Ajker Patrika

সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারত কি সত্যিই আন্তরিক?

এ কে এম শামসুদ্দিন
আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ১২: ১২
সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারত কি সত্যিই আন্তরিক?

বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে প্রায়ই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকে। এ নিয়ে সীমান্তের দুই পাড়ের মানুষের ভেতর তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাদ-প্রতিবাদ চললেও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গত মাসেও এরূপ দুটো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমটি গত  ২ নভেম্বর বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে বিএসএফের সদস্যরা বাংলাদেশি দুই নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনার ঠিক ৯ দিন পর ১১ নভেম্বর লালমনিরহাটে আরও দুই বাংলাদেশি বিএসএফের হত্যার শিকার হন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা গরু চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত; কথিত আছে লালমনিরহাটে হত্যার শিকার বাংলাদেশি নাগরিকেরা ভারতীয় গরু চোরাকারবারিদের সহযোগী হয়ে কাজ করছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও ভারতীয়দের জন্য তা লজ্জাকর।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের অতুলনীয় সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের এ সম্পর্ক ‘জাদুকরী’ সম্পর্ক! আমরা একই আকাশের নিচে বসবাস করি এবং নিশ্বাস নিই। তারপরও কিছু প্রটোকল রয়েছে, যা আমাদের মানতে হয়। লালমনিরহাট সীমান্তে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত। বিএসএফকে অবশ্যই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে।’ অপরদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেছেন, ‘ভারত কখনোই চায় না সীমান্তে কোনো প্রাণহানি ঘটুক।

বিএসএফ কখনো কোনো বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় না। কখনো কখনো নিজেদের আত্মরক্ষার্থে বিএসএফকে গুলি চালাতে বাধ্য হতে হয়।’ তিনি অবশ্য এ ঘটনাকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন।

ভারতীয় হাইকমিশনারের এ কথা বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বিশ্বাস করেছে কি না, জানি না; বিশেষ করে ‘বিএসএফ কখনো কোনো বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় না’ বলে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে কেউ একমত হবেন বলে মনে হয় না! কিসের ভিত্তিতে এ কথা বলেছেন, তা তিনি নিজেই জানেন। তাঁর কথা সত্য বলে যদি ধরেও নিই, তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড তাহলে করছে কারা? দোরাইস্বামীর এই বক্তব্যের মধ্যে নতুন কিছু নেই। তিনি তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই গতানুগতিক ধারা বজায় রেখে এ বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের এমন প্রতিশ্রুতির পর আদৌ কি সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়েছে? অতীতে এমনও হয়েছে যে সফররত ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা কিংবা মন্ত্রী ঢাকায় বসে যেদিন সীমান্তে আর কোনো হত্যাকাণ্ড হবে না বলে বক্তব্য দিচ্ছেন, ঠিক সেদিনই সীমান্তের কোনো না কোনো অঞ্চলে বিএসএফের জোয়ানরা গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা করেছে। এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলেই বাংলাদেশের নাগরিকেরা তাঁদের বক্তব্যের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছেন না।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এসব হত্যাকাণ্ডকে ‘আত্মরক্ষার কবজ’ বলে যতই বক্তব্য দিক না কেন; পরবর্তী সময়ে তদন্ত করে দেখা গেছে, হত্যার শিকার ব্যক্তিদের কাছে কোনো মারণাস্ত্র পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালে বিএসএফের হাতে ৪৮ বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার শিকার হয়েছেন; এর মধ্যে সরাসরি গুলিতে ৪২ জন মারা গেছেন। বিএসএফ জোয়ানদের নির্মম নির্যাতনে নিহত হয়েছেন আরও ছয়জন। সংবাদমাধ্যমে এসব নির্যাতনের যে খবর দেখি তা কেবল মধ্যযুগীয় নির্যাতনের সঙ্গেই তুলনা চলে। সাঁড়াশি দিয়ে হাত ও পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, পা বেঁধে ধৃত ব্যক্তিকে ওপরে পা এবং নিচে মাথা ঝুলিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হিংস্র পশুদের মতো শক্ত বাঁশ দিয়ে সজোরে আঘাত করতে করতে নাকে-মুখে রক্ত ঝরিয়ে দেওয়া এবং এভাবে মারাত্মক জখম করার পর গুলি করে হত্যা করে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার পাশে ফেলে রাখা। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যেসব সীমান্ত নদী দ্বারা ভাগ করা আছে, সেই সব সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের সদস্যরা নদীতে স্পিডবোট দিয়ে তাড়া করে যখন কাছাকাছি চলে আসে, তখন স্পিডবোটের ইঞ্জিনের ঘূর্ণমান ধারালো ব্লেড বাংলাদেশি নাগরিকদের শরীরের ওপর চালিয়ে দেয়, ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে ফালা ফালা হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। স্পিডবোটের এই নির্যাতনের ঘটনা এখন অবশ্য কম শোনা যায়।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, যা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থল সীমানা। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই ২ হাজার ২১৭ কিলোমিটার সীমানা আছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২০ বছরে মোট ১ হাজার ৫০০ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। এই সময়ের মধ্যে নিখোঁজ হয়েছেন ১১১ জন। এসব নিখোঁজ মানুষের সন্ধান আজও কেউ দিতে পারেনি। সীমান্ত দিয়ে শুধু গরুই কি পাচার হয়? গরুর পাশাপাশি তো মাদকদ্রব্য পাচার হয় আরও অনেক বেশি পরিমাণে! বিশেষ করে অস্ত্র, ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য। বিএসএফের সদস্যরা অস্ত্র ও মাদক পাচারকারীদের চোখে না দেখলেও গরু পাচারকারীদের ছাড় দিতে একেবারেই অপারগ। এই ছাড় দেওয়া অবশ্য নির্ভর করে পাচারকারী ও বিএসএফ সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়ার ওপর। যতক্ষণ পর্যন্ত বোঝাপড়া ঠিক আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয় না। তবে ভাগ-বাঁটোয়ারায় এদিক-ওদিক হলেই যত সমস্যা; ফলে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এটি আমাদের কথা নয়; ভারতের খবরের কাগজে বেরিয়েছে, গরু পাচারের সঙ্গে বিএসএফের নিম্ন পদবির সদস্য থেকে উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিছুদিন আগে বিএসএফের ডিআইজি ও কমান্ড্যান্ট পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ নিম্নপদস্থ বেশ কয়েকজন সদস্যকে গরু পাচারে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। সে দেশের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) এ বিষয়ে তৎপর রয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে পাচারকালে, গরুপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা আদায় সাপেক্ষে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে তারা।

ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রচুরসংখ্যক গরু যে আসে—এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিএসএফ সদস্যদের যোগসাজশেই যে গরু পাচার হয়, তা আগে অনুমান করা গেলেও তাঁদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে তা নতুন করে আবার প্রমাণিত হলো। শুধু তা-ই নয়, কী কারণে বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করা হয়, তা-ও পরিষ্কার হয়ে গেল। সে দেশের খবরের কাগজে ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন ‘মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)-এর প্রধান, কিরীটী রায়ের একটি সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়েও সীমান্ত হত্যার কারণ স্পষ্ট হলো। পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘একদানা চিনিও বিএসএফের নজর এড়িয়ে যেতে পারে না বাংলাদেশে। এরা দুর্নীতিগ্রস্ত। এদের কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। এর প্রমাণ বারবার পাওয়া গেছে। চোরাচালান ঠেকানোর নামে তখনই তারা গুলি করে, যখন তাদের ভাগ-বাঁটোয়ারায় কম পড়ে।’

সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে খোদ ভারতের মাটিতেও। মানুষ হত্যা বন্ধের এ দাবি জানিয়েছে কলকাতার ১৮টি সংগঠন। মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের উদ্যোগে গত মাসের ১৫ তারিখ কলকাতা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়েছে। কলকাতার মানবাধিকারকর্মীরা বলেছেন, বিএসএফের কাজ সীমান্ত পাহারা দেওয়া। সীমান্তের ভেতরে ঢুকে নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা নয়। বিএসএফ সীমান্তে হত্যালীলা বন্ধ না করলে পশ্চিমবঙ্গে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণও করেছেন তাঁরা। এরও আগে ১২ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার তৃণমূল বিধায়ক উদয়ন গুহ সীমান্তে চোরাচালানের দায় ভারতীয় বিএসএফের ঘাড়েই চাপিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএসএফের মদদ ছাড়া সীমান্তে কোনো কিছুই পাচার করা সম্ভব নয়। তিনি সীমান্তবর্তী এলাকার বিধায়ক দাবি করে বলেন, ‘অধিকাংশ এলাকা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের সমস্যার কথা আমি জানি। স্টিলের ব্লেড দিয়ে মোড়া কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে কী করে পাচার হয়? তা নিয়ে সবার মনেই প্রশ্ন আছে।’

এটি এখন স্পষ্ট, বিএসএফ নিজেদের আত্মরক্ষার্থে গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা করে বলে ভারতের দায়িত্বশীল মহল থেকে এত দিন যে বক্তব্য প্রচার করে আসছে, তা সত্যের কতটুকু কাছাকাছি, সেই প্রশ্ন বোধ হয় করাই যায়। আমরা বাংলাদেশিরা সাদাকে সাদা-ই দেখতে চাই। বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক যদি ‘জাদুকরী’ হয়েই থাকে, তার প্রতিফলনও আমরা দেখতে চাই। সীমান্ত হত্যা বন্ধে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, আমরা আশা করি তা রক্ষা করা হবে। আমাদের অনুরোধ, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যেন ফেলানী হত্যাকাণ্ডসহ সীমান্ত হত্যার সঙ্গে জড়িত সবার নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমে যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করে। প্রয়োজনে শাস্তির বিধান সংশোধন করে হলেও বর্তমানে যে দায়মুক্তির সংস্কৃতি চালু আছে, তার অবসান ঘটানো হোক। তাহলেই সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। তা না হলে সীমান্ত হত্যা যত দিন চলবে, তত দিন হতভাগা ফেলানীর মৃতদেহ কাঁটাতারে ঝুলে থাকার দৃশ্যের মতোই বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতি আমাদের সুহৃদ মনোভাবও ঝুলে পড়বে। 

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত