আসিফ, বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের এ দেশটির জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন কৃষক, মাঝি, শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, জেলে-তাঁতিসহ নানা পেশার মানুষ। তাঁরা সমাজের সাধারণ মানুষ ছিলেন। শত দুঃখ-কষ্টে থাকলেও সমাজের পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারেননি। সৃজনশীল কোনো জাতি তা মেনে নিতে পারে না। এ ছাড়া প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি না থেকেও নানাভাবে এই যুদ্ধকে সহযোগিতা করেছেন।
নানা লেখা, গবেষণা ও বক্তব্য থেকে আমরা বুঝতে পারি, সর্বোচ্চ সহনশীলতা, নমনীয়তার পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁরা। পাকিস্তানিদের অযৌক্তিক আচরণ, অত্যাচারী মনোভাব, নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাধ্য হন। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে দেশটির জন্ম হবে, সেখানে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম এক অনাবিল সময়ের মধ্য দিয়ে পথ চলবে। যেখানে রাগ-অভিমান থাকবে, বাদানুবাদ থাকবে, কিন্তু আলোচনার টেবিলে বসে তারা সমাধানে যাবে এবং সামনের দিকে এগোবে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে, শুধু পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারার অক্ষমতা ও খণ্ডিত বাক্যাংশ ব্যবহার করে যে জটিলতা, যে সংঘর্ষ আমরা সৃষ্টি করেছি, তা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নকেই অপমান করেছি, যাঁরা দেশটার আপামর মানুষের সুন্দর জীবনের কথা ভেবেছিলেন, নব প্রজন্মের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনেও তো সমাধান আলোচনায় হতে পারত। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের অদ্ভুত নীরবতা, ফরমায়েশি বক্তব্য দেওয়ার মানসিকতা, এই বড় হয়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সহনশীলতা ও মানবিকতাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। যার পরিণতিতে শত শত শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও পুলিশকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আসলেই আমরা অস্থির, অসহনশীল আর আক্রমণাত্মক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
মানুষ কেন এমন অনড়তা তৈরি করছে? কেন কেউ কারও কথা শুনতে চাচ্ছি না, বুঝতে চাচ্ছি না? সবাই তর্কে জিততে চাচ্ছি। আর মহা চোরেরা ক্রমেই চুরির পরিমাণ বাড়িয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে; এর কোনো সহজ উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে মস্তিষ্কের বিকাশ নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে, যা আমাদের জানায় এই রিজিডিটি, অসহযোগিতামূলক ও অনৈতিক আচরণের পেছনে কারণগুলো কী?
পৃথিবীর প্রাণের জন্ম অ্যামাইনো-অ্যাসিডের জটিল এক প্রকার অণু থেকে। এ অণুগুলো প্রথমে সরলপ্রাণ হয়ে এলোমেলোভাবে সংযোগে লিপ্ত হয়। শত শত কোটি বছর ধরে এই প্রাথমিক সরলপ্রাণ ক্রমেই উন্নত হতে থাকে। জটিল, বহুকোষী, মস্তিষ্কওলা প্রাণী হিসেবে রূপ নেওয়া পর্যন্ত এটা নিরন্তরভাবে চলতে থাকে। কেননা চারদিকের পরিবেশ-প্রকৃতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হলে টিকে থাকার জন্য পূর্বনির্ধারিত জেনেটিক কোডও সামগ্রিকভাবে পর্যাপ্ত হয় না। এমনকি ৫০০ পৃষ্ঠার ১ হাজার খণ্ডের বইয়ের তথ্যসমৃদ্ধ জিন লাইব্রেরি, যা আগে টিকে থাকার জন্য সঠিকভাবে কার্যসম্পাদন করেছে, তা-ও ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তন কোনো প্রাণীকে দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না। এই অসুবিধাগুলোর কারণেই আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে। মাথায় রাখতে হবে সাংস্কৃতিকভাবে পরিবেশ পরিস্থিতি এর চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত পরিবর্তিত হয়।
মস্তিষ্কের বিকাশের কারণেই আমরা বলতে পারি যে বুদ্ধিমত্তা মানে চারপাশের জগৎ থেকে সরাসরি শুধু তথ্য ধারণ করা নয়, সেই সঙ্গে জাজমেন্ট বা বিচারবুদ্ধিরও ব্যাপার বটে। যার মাধ্যমে তথ্যগুলো সমন্বয় সাধন ও ব্যবহার করা যায়, ভবিষ্যতের কোনো বিপদ সম্পর্কেই আগেই আভাস পাওয়া সম্ভব হয়, যা শুধু জিনের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ্যের মতো প্রয়োজনের তাগিদে মস্তিষ্কেরও উদ্ভব ঘটেছে এবং লাখ লাখ বছর ধরে তথ্য ধারণের মধ্য দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মস্তিষ্কের বিকাশ শুরু হয় মানুষের শরীরের স্পাইনাল কর্ডের স্ফীত ঊর্ধ্বাংশের মধ্য দিয়ে। স্পাইনাল কর্ডের এই স্ফীত ঊর্ধ্বস্থানে অবস্থান করছে সবচেয়ে পুরোনো অংশ ‘ব্রেইন-স্টেম’, অর্থাৎ স্নায়ু ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয় মস্তিষ্ক। এই ব্রেইন-স্টেম পরিচালনা করে মূল জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে প্রাণের ছন্দ, যেমন হার্টবিট, রক্ত সংবহন ও নিশ্বাস-প্রশ্বাস-প্রক্রিয়া। পল ম্যাকলিনের প্রভোকেটিভ ইনসাইট মতানুসারে, পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কের উচ্চ ক্রিয়াকলাপের অংশগুলোর উদ্ভব ঘটেছে তিনটি ধারাবাহিক পর্যায়ে।
প্রথম অংশটি হলো ব্রেইন-স্টেমকে ঢেকে রাখে। এ অংশটিকে বলে আর-কমপ্লেক্স বা সরীসৃপজাতীয় মস্তিষ্ক। আক্রমণাত্মক আচরণ, সর্বক্ষেত্রেই অন্ধ ধর্মীয় আচার-আচরণের প্রবণতাকে প্রয়োগ করা, ক্ষমতার লোভ, আমি বা আমারটাই শ্রেষ্ঠ, অর্থাৎ সমকালীনতাকে বুঝতে না চেয়ে পুরোনো ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে ধরে নতুন প্রজন্মকে অবহেলা করা ইত্যাদির জন্য এই অংশ দায়ী। এটার উদ্ভব ঘটেছিল ২৫ কোটি কোটি বছর আগে আমাদের সরীসৃপ-জাতীয় পূর্বপুরুষদের মাঝে। আমাদের প্রত্যেকের স্কালের একেবারে ভেতরের দিক হলো কুমিরের মস্তিষ্কের মতো অনেকটা। এই অংশের কারণেই আমরা নেতা নামের ব্যক্তিটির পেছনে যুক্তিহীনভাবে অন্ধের মতো দৌড়াই। তাদের দানবসুলভ বক্তৃতায় আমরা উল্লাসবোধ করি, খণ্ডিত বক্তব্যে অন্ধের মতো মাথা নাড়িয়ে একমত পোষণ করি, আরেক দলের বা মতামতের লোকদের পিটিয়ে মেরে ফেলি। ইতিহাসে অনবরত তা ঘটে চলেছে।
আর-কমপ্লেক্স-কে ঘিরে আছে লিম্বিক সিস্টেম অথবা স্তন্যপায়ীদের মস্তিষ্ক নামের অংশটি, যার উদ্ভব ঘটেছিল ২১ কোটি বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে, যারা স্তন্যপায়ী ছিল কিন্তু প্রাইমেট ছিল না ‘লিম্বিক সিস্টেম’ হলো আমাদের মেজাজ-মর্জি, আবেগ ও উদ্বেগের এবং সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা, নবীনদের প্রতি স্নেহ-বাৎসল্যের একটা বড় উৎস। মস্তিষ্কের আগের আদিম অংশগুলোকে নিচে রেখে এবং তাদের সঙ্গে বৈরিতামূলক সহাবস্থান বজায় রেখে প্রায় ৬ কোটি বছর আগে আমাদের প্রাইমেট পূর্বপুরুষদের (লেমুর, বানর, নরবানর, মানুষেরা যখন একই পূর্বপুরুষে নিহিত ছিল) মধ্যে অবশেষে বিকশিত হয়ে উঠেছিল সেরেব্রাল করটেক্স। সেরেব্রাল করটেক্স—যেখানে পদার্থ রূপ নেয় চেতনায়, এটা হলো আমাদের সব মহাজাগতিক কর্মকাণ্ডের, জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার মূল উৎস। মস্তিষ্কের দুই-তৃতীয়াংশের অধিক হলো সজ্ঞা ও জটিল বিশ্লেষণের জগৎ। সেরেব্রাল করটেক্স এখানে আছে বলেই গণিতশাস্ত্র নিয়ে মাথা ঘামাই, সংগীত রচনা করি, কবিতা লিখি। করটেক্স আমাদের সচেতন জীবনযাপনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা হলো আমাদের প্রজাতির স্বাতন্ত্র্য, মানবিকতার আবাসস্থল। আমাদের সভ্যতাটিই হলো এই ‘সেরেব্রাল করটেক্সের’ একটি ফলাফল।
এই সভ্যতা এত দীর্ঘ সময় পার করে এসে বিশ্বে তার অনড়তা ও অনমনীয়তা দেখলে মনে হয়, সেরেব্রাল করটেক্সের সৃজনশীল ও মহাজাগতিক অভিব্যক্তি যেন অন্ধবিশ্বাসের কাছে ফিরে যাচ্ছে। সমাজের মানুষগুলোর পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থ হওয়াটা আমাদের বলছে: সেরেব্রাল নয়, আর-কমপ্লেক্সই যেন সেরেব্রাল কর্টেক্সকে ঘিরে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবে এই অন্ধত্ব আর অযৌক্তিক সমর্পণ বিশ্বের অন্যান্য জায়গার মতো আমাদের দেশেও এক অন্ধকার যুগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক অর্জন ও ইতিহাসের শিক্ষা নমনীয়তা, সহনশীলতা ও মানবিকতা কি কোনো কাজে আসবে না। আমরা কি আর কমপ্লেক্সের দাস হয়ে বিচরণ করব, অন্ধত্ব থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারব না!
আসিফ, বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের এ দেশটির জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন কৃষক, মাঝি, শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, জেলে-তাঁতিসহ নানা পেশার মানুষ। তাঁরা সমাজের সাধারণ মানুষ ছিলেন। শত দুঃখ-কষ্টে থাকলেও সমাজের পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারেননি। সৃজনশীল কোনো জাতি তা মেনে নিতে পারে না। এ ছাড়া প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি না থেকেও নানাভাবে এই যুদ্ধকে সহযোগিতা করেছেন।
নানা লেখা, গবেষণা ও বক্তব্য থেকে আমরা বুঝতে পারি, সর্বোচ্চ সহনশীলতা, নমনীয়তার পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁরা। পাকিস্তানিদের অযৌক্তিক আচরণ, অত্যাচারী মনোভাব, নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাধ্য হন। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে দেশটির জন্ম হবে, সেখানে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম এক অনাবিল সময়ের মধ্য দিয়ে পথ চলবে। যেখানে রাগ-অভিমান থাকবে, বাদানুবাদ থাকবে, কিন্তু আলোচনার টেবিলে বসে তারা সমাধানে যাবে এবং সামনের দিকে এগোবে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে, শুধু পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারার অক্ষমতা ও খণ্ডিত বাক্যাংশ ব্যবহার করে যে জটিলতা, যে সংঘর্ষ আমরা সৃষ্টি করেছি, তা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নকেই অপমান করেছি, যাঁরা দেশটার আপামর মানুষের সুন্দর জীবনের কথা ভেবেছিলেন, নব প্রজন্মের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনেও তো সমাধান আলোচনায় হতে পারত। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের অদ্ভুত নীরবতা, ফরমায়েশি বক্তব্য দেওয়ার মানসিকতা, এই বড় হয়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সহনশীলতা ও মানবিকতাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। যার পরিণতিতে শত শত শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও পুলিশকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আসলেই আমরা অস্থির, অসহনশীল আর আক্রমণাত্মক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
মানুষ কেন এমন অনড়তা তৈরি করছে? কেন কেউ কারও কথা শুনতে চাচ্ছি না, বুঝতে চাচ্ছি না? সবাই তর্কে জিততে চাচ্ছি। আর মহা চোরেরা ক্রমেই চুরির পরিমাণ বাড়িয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে; এর কোনো সহজ উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে মস্তিষ্কের বিকাশ নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে, যা আমাদের জানায় এই রিজিডিটি, অসহযোগিতামূলক ও অনৈতিক আচরণের পেছনে কারণগুলো কী?
পৃথিবীর প্রাণের জন্ম অ্যামাইনো-অ্যাসিডের জটিল এক প্রকার অণু থেকে। এ অণুগুলো প্রথমে সরলপ্রাণ হয়ে এলোমেলোভাবে সংযোগে লিপ্ত হয়। শত শত কোটি বছর ধরে এই প্রাথমিক সরলপ্রাণ ক্রমেই উন্নত হতে থাকে। জটিল, বহুকোষী, মস্তিষ্কওলা প্রাণী হিসেবে রূপ নেওয়া পর্যন্ত এটা নিরন্তরভাবে চলতে থাকে। কেননা চারদিকের পরিবেশ-প্রকৃতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হলে টিকে থাকার জন্য পূর্বনির্ধারিত জেনেটিক কোডও সামগ্রিকভাবে পর্যাপ্ত হয় না। এমনকি ৫০০ পৃষ্ঠার ১ হাজার খণ্ডের বইয়ের তথ্যসমৃদ্ধ জিন লাইব্রেরি, যা আগে টিকে থাকার জন্য সঠিকভাবে কার্যসম্পাদন করেছে, তা-ও ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তন কোনো প্রাণীকে দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না। এই অসুবিধাগুলোর কারণেই আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে। মাথায় রাখতে হবে সাংস্কৃতিকভাবে পরিবেশ পরিস্থিতি এর চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত পরিবর্তিত হয়।
মস্তিষ্কের বিকাশের কারণেই আমরা বলতে পারি যে বুদ্ধিমত্তা মানে চারপাশের জগৎ থেকে সরাসরি শুধু তথ্য ধারণ করা নয়, সেই সঙ্গে জাজমেন্ট বা বিচারবুদ্ধিরও ব্যাপার বটে। যার মাধ্যমে তথ্যগুলো সমন্বয় সাধন ও ব্যবহার করা যায়, ভবিষ্যতের কোনো বিপদ সম্পর্কেই আগেই আভাস পাওয়া সম্ভব হয়, যা শুধু জিনের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ্যের মতো প্রয়োজনের তাগিদে মস্তিষ্কেরও উদ্ভব ঘটেছে এবং লাখ লাখ বছর ধরে তথ্য ধারণের মধ্য দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মস্তিষ্কের বিকাশ শুরু হয় মানুষের শরীরের স্পাইনাল কর্ডের স্ফীত ঊর্ধ্বাংশের মধ্য দিয়ে। স্পাইনাল কর্ডের এই স্ফীত ঊর্ধ্বস্থানে অবস্থান করছে সবচেয়ে পুরোনো অংশ ‘ব্রেইন-স্টেম’, অর্থাৎ স্নায়ু ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয় মস্তিষ্ক। এই ব্রেইন-স্টেম পরিচালনা করে মূল জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে প্রাণের ছন্দ, যেমন হার্টবিট, রক্ত সংবহন ও নিশ্বাস-প্রশ্বাস-প্রক্রিয়া। পল ম্যাকলিনের প্রভোকেটিভ ইনসাইট মতানুসারে, পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কের উচ্চ ক্রিয়াকলাপের অংশগুলোর উদ্ভব ঘটেছে তিনটি ধারাবাহিক পর্যায়ে।
প্রথম অংশটি হলো ব্রেইন-স্টেমকে ঢেকে রাখে। এ অংশটিকে বলে আর-কমপ্লেক্স বা সরীসৃপজাতীয় মস্তিষ্ক। আক্রমণাত্মক আচরণ, সর্বক্ষেত্রেই অন্ধ ধর্মীয় আচার-আচরণের প্রবণতাকে প্রয়োগ করা, ক্ষমতার লোভ, আমি বা আমারটাই শ্রেষ্ঠ, অর্থাৎ সমকালীনতাকে বুঝতে না চেয়ে পুরোনো ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে ধরে নতুন প্রজন্মকে অবহেলা করা ইত্যাদির জন্য এই অংশ দায়ী। এটার উদ্ভব ঘটেছিল ২৫ কোটি কোটি বছর আগে আমাদের সরীসৃপ-জাতীয় পূর্বপুরুষদের মাঝে। আমাদের প্রত্যেকের স্কালের একেবারে ভেতরের দিক হলো কুমিরের মস্তিষ্কের মতো অনেকটা। এই অংশের কারণেই আমরা নেতা নামের ব্যক্তিটির পেছনে যুক্তিহীনভাবে অন্ধের মতো দৌড়াই। তাদের দানবসুলভ বক্তৃতায় আমরা উল্লাসবোধ করি, খণ্ডিত বক্তব্যে অন্ধের মতো মাথা নাড়িয়ে একমত পোষণ করি, আরেক দলের বা মতামতের লোকদের পিটিয়ে মেরে ফেলি। ইতিহাসে অনবরত তা ঘটে চলেছে।
আর-কমপ্লেক্স-কে ঘিরে আছে লিম্বিক সিস্টেম অথবা স্তন্যপায়ীদের মস্তিষ্ক নামের অংশটি, যার উদ্ভব ঘটেছিল ২১ কোটি বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে, যারা স্তন্যপায়ী ছিল কিন্তু প্রাইমেট ছিল না ‘লিম্বিক সিস্টেম’ হলো আমাদের মেজাজ-মর্জি, আবেগ ও উদ্বেগের এবং সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা, নবীনদের প্রতি স্নেহ-বাৎসল্যের একটা বড় উৎস। মস্তিষ্কের আগের আদিম অংশগুলোকে নিচে রেখে এবং তাদের সঙ্গে বৈরিতামূলক সহাবস্থান বজায় রেখে প্রায় ৬ কোটি বছর আগে আমাদের প্রাইমেট পূর্বপুরুষদের (লেমুর, বানর, নরবানর, মানুষেরা যখন একই পূর্বপুরুষে নিহিত ছিল) মধ্যে অবশেষে বিকশিত হয়ে উঠেছিল সেরেব্রাল করটেক্স। সেরেব্রাল করটেক্স—যেখানে পদার্থ রূপ নেয় চেতনায়, এটা হলো আমাদের সব মহাজাগতিক কর্মকাণ্ডের, জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার মূল উৎস। মস্তিষ্কের দুই-তৃতীয়াংশের অধিক হলো সজ্ঞা ও জটিল বিশ্লেষণের জগৎ। সেরেব্রাল করটেক্স এখানে আছে বলেই গণিতশাস্ত্র নিয়ে মাথা ঘামাই, সংগীত রচনা করি, কবিতা লিখি। করটেক্স আমাদের সচেতন জীবনযাপনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা হলো আমাদের প্রজাতির স্বাতন্ত্র্য, মানবিকতার আবাসস্থল। আমাদের সভ্যতাটিই হলো এই ‘সেরেব্রাল করটেক্সের’ একটি ফলাফল।
এই সভ্যতা এত দীর্ঘ সময় পার করে এসে বিশ্বে তার অনড়তা ও অনমনীয়তা দেখলে মনে হয়, সেরেব্রাল করটেক্সের সৃজনশীল ও মহাজাগতিক অভিব্যক্তি যেন অন্ধবিশ্বাসের কাছে ফিরে যাচ্ছে। সমাজের মানুষগুলোর পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থ হওয়াটা আমাদের বলছে: সেরেব্রাল নয়, আর-কমপ্লেক্সই যেন সেরেব্রাল কর্টেক্সকে ঘিরে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবে এই অন্ধত্ব আর অযৌক্তিক সমর্পণ বিশ্বের অন্যান্য জায়গার মতো আমাদের দেশেও এক অন্ধকার যুগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক অর্জন ও ইতিহাসের শিক্ষা নমনীয়তা, সহনশীলতা ও মানবিকতা কি কোনো কাজে আসবে না। আমরা কি আর কমপ্লেক্সের দাস হয়ে বিচরণ করব, অন্ধত্ব থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারব না!
আসিফ, বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে