ, ডালিম, জাম্বুরা, কামরাঙা, জামরুলসহ নানান ফলের চাষ করে পারিবারিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
চ্যানেল আইয়ে আমি প্রায় তিন শতাধিক ছাদকৃষি পর্ব প্রচার করেছি। দেখেছি অবসরে চলে যাওয়া সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, কিংবা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নিজেদের অবসর সময়টাকে ফলপ্রসূ করে তুলছেন ছাদে এক টুকরো ছাদকৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। তাঁরা বলেছেন, ছাদকৃষি দিয়েছে আত্মিক প্রশান্তি। যাঁর নিজস্ব ভবন ও ছাদ রয়েছে, তাঁরা নিজেদের ছাদে একস্তর বা দ্বিস্তরবিশিষ্ট ছাদকৃষি গড়ে তুলছেন।
আবার যাঁদের নিজস্ব বাড়ির ছাদ নেই, তাঁরা বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে ছাদের একপাশে বা বারান্দায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ছাদকৃষি। এই ছাদকৃষি দিয়ে তিনি খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন, মিটছে পারিবারিক পুষ্টি, পাচ্ছেন মানসিক প্রশান্তি। পাশাপাশি পালন করছেন একটা জাতীয় দায়িত্ব। শহরকে সবুজায়নে সহায়তা করছেন। নগরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করছেন।
সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত বাড়ির মালিকেরা ছাদকৃষি করলে হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপর ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন। গত ১৪ জুন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের এ তথ্য জানিয়েছেন। এটিকে আমি দেখছি আমাদের ছাদকৃষি আন্দোলনের প্রাথমিক অর্জন হিসেবে। এই ছাদকৃষি ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা রকম সংগঠন। ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। সবার চাওয়া ইট-কাঠ-পাথরের শহরটিকে বাসযোগ্য ও সবুজ শহরে পরিণত করা।
‘ছাদকৃষি’ প্রসঙ্গে সে সময়টাতে অনেকেই আমার বিরোধিতা করেছিলেন। বলছিলেন, ছাদকৃষিতে ছাদের ক্ষতি হবে এবং এটি একটি অসম্ভব বিষয়। ছাদকৃষির জন্য ছাদ ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, টব বা ড্রামে মাটি কীভাবে ব্যবহার করতে হবে—এ বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত আমি তুলে ধরি। পাশাপাশি তুলে ধরি, ছাদকৃষির বিভিন্ন কৌশল ও প্রযুক্তি।
এক দশকে দেশ-বিদেশের বহু ছাদকৃষি ও নগরকৃষির উদাহরণ আমি তুলে ধরেছি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ছাদকৃষি ছড়িয়েছে শহর থেকে শহরে। সাত-আট বছর আগেও ওপর থেকে ঢাকা শহরকে দেখলে ধূসর এক শহর মনে হতো। এখন সবুজের পরিমাণ বেড়েছে। পাশাপাশি ছাদকৃষি ঘিরে নানা রকম কার্যক্রমের সূচনা হয়েছে। সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ‘ছাদকৃষি’ কার্যক্রম।
‘ছাদকৃষি’ নিয়ে গবেষণার সূচনা করেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. শেখ আল আহসান নাহিদ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব ইসলাম। ধীরে ধীরে ছাদকৃষি হয়ে ওঠে একটা আন্দোলনের নাম।
এটিকে মানুষের মাঝে আরও বেশি পরিসরে ছড়িয়ে দিতে দাবি ওঠে, যাঁরা ছাদকৃষি করবেন সিটি করপোরেশন যেন তাঁদের হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপর ছাড় দেয়। মনে আছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের ১০ শতাংশ হোল্ডিং কর মওকুফের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের এমন দাবি ছিল, যা ‘ছাদকৃষি’ অনুষ্ঠানে বহুবার তুলে ধরেছি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলামকেও আমি জানিয়েছি ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের দাবির প্রসঙ্গটি।
সারা পৃথিবী এখন সোচ্চার ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারের বিষয়ে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর জীব ও প্রাণের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ কারণে কৃষিকেই সবচেয়ে বেশি মুখোমুখি হতে হচ্ছে পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে। এই বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে কৃষির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। মাটি ও পানির সংকটের মধ্য থেকেই ফলিয়ে নিতে হবে কাঙ্ক্ষিত ফসল।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পরিবর্তিত জলবায়ু মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়নে কৃষিকে যুক্ত করার এই অ্যাপ্রোচটিকে বলছে, ‘ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার’। এটি কোনো কৌশল নয়। বলা যায়, কৃষিকে টিকিয়ে রাখার সম্মিলিত প্রয়াস। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশ জোরেশোরে ছাদকৃষি ও নগরকৃষি নিয়ে তাদের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত।
তরুণদের জন্য ছাদকৃষি হতে পারে নতুন উদ্যোগের ক্ষেত্র। ছাদকৃষির এই প্রসারকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে নেওয়া যায় নতুন নতুন উদ্যোগ। মহল্লার কিছু ছাদ বেছে নিয়ে তাতে অরগানিক ছাদকৃষি করে উৎপাদিত ফল-ফসল বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ফ্রান্সে দেখেছি রেস্তোরাঁর ছাদে উৎপাদিত তরতাজা শাক-সবজি দিয়ে খাবার তৈরি করে বিক্রি করতে। এতে গ্রাহক যেমন গাছ থেকে সবজি তোলার স্বাদ পাচ্ছেন, তেমনি পাচ্ছেন সতেজ সবজির স্বাদ।
এই প্রজন্মের প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থীরাও নগরকৃষির বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তমাল অ্যাগ্রোপলিস নামে একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছিলেন। বুয়েটের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশনে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। দেখলাম তাঁরাও স্থাপত্য কলাকৌশলে কৃষিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তবে নগর সবুজায়নে ছাদকৃষি বা নগরকৃষির বিকল্প নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহর বড় হতে থাকবে। শহরের আশপাশের কৃষিজমিতে গড়ে উঠবে শহরের স্থাপনা। তাই পৃথিবীর সবুজ বজায় রাখতে হলে শহরের স্থাপনার ছাদগুলোকে সবুজ করতে হবে। নিরাপদ খাদ্যের তাগিদেই শুধু নয়, পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ছাদকৃষি তথা নগরকৃষিকেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
আমি ঢাকা শহরেই বেড়ে উঠেছি এবং বড় হয়েছি। শৈশবের দেখা ঢাকা শহরের সঙ্গে বর্তমানের এই শহরকে মেলানো যায় না। কী অদ্ভুত সুন্দর ছিল এই শহর! আমার শৈশবে ঢাকা ছিল সবুজ এক শহর। সে সময় আমার বসবাসের এলাকা খিলগাঁও ছিল মূলত একটা গ্রাম। বিশ্ব রোডের ধারে বিশাল অরণ্যশোভিত নানা ধরনের বনজ ও ফলদ গাছগাছালির সমারোহে সবুজ এক বসতি ছিল। গাছপালায় এত ঘন ছিল যে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়তেই অন্ধকার নেমে আসত।
বিকেলবেলায় শিয়ালের ডাক শোনা যেত। কাছেই ছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর। বিমান ল্যান্ডিং বা উড়ে যাওয়ার সময় শব্দ শুনে আকাশের দিকে তাকালে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কখনো কখনো ঢাউস আকারের বিমান চোখে পড়ত ঠিকই, কিন্তু গাছের ডালপালা, পাতার কারণে পূর্ণ বিমান দেখাটা কখনো সম্ভব হতো না। গাছপালায় এতটাই ঘন ছিল প্রকৃতি। মনে পড়ে, রাস্তাঘাটে হাঁটার সময় খুব সাবধানে থাকতাম, এই বুঝি কোনো গাছের ডাল থেকে মৌমাছি তেড়ে আসে। প্রাকৃতিকভাবেই নানা ফুলের গাছে ভরা ছিল খিলগাঁও। ফলে মৌমাছি বাসা বাঁধত গাছে গাছে।
আমাদের খিলগাঁও উন্নয়নের ধারায় আসে কমলাপুর রেলস্টেশন নির্মাণের সময়। তখন শুনেছি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রেলস্টেশন হবে কমলাপুর রেলস্টেশন। রেললাইনের পাশাপাশি হবে ১০০ ফুটের বড় রাস্তা। শহর উন্নয়নে সারি সারি গাছ কেটে ফেলা হলো। এভাবেই প্রয়োজনের তাগিদে শহর বড় হতে থাকল। বাড়তে থাকল মানুষ। বাড়তে থাকল স্থাপনা। বুড়িগঙ্গার টলটলে পানি আমরাও দেখেছি।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দূষিত হলো বুড়িগঙ্গা। ধূসর হলো ঢাকা শহর। আমরাই ঢাকাকে নষ্ট করে ফেলেছি। ঢাকাকে ফের বাসযোগ্য করে তুলতে হলে অবশ্যই সবুজ করতে হবে। এখানে যেভাবে বেড়ে উঠছে ইট-কাঠ-পাথরের জঞ্জাল, সেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে না সবুজ।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো অনেক আগে থেকেই সবুজায়নের তাগিদ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন জাপান ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকলের ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব মোকাবিলার জন্য ভবন নির্মাণের সময় ছাদে ও কার্নিশে বাধ্যতামূলক প্রশস্ত বাগান গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়। তারা ছাদে সবুজের চাষ করাটাকে আইন পাস করে বাধ্যতামূলক করেছে। প্রতিটি বাড়ির ছাদে গাছ লাগানোকে করা হয়েছে অপরিহার্য। কারণ বসবাসের শহরটিকে সুরক্ষিত করতে হবে। গড়তে হবে অক্সিজেনের খামার।
মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে সেই পরিবেশটা নেই। আমরা যখন বাড়ি বা অট্টালিকা তৈরি করি, তখন বাড়ির ছাদটা যে সবুজ হওয়া দরকার, এই চিন্তাটা আমাদের থাকে না। দুয়েকজন বাড়ি নির্মাণের সময় ছাদকৃষির বিষয়টি মাথায় রাখেন। বহুমুখী চিন্তা থেকেই তিনি বাড়ি নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে ছাদকৃষিতে সাজিয়ে তোলেন। গত কয়েক বছরে ঢাকাকে সবুজ নগরে পরিণত করতে একটা উদ্যোগ নিয়েছি। চ্যানেল আইয়ে ছাদকৃষি বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে নগরবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি নিরন্তর।
শুধু যে শহর সবুজ হচ্ছে, তা নয়, নিরাপদ খাদ্যের প্রশ্নে অনেকেই ছাদকৃষিতে ভরসা করছেন। ইতিমধ্যে অনেকে ছাদকৃষির মাধ্যমে সফল হয়েছেন। আমি দেখেছি ছাদে লাউ, ঝিঙে, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজরসহ বিভিন্ন সবজিসহ আম, পেয়ারা, মাল্টা, আখ, ডালিম, জাম্বুরা, কামরাঙা, জামরুলসহ নানান ফলের চাষ করে পারিবারিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
চ্যানেল আইয়ে আমি প্রায় তিন শতাধিক ছাদকৃষি পর্ব প্রচার করেছি। দেখেছি অবসরে চলে যাওয়া সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, কিংবা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নিজেদের অবসর সময়টাকে ফলপ্রসূ করে তুলছেন ছাদে এক টুকরো ছাদকৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। তাঁরা বলেছেন, ছাদকৃষি দিয়েছে আত্মিক প্রশান্তি। যাঁর নিজস্ব ভবন ও ছাদ রয়েছে, তাঁরা নিজেদের ছাদে একস্তর বা দ্বিস্তরবিশিষ্ট ছাদকৃষি গড়ে তুলছেন।
আবার যাঁদের নিজস্ব বাড়ির ছাদ নেই, তাঁরা বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে ছাদের একপাশে বা বারান্দায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ছাদকৃষি। এই ছাদকৃষি দিয়ে তিনি খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন, মিটছে পারিবারিক পুষ্টি, পাচ্ছেন মানসিক প্রশান্তি। পাশাপাশি পালন করছেন একটা জাতীয় দায়িত্ব। শহরকে সবুজায়নে সহায়তা করছেন। নগরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করছেন।
সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত বাড়ির মালিকেরা ছাদকৃষি করলে হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপর ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন। গত ১৪ জুন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের এ তথ্য জানিয়েছেন। এটিকে আমি দেখছি আমাদের ছাদকৃষি আন্দোলনের প্রাথমিক অর্জন হিসেবে। এই ছাদকৃষি ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা রকম সংগঠন। ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। সবার চাওয়া ইট-কাঠ-পাথরের শহরটিকে বাসযোগ্য ও সবুজ শহরে পরিণত করা।
‘ছাদকৃষি’ প্রসঙ্গে সে সময়টাতে অনেকেই আমার বিরোধিতা করেছিলেন। বলছিলেন, ছাদকৃষিতে ছাদের ক্ষতি হবে এবং এটি একটি অসম্ভব বিষয়। ছাদকৃষির জন্য ছাদ ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, টব বা ড্রামে মাটি কীভাবে ব্যবহার করতে হবে—এ বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত আমি তুলে ধরি। পাশাপাশি তুলে ধরি, ছাদকৃষির বিভিন্ন কৌশল ও প্রযুক্তি।
এক দশকে দেশ-বিদেশের বহু ছাদকৃষি ও নগরকৃষির উদাহরণ আমি তুলে ধরেছি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ছাদকৃষি ছড়িয়েছে শহর থেকে শহরে। সাত-আট বছর আগেও ওপর থেকে ঢাকা শহরকে দেখলে ধূসর এক শহর মনে হতো। এখন সবুজের পরিমাণ বেড়েছে। পাশাপাশি ছাদকৃষি ঘিরে নানা রকম কার্যক্রমের সূচনা হয়েছে। সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ‘ছাদকৃষি’ কার্যক্রম।
‘ছাদকৃষি’ নিয়ে গবেষণার সূচনা করেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. শেখ আল আহসান নাহিদ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব ইসলাম। ধীরে ধীরে ছাদকৃষি হয়ে ওঠে একটা আন্দোলনের নাম।
এটিকে মানুষের মাঝে আরও বেশি পরিসরে ছড়িয়ে দিতে দাবি ওঠে, যাঁরা ছাদকৃষি করবেন সিটি করপোরেশন যেন তাঁদের হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপর ছাড় দেয়। মনে আছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের ১০ শতাংশ হোল্ডিং কর মওকুফের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের এমন দাবি ছিল, যা ‘ছাদকৃষি’ অনুষ্ঠানে বহুবার তুলে ধরেছি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলামকেও আমি জানিয়েছি ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের দাবির প্রসঙ্গটি।
সারা পৃথিবী এখন সোচ্চার ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারের বিষয়ে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর জীব ও প্রাণের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ কারণে কৃষিকেই সবচেয়ে বেশি মুখোমুখি হতে হচ্ছে পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে। এই বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে কৃষির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। মাটি ও পানির সংকটের মধ্য থেকেই ফলিয়ে নিতে হবে কাঙ্ক্ষিত ফসল।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পরিবর্তিত জলবায়ু মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়নে কৃষিকে যুক্ত করার এই অ্যাপ্রোচটিকে বলছে, ‘ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার’। এটি কোনো কৌশল নয়। বলা যায়, কৃষিকে টিকিয়ে রাখার সম্মিলিত প্রয়াস। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশ জোরেশোরে ছাদকৃষি ও নগরকৃষি নিয়ে তাদের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত।
তরুণদের জন্য ছাদকৃষি হতে পারে নতুন উদ্যোগের ক্ষেত্র। ছাদকৃষির এই প্রসারকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে নেওয়া যায় নতুন নতুন উদ্যোগ। মহল্লার কিছু ছাদ বেছে নিয়ে তাতে অরগানিক ছাদকৃষি করে উৎপাদিত ফল-ফসল বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ফ্রান্সে দেখেছি রেস্তোরাঁর ছাদে উৎপাদিত তরতাজা শাক-সবজি দিয়ে খাবার তৈরি করে বিক্রি করতে। এতে গ্রাহক যেমন গাছ থেকে সবজি তোলার স্বাদ পাচ্ছেন, তেমনি পাচ্ছেন সতেজ সবজির স্বাদ।
এই প্রজন্মের প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থীরাও নগরকৃষির বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তমাল অ্যাগ্রোপলিস নামে একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছিলেন। বুয়েটের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশনে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। দেখলাম তাঁরাও স্থাপত্য কলাকৌশলে কৃষিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তবে নগর সবুজায়নে ছাদকৃষি বা নগরকৃষির বিকল্প নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহর বড় হতে থাকবে। শহরের আশপাশের কৃষিজমিতে গড়ে উঠবে শহরের স্থাপনা। তাই পৃথিবীর সবুজ বজায় রাখতে হলে শহরের স্থাপনার ছাদগুলোকে সবুজ করতে হবে। নিরাপদ খাদ্যের তাগিদেই শুধু নয়, পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ছাদকৃষি তথা নগরকৃষিকেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে