Ajker Patrika

নদীগর্ভে হারাবে না জমিজিরাত

আবেদীন কাদের
আপডেট : ২৭ জুন ২০২২, ১০: ৪৭
নদীগর্ভে হারাবে না জমিজিরাত

যেকোনো দেশের রাজনীতিকদের অন্যতম দায়িত্ব জনচিত্তের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা এবং তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বড় স্বপ্ন দেখায় অভ্যস্ত করে তোলা। বড় স্বপ্ন দেখা, বিশেষ করে স্বদেশ ও স্বজাতি নিয়ে এবং তা প্রায় নিজের জীবন দিয়ে বাস্তবায়ন করেছেন একমাত্র বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তাঁর ট্র্যাজিক মৃত্যুর পর বাঙালি খুব বড় স্বপ্ন দেখেছে, তা মনে হয়নি। তবে কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিগত বিষয়ে দেখেছেন, কিন্তু জাতীয়ভাবে বড় স্বপ্ন অবশ্যই পদ্মা সেতু। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আমাদের কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়নে এত বিশাল প্রতিবন্ধকতা আগে আসেনি, সেসব প্রতিবন্ধকতা আর্থিক জোগান দেওয়া থেকে বিভিন্ন ধরনের; যা বর্তমান সরকারের জন্য সত্যিকার চ্যালেঞ্জ ছিল। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আমাদের অভিজ্ঞতায় যেসব সরকার আগে এসেছে, তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হতো কি না, সে বিষয়ে আমার ঘোর সংশয় রয়েছে।

এই চ্যালেঞ্জ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কেমন করে নিলেন এবং এতটা দুঃসাহসী তাঁর হওয়ার রাজনৈতিক ও নৈতিক কারণ বিষয়ে হয়তো একসময় সমাজবিজ্ঞানীরা অন্বেষণ করবেন। কিন্তু এই সেতু নির্মাণের ফলে অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিবর্তন যা ঘটবে, সেসব নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক আলোচনা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু একটি বিষয় সেসব লেখায় আমি একেবারেই দেখিনি। হয়তো কেউ কেউ লিখেছেন, কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। সে বিষয়টি আমি উল্লেখ করতে চাই, এটি হলো জাজিরা, ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া, সুরেশ্বর, বিক্রমপুরসহ পদ্মার দুই পাড়ের কয়েক লাখ মানুষের গত ৫০ বছর বা ততোধিক সময় অমানবিক দুর্দশার ইতিহাস।

গত শতাব্দীর মধ্য ৫০ থেকে বর্তমান জাজিরা, শরীয়তপুরের বিপুল অংশ এবং পদ্মার উত্তর পার, মানে লৌহজং বা বিক্রমপুরের একটি অংশের অগণিত মানুষ তাঁদের সর্বস্ব হারাতেন পদ্মার ভাঙনে। এই সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজ হিসেবে সরকারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বিপুল টাকা ব্যয় করতে হয়েছে, সেটি হলো নদীশাসন। পদ্মার মতো একটি ভয়াল এবং বৈরী নদীকে শাসন করা সত্যিই দুরূহ কাজ, সেটি সেতুর সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা জানতেন। সেই অনুযায়ী তাঁরা দীর্ঘ সময়ের জন্য যাতে পদ্মা নিরীহ, ভয়ালতাবিবর্জিত থাকে, তার জন্য দুই পাড়ে সুদীর্ঘ এলাকাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিপন্মুক্ত হিসেবে নিশ্চিত করেছেন। এর ফলে বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ প্রতিবছর শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে ঘরবাড়ি এবং ফসলের জমি হারানোর ভয় থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন।

পদ্মার ভাঙনের ইতিহাস ভুক্তভোগী মানুষ ছাড়া কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। কীভাবে মাঝারি থেকে বড় জমির মালিকেরা এক রাতের মধ্যে বাড়িঘর, জমাজমি হারিয়ে পথের নিঃস্ব ভিখারিতে পরিণত হতে পারেন, তা ওই এলাকার মানুষ খুব ভালো জানেন। আমি আমার ছেলেবেলার, বলা যায় শিশুবেলার কিছু স্মৃতি এ লেখায় উল্লেখ করব।

পদ্মা সেতু অত্র এলাকার, বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার ১৭টি জেলার মানুষের জীবনে কী ভূমিকা রাখবে বা অন্য কী ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা জেগে উঠবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে, সে বিষয়ে ইতিমধ্যেই অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু মানুষের মনের তুষ্টির দিকটি সম্ভবত কোনো অঙ্ক দিয়েই বোঝানো সম্ভব নয়। সেটি শুধু জমা থাকবে অত্র এলাকার মানুষের হৃদয়ে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জন্য!

এই সেতু কী বিশাল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে আমাদের সমাজজীবনে, সেটিই আমাদের সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার গত কিছুদিনের আলোচনার বিষয়। ট্রান্সপোর্টেশন-সম্পর্কিত অর্থনীতির কিছু ভিন্ন রেমিফিকেশন বা প্রতিক্রিয়া থাকে সমাজের অন্যান্য সংস্কৃতিতে। সেটা অনেক সময়ই অর্থনীতিবিদেরা পরিমাপ করেন না। সেটা করতে পারেন সংস্কৃতির তাত্ত্বিকেরা, সৃজনশীল মানুষেরা বা একেবারেই ভিন্ন সমাজদৃষ্টি আছে যে প্রাজ্ঞ মানুষদের, তাঁরা। অর্থনীতিবিদেরা অঙ্ক কষে অর্থ বা পুঁজির দিকটা বোঝান, কিন্তু একজন কবি বা সৃষ্টিশীল শিল্পীর কাছে এর ভিন্ন দিক ধরা পড়ে।

সে কারণে আমাদের সাহিত্যিকদের অনেকে এই সেতুর ফলে সম্ভাব্য ভিন্ন উন্নয়নের দিক তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছেন। এই সেতু চালু হ হয়ে গেলে লাখ লাখ পরিবার সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নিজেদের জীবনের চিত্র বদলাতে দেখবেন। সেটা শুধু আর্থিক নয়; বরং তার মাঝে থাকবে অর্থের অতীত কিছু বিষয়, যা অর্থ দিয়ে ক্রয়যোগ্য নয়। সেটি হলো সাধারণ মানুষের চেতনার পরিবর্তন বা ট্রান্সফরমেশন। যে শিশু দক্ষিণ বাংলায় বা পদ্মা সেতুর ওপারে ১০ বছর পর জন্ম নেবে, তার চেতনালোক আজকের ১০ বছরের শিশুটির চেয়ে ভিন্নতর হতে বাধ্য। বিষয়টি এই সেতু নির্মাণের কালচারাল সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের একটি।

দুয়েকজন লেখক এ সেতুটিকে ঘিরে আমাদের রাজনীতিতে যে পরিবর্তনটা ঘটতে যাচ্ছে, সেটি বলেছেন তাঁদের লেখায়, কিন্তু তাঁদের কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন একটি বেদনার দিক, সেটি হলো—আমাদের বিখ্যাত মানুষদের মধ্যে কেউ কেউ দেশে-বিদেশে হাজারটা অপপ্রচার চালিয়েছেন, এর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ক্ষতিকর ক্রিয়াকলাপ চালিয়েছেন, যা দুঃখজনক। তাঁরা নিজেদের পছন্দের দলীয় রাজনীতিকেই হয়তো জাতীয় উন্নয়ন বা জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদার দিকটির ওপর স্থান দিয়েছেন, যা ভবিষ্যৎ ইতিহাস ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভিন্নভাবে নিতে পারে। এই মানুষদের মধ্যে পণ্ডিত মানুষও রয়েছেন। তাঁরা এতটা বিষাক্ত মনোভাব, বিশেষ করে জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে কেন পোষণ করেছেন, সেটি অনেককেই বিস্মিত করেছে।

আবেদীন কাদেরআমি তাঁদের দুয়েকজনের পাণ্ডিত্য বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু তাঁদের মনের এই দীনতা আমাকে দুঃখ দিয়েছে। রাজনীতিতে দ্বিমত থাকবে, কিন্তু দেশের মানুষের কল্যাণের বিষয়ে আমাদের বিখ্যাত মানুষেরা কেন হীনতার বাইরে উঠতে পারেন না কিছু ক্ষেত্রে, আজও আমি তা বুঝি না। আমি নিজে বর্তমান সরকারের অনেক বিষয়ে ভীষণ সমালোচনামুখর, কিন্তু কিছু বিষয়কে আমি রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার পক্ষপাতী। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়টি আমি রাজনীতির বাইরে রাখতে চাই। এটি আমাদের জাতীয় কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি এক আলোচনায় জানিয়েছেন দুই-তিন দশক পর দেশের মানুষের চিন্তার চিত্রটা কেমন হতে পারে, কতটা বৈষম্য বা মানসিক দূরত্ব কমে আসতে পারে শহর ও গ্রামের মাঝে, অর্থনৈতিক বৈষম্য কতটা বাড়তে পারে। তাঁর মতে, আমরা সাধারণ মানুষেরা অনেক কিছুই বুঝতে পারি না, মানুষের স্বপ্ন এবং দূরাগত ভবিষ্যতে অসাধ্যসাধনের আকাঙ্ক্ষা যে বেড়ে যাবে।

কয়েক বছর আগে পদ্মা সেতু প্রকল্প শুরু হওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী-প্রকৌশলীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই সেতু নির্মাণের ফলে অর্থনীতির উন্নয়ন ছাড়া আর কী কী গুরুত্বপূর্ণ লাভ হতে পারে। সম্প্রতি পরলোকগত সেই বিজ্ঞানী-প্রকৌশলী জানিয়েছিলেন, ‘এই সেতুর অনেক ধরনের অকল্পনীয় লাভের দিক আছে, সবচেয়ে বড় একটি দিক হলো আমাদের প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা বিশ্বের বড় বড় দেশের মতো একটি বিশাল প্রকল্পে কাজ করার ফলে সত্যিকার বড় কাজ করার আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘরে ফিরবেন। “আমরাও পারি” এই বোধ তাঁদের অনেকটা দূর যেতে, জাতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।’ শেখ হাসিনা এ কথা শোনার পর তাঁকে নিশ্চিত করেছিলেন যে যেমন করে হোক সেতু তিনি নির্মাণ করবেনই!

এবার আমি আমার শিশুবেলার একটি স্মৃতি উল্লেখ করব, সেটি ১৯৫৯ সালের শ্রাবণ মাসের ঘটনা, আমি মাত্র চার বছরের শিশু। পদ্মার ভয়াল গ্রাসে আমার পরিবারসহ জাজিরা, সুরেশ্বর, বড়কান্দিসহ বিস্তীর্ণ এলাকার কয়েক লাখ মানুষ ঘরবাড়ি, জমিজমা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। আমার নিজের পরিবার একেবারে পথে বসার মতো অবস্থায় পড়ে। মাঝারি ধরনের বর্ধিঞ্চু কৃষক পরিবার, জীবনে যারা কোনো দিন বাজার থেকে চাল-ডাল কিনে খায়নি, বাড়িতে কোনো অভাবের অভিজ্ঞতা যাদের ছিল না, তারা তাদের বিপুল জমির আউশ ধানসহ ঘরবাড়ি চোখের সামনে পদ্মায় বিলীন হতে দেখল। বাড়ির বড়রা সবাই প্রায় বিপর্যস্ত, একমাত্র আমার দাদা আর দাদি একেবারে নিঃশঙ্ক, তাঁদের মুখে একটিই কথা ছিল সেদিন, ‘আল্লাহ দিয়েছিলেন, আল্লাহ কেড়ে নিয়েছেন। তিনিই আবার দেবেন।’

তাঁরা ছিলেন গভীরভাবে ধার্মিক মানুষ, তাই অমন করে ভাবতে পেরেছিলেন, কিন্তু আমার বাবা-কাকাদের জলে ভরা চোখের সেই করুণ দৃশ্য আমার শিশুমনে খুব দাগ কেটেছিল সেদিন। অনেক দিন সেই বেদনাভরা আর্দ্র চোখগুলো আমাকে তাড়া করে ফিরেছে। আমার সেই শিশুবেলা থেকে প্রায় বালক হয়ে ওঠার কয়েকটি বছর আমি দেখেছি কী অসহায় ছিলেন বাবা-কাকারা, অন্যের জমিতে আমাদের বাড়ি। আমার মা, যিনি কোনো দিন নিজের ঘরের ঢেঁকিছাঁটা চাল ছাড়া ভাত খেতে পারতেন না, তিনি অসহায় দরিদ্র গৃহবধূর মতো সব কষ্ট নীরবে মেনে নিয়েছিলেন, কয়েক বছর পর আমাদের নিজেদের সব জমি জেগে ওঠার আগ অবধি!

আজ পদ্মা সেতু নিয়ে ভাবতে বসে বারবার আমার পদ্মার সেই ভয়াল দিকটির কথাই মনে পড়ছে! আমার মনে হয় সেতুর উল্লেখযোগ্য দিকগুলোর কথা সবাই বলবেন বা বলেছেন, কিন্তু সেতু নির্মাণের জন্য নদীশাসনের ফলে যে বিশাল জনগোষ্ঠী তাঁদের জমিজিরাত নদীগর্ভে কোনো দিন আর হারাবে না, এ দিকটি সংবাদমাধ্যমে অবহেলিত রয়ে গেছে, এই দিকটির কথা সমাজবিজ্ঞানীরা ভেবে দেখতে পারেন, ভেবে দেখতে পারেন কী বিপুল ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যাবে ওই অঞ্চলের অগণিত মানুষ!

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক, এসেক্স কলেজ, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত