Ajker Patrika

আগে দরকার আস্থা ফেরানো

আপডেট : ১৫ মে ২০২২, ১০: ৪১
আগে দরকার আস্থা ফেরানো

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাঁশি এখনো বাজেনি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নির্বাচন হবে ২০২৩ সালের শেষে কিংবা ২০২৪ সালের শুরুতেই। তবে তার আগে অনেক ‘যদি’, ‘কিন্তু’ আছে, সেগুলোর ফয়সালা হতে হবে। আগের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক-সমালোচনা আছে। তাই সরকার নিশ্চয়ই চাইবে আগামী নির্বাচনটা বিতর্কমুক্ত করতে। সবার সব চাওয়া সব সময় পূর্ণ না হলেও কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা মোটামুটি নিজের চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে পূরণে সফলতা দেখিয়ে আসছেন। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিএনপি। এই ধারা আর কত দিন অব্যাহত থাকবে, দেখার বিষয় সেটাই।

বিএনপি ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য সহিংস আন্দোলন করেছে জোট-সঙ্গী জামায়াতকে নিয়ে। কিন্তু নির্বাচন বাতিল হয়নি। তার এক বছর পরও বিএনপি তিন মাসজুড়ে আগুন ও বোমা-সন্ত্রাসের আন্দোলন করেও সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি; বরং ওই সহিংসতা চালিয়ে বিএনপির শক্তি ক্ষয় হয়েছে, তাদের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারণার সুয়োগ পেয়েছে সরকার, আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই বিএনপি পতন চাইছে, অথচ সরকারের পতন হচ্ছে না।

২০১৮ সালের নির্বাচনেও অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপির অনীহা ছিল। তারপর নানা দৌড়ঝাঁপ শেষে ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে একটি ফ্রন্ট গঠন করিয়ে বড় ঐক্যের ছাতার নিচে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। নির্বাচনকে আন্দোলনের একটি অংশ ভেবে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামার পরিবর্তে কৌশলের খেলা খেলতে গিয়ে বিএনপি প্রতিযোগিতার মনোভাব হারিয়েছে, দলের প্রার্থীরাও মানুষের কাছে গিয়ে তাঁদের সমর্থন পাওয়ার বদলে ‘অন্য কিছু’র আশায় গাছাড়াভাবে নির্বাচন করেছেন। ফল ভালো হয়নি। তখন বাজারে গুজব ছিল, বিএনপি এবং তার সঙ্গীদের একটি সম্মানজনক আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের নির্বাচনে এনেছিল সরকার। কিন্তু ভোটের ফলাফলে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। সরকার অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে বলে বিএনপি মহলে হতাশা তৈরি হয়, যা আর দূর করতে পারেনি দলটি। এর মধ্যে দলের অভ্যন্তরে বেড়েছে বিরোধ-দ্বন্দ্ব। সরকারের প্রতি বিএনপির আস্থা নেমেছে শূন্যে। আবার নিজ দলের মধ্যেও আস্থার সংকট বেড়েছে।

যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংকটটা কী? এককথায় কেউ উত্তর দিতে পারবেন কি না, আমি জানি না। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বাংলাদেশের রাজনীতির বড় সংকট হলো আস্থাহীনতা। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, কারও প্রতি কারও আস্থা নেই। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে না বিএনপিকে। বিএনপির বিশ্বাস নেই আওয়ামী লীগের ওপর। অন্যদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। আবার প্রতিটি দলের ভেতরেও আছে নেতায় নেতায় বিরোধ, অবিশ্বাস, গ্রুপিং, মতপার্থক্য। নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি চলছে না। ক্ষমতার চর্চা, খাওয়া-পাওয়ার প্রতিযোগিতায় সবাই ব্যস্ত। সব প্রতিযোগিতাতেই হারজিৎ থাকে। একদল হারে, একদল জেতে—এটাই যেকোনো প্রতিযোগিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। হোক সেটা খেলার মাঠে প্রতিযোগিতা কিংবা ভোটের মাঠের। কিন্তু আমাদের দেশে সবাই জিততে চান। হারার জন্য কেউ মাঠে নামতে চান না। জিতলে উল্লাস, সব ঠিক। হারলে বিষাদ, কিছুই ঠিক থাকে না।

আগামী নির্বাচন ইভিএমে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত দেওয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে এর বিরুদ্ধে জিহাদ। বলা হচ্ছে, ইভিএম হচ্ছে ভোট চুরির যন্ত্র। যখন আমরা কোনো কিছুর বিরোধিতা করি, তখন সাধারণত মনে রাখি না যে কোনো কিছুই শতভাগ ভালো বা শতভাগ মন্দ হতে পারে না। ইভিএমে ভোট হলে চুরি করা যায়, ব্যালটে ভোট হলে কি চুরি হয় না? ২০১২ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ইভিএমে। বিএনপি তখনো এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির মনিরুল হক সাক্কু। সাক্কুর পক্ষে কি তখন ইভিএম ভোট চুরি করেছিল? ১৯৭৭ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান গণভোট করেছিলেন। মনে করা হয়, বাংলাদেশে ভোটকে তামাশায় পরিণত করার পথের দিশা দিয়েছিল জিয়ার হ্যাঁ-না ভোট। হ্যাঁর পক্ষে শতকরা ৯৮ দশমিক ৯ ভাগ ভোট দিয়ে বাক্স ভরেছিল ভোটাররা নয়, ভূতে। ওই ভোট কিন্তু ইভিএমে হয়নি, হয়েছিল ব্যালটে।

এসব দৃষ্টান্ত দেওয়া হলো এ জন্যই যে ভোট ইভিএমে হলেই ভোট চুরি বা ভোট জালিয়াতি হবে, ব্যালটে হলে হবে না, এটা ঠিক না। আমাদের দেশে ভোট নিয়ে যত ভৌতিক কাণ্ড হয়েছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে ব্যালটের ভোটেই। ভোট স্বচ্ছ ও অবাধ হবে কি না—তা কোন উপায়ে ভোট নেওয়া হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে সরকার, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ওপর।

বিএনপি মনে করে আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে নির্বাচন করলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ভোটারদের মনোভাবের যথাযথ প্রতিফলন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে ঘটা সম্ভব নয়। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আগের অবস্থানেই আছে বিএনপি। যে কারণে ভোট গ্রহণের পদ্ধতি নিয়েও মাথাব্যথা নেই দলটির। দেশে আঁতাতের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা চলছে—অভিযোগ করে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। ১২ মে লালমনিরহাট রেলওয়ে সোহরাওয়ার্দী মাঠে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ইভিএম-টিভিএম বুঝি না, একটা কথাই বুঝি—এই সরকারকে আগে পদত্যাগ করতে হবে। নিরপেক্ষ সরকারকে ক্ষমতা দিতে হবে। সেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে কোনো নির্বাচন নয়।’

বিভুরঞ্জন সরকার আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সরকার কি বিএনপির দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করবে? আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে যাঁদের সামান্য ধারণা আছে, তাঁরা কেউ হয়তো বলবেন না যে বিএনপির এই দাবি আদায় হবে বা শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন। বিএনপিরও তা অজানা নয়। তারপরও বিএনপি শেষমুহূর্ত কিছু ছাড়ের জন্য দেনদরবার চালিয়ে যাবে। নির্বাচনে যাওয়ার আগে কিছু আদায় করে বিজয়ের ভাব কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারলে দলটির জন্য সম্মানজনক হবে না। দেশ-বিদেশের প্রভাবশালী মহলের কাছে ধরনা দিয়ে বিএনপি অন্তত ‘আশ্বস্ত’ হতে চাইবে যে গত নির্বাচনের ফলাফলের মতো বিপর্যয়কর অবস্থা আগামী নির্বাচনে হবে না।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, সামনের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। বিএনপিসহ বিরোধী সব দল তাতে অংশ নেবে বলে আওয়ামী লীগ আশা করছে। বিএনপিসহ বিরোধীদের ভোটে আনতে আওয়ামী লীগ ভূমিকা রাখবে। তিনি ইভিএমের বিষয়ে বলেন, প্রযুক্তির ভালো দিকই বেশি। ইভিএম খুবই সহজ একটা ব্যবস্থা। এরপরও বিরোধীদের কোনো আপত্তি থাকলে আলোচনা হতে পারে। এর মাধ্যমে সমাধান বেরিয়ে আসবে।

নানা সম্ভাবনা ও সময়ের বাস্তবতার ওপর আওয়ামী লীগের পদক্ষেপ নির্ভর করবে বলে ধারণা করা যায়। প্রকাশ্যে বড় কিছু না হলেও পর্দার অন্তরালে রাজনৈতিক সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিএনপিকে ভোটে আনতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে—এমন দেশি-বিদেশি মহলকেও যুক্ত করার চেষ্টা সরকারপক্ষের থাকতে পারে।

যেহেতু সময় আছে, তাই সরকার তাড়াহুড়ো করে কিছুই করবে না। বিএনপির বৃহত্তর ঐক্য গঠনের অগ্রগতি, বিশ্ব রাজনীতির বিন্যাস, শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি—সব মিলিয়েই সিদ্ধান্ত হবে। তবে সবার আগে যে রাজনীতিতে আস্থা ফেরানোটা জরুরি, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় সব পক্ষকে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন কি আস্থা ফেরানোর ক্ষেত্রে সূত্রধরের ভূমিকা পালন করতে পারবে?

আগামী ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনেও বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নেবে না। তবে আগে দুবার নির্বাচিত মেয়র মনিরুল হক সাক্কু স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন এবং তাঁর পেছনে বিএনপি থেকে পরীক্ষা করতে পারে সরকারের হাবভাব। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কুসিক নির্বাচনে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে একটি এবং প্রতিটি ভোটকক্ষে (ভোটার বুথের গোপন স্থান ছাড়া) একটি করে সিসি ক্যামেরা থাকবে। ভোটে কোনো অনিয়ম হলে পরবর্তীকালে যেন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে জন্যই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা যখন নির্বাচনী মালামাল নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন, তখন বা তার আগে থেকেই সিসি ক্যামেরা চালু থাকবে। ভোট গণনা শেষে ফল ঘোষণার পরই ক্যামেরা সরানো হবে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এর মধ্যেই তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ১৫ মে থেকে এক প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হবে।

এসব ব্যবস্থা ভোটারদের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় কি না, দেখতে হবে সেটাই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত