Ajker Patrika

বিজয়ের কেতন ওড়ে

মযহারুল ইসলাম বাবলা
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৭: ১৭
বিজয়ের কেতন ওড়ে

নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধে জয়ী বাঙালি জাতি বিশ্বের শক্তিধর সেনাবাহিনী খ্যাত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে নতুন রাষ্ট্রের সূচনা করেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল নবজাত স্বাধীন দেশের। যুদ্ধের সময়ে গঠিত মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার তিন প্রধান স্তম্ভের ঘোষণা দিয়েছিল। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা; যার ভিত্তিতে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালিত হবে। জাতীয়তাবাদ বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের সময় যুক্ত করা হয়। আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের ভিত্তিমূলে ছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর জাতীয়তার বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হলেও, আমাদের জাতীয়তাবাদী শাসকেরা স্বাধীন দেশেও জাতীয়তার মোড়কটি ত্যাগ করতে পারেননি। সে কারণে শাসনতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভে জাতীয়তাবাদ যুক্ত করেছিলেন।

স্বাধীনতার পর জাতীয়তার প্রশ্নটির স্থায়ী সমাধানের পর আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্রের পথে যাত্রা; অর্থাৎ সব নাগরিকের সমমর্যাদা, সম-অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। বাস্তবে কিন্তু সেটা ঘটেনি। কেন ঘটেনি? সে প্রশ্নটিও অমূলক নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে আমাদের জাতীয়তাবাদীরা গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি বা সংহতি প্রকাশ করতেই সমাজতন্ত্রকে উপেক্ষা করতে পারেনি। নিরুপায়ে ঢেঁকি গেলার মতো সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়াতে তারা বাধ্য হয়েছিল। সমাজতন্ত্রকে অবদমনের অভিপ্রায়ে জাতীয়তাবাদকে শাসনতন্ত্রের প্রধান চার স্তম্ভে যুক্ত করেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের এযাবৎকালের সব শাসক দলই নিজেদের জাতীয়তাবাদী পরিচয় দিয়ে এসেছে। সেটা সামরিক বা অসামরিক যেটাই হোক। দুঃখজনক হচ্ছে, উদ্দেশ্যমূলক উপায়ে শাসনতন্ত্রের মূল স্তম্ভ থেকে সমাজতন্ত্রকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে এসেছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। জাতীয়তাবাদ বাঙালি ও বাংলাদেশি বিভাজনে বিভাজিত। গণতন্ত্রের অবস্থাও বেহাল। ক্ষমতার ভেতরে-বাইরে কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করতে কেউ কসুর করে না। বাস্তবে গণতন্ত্রের কবর রচনায় তাদের প্রত্যেকের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। বাহ্যত প্রতিটি শাসক দলই যেন গণতন্ত্রে অন্তঃপ্রাণ। অথচ ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্রের চর্চায় তাদের চরম অনীহা।

এত ত্যাগ-আত্মদানে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করলাম; সেই স্বাধীনতা প্রকৃতই জনসমষ্টির কত শতাংশ মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে? সঠিকভাবে কত শতাংশ মানুষকে স্বাধীন করেছে? গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে বলা যাবে ১ শতাংশ। এই ১ শতাংশই জাতির কাঁধে চেপে বসা আমাদের শাসকশ্রেণি, যাদের অধীনে-নিয়ন্ত্রণে ৯৯ শতাংশ মানুষ। যাদের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুসীমায়। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক ত্যাগ-আত্মত্যাগের নজির স্থাপন করেছিল এই ৯৯ শতাংশ মানুষ। প্রতিবছর বিজয় দিবস আসা-যাওয়া করে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।

আমাদের প্রতিটি শাসক দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা রাষ্ট্রের পাহারাদারদের অবাধে ব্যবহার করে জনগণের ওপর, নিজেদের কায়েমি স্বার্থে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের শাসকেরা জনরায়ে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকারপ্রাপ্ত হন মাত্র। রাষ্ট্রের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে, রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক রাষ্ট্রের জনগণ; কোনো দল, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান নয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত প্রত্যেকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, অর্থাৎ জনগণের সেবক। দেশের জনগণের করের টাকায় তাদের মাসোহারা দেওয়া হয়। দেওয়া হয় নানাবিধ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। অথচ বাস্তবে আমাদের অভিজ্ঞতা ঠিক বিপরীত। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলগুলো ‘ক্ষমতা’ লাভ করে, বনে যায় জনগণের ভাগ্যবিধাতা। জনগণকে আমলে নেওয়া তো পরের কথা, তোয়াক্কা পর্যন্ত করে না। মোটা দাগে, আমাদের শাসকদের প্রসঙ্গে সর্বাধিক সঠিক মন্তব্যটি হচ্ছে, আমাদের শাসকেরা ব্রিটিশ-পাকিস্তানি শাসন-অপশাসনের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে পারেনি; অর্থাৎ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইনকানুন, বিধিব্যবস্থা তেমনি অটুট রয়েছে স্বাধীন দেশে। শাসক চরিত্রেরও ন্যূনতম পরিবর্তন ঘটেনি; যা আমরা গত ৫০ বছর ধরে প্রত্যক্ষ করছি। পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে পৃথক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হলেও সম্ভব হয়নি সাবেকি ব্যবস্থা ভেঙে নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র নির্মাণ করা।

ব্রিটিশ ভারতবর্ষ ভেঙে তিন পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। শুরুতে দুটি, পরে অপরটি বাংলাদেশ। ধর্মীয় বিভাজনে ভারতবর্ষ খণ্ডিত হয়েছিল আপস ফর্মুলায়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দয়া-দাক্ষিণ্যে, অনুকম্পায়। হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের দুই পৃথক দল হিসেবে স্বীকৃত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ক্ষমতা ভাগাভাগির বিনিময়ে। চতুর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পুরোনো কৌশল ভাগ ও শোষণ করার নীতির ভিত্তিতে। আজও ভারত ও পাকিস্তানে ১৪ ও ১৫ আগস্টে আড়ম্বরপূর্ণ স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়। দেশ দুটিতে ওড়ে স্বাধীনতার কেতন! যেটি স্বাধীনতার আনন্দের-বিজয়ের কেতন নয়। দুই ভ্রাতৃপ্রতিম সম্প্রদায়ের রক্তে রঞ্জিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত কেতন। বাস্তবতা হচ্ছে, এই স্বাধীনতা দুই দেশের জনগণকে স্বাধীন করেনি। দ্বিজাতিতত্ত্বের খড়্গে ভ্রাতৃপ্রতিম দুই সম্প্রদায়ের রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ব্রিটিশদের ইচ্ছাপূরণে দেশভাগ সম্পন্ন হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শত্রুকে পরাজিত করে স্বাধীনতা আসেনি। বিপরীতে তারা দাতার মতো দেশভাগে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেছে দুই সম্প্রদায়ের শাসকশ্রেণির অনুকূলে। ধর্মীয় আবেগে পাকিস্তানের অংশে যুক্ত হয় পূর্ব বাংলা। কিন্তু ওই আবেগের পরিসমাপ্তি ঘটতে বিলম্ব হয়নি। পাকিস্তানি বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবিরাম আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ-আত্মত্যাগে এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানিদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করি। অথচ কী নিষ্ঠুর ভবিতব্য আমাদের, এই বিজয়ের স্বাধীনতাও সমষ্টিগত জনগণকে ‘মুক্ত’ করেনি। ব্রিটিশ কর্তৃক দয়া-দাক্ষিণের ক্ষমতার হস্তান্তর আর হানাদার পাকিস্তানি শত্রুকে পরাজিত করে আমাদের স্বাধীনতার বিজয় শাসকশ্রেণির অনুকূলে প্রকৃতই ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে।

ব্রিটিশ গেছে, পাকিস্তানিরা গেছে, কিন্তু তাদের প্রেতাত্মা প্রতিনিধি শাসকগোষ্ঠী ঘুরেফিরে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত করেছে। জনগণের রাষ্ট্র, জনগণের সরকার, জনগণের কর্তৃত্ব কোনো ক্ষেত্রেই অর্জিত বা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিপরীতে জনগণ বিদ্যমান এ ব্যবস্থায় অসহায় প্রজা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। বছরান্তে বিজয় দিবস আসা-যাওয়া করে, আমরা আপ্লুত হই। কিন্তু সমষ্টিগত মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, স্বজন হারানোর কান্না এই বিজয় দিবসেও আমাদের ভারাক্রান্ত করে। লাখো শহীদের আত্মদান আর অগণিত নারীর সম্ভ্রম হারানোর এই বিজয় হস্তগত করেছে শাসকগোষ্ঠী। তাদের পরাভূত করে বিজয় ছিনিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত সমষ্টিগত মানুষের জীবনে বিজয়ের প্রকৃত কেতন উড়বে না। এটাই বাস্তবতা।

মযহারুল ইসলাম বাবলা: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত