ড. মইনুল ইসলাম
৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান দেশের স্বৈরাচারী অপশাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। ওই দিন দুপুরে হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা-ব্যবস্থার সংস্কারকামী আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ গালাগাল দিয়ে এবং দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন নস্যাতের অপপ্রয়াস চালিয়ে হাসিনা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে স্বৈরাচার পতনের গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তর করেছিলেন। সবচেয়ে জঘন্য পদক্ষেপটি ছিল ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে তাদের হত্যালীলায় ঠেলে দেওয়া।
১৭-১৮ জুলাই এবং ৪-৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে কয়েক শ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছিল আন্দোলন দমনের জন্য। কিন্তু ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান আহূত সভায় সেনা কর্মকর্তাদের জনগণের বিরুদ্ধে গুলি না চালানোর অবস্থান হাসিনার স্বৈরশাসন উৎখাতকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। ৫ আগস্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত হাসিনা সেনাপ্রধানকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও সেনাবাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ না করার নির্দেশ বহাল রাখলেন সেনাপ্রধান। অন্যদিকে, ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করলেন আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। সেনাবাহিনীর অবস্থান যখন জনগণ বুঝতে পারল, তখন ঢাকার চারদিক থেকে লাখো মানুষের মিছিল ছুটতে শুরু করল ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে।
সেনাপ্রধান মাত্র ৪৫ মিনিট সময় দিলেন হাসিনাকে ঢাকা থেকে পালিয়ে যেতে। বেলা আড়াইটার দিকে যখন হাসিনা ও রেহানার হেলিকপ্টার ঢাকা থেকে ভারতের উদ্দেশে উড়াল দিল, তখন প্রায় ২০ লাখ মানুষের মিছিল রাজপথ ধরে শাহবাগ, গণভবন ও সংসদ ভবনের দিকে ধাবিত হলো। এই লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় জড়ো হয়ে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও পলায়ন উদ্যাপন করল।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জিতে ক্ষমতাসীন হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট, কিন্তু ২০১০ সালে প্রদত্ত বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি রায়ের সুবিধা নিয়ে হাসিনা ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তের ব্যবস্থা করেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ‘অনির্বাচিত বিধায় অসাংবিধানিক’ ঘোষিত হয়েছিল আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে, কিন্তু ওই রায়ে সংসদ চাইলে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে করার পরামর্শ প্রদান করা হয়েছিল। শুধু বলা হয়েছিল, বিচার বিভাগ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ব্যবস্থাটি বাদ দেওয়া হোক, কারণ ওই ব্যবস্থা বিচার বিভাগকে দলীয়করণের কবলে নিক্ষেপ করেছে।
হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনীর খসড়া প্রণয়নের জন্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের যে সংসদীয় কমিটি গঠন করেছিলেন, সেই কমিটিও সর্বসম্মতিক্রমে সংশোধিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। কিন্তু, হাসিনা একক সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে পঞ্চদশ সংশোধনীটি সংসদে পাস করে ফেলেন। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি।
২০১৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলেও হাসিনা সিভিল প্রশাসন ও পুলিশের সহায়তায় নির্বাচনের আগের রাতে সারা দেশের অধিকাংশ স্থানে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলেন এবং মোট সংসদীয় আসনের তিন-চতুর্থাংশ জবরদখল করে নেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনটিও একতরফা ‘ডামি নির্বাচন’ হয়ে যাওয়ায় জনগণ সিদ্ধান্তে আসে যে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উৎখাত না করলে হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন থেকে তারা মুক্তি পাবে না।
অতএব, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্র বরবাদ করে দিয়ে হাসিনাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতকে ডেকে এনেছেন। গত ১৫ বছরে হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাঁর একনায়কত্বকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়নি, এই গণ-অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। ওই দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত হাসিনা সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা গ্রহণের অবস্থানে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেনাপ্রধান বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁর আদেশ মানেননি। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করলেও সেনাবাহিনী এই গণ-অভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত হাসিনা সশরীরে পালিয়ে যেতে পারলেও ২০ দিনের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞে ছয় শতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে, শুধু ৫ আগস্টেই প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক মানুষ।
৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত দেশে চলছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া, ভাঙচুর ও লুটতরাজ এবং তাঁদের মারধর করা। কিন্তু দুঃখজনক হলো, পরিকল্পিতভাবে চালানো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো ভাঙচুরের মাধ্যমে ধ্বংস করার তৎপরতা। উদাহরণস্বরূপ মুজিবনগর কমপ্লেক্সে ভাঙচুরের বিষয়টি কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় কোনো অজ্ঞাত কারণে একবারও মুজিবনগরে যাননি, হাসিনাও মুজিবনগর কমপ্লেক্স কখনোই ভিজিট করেননি।
তাহলে হাসিনাবিরোধীদের মুজিবনগরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর যৌক্তিকতা কী? স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক অপশক্তির গোপন নির্দেশ ছাড়া এহেন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো সম্ভব নয়। হাসিনার স্বৈরাচারী অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষুব্ধ অংশের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এসব মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতাকে ‘হালাল’ করা যাবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় তোমাদের জন্ম হয়নি। তাই, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তোমাদের ভালোবাসা আমাদের ভালোবাসার মতো অত প্রগাঢ় না-ও হতে পারে। কিন্তু ওই সময়ের সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির ৯০ শতাংশ মুক্তিযুদ্ধকে এখনো তাঁদের হৃদয়ের মণিকোঠায় ধারণ করেন।
হয়তো জামায়াত-শিবিরের কিছু সমর্থকের কাছে কিংবা বিএনপির পাকিস্তানপ্রেমী সমর্থকদের কাছে ‘পেয়ারে পাকিস্তান’ এখনো বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হতেও পারে। অতএব, হুজুগের বশবর্তী হয়ে তোমরা কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড মেনে নিও না। ১৯৪৭-৭১ পর্বে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল পাকিস্তানের শাসকেরা, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে নেয়নি, তাদের পাকিস্তানপ্রেম এখনো বহাল থাকতে পারে। ইসলামী ছাত্রশিবিরেরও কেউ কেউ হয়তো প্রকাশ্যে এখনো মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে না।
কিন্তু, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বহন করছেন। অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণের পরদিনই সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে তাদের দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। তাই আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীরা এবং অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননাকারী দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী স্থানগুলো যথাযোগ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা নেবে।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৭০ শতাংশ কম ছিল। ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ পাকিস্তানকে মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে পেছনে ফেলে এসেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনাটা দেখা যাক:
১. মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৬৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে।
২. বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের চেয়ে ২০ বিলিয়ন ডলার বেশি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ছিল ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার।
৩. বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৪ সালের আগস্টে আইএমএফের হিসাব-পদ্ধতি মোতাবেক ২০.৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেটা পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি।
৪. বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭২.৪ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর।
৫. বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ।
৬. বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬০ বিলিয়ন ডলার আর পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার।
৭. বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.১২ শতাংশ আর পাকিস্তানের ২.১ শতাংশ। ফলে পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ কোটিতে আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির সামান্য বেশি।
৮. বাংলাদেশের ১১৮ টাকায় এক ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে এক ডলার কিনতে ২৮০ রুপি লাগে। অথচ ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপির বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল।
৯. বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ২৩ শতাংশ অথচ পাকিস্তানে তা জিডিপির ৪৬ শতাংশ।
১০. বাংলাদেশের নারীদের ৪১ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ।
১১. বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১ আর পাকিস্তানে ৫৯।
১২. বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় এসেছে অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
ওপরের তথ্য-উপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে আর বাংলাদেশের নাগাল পাবে না। এদিক থেকে বিবেচনা করলেও বাংলাদেশে কেউ পাকিস্তানপ্রেমী কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী থাকাটা অযৌক্তিক।
লেখক: সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আরও খবর পড়ুন:
৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান দেশের স্বৈরাচারী অপশাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। ওই দিন দুপুরে হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা-ব্যবস্থার সংস্কারকামী আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ গালাগাল দিয়ে এবং দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন নস্যাতের অপপ্রয়াস চালিয়ে হাসিনা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে স্বৈরাচার পতনের গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তর করেছিলেন। সবচেয়ে জঘন্য পদক্ষেপটি ছিল ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে তাদের হত্যালীলায় ঠেলে দেওয়া।
১৭-১৮ জুলাই এবং ৪-৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে কয়েক শ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছিল আন্দোলন দমনের জন্য। কিন্তু ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান আহূত সভায় সেনা কর্মকর্তাদের জনগণের বিরুদ্ধে গুলি না চালানোর অবস্থান হাসিনার স্বৈরশাসন উৎখাতকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। ৫ আগস্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত হাসিনা সেনাপ্রধানকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও সেনাবাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ না করার নির্দেশ বহাল রাখলেন সেনাপ্রধান। অন্যদিকে, ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করলেন আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। সেনাবাহিনীর অবস্থান যখন জনগণ বুঝতে পারল, তখন ঢাকার চারদিক থেকে লাখো মানুষের মিছিল ছুটতে শুরু করল ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে।
সেনাপ্রধান মাত্র ৪৫ মিনিট সময় দিলেন হাসিনাকে ঢাকা থেকে পালিয়ে যেতে। বেলা আড়াইটার দিকে যখন হাসিনা ও রেহানার হেলিকপ্টার ঢাকা থেকে ভারতের উদ্দেশে উড়াল দিল, তখন প্রায় ২০ লাখ মানুষের মিছিল রাজপথ ধরে শাহবাগ, গণভবন ও সংসদ ভবনের দিকে ধাবিত হলো। এই লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় জড়ো হয়ে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও পলায়ন উদ্যাপন করল।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জিতে ক্ষমতাসীন হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট, কিন্তু ২০১০ সালে প্রদত্ত বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি রায়ের সুবিধা নিয়ে হাসিনা ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তের ব্যবস্থা করেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ‘অনির্বাচিত বিধায় অসাংবিধানিক’ ঘোষিত হয়েছিল আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে, কিন্তু ওই রায়ে সংসদ চাইলে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে করার পরামর্শ প্রদান করা হয়েছিল। শুধু বলা হয়েছিল, বিচার বিভাগ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ব্যবস্থাটি বাদ দেওয়া হোক, কারণ ওই ব্যবস্থা বিচার বিভাগকে দলীয়করণের কবলে নিক্ষেপ করেছে।
হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনীর খসড়া প্রণয়নের জন্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের যে সংসদীয় কমিটি গঠন করেছিলেন, সেই কমিটিও সর্বসম্মতিক্রমে সংশোধিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। কিন্তু, হাসিনা একক সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে পঞ্চদশ সংশোধনীটি সংসদে পাস করে ফেলেন। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি।
২০১৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলেও হাসিনা সিভিল প্রশাসন ও পুলিশের সহায়তায় নির্বাচনের আগের রাতে সারা দেশের অধিকাংশ স্থানে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলেন এবং মোট সংসদীয় আসনের তিন-চতুর্থাংশ জবরদখল করে নেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনটিও একতরফা ‘ডামি নির্বাচন’ হয়ে যাওয়ায় জনগণ সিদ্ধান্তে আসে যে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উৎখাত না করলে হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন থেকে তারা মুক্তি পাবে না।
অতএব, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্র বরবাদ করে দিয়ে হাসিনাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতকে ডেকে এনেছেন। গত ১৫ বছরে হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাঁর একনায়কত্বকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়নি, এই গণ-অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। ওই দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত হাসিনা সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা গ্রহণের অবস্থানে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেনাপ্রধান বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁর আদেশ মানেননি। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করলেও সেনাবাহিনী এই গণ-অভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত হাসিনা সশরীরে পালিয়ে যেতে পারলেও ২০ দিনের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞে ছয় শতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে, শুধু ৫ আগস্টেই প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক মানুষ।
৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত দেশে চলছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া, ভাঙচুর ও লুটতরাজ এবং তাঁদের মারধর করা। কিন্তু দুঃখজনক হলো, পরিকল্পিতভাবে চালানো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো ভাঙচুরের মাধ্যমে ধ্বংস করার তৎপরতা। উদাহরণস্বরূপ মুজিবনগর কমপ্লেক্সে ভাঙচুরের বিষয়টি কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় কোনো অজ্ঞাত কারণে একবারও মুজিবনগরে যাননি, হাসিনাও মুজিবনগর কমপ্লেক্স কখনোই ভিজিট করেননি।
তাহলে হাসিনাবিরোধীদের মুজিবনগরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর যৌক্তিকতা কী? স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক অপশক্তির গোপন নির্দেশ ছাড়া এহেন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো সম্ভব নয়। হাসিনার স্বৈরাচারী অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষুব্ধ অংশের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এসব মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতাকে ‘হালাল’ করা যাবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় তোমাদের জন্ম হয়নি। তাই, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তোমাদের ভালোবাসা আমাদের ভালোবাসার মতো অত প্রগাঢ় না-ও হতে পারে। কিন্তু ওই সময়ের সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির ৯০ শতাংশ মুক্তিযুদ্ধকে এখনো তাঁদের হৃদয়ের মণিকোঠায় ধারণ করেন।
হয়তো জামায়াত-শিবিরের কিছু সমর্থকের কাছে কিংবা বিএনপির পাকিস্তানপ্রেমী সমর্থকদের কাছে ‘পেয়ারে পাকিস্তান’ এখনো বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হতেও পারে। অতএব, হুজুগের বশবর্তী হয়ে তোমরা কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড মেনে নিও না। ১৯৪৭-৭১ পর্বে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল পাকিস্তানের শাসকেরা, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে নেয়নি, তাদের পাকিস্তানপ্রেম এখনো বহাল থাকতে পারে। ইসলামী ছাত্রশিবিরেরও কেউ কেউ হয়তো প্রকাশ্যে এখনো মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে না।
কিন্তু, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বহন করছেন। অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণের পরদিনই সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে তাদের দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। তাই আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীরা এবং অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননাকারী দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী স্থানগুলো যথাযোগ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা নেবে।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৭০ শতাংশ কম ছিল। ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ পাকিস্তানকে মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে পেছনে ফেলে এসেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনাটা দেখা যাক:
১. মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৬৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে।
২. বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের চেয়ে ২০ বিলিয়ন ডলার বেশি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ছিল ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার।
৩. বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৪ সালের আগস্টে আইএমএফের হিসাব-পদ্ধতি মোতাবেক ২০.৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেটা পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি।
৪. বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭২.৪ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর।
৫. বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ।
৬. বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬০ বিলিয়ন ডলার আর পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার।
৭. বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.১২ শতাংশ আর পাকিস্তানের ২.১ শতাংশ। ফলে পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ কোটিতে আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির সামান্য বেশি।
৮. বাংলাদেশের ১১৮ টাকায় এক ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে এক ডলার কিনতে ২৮০ রুপি লাগে। অথচ ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপির বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল।
৯. বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ২৩ শতাংশ অথচ পাকিস্তানে তা জিডিপির ৪৬ শতাংশ।
১০. বাংলাদেশের নারীদের ৪১ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ।
১১. বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১ আর পাকিস্তানে ৫৯।
১২. বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় এসেছে অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
ওপরের তথ্য-উপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে আর বাংলাদেশের নাগাল পাবে না। এদিক থেকে বিবেচনা করলেও বাংলাদেশে কেউ পাকিস্তানপ্রেমী কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী থাকাটা অযৌক্তিক।
লেখক: সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আরও খবর পড়ুন:
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১৬ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে