Ajker Patrika

খসড়ার পূর্ণাঙ্গ রূপটি প্রকাশ করা জরুরি

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২২, ১০: ১৮
খসড়ার পূর্ণাঙ্গ রূপটি প্রকাশ করা জরুরি

দেশে এখন অনেক বিষয় ছাপিয়ে ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’-এর অনুমোদিত খসড়া আইনটি রাজনীতি, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং বিদেশি দাতা সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে নজরকাড়া বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের সংবিধানের ১১৮ (১)তম অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য আইন প্রণয়নের উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও আইনটি গত ৫০ বছর দেশের কোনো সরকারই প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়নি। আমাদের সংবিধানের ১১৮ ধারার বিভিন্ন উপধারায় নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির ভূমিকার কথা থাকলেও কার্যত তা সেভাবে সংঘটিত হয়নি। ১১৮ (১) ধারাতেই নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন প্রণয়নের উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও কোনো সরকার সেই উদ্যোগ এত দিন গ্রহণ করেনি। তাই রাষ্ট্রপতি সাধারণত যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, সেই সরকারপ্রধানের সুপারিশ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন করে এসেছেন। ফলে বেশির ভাগ নির্বাচন কমিশনই নিয়োগদানকারী সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার নজির উপস্থাপন করতে পারেনি।

তবে ২০০৭ সালে এক-এগারোর সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে যে নির্বাচন কমিশনটি গঠিত হয়েছিল, সেটি জাতীয় পরিচয়পত্রসংবলিত ভোটার তালিকা প্রণয়ন, আচরণবিধি এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বেশ কিছু উদ্যোগ ও সাফল্য দেখাতে পেরেছিল।

সেই হিসেবে দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে ওই কমিশনের ভূমিকা অন্য সব কমিশনের থেকে স্বতন্ত্র এবং বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে বাকি প্রায় সব কমিশনের ভূমিকা প্রধানত বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থার সংকট বেড়েই চলছিল।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যে নির্বাচন কমিশন গঠন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত হতে যাচ্ছে, সেটি কি পুরোনো প্রথায়, নাকি সংবিধানে বর্ণিত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে করা হবে–সে বিষয়টি এত দিন রাজনৈতিক মহলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিল; বিশেষ করে গত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় সার্চ কমিটির মাধ্যমে যেভাবে গঠিত হয়েছিল। এবার রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে সার্চ কমিটি গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, সেটিকে পূর্ববর্তী ধারার অনুসরণেই সম্পন্ন করার চিন্তা বলে অনেকেই ধরে রেখেছিলেন। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সার্চ কমিটির প্রতি আস্থা না রাখতে পেরে ওই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেনি।

বিএনপিসহ রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে অংশ না নেওয়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন প্রণয়নের দাবি করে আসছিল। কিন্তু সেই আইনের কোনো রূপরেখা তারা উপস্থাপন করতে পারেনি। নাগরিক সমাজের কোনো কোনো প্রতিনিধি, সুজনসহ আরও কিছু সংগঠন ওই আইনটি প্রণয়নের দাবি করে আসছিল। তবে বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে যেসব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিল, তার প্রায় সব কটিই সংবিধানের ১১৮ (১) নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ করে এসেছিল। তখনো অনেকেরই ধারণা ছিল, এই সব অনুরোধের তেমন কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাবে না।

সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং সরকারের পক্ষ থেকে এই আইনের বিরোধিতা করা না হলে আইনটি এখনই করতে সরকার কিংবা আওয়ামী লীগ সম্মত কি না, সেটি স্পষ্ট করে বলা হয়নি; বরং কখনো কখনো বলা হয়েছে নতুন কমিশন গঠনের জন্য যেহেতু এখনই উদ্যোগ নিতে হবে, সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন প্রণয়নের কাজটি যেহেতু দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার, তাই এবার হয়তো এ আইনটি করা সম্ভব হবে না।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ১৭ জানুয়ারি ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সার্চ কমিটি এবং নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন প্রণয়ন নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় বঙ্গভবনে মিলিত হয়ে দলের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ওই দিনই মন্ত্রিসভায় আইনের খসড়াটিও অনুমোদিত হয়। বিষয়টি অনেকের কাছে বেশ চমকপ্রদ মনে হয়েছে। এখন এর পক্ষে-বিপক্ষে নানাজনের নানা মত আলোচনায় স্থান করে নিচ্ছে। কেউ কেউ সরকারের নীতি কৌশলগত পরিবর্তনের উদ্দেশ্য খোঁজার চেষ্টা করছেন, কেউ কেউ আগামী নির্বাচনকে দেশি-বিদেশি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা প্রদানের সরকারি কৌশল হিসেবেও দেখছেন। আবার আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহলের একাংশের মত হচ্ছে, অতীতে যেহেতু সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীতে বা আইন প্রণয়নে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বড় ধরনের কোনো দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটায়নি, তাই আওয়ামী লীগের হাতে এ আইনটি প্রণীত হলে আওয়ামী লীগেরই সুনাম বৃদ্ধি পাবে এবং ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে এই আইন প্রণয়নের জন্য লড়াই করতে হবে না।

এ কারণে আওয়ামী লীগ ভেতরে-ভেতরে আইনটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করলেও প্রতিপক্ষ বা সমালোচকদের অপ্রস্তুত করার একটি কৌশলও মাথায় রেখেছিল।

আইনমন্ত্রী একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাতে বলেছেন, ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী এ আইনটি প্রণয়ন করার জন্য তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি বিভিন্ন দেশের এ-সংক্রান্ত আইন, বিধিবিধান পর্যালোচনা শুরু করেন। আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে আমরা উড়িয়ে দিতে চাই না। তাঁর বক্তব্যের প্রতিফলন নতুন আইনে যদি ঘটে তাহলে কারও অসন্তুষ্ট থাকার কথা নয়। বিএনপি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে যেসব শব্দ প্রয়োগ করেছে, সেগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হলে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, সংবিধানের অসম্পূর্ণতা পূর্ণতা পাবে, গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে।

প্রশ্ন উঠেছে, খসড়া আইনের পূর্ণাঙ্গ রূপটি জনসমক্ষে প্রকাশ করার। এটি খুবই ন্যায়সংগত দাবি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেছেন, তিনি তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন। এখনই যদি তা পূর্ণাঙ্গ একটি রূপ নিয়ে মন্ত্রীর টেবিলে অবস্থান করে, তাহলে দ্রুতই তা প্রকাশ করা উচিত। আইনটি নিয়ে রাজনৈতিক কোনো দলেরই তেমন কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। সবাই যদিও আইন প্রণয়নের দাবি করেছিল, কিন্তু একটি কার্যকর এবং বাস্তব প্রয়োগসম্মত আইন প্রণয়ন করা মোটেও সহজ কাজ নয়। আইনমন্ত্রী ২০১৭ সাল থেকে যদি দেশি-বিদেশি এ-সংক্রান্ত আইন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে থাকেন, তাহলে এর একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়ারূপ অংশীজনের চিন্তাভাবনার জন্য উপস্থাপিত হলে সবাই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনা করার সুযোগ পাবে।

সেটি খুবই দরকার। যাঁরা বলছেন যে হাতে খুব বেশি সময় নেই, তাঁরা তখন হয়তো তেমন দাবি থেকে সরে আসতে পারেন।

১৯৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন সংযুক্ত করার জন্য তৎকালীন বিএনপি সরকার সংসদে কয় দিন সময় নিয়েছিল? অংশীজনের তখন আলোচনার সুযোগ ছিল কি? সেই সংসদটিও তো ছিল জনগণের প্রত্যাখ্যাত, ছিল না কোনো প্রতিষ্ঠিত বিরোধী দলও। তারপরও রাতারাতি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন ৫৮ নম্বর অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়। তখন বিএনপি সরকারে থাকার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধীদলীয় দাবি অগ্রাহ্য করে দেশে একটি নৈরাজ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন সব দলের বর্জনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গঠিত সংসদ ও সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলটি কোনো ধরনের হোমওয়ার্ক ছাড়া যেভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তা শুধু ত্রুটিপূর্ণ ছিল না, অবিমৃশ্যকারিতার পরিচয়ও এতে পাওয়া যায়। এর খেসারত বাংলাদেশকে কম দিতে হয়নি।

আমরা চাই না তেমন অবিমৃশ্যকারী কোনো আইন আবার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। সেটি তখনই কেবল পরিহার করা সম্ভব হবে, যখন এর পেছনে যথেষ্ট পরিমাণ হোমওয়ার্ক, সংসদে ও সংসদের বাইরে অংশীজনের আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ এবং আইনের অপব্যবহার করার সব পথ বন্ধ থাকবে। এর জন্য চাই সবার খোলা মন।

ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে মানুষ হাসানো সহজ, বিভ্রান্ত করা আরও সহজ। তবে দিব্য দৃষ্টি দিয়ে রাষ্ট্র সংবিধানের আইনকে দেখা ও বোঝার ক্ষমতা যাঁদের রয়েছে, তাঁরা অল্প কয়দিনের মধ্যেই জাতির জন্য এমন একটি অপরিহার্য আইন সুবিন্যস্ত করতে পারদর্শিতা দেখাতে পারেন? সেটিই এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয়। আওয়ামী লীগকেও দূরের দিব্য জ্ঞান দিয়ে দেখতে হবে।

লেখক: মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত