স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায়

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৪, ০৮: ৩৯

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্ম নিয়েছিল এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে। অথচ দেশটাতে ছিল পাঁচটি প্রদেশ, যেগুলোর প্রয়োজন ছিল স্বায়ত্তশাসনের। একই সময়ে ভারতও স্বাধীন হলো ফেডারেল পদ্ধতির রাষ্ট্রব্যবস্থায়। ফলে তাদের প্রতিটি রাজ্যেরই স্বায়ত্তশাসন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর জন্য কাউকে কোনো আন্দোলন করতে হয়নি। কিন্তু আমাদের ‘স্বপ্নের পাকিস্তান’ শুরু থেকে খড়্গ হাতে বাংলাকে পাকিস্তান বানানোর সব অপচেষ্টাই শুরু করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ভাষা নিয়ে আমাদের সঙ্গে বৈরী আচরণ শুরু করে। সংবিধানও তারা দেবে কি দেবে না, তা নিয়ে কয়েক বছর কেটে গেল। আট বছর পর যে সংবিধান দেওয়া হলো, তাতে গণতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত ছিল। দেশটি হয়ে গেল ইসলামিক প্রজাতন্ত্র। কিন্তু সেই দেশও সংবিধান হজম করতে পারেনি। সামরিক শাসকেরা এসে সেই সংবিধানও ছুড়ে ফেলে দিল। আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের এক ভেলকিবাজি শুরু করলেন।

পাকিস্তান এমন একটি রাষ্ট্র হবে জেনেই ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করা হলো মূলত স্বায়ত্তশাসন ও ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করার জন্য। ভাষা নিয়ে পাকিস্তানিরা অনমনীয় থাকার চেষ্টা করল। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে ছাত্র ধর্মঘটে পুলিশ গুলি চালিয়ে ছাত্র হত্যা করল, ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করা হলো। সেই থেকে একমাত্র আওয়ামী লীগই স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এ জন্য নেতা-কর্মীদের জেল-জুলুম ও আত্মত্যাগ বরণ করে নিতে হলো। পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে এসে সামরিক শাসকেরা পাকিস্তানকে একটি অগণতান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে পাকাপোক্ত রূপ দিতে থাকে। তত দিনে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার বাঙালি বুঝতে পেরেছিল যে পাকিস্তান পূর্ব বাংলার জনগণের রাষ্ট্র কখনো হয়ে উঠবে না। কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক এই রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ছাড়া দ্বিতীয়টি দেখা যাচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিভাজন এবং প্রবীণদের অনেকেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস হারিয়ে ফেলেন।

সেই অবস্থায় শেখ মুজিবকেন্দ্রিক যেসব রাজনৈতিক উদীয়মান নেতা-কর্মী পঞ্চাশের দশকের অভিজ্ঞতায় দৃঢ়তা অর্জন করতে শিখলেন, তাঁরাই ষাটের দশকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুতি নিলেন। স্বায়ত্তশাসনের দাবি তখন তাদের কাছে অতীব গ্রহণযোগ্য বলে মনে হলো। ১৯৬৫-এর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে স্বায়ত্তশাসনের দাবির কোনো বিতর্ক রাজনীতিসচেতন মানুষ ভাবতে পারেননি। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৬ দফা উত্থাপন করল এবং দলীয় সম্মেলনে সেটিকে জাতীয় মেনিফেস্টোর মতো মর্যাদা দেওয়া হলো। সম্মেলনের পরেই জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ৬ দফা কী ও কেন—এই ব্যাখ্যা দিতে থাকেন। দ্রুত মানুষ শেখ মুজিবকে তাদের প্রাণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের নেতা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।

শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলন থেকে পাকিস্তান সৃষ্টি ও তার পরবর্তী সময় পর্যন্ত রাজনীতির ‘খনি শ্রমিকের’ মতো বেড়ে ওঠা নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। মানুষ এই নেতার কথাই তখন বিশ্বাস করতে থাকে। পাকিস্তানের রাজনীতির নিষিদ্ধ মাঠে গোপনে, প্রকাশ্যে অথবা হাত নেড়ে স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফাকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ সমর্থন জানাতে থাকেন। সেই পরিস্থিতিতে ১৯৬৬ সালের ৮ মে আইয়ুব সরকার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গণহারে বন্দী করতে থাকে। কার্যত যেন আওয়ামী লীগ একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। সেই বিবেচনা থেকে সরকারের তোষণকারী গোষ্ঠী ৬ দফার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে থাকে, ভারতের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করতে থাকে।

জেলখানায় বন্দী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এক চরম বৈরী পরিবেশে প্রত্যক্ষ করেন যে আওয়ামী লীগের পালিয়ে থাকা নেতৃবৃন্দ গোপনে ২০ মে তারিখে দলের সভা ডেকে পাকিস্তান সরকার ও তাদের দোসরদের নতুন চ্যালেঞ্জ জানালেন। সভায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ‘জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, জনাব শেখ মুজিবর রহমানসহ সকল রাজনৈতিক নেতা ও কর্ম্মীদের মুক্তি, সংবাদপত্রের উপর জারীকৃত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার, টেন্ডুপাতা অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার’ এবং অন্যান্য দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর চলতে থাকে হরতাল সফল করার জন্য প্রচারাভিযান। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই প্রথম রাষ্ট্রযন্ত্র ও আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করে।

আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা কারারুদ্ধ থাকা সত্ত্বেও গোপনে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠনগুলো হরতাল সফল করার জন্য রাত-দিন প্রচার অব্যাহত রাখে। বঙ্গবন্ধু ও নেতৃবৃন্দ জেলে বসে ভেতরের ও বাইরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি ৭ জুনের হরতালকে সমর্থন জানায়। ছাত্র ইউনিয়ন এই হরতাল সফল করার জন্য নিজেদের শক্তি নিয়ে গোপনে কাজ করতে থাকে। ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ কোথায় কার কার নেতৃত্বে কারা পিকেটিং করবে, সেই পরিকল্পনা মোতাবেক বিভক্ত হয়ে কাজ করতে থাকে। এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদসহ অনেক ছাত্রনেতা। শ্রমিক সংগঠনগুলোকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, পোস্তগোলা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ সর্বত্র কীভাবে হরতালে যুক্ত করা যায়, সেভাবে গোপনে প্রস্তুতি নেওয়া হয়।

৭ জুনের হরতালের বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কঠোর অবস্থানে ছিল। কিন্তু সরকারের এই মনোভাব জানা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক সংগঠন ছাড়াও প্রশাসনের অভ্যন্তরে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাবাপন্ন বাঙালি কর্মকর্তারাও গোপনে হরতালকে সমর্থন জানাতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু জেল থেকে আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দিয়ে রুহুল কুদ্দুসের কাছে খবর পাঠান, ‘যেভাবেই হোক, ৭ জুন সফল হরতাল দেখতে চাই।’ রুহুল কুদ্দুস এই হরতাল সফল করার জন্য ঢাকা নগরীর একটি ম্যাপ কিনে নিয়ে কোথায় কীভাবে ব্যারিকেড দিতে হবে, কোথায় ছেলেরা লুকিয়ে থাকবে—সবকিছু এঁকে তৈরি করে দেন।

অন্যদিকে তিনি ফোনে সারা পূর্ব বাংলায় অবস্থানরত বিশ্বস্ত বাঙালি সিএসপি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হরতাল সফল করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানান। মিজানুর রহমান চৌধুরী গোপনে রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে হরতাল সফল করতে তাঁর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য আনেন। এভাবেই ৭ জুনের হরতাল সফল করার জন্য গোপনে যে প্রস্তুতি চলছিল, তা পাকিস্তান সরকারের কোনো সংস্থাই আগে অনুমান করতে পারেনি। পাকিস্তানে দীর্ঘদিন কোনো হরতালের ডাক দেওয়ার সাহস অন্য কোনো রাজনৈতিক দল দেখানোর কথা কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু ৭ জুনের হরতালের প্রস্তুতি নীরবে কতটা জনসম্পৃক্ত হয়েছিল, তা বোঝা গেল সেদিন প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের দৃশ্য দেখে।

৭ জুন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আহূত হরতাল সংঘর্ষের রূপ ধারণ করে। এতে সর্বমোট ১১ জন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হন এবং অনেকেই আহত হন। সংঘর্ষ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। সেদিন ঢাকায় কয়েক শ সাধারণ ‘পাবলিক’ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জিল্লুর মোরশেদ মিটু, মোহাম্মদ সিরাজীসহ ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন কর্মীও গ্রেপ্তার হন। অন্যদিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ছাত্রলীগের খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে রেললাইন অবরোধকালে পুলিশ সেখানে আক্রমণ চালায়। তাতে পেপসি-কোলার গাড়িচালক মনু মিয়া তেজগাঁও রেললাইন অবরোধকালে রেলগাড়িতে থাকা পুলিশের ছোড়া গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা থেকে শ্রমিকদের ছোট-বড় দল হরতালে পিকেটিং ও মিছিলে অংশ নিয়েছিল। তেজগাঁওয়ে মুজিবুল্লাহ নামে আরেকজন শহীদ হন এবং সেদিন প্রায় ৮০০ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তেজগাঁওয়ের আজাদ এনামেল অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম কারখানার নোয়াখালীর শ্রমিক আবুল হোসেনকে ইপিআর বুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশের গুলিতে ছয়জন শ্রমিক নিহত হন। এ ছাড়া চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় অভূতপূর্ব হরতাল পালিত হয়।

৮ জুনের পত্রপত্রিকায় ৭ জুনের হরতালের সংবাদ প্রকাশে সরকারি বাধানিষেধ ছিল। তথ্য দপ্তর থেকে অত্যন্ত কৌশলে মাঝরাতে পত্রিকা অফিসে ১০ জনের হত্যার সরকারি খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেটিই পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে। তখনই জানাজানি হয়ে যায়, পাকিস্তান সৃষ্টির পর সবচেয়ে বড় রক্তাক্ত ঘটনা ৭ জুনের হরতালে সরকারের নির্দেশে পুলিশ ঘটিয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ৮ জুন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামধারী বেশ কিছু সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু পরদিন ৮ তারিখ জেলে বসে হরতাল পালনের খবর জানতে পেরে নিশ্চিত হন যে পূর্ব বাংলার জনগণ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং এই আন্দোলন যেকোনো মূল্যে তারা সফল করবে বলে তিনি ‘কারাগারের রোজনামচা’য় দৃঢ়ভাবে আশাবাদ প্রকাশ করেন।

লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত