সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রলোভন ও ভীতির সাহায্যে বুদ্ধিজীবীদের বিচ্ছিন্ন করার কাজ পাকিস্তান আমলে অবিরাম চলেছে এবং সফলতাও এসেছে এই দরিদ্র দেশে, ভয়ের দেশে। তবে প্রলোভন ও ভীতির বাইরেও পাকিস্তান যে একটা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র, এ রকম কথা কেউ কেউ বলেছেন নিজেদের বিশ্বাস থেকে।
আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয়, সবাই না হলেও অনেক বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি প্রলোভনে পড়ে পাকিস্তানবাদীতে পরিণত হয়েছিলেন। তবে স্বীকার করতে হবে দেশের বুদ্ধিজীবীরা যে পরিমাণে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থকে যুক্ত করতে পেরেছেন, সেই পরিমাণেই তাঁরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তুলতে। কিন্তু বলাই বাহুল্য, বুদ্ধিজীবী সমাজের সব মানুষ সব সময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকেননি। তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন নিজেদের স্বার্থকে জনসাধারণের স্বার্থ থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে দেখে।
এটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে। বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন এ দেশের উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি চিরদিনই আত্মস্বার্থ সচেতন। তরুণ বয়সে আত্মত্যাগের সাহস থাকে, পরিণত বয়সে আসে বিষয়বুদ্ধি। তাই পরিণত বয়সের বুদ্ধিজীবীরা স্বভাবতই সজাগ ছিলেন, ছিলেন আত্মসচেতন। এর আরও একটা কারণ ছিল। উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভিত্তি ছিল অর্বাচীন ও দুর্বল। তাই এই শ্রেণির লোকদের পক্ষে কোনো ঝুঁকি নেওয়া কঠিন ছিল। দেশভাগের আগে মুসলমান মধ্যবিত্তরা দেখেছিল অবিভক্ত বাংলার তুলনায় অধিকতর পুরোনো ও প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে তাদের নিজস্ব শ্রেণিগত বিকাশের সুযোগ খুব সংকীর্ণ। আশা ছিল পাকিস্তানে সেই বিকাশ অনেক সহজ ও দ্রুত হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মধ্যবিত্তদের মধ্যে তাই একটা ব্যস্ততা দেখা গিয়েছিল নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার। বুদ্ধিজীবীরাও ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সুবিধা যতটা আশা করা গিয়েছিল, ততটা পাওয়া যায়নি। সুযোগ অবাধ হয়নি, কিছুটা দ্রুত হয়েছিল যদিও। হিন্দুরা চলে যাওয়ায় চাকরি খালি হয়েছিল, সেগুলো পাওয়া গেল। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
হিন্দু মধ্যবিত্তের জায়গায় নতুন প্রতিযোগী এসে জুটেছে, পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত, যারা আগে থেকেই অনেকটা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য তো বটেই, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের প্রধান যে অবলম্বন চাকরি, সেই চাকরির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে শক্তিশালী প্রতিযোগী হয়ে দেখা দিল তা-ই নয়, চাকরির তারা মালিকও হয়ে রইল। ছোট-বড় সব রকমের চাকরির। স্পষ্ট সত্য হয়ে দাঁড়াল এই, পশ্চিম পাকিস্তানিদের অসন্তুষ্ট করলে জীবিকার্জনের পথ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে, তুষ্ট করলে উন্নতি কিছু ঘটতে পারে। প্রধানত এই অর্থনৈতিক কারণেই বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, সরে গিয়ে পাকিস্তানের গুণগানে ব্রতী হয়েছিল। এ কাজ করে তাদের লাভ হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে। তা ছাড়া সামনে প্রত্যাশার একটা দিগন্তও দেখা যাচ্ছিল।
বুদ্ধিজীবীদের প্রলোভন দেখানোর কাজ পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই করেছে। উদ্দেশ্যটা সহজ। সরকার চেয়েছে জনসাধারণকে শোষণ করতে। বুদ্ধিজীবীরা যদি জনসাধারণের অংশ হয়ে যান, জনসাধারণের সঙ্গে থাকেন, তবে তাঁরা মানুষের চোখ খুলে দিতে পারেন, চোখ খুলে দিলে শোষণ করতে অসুবিধা। আর যদি বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে পাকিস্তানের মহিমা প্রচার করানো যায় তাহলে শোষণকাজটা আরও নির্বিঘ্নে হতে পারে। বুদ্ধিজীবীদের জীবনে যেহেতু অভাব ছিল সচ্ছলতার এবং লোভ ছিল স্বাচ্ছন্দ্যের, তাই অল্পতেই তাঁরা আকৃষ্ট হতেন। চাকরিতে উন্নতি, পুস্তকের জন্য পারিশ্রমিক পরবর্তীকালে তঘমা ও পুরস্কার, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ—এসবের সাহায্যে জনসাধারণ থেকে বুদ্ধিজীবীদের বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস সরকার করেছে, সফলও হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। বুদ্ধিজীবী সমাজের, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবহারজীবী—তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট যাঁরা, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁদের প্রায় সবার জীবনেই সমৃদ্ধি এসেছে। তাই পাকিস্তানের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতাবোধ না থেকে পারেনি, তাঁদের জীবন ও সাধারণ মানুষের জীবন বিপরীত দিকে চলেছে অনিবার্যভাবেই।
তুলনায় যাঁরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন কম, তাঁদের পক্ষেও সরকারি বক্তব্য সমর্থন না করে উপায় থাকেনি। এর কারণ তাঁদের জীবনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবোধের অভাবটা ছিল আরও বেশি, তাঁরা ভয় পেয়েছেন যে সামান্য ধাক্কাতেই তাঁরা গড়িয়ে পড়বেন নিচের খাদে এবং ধাক্কার আশঙ্কা সব সময়ই ছিল। সরকার শুধু প্রলোভনই দেখায়নি, ভয়ও দেখিয়েছে এবং প্রলোভনের তুলনায় ভয় কিছু কম শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেনি। ভয়ের জন্য ভুলকে ভুল, অন্যায়কে অন্যায় বলে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। মধ্যবিত্তের মনেও অর্থনৈতিক অসন্তোষ ছিল, কিন্তু সেই অসন্তোষ কিংবা তার চেয়েও বড় অসন্তোষ সাধারণ মানুষের অসন্তোষকে উন্মোচিত করার মতো পর্যাপ্ত সাহস বুদ্ধিজীবীদের অনেকের মধ্যেই দেখা যায়নি। ভয়টা কল্পিত ভয় ছিল না।
বামপন্থী বলে পরিচিত যাঁরা, প্রয়োজনবোধে তাঁদের কারাগারে নিক্ষেপ করার ব্যাপারে সরকার দ্বিধা করেনি। অন্যদিকে অবাধে চিন্তা ও মতামত প্রকাশ করার সুযোগ বা স্বাধীনতা কোনো দিনই ছিল না বাংলাদেশে। যেমন পত্র-পত্রিকা প্রকাশের কথা উল্লেখ করা যায়। এমনিতে এ কাজটা দুরূহ ছিল অর্থনৈতিক কারণে। তদুপরি পত্রিকা প্রকাশ করতে হলে আগে অনুমতি নিতে হতো সরকারের। সরকারের অপছন্দ হলে চালু পত্রিকা যেকোনো সময় বন্ধ করা হতো। সম্পাদককে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়ার উদাহরণও অজানা নয়।
প্রলোভন ও ভীতির সাহায্যে বুদ্ধিজীবীদের বিচ্ছিন্ন করার কাজ পাকিস্তান আমলে অবিরাম চলেছে এবং সফলতাও এসেছে এই দরিদ্র দেশে, ভয়ের দেশে। তবে প্রলোভন ও ভীতির বাইরেও পাকিস্তান যে একটা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র, এ রকম কথা কেউ কেউ বলেছেন নিজেদের বিশ্বাস থেকে। তাঁরা হচ্ছেন আল-বদর বাহিনীর শিক্ষাগুরু। ভুল শিক্ষার কারণে, সংস্কারের বশে, প্রচলিত ধারণার প্রভাবে তাঁরা ইসলামি সমাজব্যবস্থা নামে একটি বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক বিরহিত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরীক্ষাস্থল হিসেবে পাকিস্তানকে কল্পনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে এমনকি সাধারণ মানুষের দুঃখে দুঃখিত মানুষও ছিলেন, তাঁরা সমাজতন্ত্র চাইতেন, কিন্তু বলতেন এ হবে ইসলামি সমাজতন্ত্র, অর্থাৎ ভয় যে একেবারে ছিল না তা নয়, ছিল অন্য এক ভয়, ঈশ্বরহীনতার ভয়। এই বিশ্বাস গোঁড়ামিতে পরিণত হয়েছে। গোঁড়ামি থেকে জন্ম হয়েছে আল-বদরের। সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য, কিন্তু ইসলামের মায়া এসে তাঁদের চিন্তাকে দূর আরবের এমন একটা মনগড়া রাজ্যে নিয়ে গিয়েছে, যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। তাঁদের বুদ্ধিজীবী কর্মগুলো গণবিরোধী, অর্থাৎ বাংলাদেশবিরোধী শক্তিকেই পুষ্ট করেছে।
কিন্তু বিভ্রান্তি আরও ছিল। বিভ্রান্তি ছিল উদ্দেশ্যহীনতা, ছিল তথাকথিত আধুনিকতার। ইসলামি আদর্শের অনুসারীরা ছিলেন অপেক্ষাকৃত প্রবীণ, তুলনায় তরুণ যাঁরা, তাঁদের একাংশ এই দ্বিতীয় বিভ্রান্তির করতলগত হয়েছেন আর উভয় বিভ্রান্তির পেছনে হাত ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের। পাকিস্তানবাদীরা ভীষণ জোরে বলেছেন যে পাকিস্তানের পুণ্য মাটিতে বিদেশি সংস্কৃতি ও আদর্শের কোনো স্থান নেই। বলা বাহুল্য, বিদেশি সংস্কৃতি বলতে বোঝানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিদেশি আদর্শ বলতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ। বিদেশি সংস্কৃতি বলতে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতিকে, বিদেশি বলতে ধনতন্ত্রের আদর্শকে তাঁরা প্রায় কখনো বোঝাননি; বরং সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের প্রভাবকে বিশেষ আদরের সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়েছে। পত্র-পত্রিকায়, চলচ্চিত্র, বেতারে, টেলিভিশনে, সভা-সমিতিতে ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার মাহাত্ম্য প্রচারের সুযোগ ও সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে অবাধে। ফলে এই অতিদরিদ্র ও ভয়ংকর অনগ্রসর দেশে বিলাসের অত্যাধুনিক সাজসরঞ্জাম যেমন এসেছে, তেমনি সঙ্গে এসেছে এমন একটা জীবনদৃষ্টি, যার পরিচয়চিহ্ন হচ্ছে উদ্দেশ্যহীনতা, জীবনবিচ্ছিন্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও নগ্নতা।
বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বিলাসের উপকরণগুলো কিছু কিছু পেয়েছেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি পেয়েছেন ওই জীবনদৃষ্টি, বলা যায় ওর জালে তাঁরা আটকা পড়েছেন। সংস্কারাচ্ছন্ন আলবদর ও সংস্কারহীন অত্যাধুনিকতার মধ্যে খুব বড় একটা মিল আছে—উভয়েই সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনে প্রতিপালিত, উভয়েই দেশের সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন শুধু নয়, সাধারণ মানুষের প্রতি বিশিষ্টও বটে।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রলোভন ও ভীতির সাহায্যে বুদ্ধিজীবীদের বিচ্ছিন্ন করার কাজ পাকিস্তান আমলে অবিরাম চলেছে এবং সফলতাও এসেছে এই দরিদ্র দেশে, ভয়ের দেশে। তবে প্রলোভন ও ভীতির বাইরেও পাকিস্তান যে একটা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র, এ রকম কথা কেউ কেউ বলেছেন নিজেদের বিশ্বাস থেকে।
আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয়, সবাই না হলেও অনেক বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি প্রলোভনে পড়ে পাকিস্তানবাদীতে পরিণত হয়েছিলেন। তবে স্বীকার করতে হবে দেশের বুদ্ধিজীবীরা যে পরিমাণে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থকে যুক্ত করতে পেরেছেন, সেই পরিমাণেই তাঁরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তুলতে। কিন্তু বলাই বাহুল্য, বুদ্ধিজীবী সমাজের সব মানুষ সব সময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকেননি। তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন নিজেদের স্বার্থকে জনসাধারণের স্বার্থ থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে দেখে।
এটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে। বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন এ দেশের উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি চিরদিনই আত্মস্বার্থ সচেতন। তরুণ বয়সে আত্মত্যাগের সাহস থাকে, পরিণত বয়সে আসে বিষয়বুদ্ধি। তাই পরিণত বয়সের বুদ্ধিজীবীরা স্বভাবতই সজাগ ছিলেন, ছিলেন আত্মসচেতন। এর আরও একটা কারণ ছিল। উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভিত্তি ছিল অর্বাচীন ও দুর্বল। তাই এই শ্রেণির লোকদের পক্ষে কোনো ঝুঁকি নেওয়া কঠিন ছিল। দেশভাগের আগে মুসলমান মধ্যবিত্তরা দেখেছিল অবিভক্ত বাংলার তুলনায় অধিকতর পুরোনো ও প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে তাদের নিজস্ব শ্রেণিগত বিকাশের সুযোগ খুব সংকীর্ণ। আশা ছিল পাকিস্তানে সেই বিকাশ অনেক সহজ ও দ্রুত হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মধ্যবিত্তদের মধ্যে তাই একটা ব্যস্ততা দেখা গিয়েছিল নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার। বুদ্ধিজীবীরাও ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সুবিধা যতটা আশা করা গিয়েছিল, ততটা পাওয়া যায়নি। সুযোগ অবাধ হয়নি, কিছুটা দ্রুত হয়েছিল যদিও। হিন্দুরা চলে যাওয়ায় চাকরি খালি হয়েছিল, সেগুলো পাওয়া গেল। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
হিন্দু মধ্যবিত্তের জায়গায় নতুন প্রতিযোগী এসে জুটেছে, পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত, যারা আগে থেকেই অনেকটা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য তো বটেই, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের প্রধান যে অবলম্বন চাকরি, সেই চাকরির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে শক্তিশালী প্রতিযোগী হয়ে দেখা দিল তা-ই নয়, চাকরির তারা মালিকও হয়ে রইল। ছোট-বড় সব রকমের চাকরির। স্পষ্ট সত্য হয়ে দাঁড়াল এই, পশ্চিম পাকিস্তানিদের অসন্তুষ্ট করলে জীবিকার্জনের পথ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে, তুষ্ট করলে উন্নতি কিছু ঘটতে পারে। প্রধানত এই অর্থনৈতিক কারণেই বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, সরে গিয়ে পাকিস্তানের গুণগানে ব্রতী হয়েছিল। এ কাজ করে তাদের লাভ হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে। তা ছাড়া সামনে প্রত্যাশার একটা দিগন্তও দেখা যাচ্ছিল।
বুদ্ধিজীবীদের প্রলোভন দেখানোর কাজ পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই করেছে। উদ্দেশ্যটা সহজ। সরকার চেয়েছে জনসাধারণকে শোষণ করতে। বুদ্ধিজীবীরা যদি জনসাধারণের অংশ হয়ে যান, জনসাধারণের সঙ্গে থাকেন, তবে তাঁরা মানুষের চোখ খুলে দিতে পারেন, চোখ খুলে দিলে শোষণ করতে অসুবিধা। আর যদি বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে পাকিস্তানের মহিমা প্রচার করানো যায় তাহলে শোষণকাজটা আরও নির্বিঘ্নে হতে পারে। বুদ্ধিজীবীদের জীবনে যেহেতু অভাব ছিল সচ্ছলতার এবং লোভ ছিল স্বাচ্ছন্দ্যের, তাই অল্পতেই তাঁরা আকৃষ্ট হতেন। চাকরিতে উন্নতি, পুস্তকের জন্য পারিশ্রমিক পরবর্তীকালে তঘমা ও পুরস্কার, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ—এসবের সাহায্যে জনসাধারণ থেকে বুদ্ধিজীবীদের বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস সরকার করেছে, সফলও হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। বুদ্ধিজীবী সমাজের, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবহারজীবী—তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট যাঁরা, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁদের প্রায় সবার জীবনেই সমৃদ্ধি এসেছে। তাই পাকিস্তানের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতাবোধ না থেকে পারেনি, তাঁদের জীবন ও সাধারণ মানুষের জীবন বিপরীত দিকে চলেছে অনিবার্যভাবেই।
তুলনায় যাঁরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন কম, তাঁদের পক্ষেও সরকারি বক্তব্য সমর্থন না করে উপায় থাকেনি। এর কারণ তাঁদের জীবনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবোধের অভাবটা ছিল আরও বেশি, তাঁরা ভয় পেয়েছেন যে সামান্য ধাক্কাতেই তাঁরা গড়িয়ে পড়বেন নিচের খাদে এবং ধাক্কার আশঙ্কা সব সময়ই ছিল। সরকার শুধু প্রলোভনই দেখায়নি, ভয়ও দেখিয়েছে এবং প্রলোভনের তুলনায় ভয় কিছু কম শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেনি। ভয়ের জন্য ভুলকে ভুল, অন্যায়কে অন্যায় বলে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। মধ্যবিত্তের মনেও অর্থনৈতিক অসন্তোষ ছিল, কিন্তু সেই অসন্তোষ কিংবা তার চেয়েও বড় অসন্তোষ সাধারণ মানুষের অসন্তোষকে উন্মোচিত করার মতো পর্যাপ্ত সাহস বুদ্ধিজীবীদের অনেকের মধ্যেই দেখা যায়নি। ভয়টা কল্পিত ভয় ছিল না।
বামপন্থী বলে পরিচিত যাঁরা, প্রয়োজনবোধে তাঁদের কারাগারে নিক্ষেপ করার ব্যাপারে সরকার দ্বিধা করেনি। অন্যদিকে অবাধে চিন্তা ও মতামত প্রকাশ করার সুযোগ বা স্বাধীনতা কোনো দিনই ছিল না বাংলাদেশে। যেমন পত্র-পত্রিকা প্রকাশের কথা উল্লেখ করা যায়। এমনিতে এ কাজটা দুরূহ ছিল অর্থনৈতিক কারণে। তদুপরি পত্রিকা প্রকাশ করতে হলে আগে অনুমতি নিতে হতো সরকারের। সরকারের অপছন্দ হলে চালু পত্রিকা যেকোনো সময় বন্ধ করা হতো। সম্পাদককে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়ার উদাহরণও অজানা নয়।
প্রলোভন ও ভীতির সাহায্যে বুদ্ধিজীবীদের বিচ্ছিন্ন করার কাজ পাকিস্তান আমলে অবিরাম চলেছে এবং সফলতাও এসেছে এই দরিদ্র দেশে, ভয়ের দেশে। তবে প্রলোভন ও ভীতির বাইরেও পাকিস্তান যে একটা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র, এ রকম কথা কেউ কেউ বলেছেন নিজেদের বিশ্বাস থেকে। তাঁরা হচ্ছেন আল-বদর বাহিনীর শিক্ষাগুরু। ভুল শিক্ষার কারণে, সংস্কারের বশে, প্রচলিত ধারণার প্রভাবে তাঁরা ইসলামি সমাজব্যবস্থা নামে একটি বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক বিরহিত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরীক্ষাস্থল হিসেবে পাকিস্তানকে কল্পনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে এমনকি সাধারণ মানুষের দুঃখে দুঃখিত মানুষও ছিলেন, তাঁরা সমাজতন্ত্র চাইতেন, কিন্তু বলতেন এ হবে ইসলামি সমাজতন্ত্র, অর্থাৎ ভয় যে একেবারে ছিল না তা নয়, ছিল অন্য এক ভয়, ঈশ্বরহীনতার ভয়। এই বিশ্বাস গোঁড়ামিতে পরিণত হয়েছে। গোঁড়ামি থেকে জন্ম হয়েছে আল-বদরের। সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য, কিন্তু ইসলামের মায়া এসে তাঁদের চিন্তাকে দূর আরবের এমন একটা মনগড়া রাজ্যে নিয়ে গিয়েছে, যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। তাঁদের বুদ্ধিজীবী কর্মগুলো গণবিরোধী, অর্থাৎ বাংলাদেশবিরোধী শক্তিকেই পুষ্ট করেছে।
কিন্তু বিভ্রান্তি আরও ছিল। বিভ্রান্তি ছিল উদ্দেশ্যহীনতা, ছিল তথাকথিত আধুনিকতার। ইসলামি আদর্শের অনুসারীরা ছিলেন অপেক্ষাকৃত প্রবীণ, তুলনায় তরুণ যাঁরা, তাঁদের একাংশ এই দ্বিতীয় বিভ্রান্তির করতলগত হয়েছেন আর উভয় বিভ্রান্তির পেছনে হাত ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের। পাকিস্তানবাদীরা ভীষণ জোরে বলেছেন যে পাকিস্তানের পুণ্য মাটিতে বিদেশি সংস্কৃতি ও আদর্শের কোনো স্থান নেই। বলা বাহুল্য, বিদেশি সংস্কৃতি বলতে বোঝানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিদেশি আদর্শ বলতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ। বিদেশি সংস্কৃতি বলতে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতিকে, বিদেশি বলতে ধনতন্ত্রের আদর্শকে তাঁরা প্রায় কখনো বোঝাননি; বরং সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের প্রভাবকে বিশেষ আদরের সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়েছে। পত্র-পত্রিকায়, চলচ্চিত্র, বেতারে, টেলিভিশনে, সভা-সমিতিতে ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার মাহাত্ম্য প্রচারের সুযোগ ও সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে অবাধে। ফলে এই অতিদরিদ্র ও ভয়ংকর অনগ্রসর দেশে বিলাসের অত্যাধুনিক সাজসরঞ্জাম যেমন এসেছে, তেমনি সঙ্গে এসেছে এমন একটা জীবনদৃষ্টি, যার পরিচয়চিহ্ন হচ্ছে উদ্দেশ্যহীনতা, জীবনবিচ্ছিন্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও নগ্নতা।
বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বিলাসের উপকরণগুলো কিছু কিছু পেয়েছেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি পেয়েছেন ওই জীবনদৃষ্টি, বলা যায় ওর জালে তাঁরা আটকা পড়েছেন। সংস্কারাচ্ছন্ন আলবদর ও সংস্কারহীন অত্যাধুনিকতার মধ্যে খুব বড় একটা মিল আছে—উভয়েই সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনে প্রতিপালিত, উভয়েই দেশের সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন শুধু নয়, সাধারণ মানুষের প্রতি বিশিষ্টও বটে।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে