হাসান মামুন
বিদায়ী অর্থবছরে দেশে কোনো চাল আমদানি হয়নি। বছরের শেষদিকে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হলে তারাও শেষতক চাল আনেনি বলে জানা গেল। সরকারি তথ্যমতে, সন্তোষজনক উৎপাদন সত্ত্বেও দাম বাড়তে থাকায় সরকার তখন কিছু চাল আমদানির সুযোগ দেয়।
অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেটি গ্রহণ না করার প্রধান কারণ—প্রতিযোগিতামূলক দামে চাল আমদানি কঠিন ছিল। একই সময়ে বেশি দামে পেঁয়াজ এনে বিপাকে পড়েছিলেন কিছু আমদানিকারক। সে ঘটনা থেকেও চাল আমদানিকারকেরা সম্ভবত শিক্ষা নিয়েছিলেন। এই সবকিছু মিলিয়ে গেল অর্থবছরে চাল আমদানি হয়নি, এটাই হলো খবর। বলা হচ্ছে, তিন দশক পর এটা ছিল ‘শূন্য চাল আমদানির বছর’!
‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলে দাবি করা হলেও আমরা আসলে চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে সেটাও টেকসই নয়। বিদায়ী অর্থবছর বাদে তিন দশকের প্রতিবছরেই কিছু না কিছু চাল আমদানি করতে হয়েছে। ধান-চালের উৎপাদন কোনো কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে কোনো কোনো বছর বিপুলভাবেও বাড়াতে হয়েছে আমদানি। যেমন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৩৮ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন চাল আনতে হয়েছিল।
২০১৯-২০ অর্থবছরেই আবার আমদানি নেমে আসে মাত্র ৪ হাজার মেট্রিক টনে। ওটা ছিল তিন দশকে সর্বনিম্ন আমদানি। সত্যি বলতে, চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়লেও বাংলাদেশকে এখন আর ব্যাপকভাবে চাল আমদানি করতে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে কিছু চাল আনতে হয় প্রধানতম এ খাদ্যশস্যের বাজারে ব্যবসায়ীদের সংযত রাখতে। এটা ‘কৌশলগত আমদানি’! গেল অর্থবছরের শেষদিকে তেমন একটি উদ্যোগই সম্ভবত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারতসহ প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোয় দাম চড়া বলে আমদানি সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি ইতিবাচক হলে কিছু চাল এনে বাজারে উদ্বৃত্ত সরবরাহ রাখা গেলে অবশ্য ভালো হতো। থেকে থেকে চালের দাম বৃদ্ধির প্রবণতাটি হয়তো কিছুটা রোধ হতো এতে।
বোরো উত্তোলন শেষে এর চাল বাজারে আসার সময় এখন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বলছে, লক্ষ্যমাত্রাও নাকি ছাড়িয়ে গেছে বোরোর উৎপাদন। ‘নাকি’ শব্দটা যোগ করতে হচ্ছে এ জন্য যে, এসব প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সংশয় বেড়ে চলেছে।
সম্প্রতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রপ্তানি তথ্যে বড় রকম গলদ ধরা পড়ার ঘটনা সরকারের জন্যও বিব্রতকর। বিভিন্ন কৃষিপণ্যের উৎপাদনসংক্রান্ত ডিএইর তথ্য নিয়েও দেখা দিচ্ছে বিভ্রান্তি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে ডিএই প্রদত্ত তথ্যের বড় গরমিলে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নিতেও জটিলতা দেখা দেয় খোদ সরকারের মধ্যে।
রপ্তানি, উৎপাদন প্রভৃতি বাড়িয়ে দেখাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এভাবে পরিস্থিতি ফুলিয়ে দেখানোর চেষ্টায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা হয়ে উঠতে পারে কঠিন। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সম্পর্কে অতিরঞ্জিত তথ্যের প্রভাবে জরুরি কোনো পণ্যের আমদানি বিলম্বিত হলেও উপস্থিত হতে পারে বিপদ। আর চালের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটলে তা হয়ে উঠতে পারে বিপর্যয়কর।
বোরো মাঠে থাকার সময় নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ গেছে দেশের সিংহভাগ অঞ্চলের ওপর দিয়ে। এলোমেলো ঝড়বৃষ্টিতেও এর ফলন ব্যাহত হতে পারে বলে কোনো কোনো কৃষিবিদ শঙ্কা জানিয়েছিলেন। স্বভাবতই তখন জোর দেওয়া হয় বাড়তি সেচ আর বালাই ব্যবস্থাপনার ওপর। এ পরিস্থিতিতেও বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ালে আমাদের সংগ্রামশীল কৃষকের সঙ্গে ডিএইও ধন্যবাদ পাবে।
তবে চালের বাজারে আশাতীত উৎপাদনের প্রতিফলনও থাকতে হবে। চালের দাম নতুন করে বাড়ার প্রবণতায় সেটা কিন্তু প্রতিফলিত হচ্ছে না। আমনের ভরা মৌসুমেও এর দাম বাড়তে দেখা গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কিছু কার্যকারণ হয়তো রয়েছে। তা নিয়ে আলোচনাও কম হচ্ছে না। আর সবকিছুর মতো ধান-চালের উৎপাদন ব্যয়ও তো বাড়ছে। কৃষককে লাভজনক দাম পেতে হবে—এ দাবিও হচ্ছে উচ্চারিত।
তবে এই মুহূর্তে বোরো ধানের সিংহভাগ রয়েছে চালকল মালিকদের হাতে। সংগ্রহ অভিযানে সরকার কতখানি ধান খোদ কৃষকের কাছ থেকে কিনছে, কে জানে! তাকে শেষতক চালের সরবরাহ পেতে হয় চালকল থেকেই। আর এভাবেই গড়ে তুলতে হয় মজুত। সরকারকে সেটা ব্যবহার করতে হয় রেশনসহ খাদ্যসহায়তা কর্মসূচিতে। এতে মজুত উদ্বেগজনকভাবে নেমে গেলে সেটাকে আবার কাম্য পর্যায়ে আনতে হয়, প্রয়োজনে আমদানি করে। সরকারের হাতে সন্তোষজনক মজুত থাকলে চালের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হলেও সেটা কমানো হয় অপেক্ষাকৃত সহজ।
সরকার অবশ্য শুধু আমন ও বোরো মৌসুমে সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করে। আউশ থেকে প্রাপ্তি অনেক কম বলে এই মৌসুমে চাল সংগ্রহ করা হয় না। তবে সব মৌসুমেই ধানের বড় ক্রেতা হিসেবে হাজির থাকেন চালকল মালিকেরা। চালের বাজার ঘুরেফিরে তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেন বলে কথা চালু রয়েছে। সাম্প্রতিককালে সব রকম চালের দাম বাড়তে থাকার জন্য তাঁরাই দায়ী বলে অনেকের ধারণা।
সরকারকে চুক্তিমাফিক চাল জোগাতে গিয়ে কিছু কম মুনাফা হলেও তাঁরা এর বাজার থেকে ঠিকই বাড়তি মুনাফা তুলে নিতে তৎপর থাকবেন। তবে বিপুলসংখ্যক চালকল মালিক ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে এর বাজার নিয়ন্ত্রণে কতখানি সক্ষম, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। এ অবস্থায় সরকারকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তুলে এবং মজুতবিরোধী আইন প্রয়োগ করে। বাজারে নিয়মবিরুদ্ধ হস্তক্ষেপ করে আবার অস্থিরতা সৃষ্টি করা যাবে না।
সরকার চালের সঙ্গে কিছু গমও সংগ্রহ করে থাকে। গম তো হয়ে উঠেছে আমাদের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। গম অবশ্য কমই উৎপাদন করে থাকি। নানা কারণে এর উৎপাদন বরং কমে এসেছে। গমের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বাড়ছে আমাদের আমদানিনির্ভরতা।
সরকারও প্রতিবছর কিছু গম এনে মজুত বাড়ায়। তবে সিংহভাগ আমদানি হয় বেসরকারি খাতে। মাঝে ‘ইউক্রেন যুদ্ধ’ ঘিরে প্রধান গম রপ্তানিকারক ওই অঞ্চল থেকে আমদানি বিঘ্নিত হলে আমরা পড়ে গিয়েছিলাম সংকটে। গমের দাম তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে এবং একই সঙ্গে দেশে বাড়তে থাকে ডলার-সংকট। এ অবস্থায় আমদানি ব্যয়বহুল হলে গম আনাও কমে যায় এবং অনেক বাড়ে আটা-ময়দার দাম। এটা ক্রমে ছাড়িয়ে যায় চালের দামকে। তখন বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে বাড়ে চাল পরিভোগ। খাদ্যনিরাপত্তায় চালের ভূমিকা আরও বেড়ে যায়। ধান-চাল উৎপাদন ঠিকঠাক রাখার ওপর তখন জোর দেওয়া হয় আরও বেশি করে।
ভাগ্য ভালো যে এই ক’বছরে চালের কোনো মৌসুমই বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়েনি। সদ্যসমাপ্ত বোরো মৌসুমে বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাব সেভাবে না পড়ে থাকলে সেটাকেও বলতে হবে সৌভাগ্য। এ সময়ে থেকে থেকে বন্যা ও অতিবৃষ্টির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে অবশ্য শঙ্কা রয়েছে আমন ফলন নিয়ে। বৃষ্টিনির্ভর হলেও আবহাওয়ার খামখেয়ালিতে এর ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা অমূলক নয়।
এ অবস্থায় চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। মোদ্দাকথা, চাল উৎপাদনে কোনো সংকট সৃষ্টি হতে দেওয়া যাবে না। এ মুহূর্তে বিশ্ববাজার থেকে চাল আমদানি সহজ নয়। তা ছাড়া দেশে ডলারের উচ্চমূল্য বিবেচনায় ব্যাপকভাবে চাল আমদানি কঠিনও বটে। এতে চালের দাম লাগামহীন হয়ে পড়ার শঙ্কাও রয়েছে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম যখন কমবেশি বাড়তির দিকে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চপর্যায়ে; তখন চালের মূল্যবৃদ্ধির কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
এ ক্ষেত্রে একটা রক্ষাকবচ অবশ্য হতে পারে গম। বিশ্ববাজারে গমের দাম কমে এসেছে অনেকখানি। দেশীয় বাজারেও আটার দাম কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বেকারিশিল্পেও পড়েছে ইতিবাচক প্রভাব। রেস্তোরাঁয়ও এর কিছুটা সুপ্রভাব পড়ার কথা। গেল অর্থবছরে দেশে গমের আমদানিও নাকি বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। ৬৮ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানি হয়েছে। শূন্য চাল আমদানির সঙ্গে এই রেকর্ড গম আমদানির সম্পর্ক আছে কি না, সেটাও চিন্তা করে দেখা যায়। তাহলে কি দেশে গমের ব্যবহার তথা পরিভোগ বেড়ে চালের ওপর নির্ভরশীলতা কমে এসেছে? উচ্চ ও মধ্য আয়ের মানুষের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণেও গমের পরিভোগ বাড়তে পারে।
এটা পুষ্টিকর খাদ্যশস্য বটে। এ অবস্থায় গমের আবাদ বাড়ানোর সুযোগ না থাকলে এটা বেশি বেশি আমদানি করা যেতে পারে। উদ্দেশ্য খাদ্য মজুত জোরদার করা। বলা যায় না—চলমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে সেটা মোকাবিলা করতে গিয়েও এ মজুত ব্যবহার করতে হতে পারে। আর তেমনটা না ঘটলেও চালের ওপর চাপ কিছুটা কমাতে অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য হয়ে ওঠা গম জোগাতে পারে স্বস্তি। এ অবস্থায় খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে জরুরি আরেক পণ্য আলুর দামটা নিয়ন্ত্রণে থাকলে তাতে আরও খানিকটা স্বস্তি লাভের সুযোগ হয়তো মিলত!
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
বিদায়ী অর্থবছরে দেশে কোনো চাল আমদানি হয়নি। বছরের শেষদিকে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হলে তারাও শেষতক চাল আনেনি বলে জানা গেল। সরকারি তথ্যমতে, সন্তোষজনক উৎপাদন সত্ত্বেও দাম বাড়তে থাকায় সরকার তখন কিছু চাল আমদানির সুযোগ দেয়।
অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেটি গ্রহণ না করার প্রধান কারণ—প্রতিযোগিতামূলক দামে চাল আমদানি কঠিন ছিল। একই সময়ে বেশি দামে পেঁয়াজ এনে বিপাকে পড়েছিলেন কিছু আমদানিকারক। সে ঘটনা থেকেও চাল আমদানিকারকেরা সম্ভবত শিক্ষা নিয়েছিলেন। এই সবকিছু মিলিয়ে গেল অর্থবছরে চাল আমদানি হয়নি, এটাই হলো খবর। বলা হচ্ছে, তিন দশক পর এটা ছিল ‘শূন্য চাল আমদানির বছর’!
‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলে দাবি করা হলেও আমরা আসলে চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে সেটাও টেকসই নয়। বিদায়ী অর্থবছর বাদে তিন দশকের প্রতিবছরেই কিছু না কিছু চাল আমদানি করতে হয়েছে। ধান-চালের উৎপাদন কোনো কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে কোনো কোনো বছর বিপুলভাবেও বাড়াতে হয়েছে আমদানি। যেমন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৩৮ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন চাল আনতে হয়েছিল।
২০১৯-২০ অর্থবছরেই আবার আমদানি নেমে আসে মাত্র ৪ হাজার মেট্রিক টনে। ওটা ছিল তিন দশকে সর্বনিম্ন আমদানি। সত্যি বলতে, চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়লেও বাংলাদেশকে এখন আর ব্যাপকভাবে চাল আমদানি করতে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে কিছু চাল আনতে হয় প্রধানতম এ খাদ্যশস্যের বাজারে ব্যবসায়ীদের সংযত রাখতে। এটা ‘কৌশলগত আমদানি’! গেল অর্থবছরের শেষদিকে তেমন একটি উদ্যোগই সম্ভবত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারতসহ প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোয় দাম চড়া বলে আমদানি সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি ইতিবাচক হলে কিছু চাল এনে বাজারে উদ্বৃত্ত সরবরাহ রাখা গেলে অবশ্য ভালো হতো। থেকে থেকে চালের দাম বৃদ্ধির প্রবণতাটি হয়তো কিছুটা রোধ হতো এতে।
বোরো উত্তোলন শেষে এর চাল বাজারে আসার সময় এখন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বলছে, লক্ষ্যমাত্রাও নাকি ছাড়িয়ে গেছে বোরোর উৎপাদন। ‘নাকি’ শব্দটা যোগ করতে হচ্ছে এ জন্য যে, এসব প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সংশয় বেড়ে চলেছে।
সম্প্রতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রপ্তানি তথ্যে বড় রকম গলদ ধরা পড়ার ঘটনা সরকারের জন্যও বিব্রতকর। বিভিন্ন কৃষিপণ্যের উৎপাদনসংক্রান্ত ডিএইর তথ্য নিয়েও দেখা দিচ্ছে বিভ্রান্তি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে ডিএই প্রদত্ত তথ্যের বড় গরমিলে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নিতেও জটিলতা দেখা দেয় খোদ সরকারের মধ্যে।
রপ্তানি, উৎপাদন প্রভৃতি বাড়িয়ে দেখাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এভাবে পরিস্থিতি ফুলিয়ে দেখানোর চেষ্টায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা হয়ে উঠতে পারে কঠিন। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সম্পর্কে অতিরঞ্জিত তথ্যের প্রভাবে জরুরি কোনো পণ্যের আমদানি বিলম্বিত হলেও উপস্থিত হতে পারে বিপদ। আর চালের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটলে তা হয়ে উঠতে পারে বিপর্যয়কর।
বোরো মাঠে থাকার সময় নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ গেছে দেশের সিংহভাগ অঞ্চলের ওপর দিয়ে। এলোমেলো ঝড়বৃষ্টিতেও এর ফলন ব্যাহত হতে পারে বলে কোনো কোনো কৃষিবিদ শঙ্কা জানিয়েছিলেন। স্বভাবতই তখন জোর দেওয়া হয় বাড়তি সেচ আর বালাই ব্যবস্থাপনার ওপর। এ পরিস্থিতিতেও বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ালে আমাদের সংগ্রামশীল কৃষকের সঙ্গে ডিএইও ধন্যবাদ পাবে।
তবে চালের বাজারে আশাতীত উৎপাদনের প্রতিফলনও থাকতে হবে। চালের দাম নতুন করে বাড়ার প্রবণতায় সেটা কিন্তু প্রতিফলিত হচ্ছে না। আমনের ভরা মৌসুমেও এর দাম বাড়তে দেখা গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কিছু কার্যকারণ হয়তো রয়েছে। তা নিয়ে আলোচনাও কম হচ্ছে না। আর সবকিছুর মতো ধান-চালের উৎপাদন ব্যয়ও তো বাড়ছে। কৃষককে লাভজনক দাম পেতে হবে—এ দাবিও হচ্ছে উচ্চারিত।
তবে এই মুহূর্তে বোরো ধানের সিংহভাগ রয়েছে চালকল মালিকদের হাতে। সংগ্রহ অভিযানে সরকার কতখানি ধান খোদ কৃষকের কাছ থেকে কিনছে, কে জানে! তাকে শেষতক চালের সরবরাহ পেতে হয় চালকল থেকেই। আর এভাবেই গড়ে তুলতে হয় মজুত। সরকারকে সেটা ব্যবহার করতে হয় রেশনসহ খাদ্যসহায়তা কর্মসূচিতে। এতে মজুত উদ্বেগজনকভাবে নেমে গেলে সেটাকে আবার কাম্য পর্যায়ে আনতে হয়, প্রয়োজনে আমদানি করে। সরকারের হাতে সন্তোষজনক মজুত থাকলে চালের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হলেও সেটা কমানো হয় অপেক্ষাকৃত সহজ।
সরকার অবশ্য শুধু আমন ও বোরো মৌসুমে সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করে। আউশ থেকে প্রাপ্তি অনেক কম বলে এই মৌসুমে চাল সংগ্রহ করা হয় না। তবে সব মৌসুমেই ধানের বড় ক্রেতা হিসেবে হাজির থাকেন চালকল মালিকেরা। চালের বাজার ঘুরেফিরে তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেন বলে কথা চালু রয়েছে। সাম্প্রতিককালে সব রকম চালের দাম বাড়তে থাকার জন্য তাঁরাই দায়ী বলে অনেকের ধারণা।
সরকারকে চুক্তিমাফিক চাল জোগাতে গিয়ে কিছু কম মুনাফা হলেও তাঁরা এর বাজার থেকে ঠিকই বাড়তি মুনাফা তুলে নিতে তৎপর থাকবেন। তবে বিপুলসংখ্যক চালকল মালিক ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে এর বাজার নিয়ন্ত্রণে কতখানি সক্ষম, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। এ অবস্থায় সরকারকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তুলে এবং মজুতবিরোধী আইন প্রয়োগ করে। বাজারে নিয়মবিরুদ্ধ হস্তক্ষেপ করে আবার অস্থিরতা সৃষ্টি করা যাবে না।
সরকার চালের সঙ্গে কিছু গমও সংগ্রহ করে থাকে। গম তো হয়ে উঠেছে আমাদের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। গম অবশ্য কমই উৎপাদন করে থাকি। নানা কারণে এর উৎপাদন বরং কমে এসেছে। গমের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বাড়ছে আমাদের আমদানিনির্ভরতা।
সরকারও প্রতিবছর কিছু গম এনে মজুত বাড়ায়। তবে সিংহভাগ আমদানি হয় বেসরকারি খাতে। মাঝে ‘ইউক্রেন যুদ্ধ’ ঘিরে প্রধান গম রপ্তানিকারক ওই অঞ্চল থেকে আমদানি বিঘ্নিত হলে আমরা পড়ে গিয়েছিলাম সংকটে। গমের দাম তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে এবং একই সঙ্গে দেশে বাড়তে থাকে ডলার-সংকট। এ অবস্থায় আমদানি ব্যয়বহুল হলে গম আনাও কমে যায় এবং অনেক বাড়ে আটা-ময়দার দাম। এটা ক্রমে ছাড়িয়ে যায় চালের দামকে। তখন বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে বাড়ে চাল পরিভোগ। খাদ্যনিরাপত্তায় চালের ভূমিকা আরও বেড়ে যায়। ধান-চাল উৎপাদন ঠিকঠাক রাখার ওপর তখন জোর দেওয়া হয় আরও বেশি করে।
ভাগ্য ভালো যে এই ক’বছরে চালের কোনো মৌসুমই বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়েনি। সদ্যসমাপ্ত বোরো মৌসুমে বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাব সেভাবে না পড়ে থাকলে সেটাকেও বলতে হবে সৌভাগ্য। এ সময়ে থেকে থেকে বন্যা ও অতিবৃষ্টির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে অবশ্য শঙ্কা রয়েছে আমন ফলন নিয়ে। বৃষ্টিনির্ভর হলেও আবহাওয়ার খামখেয়ালিতে এর ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা অমূলক নয়।
এ অবস্থায় চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। মোদ্দাকথা, চাল উৎপাদনে কোনো সংকট সৃষ্টি হতে দেওয়া যাবে না। এ মুহূর্তে বিশ্ববাজার থেকে চাল আমদানি সহজ নয়। তা ছাড়া দেশে ডলারের উচ্চমূল্য বিবেচনায় ব্যাপকভাবে চাল আমদানি কঠিনও বটে। এতে চালের দাম লাগামহীন হয়ে পড়ার শঙ্কাও রয়েছে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম যখন কমবেশি বাড়তির দিকে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চপর্যায়ে; তখন চালের মূল্যবৃদ্ধির কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
এ ক্ষেত্রে একটা রক্ষাকবচ অবশ্য হতে পারে গম। বিশ্ববাজারে গমের দাম কমে এসেছে অনেকখানি। দেশীয় বাজারেও আটার দাম কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বেকারিশিল্পেও পড়েছে ইতিবাচক প্রভাব। রেস্তোরাঁয়ও এর কিছুটা সুপ্রভাব পড়ার কথা। গেল অর্থবছরে দেশে গমের আমদানিও নাকি বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। ৬৮ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানি হয়েছে। শূন্য চাল আমদানির সঙ্গে এই রেকর্ড গম আমদানির সম্পর্ক আছে কি না, সেটাও চিন্তা করে দেখা যায়। তাহলে কি দেশে গমের ব্যবহার তথা পরিভোগ বেড়ে চালের ওপর নির্ভরশীলতা কমে এসেছে? উচ্চ ও মধ্য আয়ের মানুষের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণেও গমের পরিভোগ বাড়তে পারে।
এটা পুষ্টিকর খাদ্যশস্য বটে। এ অবস্থায় গমের আবাদ বাড়ানোর সুযোগ না থাকলে এটা বেশি বেশি আমদানি করা যেতে পারে। উদ্দেশ্য খাদ্য মজুত জোরদার করা। বলা যায় না—চলমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে সেটা মোকাবিলা করতে গিয়েও এ মজুত ব্যবহার করতে হতে পারে। আর তেমনটা না ঘটলেও চালের ওপর চাপ কিছুটা কমাতে অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য হয়ে ওঠা গম জোগাতে পারে স্বস্তি। এ অবস্থায় খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে জরুরি আরেক পণ্য আলুর দামটা নিয়ন্ত্রণে থাকলে তাতে আরও খানিকটা স্বস্তি লাভের সুযোগ হয়তো মিলত!
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে