শাইখ সিরাজ
২০০৪ সালের কথা। বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’-এর পর দীর্ঘ সাত বছরের বিরতি দিয়ে চ্যানেল আইয়ে শুরু করেছিলাম ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান। প্রথম পর্ব প্রচারিত হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। কারণ, একুশ মানেই আমাদের মুখের ভাষা, আমাদের অধিকারের লড়াই। কৃষকের অধিকার, কৃষকের বুকের মুখের জীবনের ভাষা তুলে ধরা হবে যে অনুষ্ঠানে, চেয়েছি তার সূচনা হোক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেই। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চেয়েছি কৃষককে নতুন ফল-ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে। কৃষি যে কেবল ধান ও পাট চাষই নয়, বরং খাদ্য উপকরণের প্রতিটি পণ্যই কৃষির অন্তর্গত, সে বিষয়টি কৃষকের বোধের ভেতর প্রবেশ করাতে চেয়েছি ক্রমাগত। চেয়েছি পাল্টে দিতে কৃষকের সংজ্ঞা। কৃষি মানেই সমৃদ্ধি। কৃষি মানেই সম্ভাবনা, নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা—এ সত্য অনুধাবনের মাধ্যমে চেয়েছি তরুণেরাও যুক্ত হোক কৃষিতে।
প্রায় দুই যুগের এই যাত্রায় দেখেছি পাল্টেছে বাংলাদেশের কৃষি, পাল্টেছে কৃষকও। তরুণেরা যুক্ত হচ্ছে মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু লালন-পালনে। কিন্তু কৃষক যেন ঠিক আগের জায়গাতেই রয়ে গেছেন। উৎপাদন বেড়েছে, ফসল বৈচিত্র্য বেড়েছে। তারপরও কৃষক তাঁর উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য হাতে পাচ্ছেন না। কৃষক মূল্য না পেয়ে ক্ষোভে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন মণের পর মণ সবজি। লিটারের পর লিটার দুধ। এমন দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যাচ্ছিল। মনে হলো, ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর ভাষা হবে অন্য রকম। এ অনুষ্ঠান হয়ে উঠবে কৃষকের কথা বলার, কৃষকের দাবির, কৃষকের পাওয়া না-পাওয়ার হিসাবের একটি মাধ্যম।
যাই হোক, হৃদয়ে মাটি ও মানুষের প্রথম পর্ব ধারণ করতে গিয়েছিলাম নরসিংদীর বাজনাবো গ্রামে। তখন শীতকাল ছিল। মাঠের পর মাঠ সেজেছিল শীতের নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ সবজিতে। সে গ্রামের কৃষক সিতারা বেগম কাজ করছিলেন তাঁর সবজিখেতে। তিনি খেত থেকেই ফুলকপি তুলে বিক্রি করছিলেন। মাঝারি আকৃতির একেকটি ফুলকপি তিনি বিক্রি করছিলেন ৩ টাকা করে। সিতারা বেগম জানালেন জমি, বীজ, সেচ, সার ইত্যাদি হিসাব করে ৩ টাকা করে প্রতিটি ফুলকপি বিক্রি করে নামমাত্র লাভ পাচ্ছেন। জমির আইলে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে ফসল বপন থেকে শুরু করে বিক্রি অবধি সব হিসাব করে দেখলাম, তিনি যে লাভ পাচ্ছেন সেখানে সবজি ফলাতে যে শ্রম দিতে হচ্ছে, তার মূল্য নেই। সেই মূল্য ধরলে তাঁর লাভের অঙ্ক শূন্যতে এসে ঠেকে।
অথচ সিতারার খেত থেকে আধা কিলোমিটারের কম পথ অতিক্রম করে সেই ফুলকপি বিক্রি হলো ৫ টাকা দরে। অর্থাৎ কোনো রকম বিনিয়োগ ছাড়াই সামান্য পথ ব্যবধানে ২ টাকা লাভ নিয়ে নিলেন মধ্যস্বত্বভোগী একজন। তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম, ‘খেত থেকে মাত্রই তো ৩ টাকায় কিনে আনলেন। বিক্রি করলেন ৫ টাকায়। প্রতি কপিতে ২ টাকা লাভ পাচ্ছেন। তো কৃষককে আর একটু বেশি লাভ দিতে পারলেন না?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘পথের খরচ আছে না!’ অথচ সামান্য পথ অতিক্রম করতে কপিপ্রতি ১০ পয়সাও খরচ হয়নি।
বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। বাজারে ৫ টাকা দরে যিনি কিনেছিলেন তিনি তা আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিলেন ১০ টাকা দরে। ৫ টাকা দরে ক্রেতা ও ১০ টাকা দরে বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম, ‘আপনি যে ৫ টাকায় কিনে ফুলকপি ১০ টাকায় বিক্রি করলেন?’ তিনি বিস্মিত হয়ে জবাব দিলেন, ‘খরচ আছে না!’ অথচ স্তূপ করে রাখা ফুলকপি তখনো ঠায় পড়ে ছিল। দেখতে দেখতে সে বাজারেই আরেক হাত বদল হয়ে ফুলকপির দাম গিয়ে দাঁড়াল ১৫ টাকায়। এরপর ফুলকপি ট্রাকে চড়ল। অবশেষে কারওয়ান বাজারে এসে আমি ভোক্তা হিসেবে সেই ফুলকপি কিনলাম ৩০ টাকায়। অর্থাৎ ভোক্তার ৩০ টাকায় কেনা ফুলকপি থেকে কৃষক পাচ্ছেন মাত্র ৩ টাকা। বাকি ২৭ টাকা চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে।
যেখানে কৃষক তাঁর শ্রমের মূল্যই পাচ্ছেন না, সেখানে কিছু না করেই শুধু হাত বদলে কেউ কেউ লাভ পাচ্ছেন উৎপাদকের চেয়ে বহুগুণ। কৃষক ফসল উৎপাদন করছেন, কিন্তু তাঁর উৎপাদিত ফসল নিয়ে বাজারে ঢুকতে পারছেন না। অদ্ভুত হলেও সত্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি মানুষের পেশা কৃষি বা কৃষিসংশ্লিষ্ট হলেও কৃষকদের সেই অর্থে কোনো সংগঠন নেই। ফলে কৃষক মূলত একা, শক্তিহীন। তিনি বাজারের সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। প্রতারিত হন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, গত দুই দশকে চালের দাম বেড়েছে। কিন্তু সে সুফল কৃষকের কাছে পৌঁছায়নি; বরং ভোক্তামূল্যে কৃষকের অংশ ৬৫ থেকে ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে। চালের বাড়তি দামের সুফল চলে গেছে ধান ব্যবসায়ী, চাতালমালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের মতো মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। আমার ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানে অসংখ্য কৃষকের দাবি ছিল ধান-চালের মতো অন্যান্য কৃষিপণ্যের দামও সরকার যেন নির্ধারণ করে দেয়। প্রয়োজন একটি কৃষিমূল্য কমিশন। কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহমূল্য নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন দেশে রয়েছে ‘অ্যাগ্রিকালচারাল প্রাইস কমিশন’।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে এখন কৃষিমূল্য কমিশন রয়েছে। ভারতে কৃষিমূল্য কমিশন স্থাপিত হয়েছে ১৯৬৫ সালে। এ কমিশনের কাজ হচ্ছে পণ্যের উৎপাদন খরচ নির্ণয়, ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণ, কৃষিপণ্যের রপ্তানিমূল্য নির্ধারণ ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করা। ভারতে ২৩টি কৃষিপণ্যের সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত মূল্যের নিচে যাতে বাজারদর নেমে না যায়, সে জন্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে সরকার। যতদূর জানি ভারত সরকার বিভিন্ন কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেছে উৎপাদন খরচের ওপর শতকরা ৫০ শতাংশ মুনাফা হিসাব করে।
সরকার ধান-চাল ও গম সংগ্রহ করে নামমাত্র পরিমাণে। উৎপাদন মৌসুমে মোট উৎপাদনের মাত্র ৪-৫ শতাংশ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে। সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করা হয় সাধারণত উৎপাদন খরচের ওপর ৬-১০ শতাংশ মুনাফা দেখিয়ে। তা-ও ক্রয় করা হয় ব্যবসায়ী ও চাতালের মালিকদের কাছ থেকে। ফলে কৃষক সরাসরি লাভবান হন না। এ কারণে আমাদের দেশে প্রচলিত উৎপাদিত পণ্যের সংগ্রহমূল্য স্থানীয় বাজারে তেমন প্রভাব ফেলে না। এতে করে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন কৃষক। কৃষিপণ্যের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণের জন্য আগের বছরের পণ্যমূল্য, উৎপাদন খরচ, খোলাবাজারে পণ্যমূল্যের চালচিত্র, আন্তর্জাতিক বাজারদর, সরকারি মজুত ও মূল্যস্ফীতির হার ইত্যাদি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। অথচ আমাদের দেশে বর্তমানে ধান-চালের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করা হয় মূলত উৎপাদন খরচের ওপর ভিত্তি করে। কৃষিপণ্য বিপণনের দায়িত্ব কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুধু জেলা পর্যায়ে সীমিত জনবল নিয়ে। ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে কাজ করার মতো লোকবল তাদের নেই। ফলে জেলা পর্যায়ে বাজার মনিটরিং করতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়।
উচ্চমূল্যের ফল-ফসল উৎপাদনকারী কৃষক লাভবান হলেও সাধারণ ফল-ফসল চাষ করা কৃষক মধ্যস্বত্বভোগীদের কূটকৌশলে প্রতারিত। তাই শুধু মুনাফা নির্ধারণের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের লাগাম টেনে ধরা কঠিন। তবে সরকারকে প্রারম্ভিক অবস্থান নেওয়ার জন্য সাধুবাদ জানাতেই হয়। এর পাশাপাশি বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে। ফড়িয়া দমনে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।
কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে তাঁদের সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষকের একত্র হওয়ার বিকল্প নেই। সমবায় ভিত্তিতে কৃষকদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা বেশ কয়েকবার চালানো হয়েছে। কিন্তু সেভাবে সফলতা আসেনি। কৃষকেরা সংঘবদ্ধ নন বলেই মধ্যস্বত্বভোগীরা সংঘবদ্ধ হয়ে কৃষকদের ঠকিয়ে যেতে পারছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করে কাজ করতে হবে।
আমি আশাবাদী মানুষ। বিশ্বাস করি অল্প অল্প করেই অন্ধকার ঘুচিয়ে দারুণ সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত হবে বাংলাদেশের কৃষি। একদিন বিশ্বের বুকে অনন্য সফলতা নিয়ে হেসে উঠবেন আমাদের কৃষক।
লেখক: শাইখ সিরাজ
পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
২০০৪ সালের কথা। বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’-এর পর দীর্ঘ সাত বছরের বিরতি দিয়ে চ্যানেল আইয়ে শুরু করেছিলাম ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান। প্রথম পর্ব প্রচারিত হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। কারণ, একুশ মানেই আমাদের মুখের ভাষা, আমাদের অধিকারের লড়াই। কৃষকের অধিকার, কৃষকের বুকের মুখের জীবনের ভাষা তুলে ধরা হবে যে অনুষ্ঠানে, চেয়েছি তার সূচনা হোক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেই। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চেয়েছি কৃষককে নতুন ফল-ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে। কৃষি যে কেবল ধান ও পাট চাষই নয়, বরং খাদ্য উপকরণের প্রতিটি পণ্যই কৃষির অন্তর্গত, সে বিষয়টি কৃষকের বোধের ভেতর প্রবেশ করাতে চেয়েছি ক্রমাগত। চেয়েছি পাল্টে দিতে কৃষকের সংজ্ঞা। কৃষি মানেই সমৃদ্ধি। কৃষি মানেই সম্ভাবনা, নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা—এ সত্য অনুধাবনের মাধ্যমে চেয়েছি তরুণেরাও যুক্ত হোক কৃষিতে।
প্রায় দুই যুগের এই যাত্রায় দেখেছি পাল্টেছে বাংলাদেশের কৃষি, পাল্টেছে কৃষকও। তরুণেরা যুক্ত হচ্ছে মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু লালন-পালনে। কিন্তু কৃষক যেন ঠিক আগের জায়গাতেই রয়ে গেছেন। উৎপাদন বেড়েছে, ফসল বৈচিত্র্য বেড়েছে। তারপরও কৃষক তাঁর উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য হাতে পাচ্ছেন না। কৃষক মূল্য না পেয়ে ক্ষোভে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন মণের পর মণ সবজি। লিটারের পর লিটার দুধ। এমন দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যাচ্ছিল। মনে হলো, ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর ভাষা হবে অন্য রকম। এ অনুষ্ঠান হয়ে উঠবে কৃষকের কথা বলার, কৃষকের দাবির, কৃষকের পাওয়া না-পাওয়ার হিসাবের একটি মাধ্যম।
যাই হোক, হৃদয়ে মাটি ও মানুষের প্রথম পর্ব ধারণ করতে গিয়েছিলাম নরসিংদীর বাজনাবো গ্রামে। তখন শীতকাল ছিল। মাঠের পর মাঠ সেজেছিল শীতের নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ সবজিতে। সে গ্রামের কৃষক সিতারা বেগম কাজ করছিলেন তাঁর সবজিখেতে। তিনি খেত থেকেই ফুলকপি তুলে বিক্রি করছিলেন। মাঝারি আকৃতির একেকটি ফুলকপি তিনি বিক্রি করছিলেন ৩ টাকা করে। সিতারা বেগম জানালেন জমি, বীজ, সেচ, সার ইত্যাদি হিসাব করে ৩ টাকা করে প্রতিটি ফুলকপি বিক্রি করে নামমাত্র লাভ পাচ্ছেন। জমির আইলে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে ফসল বপন থেকে শুরু করে বিক্রি অবধি সব হিসাব করে দেখলাম, তিনি যে লাভ পাচ্ছেন সেখানে সবজি ফলাতে যে শ্রম দিতে হচ্ছে, তার মূল্য নেই। সেই মূল্য ধরলে তাঁর লাভের অঙ্ক শূন্যতে এসে ঠেকে।
অথচ সিতারার খেত থেকে আধা কিলোমিটারের কম পথ অতিক্রম করে সেই ফুলকপি বিক্রি হলো ৫ টাকা দরে। অর্থাৎ কোনো রকম বিনিয়োগ ছাড়াই সামান্য পথ ব্যবধানে ২ টাকা লাভ নিয়ে নিলেন মধ্যস্বত্বভোগী একজন। তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম, ‘খেত থেকে মাত্রই তো ৩ টাকায় কিনে আনলেন। বিক্রি করলেন ৫ টাকায়। প্রতি কপিতে ২ টাকা লাভ পাচ্ছেন। তো কৃষককে আর একটু বেশি লাভ দিতে পারলেন না?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘পথের খরচ আছে না!’ অথচ সামান্য পথ অতিক্রম করতে কপিপ্রতি ১০ পয়সাও খরচ হয়নি।
বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। বাজারে ৫ টাকা দরে যিনি কিনেছিলেন তিনি তা আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিলেন ১০ টাকা দরে। ৫ টাকা দরে ক্রেতা ও ১০ টাকা দরে বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম, ‘আপনি যে ৫ টাকায় কিনে ফুলকপি ১০ টাকায় বিক্রি করলেন?’ তিনি বিস্মিত হয়ে জবাব দিলেন, ‘খরচ আছে না!’ অথচ স্তূপ করে রাখা ফুলকপি তখনো ঠায় পড়ে ছিল। দেখতে দেখতে সে বাজারেই আরেক হাত বদল হয়ে ফুলকপির দাম গিয়ে দাঁড়াল ১৫ টাকায়। এরপর ফুলকপি ট্রাকে চড়ল। অবশেষে কারওয়ান বাজারে এসে আমি ভোক্তা হিসেবে সেই ফুলকপি কিনলাম ৩০ টাকায়। অর্থাৎ ভোক্তার ৩০ টাকায় কেনা ফুলকপি থেকে কৃষক পাচ্ছেন মাত্র ৩ টাকা। বাকি ২৭ টাকা চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে।
যেখানে কৃষক তাঁর শ্রমের মূল্যই পাচ্ছেন না, সেখানে কিছু না করেই শুধু হাত বদলে কেউ কেউ লাভ পাচ্ছেন উৎপাদকের চেয়ে বহুগুণ। কৃষক ফসল উৎপাদন করছেন, কিন্তু তাঁর উৎপাদিত ফসল নিয়ে বাজারে ঢুকতে পারছেন না। অদ্ভুত হলেও সত্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি মানুষের পেশা কৃষি বা কৃষিসংশ্লিষ্ট হলেও কৃষকদের সেই অর্থে কোনো সংগঠন নেই। ফলে কৃষক মূলত একা, শক্তিহীন। তিনি বাজারের সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। প্রতারিত হন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, গত দুই দশকে চালের দাম বেড়েছে। কিন্তু সে সুফল কৃষকের কাছে পৌঁছায়নি; বরং ভোক্তামূল্যে কৃষকের অংশ ৬৫ থেকে ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে। চালের বাড়তি দামের সুফল চলে গেছে ধান ব্যবসায়ী, চাতালমালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের মতো মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। আমার ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানে অসংখ্য কৃষকের দাবি ছিল ধান-চালের মতো অন্যান্য কৃষিপণ্যের দামও সরকার যেন নির্ধারণ করে দেয়। প্রয়োজন একটি কৃষিমূল্য কমিশন। কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহমূল্য নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন দেশে রয়েছে ‘অ্যাগ্রিকালচারাল প্রাইস কমিশন’।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে এখন কৃষিমূল্য কমিশন রয়েছে। ভারতে কৃষিমূল্য কমিশন স্থাপিত হয়েছে ১৯৬৫ সালে। এ কমিশনের কাজ হচ্ছে পণ্যের উৎপাদন খরচ নির্ণয়, ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণ, কৃষিপণ্যের রপ্তানিমূল্য নির্ধারণ ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করা। ভারতে ২৩টি কৃষিপণ্যের সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত মূল্যের নিচে যাতে বাজারদর নেমে না যায়, সে জন্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে সরকার। যতদূর জানি ভারত সরকার বিভিন্ন কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেছে উৎপাদন খরচের ওপর শতকরা ৫০ শতাংশ মুনাফা হিসাব করে।
সরকার ধান-চাল ও গম সংগ্রহ করে নামমাত্র পরিমাণে। উৎপাদন মৌসুমে মোট উৎপাদনের মাত্র ৪-৫ শতাংশ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে। সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করা হয় সাধারণত উৎপাদন খরচের ওপর ৬-১০ শতাংশ মুনাফা দেখিয়ে। তা-ও ক্রয় করা হয় ব্যবসায়ী ও চাতালের মালিকদের কাছ থেকে। ফলে কৃষক সরাসরি লাভবান হন না। এ কারণে আমাদের দেশে প্রচলিত উৎপাদিত পণ্যের সংগ্রহমূল্য স্থানীয় বাজারে তেমন প্রভাব ফেলে না। এতে করে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন কৃষক। কৃষিপণ্যের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণের জন্য আগের বছরের পণ্যমূল্য, উৎপাদন খরচ, খোলাবাজারে পণ্যমূল্যের চালচিত্র, আন্তর্জাতিক বাজারদর, সরকারি মজুত ও মূল্যস্ফীতির হার ইত্যাদি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। অথচ আমাদের দেশে বর্তমানে ধান-চালের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করা হয় মূলত উৎপাদন খরচের ওপর ভিত্তি করে। কৃষিপণ্য বিপণনের দায়িত্ব কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুধু জেলা পর্যায়ে সীমিত জনবল নিয়ে। ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে কাজ করার মতো লোকবল তাদের নেই। ফলে জেলা পর্যায়ে বাজার মনিটরিং করতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়।
উচ্চমূল্যের ফল-ফসল উৎপাদনকারী কৃষক লাভবান হলেও সাধারণ ফল-ফসল চাষ করা কৃষক মধ্যস্বত্বভোগীদের কূটকৌশলে প্রতারিত। তাই শুধু মুনাফা নির্ধারণের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের লাগাম টেনে ধরা কঠিন। তবে সরকারকে প্রারম্ভিক অবস্থান নেওয়ার জন্য সাধুবাদ জানাতেই হয়। এর পাশাপাশি বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে। ফড়িয়া দমনে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।
কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে তাঁদের সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষকের একত্র হওয়ার বিকল্প নেই। সমবায় ভিত্তিতে কৃষকদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা বেশ কয়েকবার চালানো হয়েছে। কিন্তু সেভাবে সফলতা আসেনি। কৃষকেরা সংঘবদ্ধ নন বলেই মধ্যস্বত্বভোগীরা সংঘবদ্ধ হয়ে কৃষকদের ঠকিয়ে যেতে পারছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করে কাজ করতে হবে।
আমি আশাবাদী মানুষ। বিশ্বাস করি অল্প অল্প করেই অন্ধকার ঘুচিয়ে দারুণ সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত হবে বাংলাদেশের কৃষি। একদিন বিশ্বের বুকে অনন্য সফলতা নিয়ে হেসে উঠবেন আমাদের কৃষক।
লেখক: শাইখ সিরাজ
পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১৯ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে